জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর বই ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’তে (পাকিস্তান পিপলস পার্টি, করাচি, ১৯৭১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের ঘটনাবলির বিবরণ দেন।
ঢাকা যাওয়ার পথে ১২ মার্চ [১৯৭১ সাল] প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচি আসেন। আমি ১৪ তারিখে তার সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে আমাদের দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করি এবং সর্বশেষ ঘটনাবলির ব্যাপারে আমাদের অবস্থান বর্ণনা করি। আমি তাঁকে বলি যে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত দাবি চতুষ্টয় আমরা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন অথবা চূড়ান্ত, যেকোনাে মীমাংসা আমাদের সম্মতিতে হতে হবে। দেশের পশ্চিম অংশসহ সারা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। প্রেসিডেন্টকে জানানাে হলাে যে গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্ত ও সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন-সংশ্লিষ্ট দাবিগুলাে অবিলম্বে মেনে নেওয়া যেতে পারে। সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি দুটোও আমাদের কাছে গ্রহণযােগ্য। তবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের পদ্ধতি একটি সাধারণ মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এ কারণে আমাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আলােচনা সফল হতে পারে না। তাঁকে অবগত করা হলাে যে আমরা ঢাকা যেতে প্রস্তুত, যদি শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সঙ্গে অর্থবহ আলাপ-আলােচনা করেন।
যেকোনাে বাস্তবতার মানদণ্ডে, যুক্তিসংগতভাবে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিতকরণ-সংক্রান্ত ১ মার্চের ঘােষণার পর যে বিস্ফোরণােন্মুখ। প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা যথাযথ মনে হয় না। শেখ মুজিবুর রহমানের চরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কারণ অন্যত্র নিহিত ছিল। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সংবিধানসম্মত বিচ্ছিন্নতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে উপলব্ধি করতে পেরে তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করে সহিংসতার ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেন। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের পরাজিত দলসমূহের মনােভাব তাকে উৎসাহিত করে। সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ না করায়, তার মনে হয় যে তার দাবিসমূহের বিষয়ে তাদের মৌন সম্মতি রয়েছে। পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটে যে প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ঘােষণাকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে মন্তব্য করেন, প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের একজন অতিথি হিসেবে খােশ আমদেদ জানানাে হবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকার উদ্দেশে করাচি ত্যাগ করেন।
১৬ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট আমাকে ১৯ মার্চ ঢাকায় আসার জন্য সংবাদ পাঠান। পরদিন আমি বার্তার জবাব দিই। ১৯ মার্চ ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ সম্পর্কে তাকে আমি আশ্বস্ত করে শর্তারােপ করি যে আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। প্রেসিডেন্ট যেহেতু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেহেতু শুধু তাঁর সঙ্গে আরেক দফা আলাপের জন্য ঢাকায় গিয়ে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সফল। হবে না বলেই আমরা মনে করি। যা দরকার ছিল বা জরুরি ছিল তা হলাে, পিপলস পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ এবং আমরা জানতে চেষ্টা করলাম যে এ রকম কোনাে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে কি না। আমি এ বিষয়ে। ব্যাখ্যা চাইলাম—যে ব্যাখ্যার কথা আমি করাচিতে ১৮ মার্চে আয়ােজিত আমার সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছিলাম। ইতিমধ্যে ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার আমাকে আরেকটি বার্তা পাঠিয়ে জানান যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনার জন্য আমার ঢাকায় সফর করা প্রয়ােজন। তার। মতে, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলাপের ফলে এ ধরনের আলােচনা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমাকে ঢাকায় ডাকা হচ্ছিল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার জন্য নয়, এটা অবহিত হওয়ার পর আমরা সবিনয়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করি।