বিচিত্রা ২২ জুন ১৯৭২
কাজী আনোয়ার হোসেন
ছেলেটাকে পিটিয়ে মারল লোকগুলো। এই সেগুন বাগানে, একশো চল্লিশ নম্বর বাড়ীর সামনে, রাজার তেমাথায়। গতকাল তেরই মে, শনিবার, বেলা বারোটায়।
দোষী মনে হচ্ছে আমার নিজেকে।
দোতালায় বসে লিখছিলাম। সকাল সোয়া দশটা। টাশশ করে একটা পিস্তলের আওয়াজ। তারপর হৈ চৈ। বারান্দায় বেরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। গাছপালার জন্যে দেখা যাচ্ছে না। তিরিশ গজ দূরে রাস্তার ঐ তেমাথায় গোলমাল।
আবার এসে লিখতে বসলাম। কিন্তু চিৎকার বেড়েই চলেছে। আবার বারান্দায় এলাম। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল—দুজন ডাকাত ধরা পড়েছে। খানায় ফোন করেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম, ছবি তুলব ডাকাতের।
দেড়শো-দুশো লোক জড়ো হয়ে মারছে। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম—কি ব্যাপার? কেউ সঠিক কোন জবাব দিতে পারল না। আসলে কি হয়েছে কেউ জানেই না ঠিকমত! টুকরো টুকরো জানা গেল: বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কোন এক ব্যাঙ্ক লুট করে পালাচ্ছিল তিনজন হাইজ্যাক করা গাড়ী নিয়ে, ব্যাঙ্কে একজনকে গুলি করে মেরে রেখে এসেছে, বাধা দেয়ার চেষ্টা করায় একজন ট্রাফিক পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে, পিছু ধাওয়া করেছিল পুলিশ—দিশে হারিয়ে রাস্তায় গাড়ী চাপা দিয়ে মেরেছে দুজনকে, কলেজ অব মিউজিকের সামনে একটা রিক্সাকে ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলে দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে, পালাবার সময় গুলি ছুড়েছে রিভলভারের, একজন পালিয়ে গেছে, বাকি দুজন ধরা পড়েছে, লোকজন মারছে ওদেরকে। কেউ বলল ওরা রাজাকার, কেউ বলল বিহারী, কেউ বা বলছে নক্সালাইট, আলবদর।
ঠেলাঠেলির মধ্যে আরেকটু এগিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। দেখলাম একজন সাদা ইউনিফরম পরা ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। হাতে একটা রিভলভার।
এই নিরিবিলি এলাকায় এত লোক কোথা থেকে জড়ো হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সবাই মারছে। ডাল ভেঙ্গে নিয়েছে কেউ কাঁঠাল গাছের, এরই মধ্যে মোটা একটা মুগুর সংগ্রহ করে ফেলেছে একজন কোথা থেকে। কিল, ঘুষি, লাথি, কনুই চলেছে এন্তার। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে লোকগুলো। একটা কণ্ঠস্বর শুনা গেল—ছুরি লইয়া আয়, জবো কইরা ফালামু শালারে।
মারের চোটে রাস্তায় শুয়ে পড়ল সিদ্দিক। রোববারের কাগজ দেখে ওর নামটা জানতে পারলাম। নীল হয়ে গেছে মুখ, গা। কুঁকড়ে পড়ে আছে মাটিতে, থামছে না মার।
এদের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি আনার চেষ্টা করছি না। আমি শুধু বলতে চাই, কেউ জানে না কেন ওদের মারা হচ্ছে। দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সবাই। মেরেই চলেছে নেশাগ্রস্তের মত।
ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল ধাক্কাধাক্কিতে। ওদিকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পাঁচিল টপকে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে লাফিয়ে পড়েছে অপর ছেলেটা। নাম ফারুক। ত্রিশ চল্লিশ জন ঢুকে পড়ল পিছু পিছু। শিলা বৃষ্টির মত পড়ছে কিল ঘুষি। আরো কয়েকটা লাকড়ি সংগ্রহ করে ফেলেছে জনতা, ততক্ষণ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফারুকের সর্বাঙ্গ। হঠাৎ দেয়ালের পাশে কয়েকটা কয়েকটা দশ ইঞ্চি ইটের সন্ধান পেল জনতা। তাই দিয়ে মারতে শুরু করল দমাদম।
ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে হয়ত ফারুক মনে করল আমি সাংবাদিক, হয়ত সাহায্য পাবে আমার কাছে। ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে।
‘বাঁচান, ভাই। আমারে বাঁচান।’
চোখের একপাশ ফেটে গেছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে দরদর করে। সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ছেলেটা—বিশ বছর বয়স হবে—বিবর্ণ হয়ে গেছে চেহারা, অসহায়, কাতর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর। অসীম আকুতি ওর ওই দুই চোখে। হাঁপাচ্ছে। রক্তের ছোপ লেগে গেল আমার সার্টে, ঠিক বুকের কাছে। খামচে ধরেছিল, ছিঁড়ে গেল গেঞ্জিটা টান লেগে। ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওকে ক্রুদ্ধ জনতা।
পারলাম না। বাঁচাতে পারলাম না আমি ফারুককে। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন। আমি জানতাম না মারা যাবে ছেলেটা। তখন বুঝতে পারলে হয়ত চিৎকার করে মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, বলতে পারতাম—বিচার পাওয়ার অধিকার আছে ওর। হয়ত আমার কথা শুনত কেউ কেউ। হয়ত কিছুটা কমত মারের পরিমাণ। অনেক কিছুই মনে হচ্ছে এখন। যদি বলতাম, ঠিক আছে, কে কে মারতে চাও, এসো, কিন্তু মরে গেলে দায়ী হতে হবে তোমাদের—যদি বলতাম, খবর্দার কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না, পুলিশের হাতে জ্যান্ত তুলে দিতে হবে ওকে পুরো দলের খবর বেরোবে ওর কাছ থেকে—কিম্বা সত-আট জন লোক সংগ্রহ করে নিয়ে যদি রুখে দাঁড়াতাম, দু-চার ঘা পড়ত আমার পিঠে, কিন্তু তাহলে হয়ত বেঁচে যেত ছেলেটা। কার না জানি চোখের মণি।
অনেক কিছুই তাবছি এখন, অনেক কিছুই করা যেত, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। মেরে যে ফেলবে, একথা ভাবতেই পারিনি আসলে। ভেবেছি, নিশ্চয় কিছু একটা দোষ করেছে, আমি জানি না, কিন্তু যারা মারছে তারা কি কিছুই না জেনে মারছে। ভেবেছি, পুলিশ আসছে, পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ঝঞ্জাট শেষ। নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছি আমি। দায়িত্বজ্ঞানহীনের কাজ করেছি। রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত ফটোগুলো ডেভেলপ ও প্রিন্ট করে পরদিন এ নিয়ে লিখতে বসলেই এ অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কিছু না কিছু চেষ্টা করা উচিত ছিল আমার।
এলো পুলিশ। কিন্তু তখনো মেরে চলেছে ওরা। কাছে এগোনো যাচ্ছে না ভিড় ঠেলে। মনে হল, ক্ষিপ্ত জনতার হাবভাব ঠিক বুঝতে না পেরে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে দ্বিধা করছে পুলিশ। দেখলাম পুলিশের সামনেই টেনে-হিঁচড়ে মহিলা পরিষদের সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনছে ওরা ফারুককে।
ভাবলাম, তবু পুলিশ নামের গুণ আছে, অবস্থা আয়ত্তে আনতে অসুবিধে হবে না। হাঁপ ছেড়ে ফিরে এলাম বাসায়। মিনিট দশেক পরই ছুটে এল নীচতালার চাকরটা। বলল—মেরেই ফেলেছে একজনকে।
‘কীভাবে মারল? পুলিশ কি করছে?’
