বিচিত্রা ২২ জুন ১৯৭২
কাজী আনোয়ার হোসেন
ছেলেটাকে পিটিয়ে মারল লোকগুলো। এই সেগুন বাগানে, একশো চল্লিশ নম্বর বাড়ীর সামনে, রাজার তেমাথায়। গতকাল তেরই মে, শনিবার, বেলা বারোটায়।
দোষী মনে হচ্ছে আমার নিজেকে।
দোতালায় বসে লিখছিলাম। সকাল সোয়া দশটা। টাশশ করে একটা পিস্তলের আওয়াজ। তারপর হৈ চৈ। বারান্দায় বেরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। গাছপালার জন্যে দেখা যাচ্ছে না। তিরিশ গজ দূরে রাস্তার ঐ তেমাথায় গোলমাল।
আবার এসে লিখতে বসলাম। কিন্তু চিৎকার বেড়েই চলেছে। আবার বারান্দায় এলাম। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল—দুজন ডাকাত ধরা পড়েছে। খানায় ফোন করেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম, ছবি তুলব ডাকাতের।
দেড়শো-দুশো লোক জড়ো হয়ে মারছে। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম—কি ব্যাপার? কেউ সঠিক কোন জবাব দিতে পারল না। আসলে কি হয়েছে কেউ জানেই না ঠিকমত! টুকরো টুকরো জানা গেল: বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কোন এক ব্যাঙ্ক লুট করে পালাচ্ছিল তিনজন হাইজ্যাক করা গাড়ী নিয়ে, ব্যাঙ্কে একজনকে গুলি করে মেরে রেখে এসেছে, বাধা দেয়ার চেষ্টা করায় একজন ট্রাফিক পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে, পিছু ধাওয়া করেছিল পুলিশ—দিশে হারিয়ে রাস্তায় গাড়ী চাপা দিয়ে মেরেছে দুজনকে, কলেজ অব মিউজিকের সামনে একটা রিক্সাকে ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলে দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে, পালাবার সময় গুলি ছুড়েছে রিভলভারের, একজন পালিয়ে গেছে, বাকি দুজন ধরা পড়েছে, লোকজন মারছে ওদেরকে। কেউ বলল ওরা রাজাকার, কেউ বলল বিহারী, কেউ বা বলছে নক্সালাইট, আলবদর।
ঠেলাঠেলির মধ্যে আরেকটু এগিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। দেখলাম একজন সাদা ইউনিফরম পরা ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। হাতে একটা রিভলভার।
এই নিরিবিলি এলাকায় এত লোক কোথা থেকে জড়ো হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সবাই মারছে। ডাল ভেঙ্গে নিয়েছে কেউ কাঁঠাল গাছের, এরই মধ্যে মোটা একটা মুগুর সংগ্রহ করে ফেলেছে একজন কোথা থেকে। কিল, ঘুষি, লাথি, কনুই চলেছে এন্তার। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে লোকগুলো। একটা কণ্ঠস্বর শুনা গেল—ছুরি লইয়া আয়, জবো কইরা ফালামু শালারে।
মারের চোটে রাস্তায় শুয়ে পড়ল সিদ্দিক। রোববারের কাগজ দেখে ওর নামটা জানতে পারলাম। নীল হয়ে গেছে মুখ, গা। কুঁকড়ে পড়ে আছে মাটিতে, থামছে না মার।
এদের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি আনার চেষ্টা করছি না। আমি শুধু বলতে চাই, কেউ জানে না কেন ওদের মারা হচ্ছে। দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সবাই। মেরেই চলেছে নেশাগ্রস্তের মত।
ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল ধাক্কাধাক্কিতে। ওদিকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পাঁচিল টপকে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে লাফিয়ে পড়েছে অপর ছেলেটা। নাম ফারুক। ত্রিশ চল্লিশ জন ঢুকে পড়ল পিছু পিছু। শিলা বৃষ্টির মত পড়ছে কিল ঘুষি। আরো কয়েকটা লাকড়ি সংগ্রহ করে ফেলেছে জনতা, ততক্ষণ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফারুকের সর্বাঙ্গ। হঠাৎ দেয়ালের পাশে কয়েকটা কয়েকটা দশ ইঞ্চি ইটের সন্ধান পেল জনতা। তাই দিয়ে মারতে শুরু করল দমাদম।
ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে হয়ত ফারুক মনে করল আমি সাংবাদিক, হয়ত সাহায্য পাবে আমার কাছে। ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে।
‘বাঁচান, ভাই। আমারে বাঁচান।’