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকটি বৈঠক এবং ঢাকায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কতিপয় রাজনীতিবিদের কার্যকলাপে বেশ কিছু সন্দেহের উদ্ভব হয়। সংবাদপত্র মিথ্যা বিবরণ আর ওই মুহূর্তে ছড়ানাে গুজবে পরিপূর্ণ ছিল। কখনাে কখনাে প্রকাশিত হচ্ছিল যে আলােচনায় সন্তোষজনক অগ্রগতি হচ্ছে না। আবার অন্য সময় দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করা। হচ্ছিল যে সাফল্যজনক আলাপ-আলােচনা প্রায় সমাপ্তির পথে এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্টের আইন উপদেষ্টাদের ঢাকায় তলবের ফলে এসব গুজব বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জন করে। ঢাকায় তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছিল যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে। অনিশ্চয়তা ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের গভীর চক্রান্ত বিবেচনা করে আমি ১৮ মার্চ প্রেসিডেন্টকে এক বার্তা পাঠাই। যাতে আমি উল্লেখ করি যে ঢাকার গুরুতর পরিস্থিতি আমরা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি। উপরন্তু দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জনগণের প্রতি আমাদের কর্তব্য হলাে, তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখা এবং পরিস্থিতির অন্তর্বর্তীকালীন বা চূড়ান্ত মীমাংসায় পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে বাদ রাখার যেকোনাে উদ্যোগ প্রতিহত করা। পাকিস্তান পিপলস পার্টির কাছে গ্রহণযােগ্য নয়, এমন কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ তা মেনে নেবে না। আমাদের এ সুবিদিত অবস্থান আমি পুনর্ব্যক্ত করি।
প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় এক বার্তা পেলাম, যাতে বলা হয়েছে যে উপদেষ্টাদের নিয়ে আমি যেন সত্বর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। বার্তায় উল্লেখ ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ও আমার সঙ্গে আলােচনায় রাজি হয়েছেন। আমাদের শর্ত পূরণ হওয়ায় আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। পরিস্থিতি পর্যালােচনা এবং ঢাকার জন্য আমাদের সারসংক্ষেপ প্রস্তুতের জন্য ২০ তারিখ সকালে করাচিতে আমি পিপলস পার্টির হাইকমান্ডের এক জরুরি সভা ডাকলাম। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আমার কয়েকজন সহকর্মীসহ ২১ তারিখ সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। আমাদের প্রস্থানের (ঢাকার পথে) মধ্য দিয়ে উদ্বিগ্ন জাতির দৃষ্টি ঢাকার দিকে নিবদ্ধ হলাে। এমনকি রাস্তার মানুষও জানত যে বিষয়াদি চরম আকার ধারণ করেছে। পরবর্তী কদিনের মধ্যে ঢাকা পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা ঢাকা পৌছালাম। এটা ছিল জরুরি অবতরণ। কারণ, আমাদের বহনকারী বােয়িং বিমানের চারটির মধ্যে দুটি ইঞ্জিন যাত্রাপথে বিকল হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে উড্ডয়নকালে এবং বিমান অবতরণের সময় ঢাকার সবুজ ভূমি দেখে আমি এক অবর্ণনীয় অনুভূতিতে বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমাদের এ দেশ, আমাদের এ জনগণ, যারা পাকিস্তান সৃষ্টিতে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, তা প্রকৃত অর্থে বিচ্ছিন্নতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। আমি কল্পনা করতে পারিনি যে আমাদের বাহাত্তর মিলিয়ন দেশবাসী পাকিস্তান। থেকে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে গেল কয়। বছরে এত বেশি ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে যে আমাদের ভাইবােনেরা দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, যার জন্য অনেকেই রক্ত দিয়েছেন। দেশভাগের সময় পাকিস্তান পূর্ব পাঞ্জাব, পশ্চিম বাংলা এবং আসামকে হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ ভারতের দখলে চলে যায়। আর এখন, দুই যুগ বাদে, আমাদের দেশের সবচেয়ে জনবহুল অংশের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিমান থেকে অবতরণের পর আমরা সামরিক বাহিনীর লােকজন দ্বারা। পরিবেষ্টিত হই, বিমানবন্দরে প্রহরারত জওয়ানরা এবং সেনানিবাস ও এর আশপাশে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা [বিহারি] আমাদের অভিনন্দিত করে। এই শরণার্থীদের দুর্দশা এবং তাদের মর্মবিদারক কাহিনি কখনাে ভােলা যাবে না। নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে আমাদের ভিআইপি অপেক্ষাগারে আনার পর ব্রিগেডিয়ার আরবাব খান [ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, ঢাকাস্থ ৫৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক] জানালেন, সেনাবাহিনী আমাদের ঢাকা অবস্থানকালে যে ব্যবস্থাপনা করেছিল, তার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে চাচ্ছিলেন যে তার দল আমাদের দেখভাল করবে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিমানবন্দরে কয়েকটি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলেন। এই আয়ােজনে আমার কিছু সহকর্মী উদ্বিগ্ন হলেন। তবে, আমি এই সদিচ্ছামূলক প্রস্তাবটিকে তাঁর ফেসভ্যালুর কারণে গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলাম। যাহােক, জনৈক কর্নেল পরামর্শ দেন যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে হােটেল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় যাওয়া নিরাপদ হবে। আমরা অচিরেই বুঝতে পারলাম, এটা একটা যথাযথ পরামর্শ ছিল। হােটেলে আসার পথে আমরা এক বৈরী সংবর্ধনার মুখােমুখি হই, যা পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হলাে। হােটেলের লবিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা গালিগালাজপূর্ণ চিক্কার আর মাস্তানিতে মত্ত ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য হােটেলকক্ষে যাওয়ার লিফট আটকে রাখা হলাে। আমরা হােটেলকক্ষে আগমনের পর ব্রিগেডিয়ার আরবাব খান আওয়ামী লীগের দেওয়া সংবর্ধনার বিষয়ে তাঁর সদর দপ্তরকে অবহিত করেন। এরপর মুজিবুর রহমানকে জানানাে হয় যে আওয়ামী লীগের কর্মীদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতা বিবেচনা করে সেনাবাহিনী আমাদের ঢাকায় অবস্থানের দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করেছে।