একটাকে নিয়ে চলে গেছে পুলিশ। আর আরেকটাকে (ফারুক) নিতে পারেনি। দম ছিল কিছুটা, গলায় পা দিয়ে দম বের করে দিয়েছে লোকেরা।
ছুটলাম আবার।
মরে পড়ে আছে ফারুক। পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। সার্ট খুলে নিয়ে গেছে কেউ। প্যান্টটা কেন হাঁটুর নীচ পর্যন্ত টেনে নামান হয়েছে বোঝা গেল না। রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে লাশটা। পাশে পড়ে আছে ছেঁড়া একটা কাঁঠাল পাতা।
বুকটা ধরে আসতে চায়। অন্যায় করেছি আমরা ফারুকের উপর। যত দোষই করে থাকুক, থানা আছে, পুলিশ আছে, আইন আছে, আদালত আছে—আমার আপনার মতই বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল ওর। এমন একটি জনতা ওর বিচার করল, আসল ঘটনা সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই। এর নাম জনতার বিচার।
পুলিশ সূত্রের উল্লেখ করে আসল ঘটনাটা ছাপা হয়েছে রোববার এই পত্রিকাতেই। আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন? জানা গেল: ব্যাঙ্ক লুট করেনি ওরা, গাড়ীটা হাইজ্যাক করা কি না তাতে সন্দেহ আছে, ব্যাঙ্কের কাউকে গুলি করে খুন করেনি ওরা, ট্রাফিক পুলিশ নিহত হয়নি ওদের গুলিতে, এবং রাজাকার বা আলবদরের কেউ ছিল না ওরা। ব্যাপারটা অন্য কিছু।
স্বাধীনতার পর দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে, প্রাণের মূল্যই কি শুধু কম থাকবে?
Jahangir Hossain (জাহাঙ্গীর হোসেন)
বছর পাঁচেক আগে মিসরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ ইসরাইলে ঢোকার প্রবল ইচ্ছে হলো আমার। নানা কারণ ছাড়াও ইতিহাস পাঠে জেনেছিলাম যে, ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চের মাত্র ৩৩-দিনের মাথায় ইসরায়েল সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে ২৮-এ এপ্রিল ১৯৭১। ১৯৭২ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে ২য়-বারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় স্বীকৃতি প্রদান করে। এর কারণ ছিল ইসরায়েল বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেয়েছিল হয়তো কিন্তু বাংলাদেশ দুটো স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করে পরপর। বিষয়টা বিস্ময়কর ছিল আমার কাছে। তাই মিসরের প্রোগ্রাম সর্টকাট করে, ইসরাইলি দূতাবাসে গেলাম ভিসা লাগাতে, যাতে বৈধভাবে ঢুকতে পারি বিশ্বের এ ছোট অথচ নানা বিচারে শক্তিধর আলোচিত রাষ্ট্রটিতে। মিসরিয় এক ফেসবুক বন্ধুর সহযোগিতায় দুতাবাস খুুঁজে পেতে কষ্ট হলোনা খুব একটা আমার।
মনে অসিম সাহস, আতঙ্ক নিয়ে ১২/০৫/২০১৫ তারিখ আগালাম মিসরের ‘আরিশ’ থেকে ‘তাবা-রাফা’ বর্ডার পোর্টে। এটা মিসর-ইসরাইল ‘তাবা’ বর্ডারে, যার ইহুদি নাম Eilat, ইসরাইলের দক্ষিণ সীমান্তের খান ইউনুসের কাছে। এটা মুলত একটা ল্যান্ডপোর্ট, অনেকটা বাংলাদেশ-ভারত বেনাপোলের মত। আকাবা কোস্টে ঢোকার জন্যে এ বর্ডারে ১৫-দিনের ভিসা দেয়া হয় সাধারণত (ছবি- ১)।
