Jahangir Hossain (জাহাঙ্গীর হোসেন)
বছর পাঁচেক আগে মিসরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ ইসরাইলে ঢোকার প্রবল ইচ্ছে হলো আমার। নানা কারণ ছাড়াও ইতিহাস পাঠে জেনেছিলাম যে, ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চের মাত্র ৩৩-দিনের মাথায় ইসরায়েল সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে ২৮-এ এপ্রিল ১৯৭১। ১৯৭২ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে ২য়-বারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় স্বীকৃতি প্রদান করে। এর কারণ ছিল ইসরায়েল বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেয়েছিল হয়তো কিন্তু বাংলাদেশ দুটো স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করে পরপর। বিষয়টা বিস্ময়কর ছিল আমার কাছে। তাই মিসরের প্রোগ্রাম সর্টকাট করে, ইসরাইলি দূতাবাসে গেলাম ভিসা লাগাতে, যাতে বৈধভাবে ঢুকতে পারি বিশ্বের এ ছোট অথচ নানা বিচারে শক্তিধর আলোচিত রাষ্ট্রটিতে। মিসরিয় এক ফেসবুক বন্ধুর সহযোগিতায় দুতাবাস খুুঁজে পেতে কষ্ট হলোনা খুব একটা আমার।
মনে অসিম সাহস, আতঙ্ক নিয়ে ১২/০৫/২০১৫ তারিখ আগালাম মিসরের ‘আরিশ’ থেকে ‘তাবা-রাফা’ বর্ডার পোর্টে। এটা মিসর-ইসরাইল ‘তাবা’ বর্ডারে, যার ইহুদি নাম Eilat, ইসরাইলের দক্ষিণ সীমান্তের খান ইউনুসের কাছে। এটা মুলত একটা ল্যান্ডপোর্ট, অনেকটা বাংলাদেশ-ভারত বেনাপোলের মত। আকাবা কোস্টে ঢোকার জন্যে এ বর্ডারে ১৫-দিনের ভিসা দেয়া হয় সাধারণত (ছবি- ১)।
মুখে বাঙালি চেহারা দেখে, বেশ কিছুক্ষণ নীরিক্ষণ করে পাসপোর্ট ‘এক্সিট’ সিল দিলো মিসরিয় ইমেগ্রেশন অফিসার। এবার ইসরাইলে ঢোকার পালা। মিসর থেকে ইসরাইলের ইলাত তথা তাবা বর্ডারে Welcome to Israel লেখা বিশাল ইমিগ্রেশন হল দেখে বুক কেঁপে উঠলো আমার (ছবি- ২)।
এতো বেনাপোল পোর্ট নয়, যেন সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক এয়ারপোর্ট (ছবি-৩)। খুব কম মানুষ পার হয় এ পোর্ট দিয়ে। আমিসহ মাত্র ৩-জন দেখলাম ইমিগ্রেশনে। এ বর্ডার দিয়ে ৭৫-মিসরিয় পাউন্ড বা ৯৬-ইসরাইলি শেকেল টোল দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢোকারও ব্যবস্থা আছে এ পোর্টে। একজন ইউরোপিয়ান নারীকে দেখলাম মিসর থেকে ইসরাইলের ভূমিতে ঢুকেই চুম্বন করছে ইসরাইলের মাটি (ছবি-৪)। কথা বলে জানলাম, “ফরাসি ইহুদি নারী এই প্রথম ইসরাইলে ঢুকে তাদের ধমীর্য় রীতি অনুসারে চুম্বন করলো তাদের পবিত্র ভূমি ইসরাইলকে”। ইহুদি মানুষের এ ধর্মপ্রীতি আর দেশপ্রীতি দেখে অভিভুত হলাম আমি। আমার পোসপোর্ট ভিসা ঘাটাঘাটি করে অবশেষে ১২ মে ২০১৫ ঢুকতে পারলাম ইলাতের তাবা বর্ডার দিয়ে ইসরাইলে (ছবি-৫)