আমি সেদিন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। প্রেসিডেন্ট আমাকে জানান, ১৬ থেকে ২০ তারিখ নাগাদ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অনেকগুলাে বৈঠক করেছেন। অগ্রগতি বিবেচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে আলােচনায় অগ্রগতি হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এবং প্রেসিডেন্টের বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সমঝােতার ব্যাপারেও আলােচনা করেন। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ নেতার দেওয়া প্রস্তাবের বিষয়ে আমাকে অবহিত করেন।
প্রস্তাবটির মূল বৈশিষ্ট্যগুলাে হলাে, অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত না করেই পাঁচটি প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে প্রেসিডেন্ট যেরূপ আছেন, তদ্রুপ অথবা তিনি ইচ্ছা পােষণ করলে জনপ্রতিনিধি ব্যতীত অন্যদের মধ্য থেকে উপদেষ্টাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করতে থাকবেন। এই মর্মেও প্রস্তাব দেওয়া হয় যে শুরুতে জাতীয় সংসদ দুটো কমিটিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। একটি পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, অন্যটি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের জন্য গঠিত। পশ্চিম পাকিস্তানের কমিটি ইসলামাবাদে এবং বাংলাদেশের জন্য গঠিত কমিটি ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হবে। কমিটিদ্বয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ প্রতিবেদন তৈরি এবং জাতীয় সংসদে তাদের প্রস্তাবাদি পেশ করবে। অতঃপর জাতীয় সংসদের কাজ হবে প্রস্তাবগুলাে আলােচনা ও বিচার-বিবেচনা করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রে বসবাসের পদ্ধতি খুঁজে বের করা। একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাধীনে, যা হবে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের এক সংশােধিত রূপ, পূর্ব পাকিস্তানকে ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলাের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতার অনুরূপ ক্ষমতা থাকবে। তবে প্রেসিডেন্টের অনুমােদন সাপেক্ষে এবং পারস্পরিকভাবে গ্রহণযােগ্যতার ভিত্তিতে তারা স্বাধীনভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয় পরিধি নির্ধারণ করবে। গােটা পরিকল্পনাটি একটি রাষ্ট্রপতির ফরমানের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে।
প্রস্তাবটি বর্ণনা করার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমাকে বলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এটা পরিষ্কার করেছেন যে প্রস্তাবে তার সম্মতিদান প্রথমত আমার সম্মতিসাপেক্ষ। তবে তিনি অধিকতর তুষ্ট হবেন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারাও তাদের সম্মতি দেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে আরও জানান, তিনি নেতৃতাদের কাছ থেকে প্রস্তাবে তাদের সম্মতিদানের নিশ্চয়তাজ্ঞাপক চিঠি নিতে ইচ্ছুক। তাঁর মতে, এ ধরনের পত্র প্রস্তাবিত পদক্ষেপ গ্রহণে তাঁকে বাড়তি কর্তৃত্ব প্রদান করবে।
প্রস্তাবটি ছিল সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনায় অগ্রগতি সাধিত হওয়ার উপযােগী নয়। অচলাবস্থা নিরসন করতে পারে, এমন প্রচেষ্টাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এসব প্রস্তাব নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আমার প্রাথমিক আলােচনা হয়। আমি তাঁকে জানাই যে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর সবকিছু বিবেচনা করে আমি আমার মতামত তাঁকে পাঠাব। আমার প্রস্থানের আগে প্রেসিডেন্ট আমাকে জানান যে পরদিন বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার সাক্ষাৎকারের সময় নির্দিষ্ট করা আছে। এ পরিকল্পনাটিতে বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি সবে ঢাকা এসে ঘটনাবলি সরাসরি প্রত্যক্ষ করছি। চিন্তাভাবনার জন্য কিছুটা সময় চাইলাম। হােটেলে ফিরে আসার পর সহকর্মীদের ‘দুই কমিটি প্রস্তাব সম্পর্কে অবহিত করি। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে পরামর্শ দেয় যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা আমার জন্য সমীচীন হবে না। কারণ, এতে দুই পাকিস্তানের বীজ নিহিত রয়েছে। তাদের প্রতিক্রিয়া, যা কিনা আমার প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ ছিল, জেনে স্বস্তিবােধ করলাম। আমরা আরও ঐকমত্যে পৌছাই যে একান্ত আলাপচারিতা অথবা পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কোনাে চুক্তিতে আসা যায় না। এটা জনসাধারণকে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল করে সম্প্রতি নির্বাচিত সংসদে উত্থাপিত ও তাদের দ্বারা অনুমােদিত হতে হবে। দুই বা ততােধিক রাজনৈতিক নেতা আইন প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার দায়িত্বে থাকা গােটা সংসদের অস্তিত্ব উপেক্ষা করতে পারেন না।
