১. বংশাল এর হোটেল আল-রাজ্জাক এর কাচ্চি, গ্লাসি, মোরগ পোলাও।
২.লালবাগ রয়্যাল এর কাচ্চি, জাফরান বাদামের শরবত, চিকেন টিক্কা, সেরা লাবান, কাশ্মীরী নান।
৩.নবাবপুর রোডে স্টার হোটেল এর খাসির লেগ রোস্ট, চিংড়ি, ফালুদা।
৪.নবাবপুর আরজু হোটেল এর মোরগ পোলাও, নাস্তা আর কাচ্চি।
৫.নবাবপুরের মরণচাঁদ মিষ্টির দোকানের ভাজি, পরোটা, মিষ্টি ও টক দই।
৬.নাজিরা বাজারের হাজীর বিরিয়ানি।
৭.নাজিরা বাজারের হাজীর বিরিয়ানির বিপরীতে হানিফের বিরিয়ানি।
৮.নাজিরা বাজার মোড়ে বিসমিল্লাহর বটি কাবাব আর গুরদার।
৯.নাজিরা বাজারের ডালরুটি।
১০.বংশালের শমসের আলীর ভুনা খিচুড়ি, কাটারী পোলাও।
১১.বেচারাম দেউরীতে অবস্থিত নান্না বিরিয়ানি এর মোরগ পোলাও।
১২.বেচারাম দেউরীতে হাজী ইমাম এর বিরিয়ানি।
১৩.ঠাঁটারী বাজারের গ্রীন সুইটস এর আমিত্তি, জিলাপি।
১৪.ঠাঁটারীবাজার স্টার হোটেল এর কাচ্চি বিরিয়ানি, লেগ রোস্ট আর ফালুদা।
১৫.ঠাঁটারী বাজারের বটতলার কাবাব।
১৬.সূত্রাপুর বাজারের রহিম মিঞার খাসির বিরিয়ানি।
১৭.সূত্রাপুর ডালপট্টির বুদ্ধুর পুরি।
১৮.দয়াগঞ্জের সিটি বিরিয়ানি ও কাচ্চি।
১৯.দয়াগঞ্জের ঢাকা কাবাব।
২০.আরমানিটোলার তারা মসজিদের পাশে জুম্মন মামার চটপটি।
২১.সিদ্দিক বাজারের মাজাহার সুইটস।
২২.পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার রহমানিয়া এর কাবাব।
২৩.পুরান ঢাকার গেন্ডারিয়ার সোনা মিঞার দই।
২৪.গেন্ডারিয়ার আল্লাহর দান বিরিয়ানি এবং রহমান এর কাবাব।
২৫.গেন্ডারিয়া ভাটিখানার হাসেম বাঙ্গালির ডালপুরি।
২৬.গেন্ডারিয়ার ‘কিছুক্ষণ’ রেঁস্তোরার মোগলাই পরোটা, কাটলেট, কর্ন স্যুপ।
২৭.গেন্ডারিয়ার বুদ্ধুর বিরিয়ানি।
২৮.আবুল হাসনাত রোডের কোলকাতা কাচ্চি ঘর।
২৯.আবুল হাসনাত রোডের দয়াল সুইটস এর মিষ্টি।
৩০.রায় সাহেব বাজারের বিউটি লাচ্ছি।
৩১.রায়সাহেব বাজারের আল ইসলামের মোরগ পোলাও, চিকেন টিক্কা।
৩২.রায়সাহেব বাজারের ক্যাফে ইউসুফের নান ও চিকেন টিক্কা।
৩৩.রায় সাহেব বাজারের গলিতে মাখন মিঞার বিরিয়ানি।
৩৪.চকবাজারের নূরানী শরবত বা লাচ্ছি, শাহ্ সাহেবের বিরিয়ানি, Bombay এর আফ্লাতুন, আমানিয়ার খাসির গ্লাসি, বিসমিল্লাহ হোটেলের মোগলাই পরোটা এবং আলাউদ্দীন এর ভাজি পুরি।