আমার প্লান ছিল ভূমধ্য সাগরের পার ধরে তেলআবিবের দিকে এগুবো আমি সপ্তপদি জনপথ দেখতে দেখতে। তারপর আবার ফিরবো এ বর্ডার দিয়েই ইজিপ্টে । কারণ মিসর থেকেই আমার কোলকাতা রিটার্ন ফ্লাইট। খান ইউনুসে ঢোকার আগে ইসরাইলি ১ম জনপদ ‘তাল আস সুলতানে’ যাত্রা বিরতি করলাম একরাত। এখানে কটা ফিলিস্তিন বসতির সাথে বাস করছে আফ্রিকা থেকে আগত গরিব ইহুরিরা। এটা মুলত দরিদ্র এলাকা। ভূমধ্যসাগরে মাছ ধরে জীবিকা এখানের মানুষদের। তবে সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে ‘তাল আস সুলতানে’। ওখানে একরাত বিরতি দিয়ে এগুতে থাকলাম Al Qarya as Suwaydiya গ্রামে। এটাও মুলত আরবি ভাষিক এলাকা। কিছুটা গম, খেজুর উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে এ এলাকাটিতে। যা মূলত করে সুদান আর নাইজেরিয়া থেকে আগত আরবি ভাষিক ইহুদিরা। সাগরের তীর ঘেষে উত্তরে এগুতে থাকি আমি নানাভাবে। ‘রনি সালেহ’ নামক ছোট জনপদে গিয়ে পেলাম FSH Land of Fish রেস্টুরেন্ট নামের একটা খাবারের দোকান। মুূলত ভূমধ্য সাগরের তাজা মাছ রান্না করে, ফ্রাই করে, ভুনা করে কিংবা স্টিমে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় এখানে। সাথে ভাত কিংবা রুটি। একটা উসর মরু এলাকাকে কিভাবে সুন্দর বন্দর বানিয়েছি ইসরাইল তা দেখে বিস্ময়ে চোখ জুড়িয়ে যায় আমার। অনেক রাত অবধি একাকি সাগরতীরে রেস্টুরেন্টের চেয়ারে বসে থাকি আমি এ অচেনা নগরে (ছবি-৬)।
সমুদ্র তীরের এ ছোট গ্রামে রাতে থেকে পরদিন আবার চলতে চলতে পৌঁছি Al Mawasi এলাকায়। ভূমধ্য সাগর থেকে পাইপ লাইনে পানি এনে, তা শোধন করে ঐ পানির সাহায্য পুরো এলাকাটি করা হয়েছে কৃষি প্রধান। গম, টমেটো, সবজির ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার (ছবি-৭,৮)। মুলত আফ্রিকা থেকে আসা দরিদ্র ইহুদিরা কৃষিকাজ করছে এ এলাকাতে। al bala গ্রামে দেখলাম প্রচুর খেজুর গাছ। মুলত এখানের মূল বসতির আরব মুসলমানরা চাষ করছে খেজুরের। পাশের az zawada গ্রামেও দেখলাম এখানের ফিলিস্তিনি মুসলিমরাও চাষ করছে খেজুরের। খেজুর গাছে ওঠার জন্যে সরকার দিয়েছে বিশেষ সিঁড়ির মত যন্ত্র, যা ব্যবহার করছে মুসলিম খেজুর চাষিরা (ছবি-৯)। যদিও রাতে তেলআবিব টিভিতে দেখলাম পুরো ইসরাইলের তাপমাত্রা তখন – “জেরুজালেমে-68°, অ্যাশডড-68°, এলাট-81°, তেল আবিব-70°, নাজারথ-65°, নেতানিয়া-70°, পেটাহ টিকোয়া-68°, বাট ইয়াম-70°, বিয়ারশিবা-64°, বেনে বেরাক-70°, রামলা-68°, রামাত গান-70°, রিশন-লেজিয়ন-68°, হোলোন-70° এবং হাইফা-69°।