২২ তারিখ সকালে নির্ধারিত সময়ের মিনিট কয়েক আগে আমি প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছাই। শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুততার সঙ্গে ১১টায়। এলেন। আমরা একে অন্যকে সম্ভাষণ জানিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক বাক্যালাপ করি। তারপর আমাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আবারও আনুষ্ঠানিক সম্ভাষণ বিনিময় হয়। শেখ মুজিবুর রহমান বিমানবন্দর থেকে হােটেলের গমনপথে এবং হােটেলের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তিনি জনতার আবেগ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে আবেগ তীব্র হওয়ায় প্রতিটি ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর। জবাবে বললাম, এরূপ বিষয়াদি আমাকে বিব্রত করেনি। কারণ, আমার লক্ষ্য হলাে একটি সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌছা। অন্য কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তারপর শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবগুলােতে তিনি চূড়ান্ত অনুমােদন দিয়েছেন কি না। প্রেসিডেন্ট তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এতে আমারও সম্মত হওয়া আবশ্যক এবং সে কারণেই আমি এই আলােচনায় অংশ নিচ্ছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবুর রহমান মন্তব্য করেন, প্রস্তাবগুলাে প্রেসিডেন্টকে প্রদত্ত হয়েছে বিধায় আমাকে রাজি করানাে প্রেসিডেন্টের ব্যাপার এবং তিনি আরও বলেন, জনাব ভুট্টো প্রস্তাবসমূহে নীতিগতভাবে সম্মত হলে তারা আনুষ্ঠানিক আলােচনা করতে পারেন। তবে তার আগে আলােচনা হবে অনানুষ্ঠানিক ধরনের। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানাবেন যে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং ভুট্টোও সেখানে। উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন, এটাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অবিচল রইলেন। আলােচনার পুরাে সময় শেখ মুজিবুর রহমান নম্র, তবে স্নায়বিক চাপে ছিলেন। স্নায়বিক চাপ নিরসন করতে প্রেসিডেন্ট হালকা নাশতাসহ কফি পরিবেশনের আদেশ দিলেন। কফি পানের ঠিক পরপরই আওয়ামী লীগ নেতা বললেন যে তার তাড়া আছে। কারণ, তাঁর জনৈক সহকর্মী ওই দিন প্রত্যুষে ইন্তেকাল করেছেন। এরপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম।
বেরােনাের সময় আমরা সামরিক সচিবের কক্ষে গেলাম। সেখানে জেনারেল মােহাম্মদ ওমর (জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান, জেনারেল। ইসহাক, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব, নৌ এডিসি বসে ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে তাঁদের কক্ষটি ছেড়ে দিতে বললেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এ আকস্মিক পরিবর্তনে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসালেন। তিনি বললেন, পরিস্থিতি খুবই গুরুতর এবং তা উত্তরণ করতে আমার সহায়তা তার দরকার। এ পর্যায়ে কক্ষটিতে আড়িপাতার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে ভেবে আমরা বারান্দা দিয়ে হেঁটে ভবনের পশ্চাদ্দিকে প্রেসিডেন্টের কক্ষের পেছনের দহলিজে
বসলাম।
শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক সচিবের কক্ষে বলা কথার পুনরুক্তি করে বললেন, পরিস্থিতি এখন এত দূর এগিয়েছে যে ফিরে আসার উপায় নেই। তাঁর মতে, আমার জন্য প্রকৃষ্ট পথ হলাে তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হওয়া। তিনি জোর দিয়ে বললেন, আর কোনাে বিকল্প নেই। আমাকে বললেন, এখন তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে পিপলস পার্টিই পশ্চিম পাকিস্তানে একমাত্র শক্তি, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য রাজনীতিবিদেরা তাঁর সময়ের অপচয় করেছে। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানালেন, মাত্র একটি প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী খান আবদুল ওয়ালী খান ব্যতীত অন্য সবাইকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিরস্কৃত করেছেন। বললেন, এখন তিনি সুনিশ্চিত যে আমাদের দুজনের মতৈক্যে আসা অত্যাবশ্যক। বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আমি যা চাই, করতে পারি, তিনি আমাকে সমর্থন করবেন। বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁকে একাকী ছেড়ে দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে তাঁকে সাহায্য করতে হবে। তিনি আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন, পূর্ব পাকিস্তানের তত্ত্বাবধান তিনি করবেন। তাঁর মতে অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এটাই একমাত্র পথ। সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিলেন এবং আমাকে তাদের বিশ্বাস না করার জন্য বললেন। তারা যদি প্রথমে তাকে ধ্বংস করে, পরে আমাকেও বিনাশ করবে। জবাবে বললাম, আমি বরং সেনাবাহিনীর দ্বারা পুরােপুরি ধ্বংস হব, ইতিহাসের দৃষ্টিতে নয়। তিনি তাঁর প্রস্তাবমতাে প্রথমে দুটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে রাজি হতে আমাকে চাপ দেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অবস্থায় জাতীয় সংসদের পক্ষে একক সংগঠনরূপে মিলিত হওয়া অসম্ভব, এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করা সমীচীন হবে। তিনি আমার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ দেখালেন এবং আমাদের মধ্যে গােপন বৈঠকের আয়ােজন করবেন বলে জানালেন। ইত্যবসরে আমি যেন গােলাম মােস্তফা খারকে তার (শেখ মুজিব) সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে বলি; পরদিন খারকে তাঁর বাড়িতে নেওয়ার জন্য তিনি আমার কাছে লােক পাঠাবেন।