৩৫.লালবাগ মোড়ের মীরা মিঞার চিকেন ফ্রাই আর গরুর শিক।
৩৬.লালবাগ চৌরাস্তার খেতাপুরি ও মদিনা মিষ্টান্ন ভান্ডারের মিষ্টি।
৩৭.লালবাগের পাক-পাঞ্জাতন এর মজার তেহারি।
৩৮.লালবাগের ভাটের মসজিদের কাবাব বন।
৩৯.নাজিমুদ্দিন রোডের নীরব হোটেলের অনেক ধরণের ভর্তা।
৪০.বাংলাবাজারের ক্যাফে কর্ণার এর কাটলেট ও চপ।
৪১.বাংলাবাজারের নর্থব্রুক হলে রোডের চৌরঙ্গী হোটেলের লুচি, ডাল, পরোটা।
৪২.তাঁতীবাজারের কাশ্মীরের কাচ্চি।
৪৩.লক্ষীবাজারের মাসহুর সুইটমিট এর লুচি, ভাজি আর ডাল।
৪৪.লক্ষীবাজার পাতলা খান লেন এর লুচি-ভাজি।
৪৫.পুরান ঢাকার নারিন্দার সফর বিরিয়ানি।
৪৬.নারিন্দার শাহ্ সাহেবের ঝুনু বিরিয়ানি।
৪৭.নারিন্দার সৌরভ এর মাঠা আর ছানা।
৪৮.নারিন্দায় অবস্থিত রাসেল হোটেল এর নাস্তা।
৪৯.নারিন্দার মহান চাঁদের লুচি, হালুয়া, সবজির লাবরা, কাঁচা ছানা।
৫০.পুরান ঢাকার ওয়াইজ ঘাটের নানা রেঁস্তোরা।
৫১.শাঁখারীবাজারের অমূল্য সুইটস এর পরোটা ভাজি, হালুয়া আর সন্দেশ।
৫২.কলতাবাজারের নাসির হোটেলের বিখ্যাত গরুর মাংস আর পরোটা।
৫৩.টিপু সুলতান রোডের খান হোটেল এর টাকি মাছের পুরি।
৫৪.টিপু সুলতান রোডের ‘দিল্লী সুইটমিট’ এর সন্দেশ, পরোটা ও টকভাজি।
৫৫.হোসনী দালান রোডে রাতের বেলার পরোটা আর কলিজা ভুনা।
৫৬.চানখাঁরপুলের মামুন হোটেল এর স্পেশাল কাচ্চি। (প্রতি মাসের প্রথম শুক্রবার)
৫৭.হাজারিবাগ বাজারের মারুফ বিরিয়ানি।
৫৮.মিটফোর্ড এর দিগু বাবু লেন এর মানিক চানের পোলাও।
৫৯.খিঁলগাও তালতলা- ফাস্টফুডে একের ভেতর সব। বিশেষত, খিঁলগাওয়ের ভোলা ভাই বিরিয়ানির গরুর চপ এবং মুক্তা বিরিয়ানির গরুর চপ, খাসির চপ ও ফুল কবুতর। খিলগাঁও বাজারের উল্টো পাশে আল রহমানিয়ার গ্রিল চিকেন আর তেহারি।
৬০. পুরান ঢাকার আগুন পান এবং রোজার দিনের ইফতার আইটেম।
৬১.মতিঝিলের ঘরোয়া হোটেল এবং হীরাঝিলের ভুনা খিচুড়ি। মতিঝিল সিটি সেন্টারের পেছনের বালুর মাঠের পেছনের মামার খিচুড়ি।
৬২.লালমাটিয়ার ‘স্বাদ’ এর তেহারি।
৬৩.নয়াপল্টনে হোটেল ভিক্টোরিতে ৭০টি আইটেমের বুফে।
৬৪.হাতিরপুল মোড়ে হেরিটেজের শর্মা।
৬৫.ধানমন্ডির কড়াই গোশতের ইলিশ সস।
৬৬.মোহাম্মদপুর জেনেভা/বিহারী ক্যাম্পের গরু ও খাশির চপ, গরুর মগজ ফ্রাই এবং মুস্তাকিমের চপ।
৬৭.মোহাম্মদপুর টাউন হল বাজারের সামনের বিহারী ক্যাম্পের “মাঞ্জারের পুরি”।
