আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ, সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক এবং প্রথম সারির সৈনিক । তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচয়িতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সার্বক্ষণিক কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান সহায়ক ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন।
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর গঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদসহ সাক্ষাৎ করে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ভূমিকা রাখেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনে। ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র তাঁরই প্রণয়ন করা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। খ্যাতিমান এই আইনজীবী এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি তাঁর একটি অডিও-ভিজুয়্যাল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক ও গবেষক আজিজুল পারভেজ। সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোস্তফা কামাল ও সহকারী সম্পাদক ড. সারিয়া সুলতানা।
অনুস্বর: আপনারা কখন বুঝলেন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না?
আমীর-উল ইসলাম: মার্চ মাসে এসে ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। সে সময় আমরা আমাদের খসড়া সংবিধান তৈরি করে ফেলেছি। অ্যাসেম্বলির যখন বৈঠক বসবে সেই বৈঠকে আমরা সেটা পাশ করে দেব। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে যখন আমরা আমাদের কাজগুলো গুছিয়ে এনেছি, সেই সময় (১ মার্চ ১৯৭১) ঢাকার পূর্বানী হোটেলে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ও প্রোভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলির এমপিদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। পার্টির হুইপ হিসেবে আমি তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছি। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একজন একটা রেডিও নিয়ে আসলো। সেখানে ঘোষণা করা হচ্ছে- অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। এটা হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা। ৩ মার্চ অধিবেশন বসার কথা ছিল।
সেই দিন স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। সেখান থেকে দর্শক সবাই বেরিয়ে এল। শহরের অলি-গলি থেকে একের পর এক মিছিল আসতে লাগল। তারা স্লোগান দিচ্ছে- ‘ছয়দফা না এক দফা-এক দফা এক দফা।’ ‘তুমি কে আমি কে-বাঙালী বাঙালী’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
তখন ওইখানে বসেই একটা বিবৃতি লিখে ফেললাম। সেখানে বলা হলো, ইয়াহিয়ার ঘোষণা বিশ্বাসঘাতকতা। এটাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা সকল ক্ষমতা অর্পণ করলাম। জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের নেতা নির্বাচন করলেন। এখন থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দেবেন সেই নির্দেশ এই সভার সিদ্ধান্ত বলে পরিগণিত হবে। তারপর জোরদার আন্দোলন শুরু হলো।
অনুস্বর: পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালালে কী করতে হবে সে ব্যাপারে কি কোনো পরিকল্পনা ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: একটা পরিকল্পনা যে ছিল সেটা তো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণেই জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।… তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’ তিনি ৭ই মার্চে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেটিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা বলে মনে করি।
অনুস্বর: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তা কীভাবে পরিচালিত হবে, কারা নেতৃত্ব দেবেন- সে রকম কোনো পরিকল্পনা কি আপনারা করেছিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: সেগুলো তো আমাদের যে নেতৃত্ব ছিল, সেই নেতৃত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তার সঙ্গে যে চারজন নেতা ছিলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও এম. মনসুর আলী। এরাই ছিলেন আমাদের হাইকমান্ড। এরাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতেন। সে সময় তারাই দেশ চালাচ্ছিলেন। তারা যেটা বন্ধ থাকবে বলতেন, সেটাই বন্ধ থাকত। কোনটা কোন সময় খোলা থাকবে সেটা তারা যা বলতেন তাই হতো।…ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে মার্চ মাস থেকেই স্বাধীনতার প্রস্তুতি সৃষ্টি হয়ে গেছে।
অনুস্বর: পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা সফল না হলে কী করতে হবে সেটা নির্ধারণ হয়েছিল কিনা?
আমীর-উল ইসলাম: আলোচনা তো হলো না। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হলো। ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনী নিয়ে বাঙালির উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিল।
অনুস্বর: পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা সফল না হলে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে যাবেন, এ রকম একটি প্রস্তাব কি আপনারা দিয়েছিলেন? কোন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে না গিয়ে বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু কখনো আত্মগোপনে যান নি। জীবনেও না। উনাকে বলেছিলাম, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে কারণ আপনার জীবনের উপর হামলা হতে পারে। কিন্তু উনি যেতে রাজি হলেন না। তিনি কখনো গোপনে কোথাও গিয়ে পালিয়ে থাকেন নি। রাজনৈতিক জীবনে না, ব্যক্তিগত জীবনেও না।
আমাদের আশঙ্কা ছিল উনার জীবনের উপর হামলা হতে পারে। উনি (বঙ্গবন্ধু) যখন যাবেন না এ রকম পরিস্থিতিতে কী করা যায় তার জন্য তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গেলাম। বললাম, আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু যখন আসলেন না তখন আপনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতে অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তাঁর পক্ষে নেতৃত্ব দিতে হবে। গাইড করতে হবে।
উনি খুব ইতস্তত করছিলেন। তাঁকে বললাম, আপনার উপরেও হামলা হতে পারে। অতএব আপনার জীবনের নিরাপত্তার জন্যও যাওয়া দরকার। এমন সময় বিডিআর ক্যাম্প থেকে লোক চলে আসলো, বলল, আপনারা চলে যান, পাকিস্তানিরা আমাদের বন্দী করে ফেলেছে, আমাদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলেছে। তখন তিনি কনভিন্সড হলেন। বুঝতে পারলেন বড় রকমের একটা সংকট সৃষ্টি হবে।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের যে সময় সেই সময়ে তার প্রেজেন্টস ও লিডারশিপ, অন দ্য ফিল্ড থাকলে, উনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে যেত। উনি বুঝতে পারতেন পরিস্থিতি।
উনি (বঙ্গবন্ধু) কখনোই ভাবতে পারেন নি যে, বাংলাদেশের কোনো মানুষ বা তাদের কোনো বাহিনী তাঁকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করতে পারবে। আমার মনে হয় সেটা ঘটত না। পরিচালনার সময় তিনি থাকলে তখন যুদ্ধ পরিচালনার সময় কী ঘটেছিল, যুদ্ধের সময় কী অবস্থা ছিল, কী ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সব কিছু তার জানা থাকত।
অনুস্বর: আত্মগোপনে যাবেন না, এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছিল কী?
আমীর-উল ইসলাম: আমরা যখন উনার সঙ্গে আলোচনা করেছি, আপনাকে আমাদের সঙ্গে (আত্মগোপনে) থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, আমি কখনো পালিয়ে যাব না। আত্মগোপন করবো না। এটা উনার চরিত্রের মধ্যে ছিল না। সিংহের মতো যার সাহস, সেই সাহস নিয়ে তিনি কখনো পালিয়ে…।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালনার ক্ষেত্রে উনার কমান্ড যদি সরাসরি থাকত, উনি যদি ইন্ডিয়াতে যেতেন, তিনি জানতেন কার কী অবস্থা, কে কি অবস্থায় আছে, কার কী মানসিকতা- তিনি বুঝতে পারতেন। উনি বুঝতে পারতেন, কার কি যোগ্যতা, কার কি মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ফারুক-রশীদদের তিনি চিনতে পারতেন। শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন।
অনুস্বর: ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আপনারা ভারত গেলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন সেই স্মৃতি যদি বলেন।
আমীর-উল ইসলাম: আমরা যখন তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে গেছি, তখন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও এসপি মাহবুবের (মাহবুব উদ্দিন আহমেদ) সঙ্গে আমাদের ঝিনাইদহতে দেখা। ওদেরকে বললাম, আপনারা আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে ওপারে যাবেন এবং ওদেরকে বলবেন। বাংলাদেশের দুই জন উচ্চ পর্যায়ের নেতা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে আসতে চান। তারা তখনই যাবেন যদি তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রহণ হয়। এটা ইচ্ছা করেই বললাম, কারণ প্রাইম মিনিস্টার ছাড়া তো এটা কেউ বলতে পারবে না। বিএসএফ-এর অফিসার তো এটা সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। সে এটা তার চিফের কাছে দিল্লীতে পাঠালেন। বিএসএফ-এর চিফ ছিলেন নেগেন্দ্র সিং । উনি এটা পাঠালেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। উনার একটা সুবিধা ছিল, উনি এক সময় মি. নেহরুর চিফ অব সিকিউরিটি ছিলেন। সেই সূত্রে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, ‘ইউ গো ইয়রসেলফ টু রিসিভ দেম। অ্যান্ড বেঙ্গলিজ আর নট অ্যাজ টলার্স ইউ আর। বাট দে আর ভেরি টল ইন দ্য থটস।’ এই যে আমরা পাঠালাম, যে প্রধান তার সঙ্গেই আমাদের কথা বলতে হবে।
তারপর একটি ভিআইপি গাড়ি এল। আমাদের সোজা কলকাতা বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। বিমানবন্দর তখন ব্ল্যাক আউট করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা কেউ না জানতে পারে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বিএসএফ-এর একটি কার্গো প্লেনে করে। দিল্লীতে পৌঁছলাম ভোর বেলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখান থেকে একটি ভালো গাড়িতে করে আমাদের দুইজনকে নিয়ে গেল রাষ্ট্রীয় গেস্ট হাউসে।
আমরা তো ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর অবস্থা। তারা খাবার আনার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যবস্থা করতে পারল না। বিএসএফ অফিসার গোলক মজুমদার তার কাছে রাখা কিছু টোস্ট দিল। তখন খাওয়া তো দূরের কথা। আমাদের গা থেকে তখন গন্ধ বেরুচ্ছে। এক কাপড়ে আছি কয়েকদিন ধরে। গোলক মজুমদার তার একটি গাউন দিল। যেটা গোটা শরীর ঢেকে দিল। তারপর গোসল করে খেলাম।
দিল্লীতে দেখা হলো শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। উনিও এক্সপেক্ট করছিলেন, বঙ্গবন্ধু আসবেন। উনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব?’ আমরা বললাম, ‘আমরা যখন এসেছি তখন তিনি ভালোই আছেন, তিনিই সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন। উনি সার্বিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সে জন্য তিনি আসতে পারেন নি। তিনিই আমাদের পাঠিয়েছেন, ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন। সে জন্যই আমরা এসেছি।’
সম্ভবত তারপরই জানা গেল, বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। তখন আর কিছুই গোপন থাকল না।
অনুস্বর: স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র রচনার পরিকল্পনাটা কীভাবে এলো?
আমীর-উল ইসলাম: ইতিহাসে আছে। আমেরিকান ইনডিপেন্ডেন্সে সেখানেও তো আছে ঘোষণা, ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’। পৃথিবীতে দুইটিই আছে। একটি আছে আমেরিকার যুদ্ধের সময়। আর দ্বিতীয়টি আমাদের। আমাদেরটা বোধহয় অনেক বেটার ওদের চাইতে। এই রকম কিছু করবো এটা বর্ডার পার হওয়ার আগেই করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