আমি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ব্যাখ্যা করলাম যে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার অনুরােধটি আমি সরলভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, বিপরীতে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সহিংস। মাত্র কয়েক দিন বাদে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন এখন তিনি আর চাচ্ছেনই না। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলােচনা এবং আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা, সংসদ অধিবেশন বিষয়ে আমার আগের দেওয়া পরামর্শগুলাের প্রয়ােজনীয়তাকে সমর্থন করছে। আমি তাকে জানালাম যে এ কারণেই আমি দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্যে পূর্বালােচনার ওপর জোর দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে আমাদের নেওয়া সব উদ্যোগই তিনি পরিহার করেন। যদিও সংসদ অধিবেশন স্থগিতের জন্য আমার দেওয়া যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করে এর ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন, তথাপি ঘটনাপ্রবাহ আমার আগের অবস্থান সমর্থন করছিল। তাকে বললাম, আমি অবশ্যই তার প্রস্তাব আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করব এবং একটি ন্যায্য মীমাংসায় উপনীত হতে সম্ভাব্য সবকিছু করব। তবে প্রস্তাবটির যেকোনাে চূড়ান্ত রূপ জাতীয় সংসদে অনুমােদিত হওয়া উচিত। প্রয়ােজনে প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে ফরমান জারির কর্তৃত্ব দিয়ে সংসদে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তাঁকে আরও জানালাম, সংসদের বাইরে প্রস্তাবসংশ্লিষ্ট কোনাে পত্রদানে আমি প্রস্তুত নই। আমি ব্যক্তি হিসেবে অথবা। আমার দলের পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব নিতে পারি না, যেখানে সংসদে ইতিমধ্যেই। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন এবং তারা অপেক্ষায় আছেন তাদের অধিকার। অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালনের জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি অনুধাবন করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘সঠিক বলেছেন। আমিও কোনাে চিঠি দেব না। তবে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি আপনাকেই আগে অস্বীকার করতে হবে, আমি আপনাকে অনুকরণ করব।’
শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে প্রকার সংসদ অধিবেশন, এমনকি সংক্ষিপ্ত অধিবেশনের ধারণাও প্রত্যাখ্যান করেন। যেকোনাে রকমের আয়ােজনের মাধ্যমেই হােক না কেন, জাতীয় সংসদ অধিবেশন ছাড়াই তিনি তার প্রস্তাবের ওপর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকলেন। এসব অভিমত জানিয়ে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে আমি গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বিদায় জানালাম। আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে এটাই আমার শেষ সাক্ষাৎকার।
প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আমি আলােচনায় উপস্থিত ছিলাম। তার উদ্যোগে আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত পৃথক আলােচনার ব্যাপারে তিনি কিছু উল্লেখ করেননি। হােটেলে প্রত্যাবর্তনের পর সংবাদ প্রতিনিধিরা জিজ্ঞেস করেন যে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার মধ্যে কোনাে আলাদা আলােচনা হয়েছিল কি না। আমি উত্তরে জানাই যে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের যে ধারণা দিয়েছেন, আমি তার বিরােধিতা করতে চাই না।
শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদায় জানানাের পর আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি তার সেলুন থেকে সম্ভবত আমাদের লক্ষ করছিলেন। প্রেসিডেন্ট আমাদের একান্ত আলাপকে ‘হানিমুন’ (মধুচন্দ্রিমা) বলে অভিহিত করে বিস্ময় প্রকাশ করলে আমি তাকে বললাম, এ ধরনের কথােপকথন রাজনীতিরই অংশ। আলােচনার গােপনীয় বিষয়গুলাে এড়িয়ে। গিয়ে বর্তমান সংকটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশগুলাের বিবরণ প্রেসিডেন্টকে জানালাম। আওয়ামী লীগ নেতার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার সুচিন্তিত মতামত তাকে জানালাম। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দিই যে আমি [শেখ মুজিবের] প্রস্তাবিত পরিকল্পনার অংশীদার হতে পারি না। কারণ, এটার অর্থ দুই পাকিস্তানের অনিবার্যতা। এই পরিকল্পনায় এটিই আমার প্রধান আপত্তি ছিল। তবে এতে আরও কিছু মারাত্মক ত্রুটি ছিল। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের বিনা অনুমােদনে অন্তর্বর্তীকালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহে আলাদাভাবে স্বায়ত্তশাসন চালু করলে বিষয়টি পরবর্তী সময়ে অনুমােদন করানাে দুঃসাধ্য হবে। তা ছাড়া ওই সময় পাকিস্তানে চালু আইনগুলাের উৎস আর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল সামরিক আইন। সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘােষণা দেওয়া হলে প্রেসিডেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আইনি কর্তৃত্ব ও অধিকার হারাবে। অতএব, জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় পর্যায়ে সার্বভৌম ক্ষমতার নতুন উৎস সৃষ্টি না করলে একটি (সাংবিধানিক) শূন্যতা দেখা দেবে। যদি এ ধরনের কোনাে জাতীয় (কর্তৃত্বের) উৎস ছাড়া প্রস্তাব মােতাবেক প্রদেশগুলাের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে প্রতিটি প্রাদেশিক সরকার কার্যত (ডি ফ্যাক্টো) এবং আইনানুগভাবে (ডিজুরাে) সার্বভৌম মর্যাদা লাভ করতে পারে। এটা কেবল আইনগত নয়, প্রায়ােগিক সমস্যাও বটে। শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য হলাে বাস্তব ও আইনতগত—উভয় দিক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা। এরূপ হলে কোনাে কিছুই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলােও স্বাধীনতা ঘােষণার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। শুরুতে দুটি কমিটি স্বতন্ত্রভাবে বৈঠকে মিলিত হলে (দেশের) দুই অঞ্চলের মধ্যকার মেরুকরণ ত্বরান্বিত হতাে। বিভক্ত এবং একক সংগঠন হিসেবে অধিবেশনে বসার সম্ভাবনা না থাকায় জাতীয় সংসদ এই মেরুকরণে বাধা দিতে পারত না। মূলত এসব কারণেই [শেখ মুজিবের প্রস্তাব যে অবস্থায় ছিল, তাতে। সম্মতিদানে আমার অপারগতা প্রকাশ করি।
যাহােক, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার প্রয়ােজনে আমি একটি সমঝােতা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে বলি যে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্টের ফরমানের আওতায় একটি আলােচনাভিত্তিক মীমাংসায় পৌছাতে সম্মত আছি, যদি তা জাতীয় সংসদ দ্বারা অনুমােদিত এবং তাদের প্রদত্ত অধিকারবলে করা হয়। এ ছাড়া আমরা এটাও প্রয়ােজনীয় মনে করি। যে কেন্দ্রের ওপর ন্যস্ত বিষয়গুলাে নির্ধারণ করা এবং পরবর্তী সময়ে কী প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পুনরায় কাজ শুরু করবে, তা নির্ধারণ করার জন্য একক সংগঠন হিসেবে সংসদের প্রথম অধিবেশনে বসা উচিত। যখন কেন্দ্রীয়। বিষয়াদি নির্ধারিত হয়ে যাবে, তখন কমিটিদ্বয়ের দায়িত্ব হবে জাতীয় ছত্রচ্ছায়ার আওতায় তাদের পরবর্তী বিষয়গুলাে সীমিত রাখা। কমিটি দুটো প্রথমেই পৃথক বৈঠকে বসলে এ ধরনের কোনাে বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিই যে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের একটি সমঝােতায় সম্মত করাবেন। কদিনের মধ্যেই সংসদ অধিবেশনের আয়ােজন করে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এসব স্থির করা যেতে পারে। এটা আশা করা যায় যে শেখ মুজিবুর রহমানও [তার দাবিতে] কিছু সমন্বয় সাধন করবেন, যা জাতীয় ঐক্য রক্ষার পাশাপাশি তাঁকে তাঁর দাবির প্রধান অংশ প্রদান করবে। প্রেসিডেন্ট বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে তাঁর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এসব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করার জন্য আমাকে অনুরােধ করেন। সেইমতাে আমি আমার সংবিধান ও রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করি। এ সভায় আমরা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের নিহিতার্থ নিয়ে বেশ লম্বা আলােচনা করি। তা ছাড়া মীমাংসার ধরন সম্পর্কেও আমাদের নিজস্ব মতামতের পুনরাবৃত্তি করি।
২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। আমাকে জানানাে হয়, প্রেসিডেন্ট এ আলােচনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত বিষয়াদি নির্ধারণ করতে সংসদের প্রয়ােজনীয়তার ওপর আমার মতামতগুলাে আলােচনা করেছিলেন। পরে আমাকে বলা হয়, বেলুচিস্তানের জনৈক নেতা বলেছেন যে দুটি কমিটি থাকলে পাঁচটি থাকতে পারবে না কেন? তবে তারা সবাই আমার আপত্তিসমূহ মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদ ছাড়া কোনাে স্থায়ী মীমাংসা প্রত্যাখ্যান করেন। আমি যখন ২৩ মার্চ মাহমুদ আলী কাসুরীসহ [পিপিপি নেতা] অন্য সহকর্মীদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাসহ আমাদের সিদ্ধান্ত তাঁদের অবহিত করতে পাঠাই, তখন তাঁরা এ বিষয়টি জোরালােভাবে পুনর্ব্যক্ত করেন।
২৩ ও ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব আলােচনায় আওয়ামী লীগ তাদের মূল প্রস্তাবে সংশােধন আনে। এখন তারা দুটি কমিটির বদলে দুটি সাংবিধানিক সম্মেলন (কনভেনশন) চায়। তারা চায় সাংবিধানিক সম্মেলনদ্বয় শুধু প্রস্তাবনাসংবলিত প্রতিবেদন নয়, বরং দুটো শাসনতন্ত্রের খসড়া জাতীয় সংসদে পেশ করবে। পরবর্তী সময়ে সংসদ ‘পাকিস্তান কনফেডারেশন’-এর জন্য অধিবেশনের মাধ্যমে দুটো সংবিধানকে একত্রে করবে। আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের জন্য কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেয়। নতুন পরিকল্পনামতে, প্রদেশগুলােতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা। থাকবে না, এমনকি জরুরি অবস্থায়ও না। বস্তুতপক্ষে, তারা একটি স্বতন্ত্র দেশ চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ২৪ তারিখে এই মর্মে এক সংবাদ বিবৃতি দেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আওয়ামী লীগ তাদের চূড়ান্ত অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে এবং অধিকতর আলাপ-আলােচনার আর কিছু নেই।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ৩১ বছর আগে এদিনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি করে লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ৩১ বছর পর আমরা আমাদের স্বপ্ন ও তার ওপর নির্মিত স্বপ্নসৌধ ভেঙে চুরমার হওয়া প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি। এ ঐতিহাসিক দিনে আমরা জাতীয় আবেগ প্রদর্শনের পরিবর্তে পাকিস্তানিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণা প্রত্যক্ষ করলাম। এদিনে জাতীয় বিজয়ানন্দের বদলে ছিল টানটান উত্তেজনা। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল সব ভবনশীর্ষে পাকিস্তানি পতাকা সগর্বে পতপত করে ওড়ার বদলে সরকারি ভবন, প্রতিষ্ঠানসমূহসহ সর্বত্র প্রথমবারের মতাে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত দেখলাম। এদিন বেসামরিক বাহিনী এবং পাকিস্তানের বাঙালি যুবকদের পাকিস্তানের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শন করে কুচকাওয়াজ করার বদলে আমরা স্থানীয় যুবকদের এবং নবসৃষ্ট বেসামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের সৈনিক হিসেবে সশস্ত্র কুচকাওয়াজ করতে দেখলাম। শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাঁর বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন।
আমরা যারা যৌবন থেকে পাকিস্তানের ভাবধারায় মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম এবং যারা স্বদেশে ও বিদেশে উভয়ত নিষ্ঠার সঙ্গে পাকিস্তানের সেবা করেছি, তাঁদের জন্য এটা এক বেদনাদায়ক দৃশ্য। ঘটনাবলি সত্যিই সময়ের সঙ্গে তাল রাখার চেয়েও দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। যেভাবেই হােক একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হব। আমরা এক গিরিচূড়ার খাড়া পিঠে। আমাদের হয় পিছিয়ে আসতে হবে, না হয় সামনে এগিয়ে পতিত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে হবে। এটা আত্মােপলব্ধির মুহূর্ত, হিসাব-নিকাশের সময়। এটা এক ভয়াবহ বিষয় যে আমাদের দেশবাসীর ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ তিন জোড়া হাতে সমর্পিত এবং আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞায় আমাকে তাদের একজন মনােনীত করেছেন।
২৪ তারিখ সকালে আমি আবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার প্রধান স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে বলি যে একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়ার সময় সম্ভবত নিঃশেষ হয়ে। গেছে এবং বিনা বিলম্বে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়ােজন। তাঁকে জানালাম, আমার কতিপয় দলীয় নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে হয়েছে, যেহেতু আমি মনে করি যে এ চরম সংকটময় মুহূর্তে সেখানে তাদের উপস্থিতি জরুরি। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের অনড় ও অনমনীয় মনােভাবের দরুন আমার দলের অবশিষ্টদের ঢাকা অবস্থানে তেমন লাভ নেই। তবু আমরা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, গােলাম মােস্তফা খারকে লােক মারফত জানানাে হয়েছিল যে ওই রাতে প্রহরীসহ তাঁকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নেওয়া হবে।
২৪ তারিখ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় খার তাকে উত্তেজিত দেখতে পান। তিনি খারকে জানান, চট্টগ্রামে ভীষণ গােলযােগ হয়েছে, কিছুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি বিস্ফোরণােন্মুখ হওয়ায় তিনি খারকে বলেন, আমি যেন অবশ্যই তার প্রস্তাবে একমত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁর ও তাঁর জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হই। খার শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন, তিনি এটা আমাকে অবহিত করবেন, তবে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রস্তাবে আমি সম্মত হব কি না, তাতে তিনি তার সন্দেহ প্রকাশ করেন। খার প্রস্থান। করার আগে মুজিবুর রহমান বলেন, তারা যােগাযােগ রক্ষা করবেন এবং ২৫ তারিখ রাতে সাক্ষাতের জন্য তাঁকে পুনরায় নিয়ে আসতে কাউকে পাঠানাে হবে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদের চূড়ান্ত শর্তসহ সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে ২৫ তারিখ সকালে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক জে এ রহিম ও গােলাম মােস্তফা খারকে নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ২৫ তারিখ অপরাহে প্রেসিডেন্টের সহকারীরা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রস্তাবের ব্যাপারে আমাদের উপদেষ্টাদের অবহিত করেন।
আনুমানিক রাত আটটায় শেখ মুজিবুর রহমানের দূত খারকে নিতে আসেন। নতুন কোনাে অগ্রগতি সাধিত না হওয়ায় খার দূতকে বলেন, তার [দূতের] নেতাকে অবহিত করার মতাে নতুন কিছু তার (খারের কাছে নেই। সুতরাং সাক্ষাৎকার স্থগিত রাখাই শ্রেয়। ২৬ তারিখ সকালে করাচির উদ্দেশে যাত্রার আগে আমরা আবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারি এবং যদি কোনাে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি থাকে, তবে আমরা থেকে যেতে পারি এবং ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দেখা করবেন। দূত অবশ্য খারকে জানান যে প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এটা সঠিক কি না, তা জানার জন্য আমরা প্রেসিডেন্ট ভবনে ফোন করি, যদিও এর সঠিকতা নিশ্চিত করতে পারলাম না।
এদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে একটি বিবৃতি দেন। আমার মনে পড়ে যে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলােচনায় বলেছিলাম, এ রকম চরম সংকট মুহূর্তে এ ধরনের আহ্বান বিস্ময়করভাবে ভঙ্গুর, নাকি এটা ছিল ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত?