৬৮.মিরপুর-১০ এর শওকতের কাবাব।
৬৯.গুলশানের কস্তুরির শর্মা।
৭০.পুরান ঢাকার মদিনা হোটেলের লুচি-ডাল।
৭১.জেলখানা গেইটের পাশে হোটেল নীরব এর ব্রেন ফ্রাই।
৭২.নয়া বাজারের করিমের বিরিয়ানি।
৭৩.চানখারপুলের নীরব হোটেলের ভুনা গরু আর ভর্তার সাথে ভাত।
৭৪.ধানমন্ডি লায়লাতির খাসির ভুনা খিচুড়ি।
৭৫.পুরানা পল্টনে খানা-বাসমতির চাইনিজ প্যাকেজ।
৭৬.গুলশান ২-এর খাজানার মাটন দম বিরিয়ানি এবং হায়দ্রাবাদি বিরিয়ানি।
৭৭.মৌচাকের ‘স্বাদ’ রেঁস্তোরার ভাতের সাথে ৩৬ রকমের ভর্তা।
৭৮.সায়েন্স ল্যাবে ‘মালঞ্চ’ রেঁস্তোরার কাচ্চি বিরিয়ানি।
৭৯.বেইলি রোডে স্টামফোর্ড ইউনিভার্সিটির সামনের গরু, খাশির চপ+স্যুপ।
৮০.পুরানা পল্টনের ভাই ভাই রেস্টুরেন্টের কাচ্চি।
৮১.গ্যান্ড নওয়াবের কাচ্চি বিরিয়ানি।
৮২.নবাবী ঝালমুড়ি (রামপুরা)
৮৩.নীলক্ষেতের ইয়াসিন আর ঢাকা বিরিয়ানির গরুর কাচ্চি।
৮৪.নীলক্ষেতের সুলতানী ভোজের তেহারি, মোরগ পোলাও, ভুনা খিচুড়ি।
৮৫.কাঁটাবন ঢালে অষ্টব্যঞ্জনের চিকেন খিচুড়ি।
৮৬.গুলশানের পিংক সিটিতে ‘Baton Rouge’ এর বুফে।
৮৭.ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ডাকসু ভবনের পেছনের ফুসকা মামার ফুসকা।
৮৮.সুলতান ডাইন মেন্যু সেট।
৮৯.মিরপুর ঝুট পট্টির রাব্বানির চা।
৯০.বিউটি বোর্ডিং এর আলুর দম, লুচি আর চা।
৯১.গোপীবাগের খাজা হালিম ও টিটির কাচ্চি।
৯২.বায়তুল মোকাররমে অলিম্পিয়া কনফেকশনারীর “চকলেট পেস্টি”।
৯৩.মধ্য বাড্ডায় (গুদারাঘাট) নয়ন বিরিয়ানি হাউজের কাচ্চি, মোরগ পোলাও ও তেহারি (স্পেশাল)।
১৪.ডিসেন্ট (মতিঝিল, হাতিরপুল, বনশ্রী, ধানমন্ডি, চকবাজার, নওয়াব- এর ডেজার্ট আইটেম।)
৯৫.আগামাসিহ লেনের মাকসুদের খাসির পায়ার নেহারি।
৯৬.ফকরুদ্দিনের কাচ্চি বিরিয়ানি, বোরহানি।
৯৭.আরমানিটোলা তারা মসজিদের পাশে জুম্মন মামার চটপটি।
৯৮.পলাশীর মোড়ের ফ্রেশ ফলের জুস ৷
৯৯.উর্দু রোডের খেতাপুরি, বাখরখানি ৷
১০০.প্লাটিনাম ক্লাবের জুসি নুডুলস।
সংবিধান প্রণেতাগণ-৭: বঙ্গবন্ধু কাদেরকে বেছে নিয়েছিলেন?
সংবিধান প্রণয়নের মতো একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাঁদের যোগ্যতা কী ছিল এবং সংবিধানের প্রণয়নের পরে অর্থাৎ বাহাত্তর পরবর্তী জীবন কেমন ছিল?
মহান মুক্তিযুদ্ধের মধ্য দিয়ে বাংলাদেশ স্বাধীন হওয়ার পরপরই শুরু হয় নতুন রাষ্ট্রের জন্য সংবিধান প্রণয়নের আনুষ্ঠানিকতা। বস্তুত ১৯৭১ সালের ৭ মার্চ রেসকোর্স ময়দানে (সোহরাওয়ার্দী উদ্যান) বঙ্গবন্ধু বাংলাদেশকে মুক্ত করার জন্য ‘যার যা কিছু আছে, তা-ই নিয়ে প্রস্তুত থাকা’ তথা নিরস্ত্র বাঙালি জাতিকে সশস্ত্র হওয়ার ঘোষণা দেয়ার দুই মাস আগেই সংবিধান প্রণয়নের প্রক্রিয়া শুরু হয়।
১৯৭২ সালের ৪ নভেম্বর গণপরিষদে গৃহীত হয় বাংলাদেশের সংবিধান এবং কার্যকর হয় ওই বছরের ১৬ ডিসেম্বর প্রথম বিজয় দিবসে। কিন্তু এর একটি ঐতিহাসিক প্রেক্ষাপট ও দীর্ঘ যাত্রা আছে। বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ যেমন কেবল ৯ মাসের সশস্ত্র যুদ্ধ নয়, বরং এর পেছনে রয়েছে দীর্ঘ ২৩ বছরের লড়াই-সংগ্রামের ইতিহাস; বাংলাদেশের সংবিধানও তেমনি বিভিন্ন দেশের সংবিধান থেকে কিছু অনুচ্ছেদ ধার করে তৈরি করা কোনো ডকুমেন্ট নয়। বরং সংবিধানের প্রতিটি বাক্য, শব্দ, সেমিকোলন নিয়ে গণপরিষদে বিতর্ক হয়েছে।
প্রশ্ন হলো, সংবিধান প্রণয়নের মতো একটি জটিল ও গুরুত্বপূর্ণ কাজের জন্য বঙ্গবন্ধু কাদেরকে বেছে নিয়েছিলেন? ড. কামাল হোসেনের নেতৃত্বে যে ৩৪ সদস্যের কমিটি গঠন করা হয়েছিল, তাঁদের যোগ্যতা কী ছিল এবং সংবিধানের প্রণয়নের পরে অর্থাৎ বাহাত্তর পরবর্তী জীবন কেমন ছিল? বঙ্গবন্ধু ঘোষিত দ্বিতীয় বিপ্লব কর্মসূচি অর্থাৎ বাকশালে এই কমিটির কতজন যোগ দিয়েছিলেন এবং ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে খন্দকার মোশতাকের মন্ত্রিসভায় কারা যোগ দিয়েছিলেন? পরবর্তী জীবনে আওয়ামী লীগের সঙ্গে কতজন যুক্ত থেকেছিলেন এবং কতজন থাকেননি, এসব প্রশ্নের উত্তর অনেকেরই জানা নেই।
সদস্যদের গড় বয়স ৪২ বছর
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের গড় বয়স ছিল ৪২ বছর। যখন সংবিধান প্রণয়ণ করা হয় তখন জাতির পিতা বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের বয়স ৫২ বছর। তাঁর জন্ম ১৯২০ সালে। সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে তাঁর চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন তিন জন। সবচেয়ে বয়োজ্যেষ্ঠ হাফেজ হাবীবুর রহমান। জন্ম ১৯১৫। বঙ্গবন্ধুর চেয়ে বয়সে বড় বাকি দুই সদস্য হলেন আছাদুজ্জামান খান (জন্ম ১৯১৬) এবং এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ (জন্ম ১৯১৭)।
বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টার মাইন্ড খন্দকার মোশতাক আহমদ ছিলেন বঙ্গবন্ধুর সমবয়সী।বাংলাদেশ জাতীয় সংসদ সদস্যদের জীবনবৃত্তান্তে (ফেব্রুয়ারি ১৯৭৫) উল্লিখিত তথ্য বলছে, খন্দকার মোশতাক আহমদের জন্মও ১৯২০ সালে।
কমিটির বাকি সদস্যরা ছিলেন বঙ্গবন্ধুর চেয়ে ছোট। তবে তাঁর ‘ক্লোজেস্ট ফ্রেন্ড’ হিসেবে পরিচিত শামসুদ্দিন মোল্লা ছিলেন তাঁর প্রায় সমবয়সী। শামসুদ্দীন মোল্লার জন্ম ১৯২১ সালে। কমিটির সর্বকনিষ্ঠ সদস্য ছিলেন অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। উভয়েরই জন্ম ১৯৪৫ সালে। অর্থাৎ সংবিধান প্রণয়নের সময় তাঁদের বয়স ছিল ২৭ বছর।