মুখে বাঙালি চেহারা দেখে, বেশ কিছুক্ষণ নীরিক্ষণ করে পাসপোর্ট ‘এক্সিট’ সিল দিলো মিসরিয় ইমেগ্রেশন অফিসার। এবার ইসরাইলে ঢোকার পালা। মিসর থেকে ইসরাইলের ইলাত তথা তাবা বর্ডারে Welcome to Israel লেখা বিশাল ইমিগ্রেশন হল দেখে বুক কেঁপে উঠলো আমার (ছবি- ২)।
এতো বেনাপোল পোর্ট নয়, যেন সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক এয়ারপোর্ট (ছবি-৩)। খুব কম মানুষ পার হয় এ পোর্ট দিয়ে। আমিসহ মাত্র ৩-জন দেখলাম ইমিগ্রেশনে। এ বর্ডার দিয়ে ৭৫-মিসরিয় পাউন্ড বা ৯৬-ইসরাইলি শেকেল টোল দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢোকারও ব্যবস্থা আছে এ পোর্টে। একজন ইউরোপিয়ান নারীকে দেখলাম মিসর থেকে ইসরাইলের ভূমিতে ঢুকেই চুম্বন করছে ইসরাইলের মাটি (ছবি-৪)। কথা বলে জানলাম, “ফরাসি ইহুদি নারী এই প্রথম ইসরাইলে ঢুকে তাদের ধমীর্য় রীতি অনুসারে চুম্বন করলো তাদের পবিত্র ভূমি ইসরাইলকে”। ইহুদি মানুষের এ ধর্মপ্রীতি আর দেশপ্রীতি দেখে অভিভুত হলাম আমি। আমার পোসপোর্ট ভিসা ঘাটাঘাটি করে অবশেষে ১২ মে ২০১৫ ঢুকতে পারলাম ইলাতের তাবা বর্ডার দিয়ে ইসরাইলে (ছবি-৫)
আমার প্লান ছিল ভূমধ্য সাগরের পার ধরে তেলআবিবের দিকে এগুবো আমি সপ্তপদি জনপথ দেখতে দেখতে। তারপর আবার ফিরবো এ বর্ডার দিয়েই ইজিপ্টে । কারণ মিসর থেকেই আমার কোলকাতা রিটার্ন ফ্লাইট। খান ইউনুসে ঢোকার আগে ইসরাইলি ১ম জনপদ ‘তাল আস সুলতানে’ যাত্রা বিরতি করলাম একরাত। এখানে কটা ফিলিস্তিন বসতির সাথে বাস করছে আফ্রিকা থেকে আগত গরিব ইহুরিরা। এটা মুলত দরিদ্র এলাকা। ভূমধ্যসাগরে মাছ ধরে জীবিকা এখানের মানুষদের। তবে সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে ‘তাল আস সুলতানে’। ওখানে একরাত বিরতি দিয়ে এগুতে থাকলাম Al Qarya as Suwaydiya গ্রামে। এটাও মুলত আরবি ভাষিক এলাকা। কিছুটা গম, খেজুর উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে এ এলাকাটিতে। যা মূলত করে সুদান আর নাইজেরিয়া থেকে আগত আরবি ভাষিক ইহুদিরা। সাগরের তীর ঘেষে উত্তরে এগুতে থাকি আমি নানাভাবে। ‘রনি সালেহ’ নামক ছোট জনপদে গিয়ে পেলাম FSH Land of Fish রেস্টুরেন্ট নামের একটা খাবারের দোকান। মুূলত ভূমধ্য সাগরের তাজা মাছ রান্না করে, ফ্রাই করে, ভুনা করে কিংবা স্টিমে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় এখানে। সাথে ভাত কিংবা রুটি। একটা উসর মরু এলাকাকে কিভাবে সুন্দর বন্দর বানিয়েছি ইসরাইল তা দেখে বিস্ময়ে চোখ জুড়িয়ে যায় আমার। অনেক রাত অবধি একাকি সাগরতীরে রেস্টুরেন্টের চেয়ারে বসে থাকি আমি এ অচেনা নগরে (ছবি-৬)।
সমুদ্র তীরের এ ছোট গ্রামে রাতে থেকে পরদিন আবার চলতে চলতে পৌঁছি Al Mawasi এলাকায়। ভূমধ্য সাগর থেকে পাইপ লাইনে পানি এনে, তা শোধন করে ঐ পানির সাহায্য পুরো এলাকাটি করা হয়েছে কৃষি প্রধান। গম, টমেটো, সবজির ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার (ছবি-৭,৮)। মুলত আফ্রিকা থেকে আসা দরিদ্র ইহুদিরা কৃষিকাজ করছে এ এলাকাতে। al bala গ্রামে দেখলাম প্রচুর খেজুর গাছ। মুলত এখানের মূল বসতির আরব মুসলমানরা চাষ করছে খেজুরের। পাশের az zawada গ্রামেও দেখলাম এখানের ফিলিস্তিনি মুসলিমরাও চাষ করছে খেজুরের। খেজুর গাছে ওঠার জন্যে সরকার দিয়েছে বিশেষ সিঁড়ির মত যন্ত্র, যা ব্যবহার করছে মুসলিম খেজুর চাষিরা (ছবি-৯)। যদিও রাতে তেলআবিব টিভিতে দেখলাম পুরো ইসরাইলের তাপমাত্রা তখন – “জেরুজালেমে-68°, অ্যাশডড-68°, এলাট-81°, তেল আবিব-70°, নাজারথ-65°, নেতানিয়া-70°, পেটাহ টিকোয়া-68°, বাট ইয়াম-70°, বিয়ারশিবা-64°, বেনে বেরাক-70°, রামলা-68°, রামাত গান-70°, রিশন-লেজিয়ন-68°, হোলোন-70° এবং হাইফা-69°।
এসব কৃষি খামারে ঘুরে আর খেজুর গাছের আরব মুসলিমদের সাথে আলাপ করে, আবার দুদিন পর ছুটলাম ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেসে আরো ১০-কিমি উত্তরে Ben-Gurion University। এটা নাগেভ নামক ছোট্ট শহরে। নিজের পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম ভার্সিটিটা দেখতে। মাত্র ২০০-এর মত শিক্ষার্থী বিশাল এ ভার্সিটিতে। মানুষজন না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আবার পাড়ি দিলাম পাশের কৃষি প্রধান nusairat আর al muqaraka গ্রামের দিকে। একটা লেটুস পাতার ক্ষেতে কাজ করছিল এক নিগ্রো নারী। ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে সব কথা বুঝিনি তার। তারপরো সে বললো, “তানজানিয়া থেকে এসেছে সে, তার নাম কুতি হিদাই। ইহুদি ধর্ম অনুসারি সে” (ছবি-১০)। এ এলাকার কৃষি কাজ দেখে মনেই হলোনা, এটা একটা মরু এলাকা। কি ফল নেই এ এলাকাতে? এভোকোডা, কলা, আপেল, চেরি, পাম, আঙুর সবই ফলে এ এলাকায়। এমন তাপমাত্রায় তারা কিভাবে আঙুর বা শীত প্রধান দেশের ফল ফলাচ্ছে কঠোর পরিশ্রমে, তা দেখে বিস্মিত হলাম আমি (ছবি-১১)। নুসাইরাত নামক একটা ছোট্ট গ্রামের পোস্ট অফিস দেখে ‘ভিমরি খাওয়ার’ পালা আমার। ঢাকা বা কোলকাতার জিপিও এতো সুন্দর নয়! চমৎকার মনোরম এ ইসরাইলি ডাকঘরে কাজ করতে দেখলাম এক আরব মুসলমানকে। সালামালেকুম দিয়ে কথা বললাম তার সাথে আরবিতে। ডাকটিকেট কিনে কোলকাতা এক বন্ধুর ঠিকানায় একটা চিঠি পোস্ট করলাম এ অচেনা গাঁ থেকে। এ ইচ্ছেতে যে, দেখি চিঠিটা কত দিনে পৌঁছে কোলকাতা (ছবি-১৩)।
Photo 10 Photo 11 Photo 12 Photo 13
এ এলাকার ‘পেটাহ তিকাহ’ একটা মোটামোটি বড় শহর। বিমানবন্দর আছে এ ছোট শহরটিতে। প্রত্যকেটি গাঁয়ের সড়কেও সুন্দর সাইনবোর্ড লাগানো, যাতে আরবি, ইংরেজি আর হিব্রু ভাষাতে লেখা বিভিন্ন জনপদের নাম। পোস্ট অফিসে চিঠি পোস্ট করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আরব মুসলিম উমার আবদাল্লার সাথে। আমি বাঙালি, অনেক দূর থেকে ইসরাইল দেখতে এসেছি, শুনে প্রায় ২০-কিমি দূরের “আল-সারাহ” গ্রামে যেতে বললেন তিনি। যেটি হযরত ইব্রাহিম নবীর স্ত্রী বিবি সারাহর জন্মস্থান হিসেবে তার নামেই পরিচিত। ঐ গ্রামে যাওয়ার সড়কটির নামও সারা স্ট্রিট (ছবি-১২)। কিন্তু গ্রামটতে কোন মুসলিম বা কথা বলবো, এমন কাউকে পেলাম না আমি ঘন্টা দুয়েক ঘুরেও। তাই কেবল ২/৪-টা শূন্য ঘর দেখে চলে আসতে হলো আমাকে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে।