চোখের একপাশ ফেটে গেছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে দরদর করে। সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ছেলেটা—বিশ বছর বয়স হবে—বিবর্ণ হয়ে গেছে চেহারা, অসহায়, কাতর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর। অসীম আকুতি ওর ওই দুই চোখে। হাঁপাচ্ছে। রক্তের ছোপ লেগে গেল আমার সার্টে, ঠিক বুকের কাছে। খামচে ধরেছিল, ছিঁড়ে গেল গেঞ্জিটা টান লেগে। ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওকে ক্রুদ্ধ জনতা।
পারলাম না। বাঁচাতে পারলাম না আমি ফারুককে। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন। আমি জানতাম না মারা যাবে ছেলেটা। তখন বুঝতে পারলে হয়ত চিৎকার করে মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, বলতে পারতাম—বিচার পাওয়ার অধিকার আছে ওর। হয়ত আমার কথা শুনত কেউ কেউ। হয়ত কিছুটা কমত মারের পরিমাণ। অনেক কিছুই মনে হচ্ছে এখন। যদি বলতাম, ঠিক আছে, কে কে মারতে চাও, এসো, কিন্তু মরে গেলে দায়ী হতে হবে তোমাদের—যদি বলতাম, খবর্দার কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না, পুলিশের হাতে জ্যান্ত তুলে দিতে হবে ওকে পুরো দলের খবর বেরোবে ওর কাছ থেকে—কিম্বা সত-আট জন লোক সংগ্রহ করে নিয়ে যদি রুখে দাঁড়াতাম, দু-চার ঘা পড়ত আমার পিঠে, কিন্তু তাহলে হয়ত বেঁচে যেত ছেলেটা। কার না জানি চোখের মণি।
অনেক কিছুই তাবছি এখন, অনেক কিছুই করা যেত, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। মেরে যে ফেলবে, একথা ভাবতেই পারিনি আসলে। ভেবেছি, নিশ্চয় কিছু একটা দোষ করেছে, আমি জানি না, কিন্তু যারা মারছে তারা কি কিছুই না জেনে মারছে। ভেবেছি, পুলিশ আসছে, পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ঝঞ্জাট শেষ। নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছি আমি। দায়িত্বজ্ঞানহীনের কাজ করেছি। রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত ফটোগুলো ডেভেলপ ও প্রিন্ট করে পরদিন এ নিয়ে লিখতে বসলেই এ অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কিছু না কিছু চেষ্টা করা উচিত ছিল আমার।
এলো পুলিশ। কিন্তু তখনো মেরে চলেছে ওরা। কাছে এগোনো যাচ্ছে না ভিড় ঠেলে। মনে হল, ক্ষিপ্ত জনতার হাবভাব ঠিক বুঝতে না পেরে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে দ্বিধা করছে পুলিশ। দেখলাম পুলিশের সামনেই টেনে-হিঁচড়ে মহিলা পরিষদের সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনছে ওরা ফারুককে।
ভাবলাম, তবু পুলিশ নামের গুণ আছে, অবস্থা আয়ত্তে আনতে অসুবিধে হবে না। হাঁপ ছেড়ে ফিরে এলাম বাসায়। মিনিট দশেক পরই ছুটে এল নীচতালার চাকরটা। বলল—মেরেই ফেলেছে একজনকে।
‘কীভাবে মারল? পুলিশ কি করছে?’
একটাকে নিয়ে চলে গেছে পুলিশ। আর আরেকটাকে (ফারুক) নিতে পারেনি। দম ছিল কিছুটা, গলায় পা দিয়ে দম বের করে দিয়েছে লোকেরা।
ছুটলাম আবার।
মরে পড়ে আছে ফারুক। পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। সার্ট খুলে নিয়ে গেছে কেউ। প্যান্টটা কেন হাঁটুর নীচ পর্যন্ত টেনে নামান হয়েছে বোঝা গেল না। রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে লাশটা। পাশে পড়ে আছে ছেঁড়া একটা কাঁঠাল পাতা।
বুকটা ধরে আসতে চায়। অন্যায় করেছি আমরা ফারুকের উপর। যত দোষই করে থাকুক, থানা আছে, পুলিশ আছে, আইন আছে, আদালত আছে—আমার আপনার মতই বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল ওর। এমন একটি জনতা ওর বিচার করল, আসল ঘটনা সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই। এর নাম জনতার বিচার।
পুলিশ সূত্রের উল্লেখ করে আসল ঘটনাটা ছাপা হয়েছে রোববার এই পত্রিকাতেই। আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন? জানা গেল: ব্যাঙ্ক লুট করেনি ওরা, গাড়ীটা হাইজ্যাক করা কি না তাতে সন্দেহ আছে, ব্যাঙ্কের কাউকে গুলি করে খুন করেনি ওরা, ট্রাফিক পুলিশ নিহত হয়নি ওদের গুলিতে, এবং রাজাকার বা আলবদরের কেউ ছিল না ওরা। ব্যাপারটা অন্য কিছু।
স্বাধীনতার পর দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে, প্রাণের মূল্যই কি শুধু কম থাকবে?