রবীন্দ্রনাথের স্বদেশ সংগীতের উল্লেখ করিতে গিয়া মনে হইতেছে বঙ্গ-বিভক্তি ও স্বদেশী-আন্দোলনের সময় তাহার জাতীয় সংগীতের প্রভাব। সে সময়কার গানগুলি বঙ্গভাষায় ও বাঙালীর প্রাণে চিরস্মরণীয় হইয়া থাকিবে। আমার বোধ হয় সে সময় বঙ্গদেশে যে দেশপ্রীতির স্রোত বহিয়াছিল তাহার উৎস রবীন্দ্রনাথের গান। বাংলার ঘরে ঘরে শোনা যাইত ‘আমার সোনার বাংলা।’ পথে পথে শুনা যাইত ‘বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পুণ্য হোক হে ভগবান।’ আর একটি চিত্র আমার মনে পড়িতেছে। আমি সে সময় কলিকাতায় গিয়াছিলাম। গঙ্গার ধারে গিয়া দেখিলাম দেশপ্রেমিকেরা গান গাহিতে গাহিতে গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেছেন বঙ্গবিচ্ছেদের অভিশাপ ক্ষালন করিবার জন্য। বাংলার ঘরে ঘরে শানা যাইত। ‘আমার সোনার বাংলা।’ পথে পথে শুনা যাইত বাংলার মাটি বাংলার জল, বাংলার বায়ু বাংলার ফল, পুণ্য হোক পুণ্য হাক হে ভগবান।’ আর একটি চিত্র আমার মনে পড়িতেছে। আমি সে ময় কলিকাতায় গিয়াছিলাম। গঙ্গার ধারে গিয়া দেখিলাম, দেশপ্রেমিকেরা গান গাহিতে গাহিতে গঙ্গাস্নান করিতে যাইতেছেন – বঙ্গবিচ্ছেদের অভিশাপ ক্ষালন করিবার জন্য। শোভাযাত্রার সর্বপ্রথমে একটি অল্পবয়স্ক বালক একটি সুস্থকায় ভদ্রলোকের স্কন্ধে চড়িয়া, হাত তুলিয়া সুললিত কণ্ঠে গাহিতেছে ‘বাংলার মাটি…।’ আর সকলে সহস্র কণ্ঠে সে গানের পুনরাবৃত্তি করিতেছে। সে বালকটি মহারাজা জগদীন্দ্রনারায়ণ রায়ের শিশুপুত্র – অধুনা মহারাজ। সে দৃশ্য এত হৃদয়স্পর্শী যে আমার চোখে জল আসিল। রবীন্দ্রনাথও নতশিরে সে স্নানযাত্রায় যোগ দিয়েছিলেন। যুবকরা সে সময় স্ফীতবক্ষে গাহিত ‘যদি তোর ডাক শুনে…।’ ভারতকে উদ্দেশ করিয়া কবি যে অপূর্ব দেশ-সঙ্গীত রচনা করিয়াছিলেন তন্মধ্যে একটি শ্রেষ্ঠ গান :
সার্থক জনম আমার জন্মেছি এ দেশে…
কোন্ গগনে ওঠে রে চাঁদ এমন হাসি হেসে।
— জগতের গীতিসাহিত্যে এমন হৃদয়স্পর্শী গান আর একটি আছে কি না জানি না। সে সময়ে রবীন্দ্রনাথের গানগুলি বাংলার প্রাণকে যেমন করিয়া আন্দোলিত করিয়াছিল, বিপুল জনসভায় ওজস্বী বক্তারা তেমন করিতে পারেন নাই। এমন কি বিপ্লববাদীরাও তাঁহার গান গাহিয়া আত্মোৎসর্গের পথে অগ্রসর হইত। তাঁহার জাতীয় সংগীতে প্রতিহিংসা বা সংকীর্ণতার লেশ মাত্র নাই। অথচ তাঁহার গানে লোকের মনে আসিত দেশপ্রেম সাহস ও শক্তি। তাঁহার স্বদেশ-গীতির মন্ত্রশক্তি অবর্ণনীয়।