অনুস্বর: মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার ভূমিকা কেমন ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: মাওলানা ভাসানী কলকাতায় এসেছিলেন এবং আরও চারজনসহ আমাদের সাপোর্ট দিয়েছিলেন। উপদেষ্টা হিসেবে উনাদের ইনভলভ্্ করা, তাদের ওই ধরনের কোনো ভূমিকা ছিল না। সব পার্টি যে যুক্ত রয়েছে, সবার যে সহযোগিতা আছে, সেটাই দেখানো। কিন্তু ভাসানী সাহেব আসামসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। চায়নিজদের সঙ্গে উনার একটা সম্পর্ক ছিল। আবার চায়না তো আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। মাওলানা সাহেবকে আমাদের সঙ্গে রাখাটা দরকার ছিল।
অনুস্বর: মাওলানা ভাসানীর চলাফেরা কি নিয়ন্ত্রিত ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: থাকাটা স্বাভাবিক। উনি তো ভারতবিরোধী ছিলেন। চীনের সঙ্গে উনার সম্পর্ক। চীন-পাকিস্তান একজোট হয়েছে। যুদ্ধ তো আমাদের তাদের বিরুদ্ধে।
অনুস্বর: পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। ওই অনুষ্ঠানে কী জেনারেল ওসমানীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: ওরা তো বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে সারেন্ডার করবে না। যুদ্ধে যারা হেরেছে তারা, যুদ্ধে যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের কাছে সারেন্ডার করেছে। অন্য কারও কাছে তো আত্মসমর্পণ করবে না। আমি যদি পাকিস্তানি হতাম আমিও তো বাঙালির কাছে সারেন্ডার করতাম না। আমি তো জেনারেল অব পাকিস্তান। সারেন্ডার করতাম, ওই যুদ্ধে যে নেতৃত্ব দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল অরোরা। তার কাছেই তো সারেন্ডার করেছে।
ওসমানী সাহেবের উপস্থিত থাকা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি চলে আসলেন সিলেটে। সেখানে গিয়ে তার প্লেনে একটা গুলি লাগল। তার সঙ্গে সেক্রেটারি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালও। গুলি লাগার কারণে তিনি আর সেখানে উপস্থিত হতে পারেন নি। তা না হলে উনি উপস্থিত থাকতে কোনো ডিফিকাল্টি তো ছিল না।
অনুস্বর: শোনা যায়, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ষড়যন্ত্রে মেতেছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু জেলখানায়। তখন আমি শার্ন ম্যাকব্রাইট নামক পৃথিবী বিখ্যাত একজন জ্যুরিস্ট; তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল যখন ব্যারিস্টারি পড়ছিলাম লন্ডনে। তার কাছে আমি একটি চিঠি লিখলাম, বঙ্গবন্ধুকে জেলে রাখার বিষয় এবং তার জীবন রক্ষা করার বিষয়টা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু ইজ দ্য ইলেক্টেড লিডার অব ফিফটি মিলিয়ন পিপল অব বাংলাদেশ। তিনি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাকে আমরা প্রেসিডেন্ট বানিয়েছি। তাকে বন্দি করে রাখা যায় কি-না।
রাষ্ট্রপ্রধানকে বন্দি করে রাখা যায় কি-না। তখন উনি বললেন, এটা করতে পারে না। একজন রাষ্ট্র প্রধানকে এটা করতে পারে না। তার ভালো উত্তরটি প্রধানমন্ত্রীকে দেখালাম। তিনি কোয়াইট হ্যাপি। তিনি বললেন, মোশতাককে দেখান, তিনি তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মোশতাকের কাছে যখন গেছি, তখন দেখি তার বাসায় অনেক লোকজন। বেশ সময় লাগল দেখাতে। লোকজন যাওয়ার পর অপিনিয়নটা দেখিয়ে বললাম, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটা আপনাকে দেখানোর জন্য।
উনি দেখে উত্তর দিলেন, ‘ইউ হ্যাভ টু চুজ, হোয়েদার ইউ ওয়ান্ট শেখ মুজিব অর ইউ ওয়ান্ট বাংলাদেশ’। আমি বললাম, ‘বাংলাদেশ উইল রিমেইন ইনকমপ্লিট উইদাউট বঙ্গবন্ধু, অ্যান্ড বঙ্গবন্ধু উইল রিমেইন ইনকমপ্লিট উইদাউট বাংলাদেশ। সো আই হ্যাভ টু হ্যাভ বোথ। তার টেস্টটা তো তখনই হয়ে গেল।
আগরতলায় বাংলাদেশ সরকার গঠনের জন্য বৈঠক বসেছে। সেখানে নেতা আছেন। এমপিরা আছেন। জেনারেল ওসমানীও এসেছেন। মোশতাকও এসেছেন, সেখানে যখন সরকার গঠনের বিষয়ে জানানো হলো, তিনি বললেন, তাকে যেন সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তিনি হজ্ব করতে যাবেন। তাকে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় নি। অভিমানেই তিনি সেটা বললেন। অনেক রাত হয়েছে, সেটা শুনে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন কমপ্রোমাইজ হলো তাকে ফরেন মিনিস্টার বানালে তিনি রাজি হবেন। যাতে বিদেশ যেতে পারেন। যখন জাতিসংঘে আমাদের প্রতিনিধি গেল, তখন তাকে পাঠানো হয় নি। হি ওয়াজ এক্সপ্লয়টেড। যাতে বাইরে যেতে না পারে। বাইরে গেলে তো.. অলরেডি সিআইএ-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল।
অনুস্বর: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তো আপনি ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন। তার মূল্যায়ন যদি করেন।
আমীর-উল ইসলাম: তিনি খুব সিম্পল পারসন। নিজেকে কখনো নেতা হিসেবে প্রজেক্ট করতেন না। আমি আর উনি একই ঘরে থাকতাম। খুবই সিম্পল ঘর। ছোট দুইটি চৌকি। ওইখানে আমরা শুইতাম। উনি বসতেন যে চেয়ারে সেটাতে হাতল ছিল না। আরেকটা চেয়ারে হাতল ছিল। সেইটাতে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা রাখতেন। এটা অনেকটা মনে পড়ে, রাম যখন বনবাসে, লক্ষণ তখন রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্য চালাতেন। আমিও তাকে বলতাম, আপনি তো লক্ষণের ভূমিকা পালন করছেন। ও রকম একটা মানুষ পাশে থাকা মানে বিরাট একটা…। জ্ঞান-গরিমা, অর্থনীতি, ইতিহাস, লেখাপড়া। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাকে খুবই সম্মান করতেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে।
অনুস্বর: স্বাধীনতার তো পঞ্চাশ বছর হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই রাষ্ট্রের যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হলো?
আমীর-উল ইসলাম: জাস্ট উল্টোটা হচ্ছে। আমি যেটা লিখেছিলাম, প্রক্লেমেশন অব দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো। তিনটি কথা ছিল। রাষ্ট্র হবে ইকুয়ালিটি; এখানে সাম্য থাকবে। হিউম্যান ডিগনিটি থাকবে; মানবিক মর্যাদা। আরেকটা হচ্ছে- সোস্যাল জাস্টিস; সামাজিক ন্যায়বিচার।
সামাজিক মর্যাদাটা কি আছে? খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, মহিলাদের উপর কী রকম নির্যাতন হচ্ছে। শিশুদের উপর পর্যন্ত ব্যাভিচার হচ্ছে। হিউম্যান ডিগনিটি কোথায়? এটা তো জাতীয় অপরাধ। আমরা কি সেই বাংলাদেশ তৈরি করতে পেরেছি? পারি নাই।
অনুস্বর: এই না পারার ব্যর্থতাটা কাদের?
আমীর-উল ইসলাম: কপালের। ব্যর্থতা আমাদের কপালের। বঙ্গবন্ধুর তো মৃত্যু হওয়ার কথা না। উনি যদি তাজউদ্দীন সাহেবকে পাশে রাখতেন, কিছুই হতো না তার। যাই করতেন তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়েই যদি করতেন। কিন্তু মোশতাকের ষড়যন্ত্রে তাজউদ্দীন সাহেব দূরে সরে গেল।
অনুস্বর: মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কী করা উচিৎ?
আমীর-উল ইসলাম: প্রথমত খাঁটি মানুষ তৈরি করা। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে যোগ্য মানুষ তৈরি করতে হবে। দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। সবার মধ্যে মানবিক বোধ তৈরি করতে হবে।
অনুস্বর:আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমীর-উল ইসলাম: ধন্যবাদ।