অধিকাংশই আইনের ছাত্র
কমিটির সদস্যদের মধ্যে ২৫ জনই ছিলেন আইনের ছাত্র (ব্যারিস্টার/এলএলবি/বি.এল)। একজন রাষ্ট্রবিজ্ঞান, একজন পদার্থ বিজ্ঞান, একজন বাংলা এবং একজন ইসলামের ইতিহাসে স্নাতকোত্তর। একজন স্নাতক। দুজন সাধারণ বি.এ পাস। একজনের বিএসসি অসম্পূর্ণ। একজন চিকিৎসক। আবার যাঁরা আইনে পড়েছেন তাঁদের অনেকেরই অন্য বিষয়েও ডিগ্রি ছিল। অর্থাৎ অন্য কোনো বিষয়ে স্নাতক বা স্নাতকোত্তর হওয়ার পরে আইনে পড়াশোনা করেছেন। রাজনীতি করতে গেলে আইন পড়তে হয়—এরকম একটি ধারণা, বিশ্বাস ও রেওয়াজ তখন ছিল।
১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম (১৯২৫-১৯৭৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং এল.এল.বি।
২. তাজউদ্দিন আহমদ (১৯২৫-১৯৭৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে অর্থনীতিতে স্নাতক ও এল.এল.বি।
৩. খন্দকার মোশতাক আহমদ (১৯২০-১৯৯৬)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
৪. এ এইচ এম কামারুজ্জামান (১৯২৩-১৯৭৫)
প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে অর্থনীতিতে এম.এ এবং রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
৫. এম আবদুর রহিম (১৯২৭-২০১৬)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
৬. আবদুর রউফ (১৯৪২-২০১১)
ঢাকার মোহাম্মদপুর কলেজ থেকে বি.এ।
৭. মো. লুৎফর রহমান (১৯২৭- ২০০৮)
রংপুর কারমাইকেল কলেজ থেকে বি.এ।
৮. আবদুল মমিন তালুকদার (১৯২৯-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
৯. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (জন্ম ১৯৪৫)
রাজশাহী বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বাংলায় এম.এ।
১০. মোহাম্মদ বায়তুল্লাহ (১৯২৭-১৯৮৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ. এবং এলএলবি।
১১. এম আমীর-উল ইসলাম (১৯৩৭)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১২. বাদল রশীদ (১৯২৯-১৯৯৩)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১৩. খন্দকার আবদুল হাফিজ (১৯৩০-২০০১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৪. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর (১৯৩৬-২০২০)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৫. অধ্যক্ষ হুমায়ুন খালিদ (১৯৩৫-২০০২)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৬. আছাদুজ্জামান খান (১৯১৬-১৯৯২)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ এবং বি.এল (ব্যাচেলর অব ল)।
১৭. এ কে মুশাররফ হোসেন আখন্দ (১৯১৭-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
১৮. শওকত আলী খান (১৯২৬-২০০৬)
বার অ্যাট ল (লিংকনস ইন)।
১৯. আবদুল মমিন (১৯২৯-২০০৪)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
২০. শামসুদ্দিন মোল্লা (১৯২১-১৯৯১)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে এল.এল.বি।
২১. শেখ আবদুর রহমান (১৯৩০-২০০৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে এম.এ. এবং এলএল.বি।
২২. ফকির সাহাব উদ্দিন আহমদ (১৯২৫- ১৯৮৯)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং এল.এল.বি।
২৩. আবদুল মুন্তাকীম চৌধুরী (জন্ম ১৯২৯)।
কলকাতার সেন্ট জেভিয়ার্স কলেজ থেকে বি.এ এবং লিংকনস ইন থেকে বার অ্যাট ল।
২৪. অধ্যাপক খোরশেদ আলম (১৯২৯-২০০৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পদার্থবিজ্ঞানে এম.এস.সি।
২৫. সিরাজুল হক (১৯২৫-২০০২)
কলকাতার প্রেসিডেন্সি কলেজ থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ এবং ঢাকা বিশ্ববিদ্যলয় থেকে এম.এ ও এল.এল.বি।
২৬. দেওয়ান আবুল আব্বাস (১৯২৩-২০০৮)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইংরেজি সাহিত্যে এম.এ. এবং এল.এল.বি।
২৭. হাফেজ হাবীবুর রহমান (১৯১৫-১৯৮৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ।
২৮. মুহাম্মদ আবদুর রশিদ (১৯২৫-২০০০)
বিএসসি অসম্পূর্ণ।
২৯. সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত (১৯৪৫-২০১৭)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে স্নাতকোত্তর এবং ঢাকা সেন্ট্রাল ল কলেজ থেকে আইনে স্নাতক।
৩০. নুরুল ইসলাম চৌধুরী (১৯২৭-১৯৯৫)
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রাষ্ট্রবিজ্ঞানে এম.এ এবং এল.এল.বি।
৩১. মোহাম্মদ খালেদ (১৯২২- ২০০৩)
কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইসলামের ইতিহাসে এম.এ।
৩২. রাজিয়া বানু (১৯২৬- ১৯৯৮)
কলকাতার আশুতোষ কলেজ থেকে বি.এ অনার্স।
৩৩. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল (১৯৩৯-২০২০)
চট্টগ্রাম মেডিকেল কলেজ থেকে এমবিবিএস।
৩৪. ড. কামাল হোসেন (জন্ম ১৯৩৭)
অক্সফোর্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে জুরিসপ্রুডেন্সে স্নাতক ও ব্যাচেলর অব সিভিল ল ডিগ্রি এবং লিংকনস ইনে বার-অ্যাট-ল। আন্তর্জাতিক আইনে পিএইচডি।
সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন ৭ জন
বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে রাজনীতির পাশাপাশি সাংবাদিকতার সঙ্গে যুক্ত ছিলেন সাত জন।
১. হাফেজ হাবীবুর রহমান: ছয় দফা নিয়ে পুরো পূর্ব পাকিস্তানে বঙ্গবন্ধুর নির্দেশে জনমত তৈরির কাজ করেন এবং ছয় দফা প্রচারের জন্য ‘সোনার বাংলা’ নামে একটি পাক্ষিক পত্রিকা প্রকাশ করেন। যদিও পূর্ব পাকিস্তানের গভর্নর মোনায়েম খান পত্রিকাটি বাজেয়াপ্ত করেন। পরবর্তীতে ‘সোনার বাংলা’ পত্রিকাটি তিনি আর কখনো চালু করেননি।
এরপর তিনি ‘সাপ্তাহিক বাংলার বাণী’ নামে একটি পত্রিকা প্রকাশ করেন। তিনি ছিলেন এই পত্রিকার প্রতিষ্ঠাতাদের একজন এবং প্রতিষ্ঠাতা সম্পাদক। তাঁর সম্পাদনায় ‘বাংলার বাণী’ সাপ্তাহিক আকারে প্রথম প্রকাশিত হয় ১১ জানুয়ারি ১৯৭০ সালে। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর পত্রিকাটি মুজিবনগর থেকে প্রকাশিত হয়। দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে আওয়ামী লীগ নেতা শেখ ফজলুল হক মণির সম্পাদনায় পত্রিকাটি দৈনিক আকারে প্রকাশিত হতে শুরু করে।