মোট ৮-দিন ইসরাইলে ঘুরে জানলাম ইসরায়েলের রাষ্ট্রভাষা দু’টি৷ আধুনিক হিব্রু ভাষা এবং আরবি৷ হিব্রু ভাষার কথা তো সবাই শুনেছি আমরা কিন্তু ‘আধুনিক হিব্রু’ বলতে ঠিক কি বোঝানো হচ্ছে, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবোনা৷ এই ভাষাটি গত ১৯-শতকের শেষভাগ পর্যন্তও বিকশিত হয়েছে বিশ্বে৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আধুনিক হিব্রুর শেকড় প্রাচীন হিব্রু হলেও, এখন এ ভাষায় ইংরেজি, স্লাভিচ, আরবি এবং জার্মানসহ অনেকগুলো বিদেশি ভাষার প্রভাব রয়েছে বেশ৷ ওখানে সব স্কুলে সবার জন্যে আরবি আর হিব্রু শেখা বাধ্যতামূলক। ইসরাইলের ভেতরে গেলে বোঝা্ই যায়না যে, এ দেশটির বর্ডারের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কত খারাপ সম্পর্ক তাদের। বরং ভেতরের আরবরা কাজ করে ইসরাইলি ইহুদিদের সাথে এক সাথেই সরকারি দপ্তরে, রাস্তায়, বাজার, শপিং মল আর বাণিজ্যালয়ে।
দেশটির ভেতরের মুসলমানরা ভালই আছে দেখলাম। ইসরাইলের মোট ৮৫,০২,৯০০ মানুষের মধ্যে ৬৩,৬৩,৭০০ জন ইহুদি (৭৪.৯%), ১৭,৬৬,৫০০ জন (২০.৯%) আরব মুসলিম, ১৩০,০০০ ইথিওপিয়ান ইহুদি। এ ছাড়া ২% আরব খৃস্টান, ১.৫% দ্রুজ মুসলিম ও ইরানি বাহাই ধর্মের লোক বিদ্যামান। মাথাপিছু আয় ৩৫,৩৪৩ আমেরিকান ডলার। টাকার নাম সেকেল, আর পয়সা হচ্ছে আগোরা। ১-সেকেলের নোটে দেখলাম এক আরব মুসলিমের ছবি, যে কিনা ইসরাইল আরব মুসলিমদের মিলেমিশে থাকার কথা বলে “শহীদ” হন (ছবি-১৪)। দেশটির সরাসরি ডায়ালিং কোড +৯৭২। ইসরাইলের প্রধান জেলাগুলো হলো :- জেরুজালেম যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, উত্তর নাজারেথ যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, হাইফা যার জনসংখ্যা ৬৯% ইহুদি ও ২৫% মুসলিম, রামাল্লা যার জনসংখ্যা ৮৮% ইহুদি ও ৮% মুসলিম, তেলআবিব যার জনসংখ্যা ৯৩% ইহুদি ও ১% মুসলিম, বীরসেবা যার জনসংখ্যা ৭৪% ইহুদি ও ২০% মুসলিম, জুডিয়া ও সামারিয়া যার জনসংখ্যা ৯৮% ইহুদি ও ২% মুসলিম।
৮-দিন শেষে আবার ফিরতে হলো তাবা বর্ডারে। কারণ পরের দিন মিসর থেকে আমার কোলকাতা ফ্লাইট। ইসরাইলের মাটি থেকে মিসরের বর্ডারে পা দিতেই কেমন এক মৃত্যু নৈশব্দের মতো কষ্টপথ আগলে ধরে আমায় সন্তর্পণে। নিজের বোধ আমায় তাড়িত করে অনেকক্ষণ। আর সুখভরা রাতপরীর দেশে উড়ে চলা অবোধ বালিকার মতো প্রশ্ন করে আমায়, ইসরাইলি ইহুদি আর আরব মুসলমানরা কি মিলেমিশে থাকতে পারেনা এ পৃথিবীতে? সিনাই বীরসেবা গাজাস্ট্রিপে ভর দুপুরের তপ্ত রোদে দুখভরা সুখনাশক মৃত্যু বিকেলে হাঁটতে থাকি এক গনগনে আগুনে কষ্টের ভেতর আমি কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাইনা এ ত্রিভুবনের কোথাও!
