পাকিস্তানে LFO আওতায় ১৯৭০ এর ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের ও ১৭ ডিসেম্বর প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয়। LFO হোল Legal framework Order. প্রেসিডেন্ট ও প্রধান সামরিক আইন প্রশাসক ১৯৬৯ এর ২৬ মার্চ এই অর্ডারটি জারী করেন। এই নির্দেশনা পাকিস্তানের আইন প্রণয়নে গণপ্রতিনিধিত্বের বিভাজন ছিল এমন।
জাতীয় পরিষদের প্রদেশ ভিত্তিক আসন ভাগ করা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ১৬২ (+৭), পাঞ্জাবের ৮২ (+৩), সিন্ধের ২৭ (+১), বেলুচিস্তানের ৪ (+১), উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ১৮ (+১), কেন্দ্র শাসিত উপজাতি ৭ (+০)। সব মিলিয়ে ৩১৩ যার মাঝে রয়েছে নারী ১৩।
প্রাদেশিক পরিষদের আসন ভাগ করা ছিল পূর্ব পাকিস্তানের ৩০০ (১০), পাঞ্জাবের ১৮০ (+৬), সিন্ধের ৬০ (+২), বেলুচিস্তানের ২০ (+১), উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশের ৪০ (+২)। সব মিলিয়ে ৬২১ যার মাঝে রয়েছে নারী ২১।
নির্বাচনে ভোট গণনার ফলাফল নিয়ে বিস্তারিত আলোচনা করতে গেলে বলা যায় জাতীয় পরিষদের ক্ষেত্রে শেখ মুজিবর রহমানের নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ বিজয়ী হয় পূর্ব পাকিস্তানের (১৬০+৭) মোট ১৬৭ আসন এবং জুলফিকার আলি ভুট্টোর নেতৃত্বে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পিপিপি বিজয়ী হয় পাঞ্জাবের ৬৪, সিন্ধে ১৮, উত্তর পশ্চিম সীমান্তে ১টি মিলিয়ে মোট ৮৩ আসন।
১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর জাতীয় পরিষদের নির্বাচনে পূর্ব পাকিস্তানের জন্য সংরক্ষিত ১০টি মহিলা আসনে আওয়ামী লীগ থেকে জাতীয় পরিষদে ৭ জন নির্বাচিত হয়। নির্বাচনে আওয়ামী লীগ সংরক্ষিত মহিলা আসন সহ ১৬৭টি আসন লাভ করে একক সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে বিজয়ী হয়। বাকি দুইটি আসনের একটি পায় স্বতন্ত্র প্রার্থী পার্বত্য চট্টগ্রামের রাজা ত্রিদিব রায় এবং পিডিপির নূরুল আমীন। স্বতন্ত্র সদস্য রাজা ত্রিদিব রায় পরবর্তীসময় আওয়ামী লীগে যোগদান করেন। কিন্তু আওয়ামী লীগের পক্ষে পশ্চিম পাকিস্তান থেকে একটি আসনও পায় না।
৯৩ পশ্চিম পাকিস্তানে ৪টি প্রদেশের মধ্যে পাঞ্জাবে ৬৪টি, সিন্ধুতে ১৮টি ও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে ১টি আসনসহ মোট ৮৩টি জাতীয় পরিষদের আসনে জয়ী হয়ে পাকিস্তান পিপলস পার্টি দ্বিতীয় সংখ্যাগরিষ্ঠতা অর্জন করে। ওয়ালী ন্যাপ উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে জাতীয় পরিষদের ১৮টি আসনের ৩টিতে এবং বেলুচিস্তানের ৪টি আসনের মধ্যে ৩টিতে জয় লাভ করে, পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে জাতীয় পরিষদের কোনো আসনে জয়ী হয়নি।
১০ দিন পর অর্থাৎ ১৭ ডিসেম্বর অনুষ্ঠিত প্রাদেশিক পরিষদের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ ৩০০টি আসনের মধ্যে ২৮৮টি আসন লাভ করে।
পশ্চিম পাকিস্তানে নির্বাচনের ফলাফল দেখে বুঝা যায় কোনো দলই সেখানে ম্যান্ডেট পায়নি। পাঞ্জাব ও সিন্ধু প্রদেশে পিপলস পার্টি সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে পরিচিতি পায়। জাতীয় পরিষদ নির্বাচনে পাকিস্তান পিপলস পার্টি পশ্চিম পাকিস্তানে ১৪৪টি আসনের মধ্যে ৮৮টি আসন লাভ করে। উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশ ও বেলুচিস্তান এই দুটি প্রদেশের প্রথমটিতে ১টি ও দ্বিতীয়টিতে কোনো আসনেই পিপলস পার্টি জয়ী হয়নি। পাকিস্তান ব্যাপী কেন্দ্রীয় দল ওয়ালী ন্যাপ একমাত্র বেলুচিস্তান প্রদেশেই সরকার গঠন করার মতো আসন পায়। যদিও উত্তর পশ্চিম সীমান্ত প্রদেশে তারা হাজারভী গ্রুপের সাথে কোয়ালিশন সরকার গঠনের মতো সংখ্যাগরিষ্ঠতা পেয়েছিল। পূর্ব পাকিস্তান প্রাদেশিক পরিষদে তারা ১টি মাত্র আসন লাভ করতে সমর্থ হলেও পাঞ্জাব ও সিন্ধুতে তারা কোনো আসন লাভ করতে পারেনি।, ডানপন্থী ধর্মীয় দলগুলো দুই অঞ্চলেই ব্যর্থ হলো।
ধারণা করা হয়, গোয়েন্দা বিভাগের রিপোর্টের ভিত্তিতেই পাকিস্তানের সামরিক সরকার এমন একটি নিরপেক্ষ সাধারণ নির্বাচন অনুষ্ঠান করতে সাহস করেছিল। তাদের ধারণা ছিল, পাকিস্তানের দক্ষিণপন্থী দলগুলো যথা পিডিপি, মুসলিম লীগ, জামায়াতে ইসলামি ও আসগর খানের গ্রুপ প্রমুখ নির্বাচনে ফল লাভ করবে।
নির্বাচনের ফলাফল সম্পর্কে মন্তব্য করতে গিয়ে ইয়াহিয়া খানের মন্ত্রিসভার অন্যতম সদস্য জি ডব্লিউ চৌধুরী মন্তব্য করেছেন- ‘নির্বাচন অনুষ্ঠিত হয় ১৯৭০ সালের ৭ ডিসেম্বর এবং যে কোনো মানদণ্ডেই তা ছিল অবাধ ও নিরপেক্ষ। ভাগ্যের পরিহাস এটাই ছিল অখণ্ড পাকিস্তানের সর্বপ্রথম ও সর্বশেষ প্রকৃত নির্বাচন। নানা মহলে ব্যক্ত অভিমতের বিপরীতে নির্বাচনী ফলাফল অন্ততঃ পূর্ব পাকিস্তানের ক্ষেত্রে শাসক মহল কিংবা সেখানকার রাজনৈতিক ঘটনা প্রবাহের যে কোনো ঐকান্তিক পর্যবেক্ষকের কাছেই কোনো বিস্ময় উদেককারী ছিল না। কিন্তু পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচনী ফলাফল বিস্ময়ের উৎপাদন করে বিশেষ করে সেখানে ডানপন্থী ও ধর্মীয় দলগুলোর সম্পূর্ণ পরাজয়ে এবং একজন অপাঞ্জাবী ভুট্টোর পশ্চিম পাকিস্তানের নেতা হিসেবে আরো সঠিকভাবে বললে পাঞ্জাবের নেতা হিসেবে উত্থানে। (অখণ্ড পাকিস্তানের শেষ দিনগুলি, পৃ. ১২২)।