২. এ এইচ এম কামারুজ্জামান: চাচা মুহম্মদ আবদুস সামাদের সম্পাদনায় ১৯৫৪ সালে রাজশাহী থেকে ‘প্রবাহ’ নামে একটি মাসিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। কিছুকাল পরে কামারুজ্জামান পত্রিকাটি সম্পাদনার দায়িত্ব নেন। নানা প্রতিকূল পরিবেশে কিছুদিন পরেই এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। ১৯৭০ সালের জুন মাসে তাঁর উদ্যোগে এবং সরদার আমজাদ হোসেনের সম্পাদনায় রাজশাহী থেকে ‘সোনার দেশ’ নামে একটি সাপ্তাহিক পত্রিকা প্রকাশিত হয়। ১৯৭১ সালের ২৫ মার্চের পর এর প্রকাশনা বন্ধ হয়ে যায়। স্বাধীনতার পর কামারুজ্জামানের উদ্যোগে ঢাকা থেকে প্রকাশিত হয় ‘দৈনিক জনপদ’।
৩. শামসুদ্দীন মোল্লা: তিনি দৈনিক ইত্তেফাকের ফরিদপুর সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। যদিও পরবর্তীতে পুরোপুরি আইন পেশায় নিযুক্ত হন।
৪. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ: তিনি ছিলেন চট্টগ্রামের জনপ্রিয় ‘দৈনিক আজাদী’র সম্পাদক।
৫. লুৎফর রহমান: ১৯৫৭ থেকে ৮ বছর দৈনিক সংবাদের গাইবান্ধা সংবাদদাতা হিসেবে কাজ করেছেন। তবে পরে পুরোপুরি রাজনীতিতে মনোনিবেশ করেন।
৬. শওকত আলী খান: পেশায় আইনজীবী হলেও তিনি ছিলেন ইংরেজি সাপ্তাহিক ‘নিউ ওয়ার্ল্ড’ এবং বাংলা সাপ্তাহিক ‘জনতা’র সম্পাদক।
৭. বাদল রশীদ: ১৯৭২ সালের ১৯ এপ্রিল প্রতিষ্ঠিত হয় বাংলাদেশ কৃষক লীগ। বাদল রশীদ ছিলেন কৃষক লীগের প্রতিষ্ঠাতা সভাপতি। এ সময় তিনি ‘সাপ্তাহিক কৃষক’ এবং ‘কৃষক ও কৃষাণী’ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করতেন।
বাকশালে ছিলেন যাঁরা
সমাজকে শোষণমুক্ত করতে বঙ্গবন্ধু ১৯৭৫ সালের ২৫ জানুয়ারি জাতীয় সংসদে সংবিধানের চতুর্থ সংশোধনী বিল পাস করান। এই বিলে দ্বিতীয় বিপ্লবের কর্মসূচি বাস্তবানের লক্ষ্যে বাংলাদেশ কৃষক শ্রমিক আওয়ামী লীগ (বাকশাল) গঠনের কথা বলা হয়েছে। বঙ্গবন্ধু ওই বছরের ২৪ ফেব্রুয়ারি বাকশাল গঠনের আদেশ জারি করেন। সংবিধানের বিধান মোতাবেক একদল অর্থাৎ বাকশাল গঠনের আদেশ জারি হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে বাংলাদেশ আওয়ামী লীগসহ সকল দল বাতিল হয়ে যায়।
১১৫ জন সদস্যকে নিয়ে গঠিত হয় বাকশালের কেন্দ্রীয় কমিটি—যেখানে সংবিধান প্রণয়ন কমিটিরও ১৪ জন ছিলেন। তাঁরা হলেন ১. সৈয়দ নজরুল ইসলাম, ২. খন্দকার মোশতাক আহমদ, ৩. এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান, ৪. ড. কামাল হোসেন, ৫. আব্দুল মমিন, ৬. আছাদুজ্জামান খান, ৭. আবদুল মমিন তালুকদার, ৮. অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরী, ৯. মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর, ১০. ডা. ক্ষিতীশ চন্দ্র মণ্ডল, ১১. আবদুর রহিম, ১২. মো. লুৎফর রহমান, ১৩. শামসুদ্দীন মোল্লা ও ১৪. রাজিয়া বানু।
১৫ সদস্যবিশিষ্ট বাকশালের কার্যকরী সংসদের ভাইস চেয়ারম্যান ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য সৈয়দ নজরুল ইসলাম। সদস্য ছিলেন খন্দকার মোশতাক আহমদ এবং এ. এইচ. এম. কামারুজ্জামান।