[লেখা বিষয়ক নোট : ছবি সব নেট থেকে নেয়া। বাংলাদেশী পাসপোর্টে ইসরাইলে যাওয়া অসম্ভব বিধায়, ভ্রমণ কাহিনীটি কাল্পনিক] https://www.facebook.com/JahangirHossainDDMoEduGoB
১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারী করা হয়।
ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষ সবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অবারিত রাখা হয়েছিল।
১৯২১ সালের ১লা জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে, সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৮৪৭ জন, যাদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের এলিট পরিবারের বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন।
মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন না।
শুধু মুসলমান পরিবারই নয়, অনেক হিন্দু শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন না।
১৯২৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন নেসা গণিত বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন।
১৯২৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।
১৯২১ সালে মাত্র একজন নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল যে বিদ্যাপীঠে,
১৯২৭ সালে সেখানে ছাত্রী ছিলেন নয়জন।
ছাত্রী সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রী ছিলেন ৩৯ জন।
১৯৪৫-৪৬ সালে ৯০ জন ছাত্রী ভর্তি হন।
১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১,৩৩৬ জন।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৯৬জন। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৫ জন।
মোট ১৯৯২জন শিক্ষকের মধ্যে এখন নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬৮জন।
১৯২১ সালে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদ, এবং আইন বিভাগ নিয়ে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন।
যাদের মধ্যে নারী শিক্ষক ছিলেন না একজনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন পদেও সে সময় নারী কর্মী ছিলেন না।
______________
২৭ জুন ২০২১
সাইয়েদা আক্তার
বিবিসি বাংলা, ঢাকা
https://www.bbc.com/bengali/news-57602325
Freedom House rates people’s access to political rights and civil liberties in 210 countries and territories through its annual Freedom in the World report.
Individual freedoms—ranging from the right to vote to freedom of expression and equality before the law—can be affected by state or nonstate actors. Click on a country name below to access the full country narrative report.
Follow Me