আনুমানিক রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে রাতের খাবার খাওয়ার পর আমরা কক্ষে গেলাম। এক ঘণ্টা পর গুলির আওয়াজে আমরা সচকিত হয়ে উঠি। কয়েকজন বন্ধু আমার কামরায় আসে। আমরা সেনাবাহিনীকে অভিযান চালনারত দেখলাম। তিন ঘণ্টা এ অভিযান প্রত্যক্ষ করলাম। কয়েকটি স্থানে অগ্নি প্রজ্বলিত হতে দেখা যায়। দ্য পিপল পত্রিকার অফিস গুঁড়িয়ে দিতে দেখা গেল। এই স্থানীয় ইংরেজি দৈনিকটি সেনাবাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্কুল এবং অনিয়ন্ত্রিত প্ররােচনায় প্রশ্রয় দিয়ে আসছিল। দিগন্ত বহ্নিমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চিন্তা অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে মােড় নিল। আমাদের ভাগ্যে কী আছে, তা ভেবে বিস্মিত হই। এখানে চোখের সামনে। আমার নিজের মানুষের মৃত্যু ও বিনাশ দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক চিন্তা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমার মনে অনেক চিন্তার উদয় হচ্ছিল। আমরা কি এমন অবস্থানে চলে এসেছি, যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের আর কোনাে পথ নেই—অথবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত নিরাময়ের পর পাকিস্তানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে? কী করে আশা করি যে এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা।
২৬ তারিখ সকাল ৮টায় কর্নেল সাইদ আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে আসেন। হােটেলের লবি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিদেশি সাংবাদিকেরা চারদিক থেকে ঘিরে আমাকে কতগুলাে প্রশ্ন করেন। আমি জবাব দিতে অস্বীকার করি। বিমানবন্দরের পথে কর্নেল সাইদ জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে বর্তমানে। সেনানিবাসের একটি স্কুলে আটক রাখা হয়েছে। আমি কর্নেল সাইদকে তার। সঙ্গে শােভনীয় আচরণ করতে বললাম। তাঁকে স্মরণ রাখতে বললাম, যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু শেখ মুজিব সমর্থন করে থাকুন না কেন, তিনি একজন জননেতা এবং সম্মানিত ব্যক্তি। এটা লােকদেখানাের মতাে শােনালেও আমি। আন্তরিকতার সঙ্গেই কথাটি বলেছিলাম। কর্নেল সাইদ আশ্বস্ত করেন যে আওয়ামী লীগ নেতাকে ভালােভাবে দেখাশােনা করা হবে এবং যথাযথ সম্মান দেখানাে হবে। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে বাড়ির ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে নিতে দেখলাম এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতাও দেখলাম। ঢাকা ত্যাগের সময় পুনরায় আমাকে ভবিষ্যতের চিন্তা তাড়া করতে থাকে। প্রার্থনা করলাম, ঘটনার এ মােড় পরিবর্তন যাতে এক দীর্ঘায়িত অন্তর্ঘাতী সংঘাতে। পরিণত না হয়। প্রত্যাশা করলাম, সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম যেন ওজস্বিতা নিয়ে পুনরাবির্ভূত হয় এবং দুঃস্বপ্ন ও ফ্যাসিজম তিরােহিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। করাচি প্রত্যাবর্তনের পর এক কোলাহলমুখর জনতা সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে করাচি বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানায় এবং আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। কিন্তু বক্তৃতাদানের মতাে মনের অবস্থা আমার ছিল না। তবু অবস্থা সামলে নিয়ে বললাম, অবশেষে আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। আন্তরিকভাবে আমি আশা ও প্রার্থনা করছিলাম যে আমি যেন সঠিক হই। ভবিতব্যই বলবে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে না পরাজিত হয়েছে। তবে এটুকু নির্বিঘ্নে বলা যায় যে সরকার ২৫ মার্চ রাতে অভিযান শুরু না করলে পরদিন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করত। এর জন্য সবকিছু প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তাদের সশস্ত্র প্রস্তুতি, শৃঙ্খলা বাহিনীগুলাের একত্রকরণ এবং রাস্তাসমূহে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলাে এর চাক্ষুষ প্রমাণ। ২৭ তারিখে আহূত সাধারণ ধর্মঘট স্পষ্টতই সরকারকে বিপদে ফেলার একটি কৌশল ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ শুক্রবার বাদ জুমা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি আমাদের দেশের হতভম্ব জনসাধারণকে জানান যে আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করা হয়েছে, দেশের অবস্থা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সামরিক আইন কঠোর করা হবে। প্রেসিডেন্ট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যকলাপ দেশদ্রোহের শামিল। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও তার দলকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান। থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, তাদের অপরাধের শাস্তি বিধান করা হবে। প্রেসিডেন্ট জনসাধারণকে আশ্বস্ত করেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ামাত্রই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে।
———————————————————————————————–
The Great Tragedy by Zulfikar Ali Bhutto, September 1971, Pakistan
অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান সিদ্দিক
বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত মতিউর রহমান সম্পাদিত বই ১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে