সংবিধান প্রণেতাগণ-৭: বঙ্গবন্ধু কাদেরকে বেছে নিয়েছিলেন?
সংবিধান প্রণয়নের মতো একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাঁদের যোগ্যতা কী ছিল এবং সংবিধানের প্রণয়নের পরে অর্থাৎ বাহাত্তর পরবর্তী জীবন কেমন ছিল?
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই শুরু হয় নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের আনুষ্ঠানিকতা। বস্তুত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকা’ তথা নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র হওয়ার ঘোষণা দেয়ার দুই মাস আগেই সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান এবং কার্যকর হয় ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে। কিন্তু এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘ যাত্রা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাংলাদেশের সংবিধানও তেমনি বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে কিছু অনুচ্ছেদ ধার করে তৈরি করা কোনো ডকুমেন্ট নয়। বরং সংবিধানের প্রতিটি বাক্য, শব্দ, সেমিকোলন নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সংবিধান প্রণয়নের মতো একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু কাদেরকে বেছে নিয়েছিলেন? ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাঁদের যোগ্যতা কী ছিল এবং সংবিধানের প্রণয়নের পরে অর্থাৎ বাহাত্তর পরবর্তী জীবন কেমন ছিল? বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি অর্থাৎ বাকশালে এই কমিটির কতজন যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় কারা যোগ দিয়েছিলেন? পরবর্তী জীবনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কতজন যুক্ত থেকেছিলেন এবং কতজন থাকেননি, এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা নেই।
সদস্যদের গড় বয়স ৪২ বছর
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের গড় বয়স ছিল ৪২ বছর। যখন সংবিধান প্রণয়ণ করা হয় তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ৫২ বছর। তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন তিন জন। সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হাফেজ হাবীবুর রহমান। জন্ম ১৯১৫। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে বড় বাকি দুই সদস্য হলেন আছাদুজ্জামান খান (জন্ম ১৯১৬) এবং এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ (জন্ম ১৯১৭)।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টার মাইন্ড খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী।বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্তে (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫) উল্লিখিত তথ্য বলছে, খন্দকার মোশতাক আহমদের জন্মও ১৯২০ সালে।
কমিটির বাকি সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে ছোট। তবে তাঁর ‘ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড’ হিসেবে পরিচিত শামসুদ্দিন মোল্লা ছিলেন তাঁর প্রায় সমবয়সী। শামসুদ্দীন মোল্লার জন্ম ১৯২১ সালে। কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। উভয়েরই জন্ম ১৯৪৫ সালে। অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নের সময় তাঁদের বয়স ছিল ২৭ বছর।
অধিকাংশই আইনের ছাত্র
কমিটির সদস্যদের মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন আইনের ছাত্র (ব্যারিস্টার/এলএলবি/বি.এল)। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, একজন পদার্থ বিজ্ঞান, একজন বাংলা এবং একজন ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। একজন স্নাতক। দুজন সাধারণ বি.এ পাস। একজনের বিএসসি অসম্পূর্ণ। একজন চিকিৎসক। আবার যাঁরা আইনে পড়েছেন তাঁদের অনেকেরই অন্য বিষয়েও ডিগ্রি ছিল। অর্থাৎ অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে আইনে পড়াশোনা করেছেন। রাজনীতি করতে গেলে আইন পড়তে হয়—এরকম একটি ধারণা, বিশ্বাস ও রেওয়াজ তখন ছিল।
১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং এল.এল.বি।
২. তাজউদ্দিন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও এল.এল.বি।
৩. খন্দকার মোশতাক আহমদ (১৯২০-১৯৯৬)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
৪. এ এইচ এম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫)
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এম.এ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
৫. এম আবদুর রহিম (১৯২৭-২০১৬)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
৬. আবদুর রউফ (১৯৪২-২০১১)
ঢাকার মোহাম্মদপুর কলেজ থেকে বি.এ।
৭. মো. লুৎফর রহমান (১৯২৭- ২০০৮)
রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ।
৮. আবদুল মমিন তালুকদার (১৯২৯-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
৯. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (জন্ম ১৯৪৫)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ।
১০. মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (১৯২৭-১৯৮৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. এবং এলএলবি।
১১. এম আমীর-উল ইসলাম (১৯৩৭)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১২. বাদল রশীদ (১৯২৯-১৯৯৩)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১৩. খন্দকার আবদুল হাফিজ (১৯৩০-২০০১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৪. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (১৯৩৬-২০২০)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৫. অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ (১৯৩৫-২০০২)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৬. আছাদুজ্জামান খান (১৯১৬-১৯৯২)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
১৭. এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ (১৯১৭-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৮. শওকত আলী খান (১৯২৬-২০০৬)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১৯. আবদুল মমিন (১৯২৯-২০০৪)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
২০. শামসুদ্দিন মোল্লা (১৯২১-১৯৯১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
২১. শেখ আবদুর রহমান (১৯৩০-২০০৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. এবং এলএল.বি।
২২. ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ (১৯২৫- ১৯৮৯)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং এল.এল.বি।
২৩. আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী (জন্ম ১৯২৯)।
কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এ এবং লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল।
২৪. অধ্যাপক খোরশেদ আলম (১৯২৯-২০০৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম.এস.সি।
২৫. সিরাজুল হক (১৯২৫-২০০২)
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে এম.এ ও এল.এল.বি।
২৬. দেওয়ান আবুল আব্বাস (১৯২৩-২০০৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. এবং এল.এল.বি।
২৭. হাফেজ হাবীবুর রহমান (১৯১৫-১৯৮৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ।
২৮. মুহাম্মদ আবদুর রশিদ (১৯২৫-২০০০)
বিএসসি অসম্পূর্ণ।
২৯. সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (১৯৪৫-২০১৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক।
৩০. নুরুল ইসলাম চৌধুরী (১৯২৭-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং এল.এল.বি।
৩১. মোহাম্মদ খালেদ (১৯২২- ২০০৩)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ।
৩২. রাজিয়া বানু (১৯২৬- ১৯৯৮)
কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ অনার্স।
৩৩. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল (১৯৩৯-২০২০)
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস।
৩৪. ড. কামাল হোসেন (জন্ম ১৯৩৭)
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক ও ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি এবং লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল। আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি।
সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৭ জন
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাত জন।
১. হাফেজ হাবীবুর রহমান: ছয় দফা নিয়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনমত তৈরির কাজ করেন এবং ছয় দফা প্রচারের জন্য ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করেন। পরবর্তীতে ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকাটি তিনি আর কখনো চালু করেননি।
এরপর তিনি ‘সাপ্তাহিক বাংলার বাণী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলার বাণী’ সাপ্তাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১১ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পত্রিকাটি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সম্পাদনায় পত্রিকাটি দৈনিক আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
২. এ এইচ এম কামারুজ্জামান: চাচা মুহম্মদ আবদুস সামাদের সম্পাদনায় ১৯৫৪ সালে রাজশাহী থেকে ‘প্রবাহ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পরে কামারুজ্জামান পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশে কিছুদিন পরেই এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের জুন মাসে তাঁর উদ্যোগে এবং সরদার আমজাদ হোসেনের সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে ‘সোনার দেশ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর কামারুজ্জামানের উদ্যোগে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক জনপদ’।
৩. শামসুদ্দীন মোল্লা: তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদপুর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। যদিও পরবর্তীতে পুরোপুরি আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
৪. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ: তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ‘দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক।
৫. লুৎফর রহমান: ১৯৫৭ থেকে ৮ বছর দৈনিক সংবাদের গাইবান্ধা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তবে পরে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন।
৬. শওকত আলী খান: পেশায় আইনজীবী হলেও তিনি ছিলেন ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং বাংলা সাপ্তাহিক ‘জনতা’র সম্পাদক।
৭. বাদল রশীদ: ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক লীগ। বাদল রশীদ ছিলেন কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ সময় তিনি ‘সাপ্তাহিক কৃষক’ এবং ‘কৃষক ও কৃষাণী’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
বাকশালে ছিলেন যাঁরা
সমাজকে শোষণমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস করান। এই বিলে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের আদেশ জারি করেন। সংবিধানের বিধান মোতাবেক একদল অর্থাৎ বাকশাল গঠনের আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ সকল দল বাতিল হয়ে যায়।
১১৫ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হয় বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি—যেখানে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও ১৪ জন ছিলেন। তাঁরা হলেন ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ২. খন্দকার মোশতাক আহমদ, ৩. এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, ৪. ড. কামাল হোসেন, ৫. আব্দুল মমিন, ৬. আছাদুজ্জামান খান, ৭. আবদুল মমিন তালুকদার, ৮. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ৯. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর, ১০. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, ১১. আবদুর রহিম, ১২. মো. লুৎফর রহমান, ১৩. শামসুদ্দীন মোল্লা ও ১৪. রাজিয়া বানু।
১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালের কার্যকরী সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান।
বাকশালের জেলা গভর্নর মনোনীত করা হয় ৬১ জনকে। তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৮জন সদস্য ছিলেন জেলার গভর্নর। তাঁরা হলেন ১. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (চট্টগ্রাম), ২. মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ (লক্ষ্মীপুর), ৩. অধ্যাপক মো. খোরশেদ আলম (কুমিল্লা), ৪. শামসুদ্দীন মোল্লা (ফরিদপুর), ৫. খন্দকার আবদুল হাফীজ (নড়াইল), ৬. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা), ৭. আবদুর রউফ (নীলফামারী) এবং ৮. মো. লুৎফর রহমান (গাইবান্ধা)।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ৫ জন
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন যিনি, সেই খন্দকার মোশতাক আহমদও ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। যদিও মাত্র ৮৩ দিন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এরপর একের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুতে তিনিও ক্ষমতাচ্যুত হন।
মোশতাকের ওই ৮৩ দিনের সরকারে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। বলা হয়, তাঁদের অধিকাংশই যোগ দিয়েছিলেন বন্দুকের নলের মুখে বাধ্য হয়ে।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন ৫ জন। তাঁরা হলেন ১. আবদুল মোমিন (কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী), ২. আছাদুজ্জামান খান (বন্দর ও জাহাজ চলাচল বিষয়ক মন্ত্রী), ৩. নুরুল ইসলাম মনজুর (রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী), ৪. নুরুল ইসলাম চৌধুরী (শিল্প ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী) এবং ৫. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল (সাহায্য ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী)।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে আবদুল মোমিন ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আছাদুজ্জামান খানও মোশতাকের পতনের পর আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি সংসদ সদস্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা হন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন। ডা. ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডলও ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন।
সংবিধান প্রণয়ন থেকে গণফোরাম
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন নিজেই গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যে দলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও তিনজন সদস্য (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও আব্দুর রউফ) যোগ দেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। ওই নির্বাচনে ঢাকা-১১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হারুন রশীদ মোল্লার কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেন। শেখ হাসিনা নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ আনলেও ড. কামাল হোসেন তখন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’
ড. কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইতে লিখেছেন, এর জের ধরে ড. কামাল হোসেনের গাড়ি আক্রান্ত হয় এবং তিনি কটুবাক্যের শিকার হন।
দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া এক চিঠিতে ড. হোসেন নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন। এর ফলে তার এবং শেখ হাসিনার মধ্যকার দূরত্ব অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে ড. কামাল হোসেনের পক্ষে তখন আওয়ামী লীগে টিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল।
সে সময় আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সবগুলো জেলার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দেন। সে চিঠিতে তিনি দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য সতর্ক করে দেন।
১৯৯২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে বর্ধিত সভায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ড. কামাল হোসেন। ড. হোসেন হয়তো বুঝতে পারছিলেন তাকে ভিন্ন পথ দেখতে হবে। সেজন্য তিনি নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে একটি মঞ্চ তৈরির চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। (বিবিসি বাংলা, ৮ নভেম্বর ২০১৮)।
১৯৯২ সালের ১৯ জুন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ গঠন করেন ড. কামাল হোসেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এই ফোরামের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যারা শুভেচ্ছা বক্তব্য রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও ছিলেন। সেদিন গণতান্ত্রিক ফোরামের ১০ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি গঠিত হয় সেখানে ড. কামাল হোসেন ছাড়াও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও ছিলেন। (অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, বাংলাদেশের রাজনীতি: আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি)।
এরপর ১৯৯৩ সালের ২৮ অগাস্ট গঠিত হয় গণফোরাম। কমিটির সভাপতি হন ড. কামাল হোসেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। পরে এই দলে যোগ দেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আব্দুর রউফ এবং সবশেষ ২০১৮ সালে গণফোরামে যোগ দেন কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।
সম্প্রতি রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও সম্মানজনক পদ হিসেবে তাকে গণফোরামের ‘ইমেরিটাস সভাপতি’ করা হয়েছে।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন খন্দকার মোশতাক
একসময় বঙ্গবন্ধুর ‘অতি ভক্ত’ হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমদই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টার মাইন্ড—সেটি এখন প্রমাণিত। সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে তিনি ছিলেন তিন নম্বর সদস্য। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তার অবদানও অনস্বীকার্য। সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদের ওপর তিনি গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের তিন বছর না যেতেই ঘাতকের গুলিতে সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এই হত্যার নেপথ্য কুশীলব আসলে খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য ও আসামির জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, পচাঁত্তরের মাঝামাঝি মোশতাকের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তিনি নিজে ও আত্মীয়দের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের নিয়ে জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ সময় গাজীপুর, কুমিল্লাসহ ঢাকায় সহযোগীদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল পরিকল্পনায় যে মোশতাক ছিলেন, তা স্পষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরপরই। ওইদিনই মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ‘সূর্যসন্তান’ বলে আখ্যায়িত করেন। ক্ষমতায় বসে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মোশতাক ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান চালু করেন। শুধু তাই নয়, তার শাসনামলেই চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামারুজ্জামান ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য।
যদিও মোশতাকেরও শেষরক্ষা হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর খালেদ মোশারফের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর মোশতাক প্রথমে বন্দি থাকলেও ১৯৭৬ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে ‘ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। আদালত তাকে পাঁচ বছরের শাস্তি দেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। তবে সফলতা পাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। যদিও এর ৭ মাস আগে, ওই বছরের ৫ মার্চ খন্দকার মোশতাকের মৃত্যু হয়। যে কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিচারের হাত থেকে তিনি ‘মরে গিয়ে বেঁচে যান’।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ‘বিতর্কিত’ নুরুল ইসলাম মঞ্জুর
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বহিষ্কৃত হন। তবে এরকমটিও শোনা যায় যে, তৎকালীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে বিরোধের কারণে তাঁকে অপসারণ করা হয়। তাঁদের দুজনের মধ্যে বরিশাল জেলাকেন্দ্রিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ছিল।
অগাস্ট ট্র্যাজেডির পর মোশতাক আহমদের সরকারে রেলপথ ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন নুরুল ইসলাম মনজুর। পরবর্তীতে খন্দকার মোশতাকের ‘ডেমোক্রেটিক লীগ’ হয়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। সবশেষ ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
১৯৯৯ সালে কে এম ওবায়দুর রহমান এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে নুরুল ইসলাম মনজুরকেও ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও ২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান।
জাতীয় পার্টিতে শেখ আবদুর রহমান
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে স্থানীয় জনগণের চাপে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য বাগেরহাট পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য শেখ আবদুর রহমান। মাত্র ৭৫৫ ভোটের ব্যবধানে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বাগেরহাট-২ আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে বাগেরহাট-২ আসন থেকে পরাজিত হন।
বাদল রশীদ: এমপি থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান
সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো খ্যাতনামা আইনজীবী থাকলেও এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে বাদল রশীদই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর নামের সঙ্গে ‘বার অ্যাট ল’ ব্যবহৃত হতো। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। এর চার বছর পরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন বাদল রশীদ। যদিও এর পরের বছরই বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে। ফলে বাদল রশীদ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। এর মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
শেষ বয়সে কিছুটা সমালোচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
বহুল আলোচিত, সমালোচিত ‘এক-এগারো’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট। সেনা নিয়ন্ত্রিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান দুই দলের অনেক নেতাই সংস্কারপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হলে পরবর্তীতে তাঁরা দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ হারান। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে সরিয়ে তাঁকে নেয়া হয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মেয়াদের শেষ দিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু এই দায়িত্বেই তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় কলঙ্কের দাগ লাগে। তাঁর এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। সেই ঝড় এলোমেলো করে দেয় সুরঞ্জিতের অনেক অর্জন। সমালোচনার মুখে মন্ত্রণালয় হারান তিনি। পদত্যাগপত্র দিলেও প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহণ করেননি। বাকি মেয়াদে ছিলেন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। এই অবহেলা আর অসুস্থতায় সবকিছু থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও এরকম একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের মৃত্যু হয় অনেকটা অভিমান বুকে নিয়ে।
চারজন জীবিত, তিনজন নিহত
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে এখনও (নভেম্বর ২০২৩) চারজন জীবিত। তাঁরা হলেন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবং আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। কমিটির সদস্য এবং জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান নিহত হয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। কমিটির বাকি সদস্যদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে। কেউ দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে।
——————————————————————————————————-
আমীন আল রশীদ
https://bangla.bdnews24.com/opinion/sy71g6q9rp
Published : 04 Nov 2023, 12:47 PM