এসব কৃষি খামারে ঘুরে আর খেজুর গাছের আরব মুসলিমদের সাথে আলাপ করে, আবার দুদিন পর ছুটলাম ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেসে আরো ১০-কিমি উত্তরে Ben-Gurion University। এটা নাগেভ নামক ছোট্ট শহরে। নিজের পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম ভার্সিটিটা দেখতে। মাত্র ২০০-এর মত শিক্ষার্থী বিশাল এ ভার্সিটিতে। মানুষজন না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আবার পাড়ি দিলাম পাশের কৃষি প্রধান nusairat আর al muqaraka গ্রামের দিকে। একটা লেটুস পাতার ক্ষেতে কাজ করছিল এক নিগ্রো নারী। ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে সব কথা বুঝিনি তার। তারপরো সে বললো, “তানজানিয়া থেকে এসেছে সে, তার নাম কুতি হিদাই। ইহুদি ধর্ম অনুসারি সে” (ছবি-১০)। এ এলাকার কৃষি কাজ দেখে মনেই হলোনা, এটা একটা মরু এলাকা। কি ফল নেই এ এলাকাতে? এভোকোডা, কলা, আপেল, চেরি, পাম, আঙুর সবই ফলে এ এলাকায়। এমন তাপমাত্রায় তারা কিভাবে আঙুর বা শীত প্রধান দেশের ফল ফলাচ্ছে কঠোর পরিশ্রমে, তা দেখে বিস্মিত হলাম আমি (ছবি-১১)। নুসাইরাত নামক একটা ছোট্ট গ্রামের পোস্ট অফিস দেখে ‘ভিমরি খাওয়ার’ পালা আমার। ঢাকা বা কোলকাতার জিপিও এতো সুন্দর নয়! চমৎকার মনোরম এ ইসরাইলি ডাকঘরে কাজ করতে দেখলাম এক আরব মুসলমানকে। সালামালেকুম দিয়ে কথা বললাম তার সাথে আরবিতে। ডাকটিকেট কিনে কোলকাতা এক বন্ধুর ঠিকানায় একটা চিঠি পোস্ট করলাম এ অচেনা গাঁ থেকে। এ ইচ্ছেতে যে, দেখি চিঠিটা কত দিনে পৌঁছে কোলকাতা (ছবি-১৩)।
Photo 10 Photo 11 Photo 12 Photo 13
এ এলাকার ‘পেটাহ তিকাহ’ একটা মোটামোটি বড় শহর। বিমানবন্দর আছে এ ছোট শহরটিতে। প্রত্যকেটি গাঁয়ের সড়কেও সুন্দর সাইনবোর্ড লাগানো, যাতে আরবি, ইংরেজি আর হিব্রু ভাষাতে লেখা বিভিন্ন জনপদের নাম। পোস্ট অফিসে চিঠি পোস্ট করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আরব মুসলিম উমার আবদাল্লার সাথে। আমি বাঙালি, অনেক দূর থেকে ইসরাইল দেখতে এসেছি, শুনে প্রায় ২০-কিমি দূরের “আল-সারাহ” গ্রামে যেতে বললেন তিনি। যেটি হযরত ইব্রাহিম নবীর স্ত্রী বিবি সারাহর জন্মস্থান হিসেবে তার নামেই পরিচিত। ঐ গ্রামে যাওয়ার সড়কটির নামও সারা স্ট্রিট (ছবি-১২)। কিন্তু গ্রামটতে কোন মুসলিম বা কথা বলবো, এমন কাউকে পেলাম না আমি ঘন্টা দুয়েক ঘুরেও। তাই কেবল ২/৪-টা শূন্য ঘর দেখে চলে আসতে হলো আমাকে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে।
মোট ৮-দিন ইসরাইলে ঘুরে জানলাম ইসরায়েলের রাষ্ট্রভাষা দু’টি৷ আধুনিক হিব্রু ভাষা এবং আরবি৷ হিব্রু ভাষার কথা তো সবাই শুনেছি আমরা কিন্তু ‘আধুনিক হিব্রু’ বলতে ঠিক কি বোঝানো হচ্ছে, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবোনা৷ এই ভাষাটি গত ১৯-শতকের শেষভাগ পর্যন্তও বিকশিত হয়েছে বিশ্বে৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আধুনিক হিব্রুর শেকড় প্রাচীন হিব্রু হলেও, এখন এ ভাষায় ইংরেজি, স্লাভিচ, আরবি এবং জার্মানসহ অনেকগুলো বিদেশি ভাষার প্রভাব রয়েছে বেশ৷ ওখানে সব স্কুলে সবার জন্যে আরবি আর হিব্রু শেখা বাধ্যতামূলক। ইসরাইলের ভেতরে গেলে বোঝা্ই যায়না যে, এ দেশটির বর্ডারের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কত খারাপ সম্পর্ক তাদের। বরং ভেতরের আরবরা কাজ করে ইসরাইলি ইহুদিদের সাথে এক সাথেই সরকারি দপ্তরে, রাস্তায়, বাজার, শপিং মল আর বাণিজ্যালয়ে।
দেশটির ভেতরের মুসলমানরা ভালই আছে দেখলাম। ইসরাইলের মোট ৮৫,০২,৯০০ মানুষের মধ্যে ৬৩,৬৩,৭০০ জন ইহুদি (৭৪.৯%), ১৭,৬৬,৫০০ জন (২০.৯%) আরব মুসলিম, ১৩০,০০০ ইথিওপিয়ান ইহুদি। এ ছাড়া ২% আরব খৃস্টান, ১.৫% দ্রুজ মুসলিম ও ইরানি বাহাই ধর্মের লোক বিদ্যামান। মাথাপিছু আয় ৩৫,৩৪৩ আমেরিকান ডলার। টাকার নাম সেকেল, আর পয়সা হচ্ছে আগোরা। ১-সেকেলের নোটে দেখলাম এক আরব মুসলিমের ছবি, যে কিনা ইসরাইল আরব মুসলিমদের মিলেমিশে থাকার কথা বলে “শহীদ” হন (ছবি-১৪)। দেশটির সরাসরি ডায়ালিং কোড +৯৭২। ইসরাইলের প্রধান জেলাগুলো হলো :- জেরুজালেম যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, উত্তর নাজারেথ যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, হাইফা যার জনসংখ্যা ৬৯% ইহুদি ও ২৫% মুসলিম, রামাল্লা যার জনসংখ্যা ৮৮% ইহুদি ও ৮% মুসলিম, তেলআবিব যার জনসংখ্যা ৯৩% ইহুদি ও ১% মুসলিম, বীরসেবা যার জনসংখ্যা ৭৪% ইহুদি ও ২০% মুসলিম, জুডিয়া ও সামারিয়া যার জনসংখ্যা ৯৮% ইহুদি ও ২% মুসলিম।
৮-দিন শেষে আবার ফিরতে হলো তাবা বর্ডারে। কারণ পরের দিন মিসর থেকে আমার কোলকাতা ফ্লাইট। ইসরাইলের মাটি থেকে মিসরের বর্ডারে পা দিতেই কেমন এক মৃত্যু নৈশব্দের মতো কষ্টপথ আগলে ধরে আমায় সন্তর্পণে। নিজের বোধ আমায় তাড়িত করে অনেকক্ষণ। আর সুখভরা রাতপরীর দেশে উড়ে চলা অবোধ বালিকার মতো প্রশ্ন করে আমায়, ইসরাইলি ইহুদি আর আরব মুসলমানরা কি মিলেমিশে থাকতে পারেনা এ পৃথিবীতে? সিনাই বীরসেবা গাজাস্ট্রিপে ভর দুপুরের তপ্ত রোদে দুখভরা সুখনাশক মৃত্যু বিকেলে হাঁটতে থাকি এক গনগনে আগুনে কষ্টের ভেতর আমি কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাইনা এ ত্রিভুবনের কোথাও!
[লেখা বিষয়ক নোট : ছবি সব নেট থেকে নেয়া। বাংলাদেশী পাসপোর্টে ইসরাইলে যাওয়া অসম্ভব বিধায়, ভ্রমণ কাহিনীটি কাল্পনিক] https://www.facebook.com/JahangirHossainDDMoEduGoB