বাকশালের জেলা গভর্নর মনোনীত করা হয় ৬১ জনকে। তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৮জন সদস্য ছিলেন জেলার গভর্নর। তাঁরা হলেন ১. অধ্যাপক মোহাম্মদ খালেদ (চট্টগ্রাম), ২. মুহাম্মদ আব্দুর রশিদ (লক্ষ্মীপুর), ৩. অধ্যাপক মো. খোরশেদ আলম (কুমিল্লা), ৪. শামসুদ্দীন মোল্লা (ফরিদপুর), ৫. খন্দকার আবদুল হাফীজ (নড়াইল), ৬. অধ্যাপক আবু সাইয়িদ (পাবনা), ৭. আবদুর রউফ (নীলফামারী) এবং ৮. মো. লুৎফর রহমান (গাইবান্ধা)।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় ৫ জন
১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট বঙ্গবন্ধুকে সপরিবারে নৃশংসভাবে হত্যার পরে রাষ্ট্রক্ষমতা দখল করেন যিনি, সেই খন্দকার মোশতাক আহমদও ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির অন্যতম সদস্য। যদিও মাত্র ৮৩ দিন তিনি রাষ্ট্রক্ষমতায় ছিলেন। এরপর একের পর ক্যু ও পাল্টা ক্যুতে তিনিও ক্ষমতাচ্যুত হন।
মোশতাকের ওই ৮৩ দিনের সরকারে বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভার অনেকেই যোগ দিয়েছিলেন। বলা হয়, তাঁদের অধিকাংশই যোগ দিয়েছিলেন বন্দুকের নলের মুখে বাধ্য হয়ে।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যাঁরা যোগ দিয়েছিলেন তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ছিলেন ৫ জন। তাঁরা হলেন ১. আবদুল মোমিন (কৃষি ও খাদ্যমন্ত্রী), ২. আছাদুজ্জামান খান (বন্দর ও জাহাজ চলাচল বিষয়ক মন্ত্রী), ৩. নুরুল ইসলাম মনজুর (রেল ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী), ৪. নুরুল ইসলাম চৌধুরী (শিল্প ও প্রতিরক্ষা প্রতিমন্ত্রী) এবং ৫. ডা. ক্ষিতিশ চন্দ্র মণ্ডল (সাহায্য ও পুনর্বাসন প্রতিমন্ত্রী)।
মোশতাকের মন্ত্রিসভায় যোগ দেয়া সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্যদের মধ্যে আবদুল মোমিন ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন। ২০০২ সাল পর্যন্ত আওয়ামী লীগের প্রেসিডিয়াম সদস্য ছিলেন। ১৯৯৬ ও ২০০১ সালের নির্বাচনে তিনি আওয়ামী লীগের মনোনয়নে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন।
আছাদুজ্জামান খানও মোশতাকের পতনের পর আওয়ামী লীগে ফিরে আসেন। ১৯৭৯ সালে তিনি সংসদ সদস্য এবং বিরোধীদলীয় নেতা হন।
অধ্যাপক নুরুল ইসলাম চৌধুরীও পরবর্তীতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে যুক্ত হন এবং আমৃত্যু আওয়ামী লীগের সঙ্গে ছিলেন। ডা. ক্ষীতিশ চন্দ্র মণ্ডলও ১৯৭৮ সালে আওয়ামী লীগে ফেরত আসেন।
সংবিধান প্রণয়ন থেকে গণফোরাম
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে অনেকেই শেষ পর্যন্ত আওয়ামী লীগে সক্রিয় ছিলেন না। তাঁদের মধ্যে কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন নিজেই গণফোরাম নামে একটি রাজনৈতিক দল গঠন করেন, যে দলে সংবিধান প্রণয়ন কমিটির আরও তিনজন সদস্য (ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ ও আব্দুর রউফ) যোগ দেন।
১৯৯১ সালের নির্বাচনে আওয়ামী লীগ হেরে যায়। ওই নির্বাচনে ঢাকা-১১ আসনে বিএনপির প্রার্থী হারুন রশীদ মোল্লার কাছে হেরে যান আওয়ামী লীগের প্রার্থী ড. কামাল হোসেন। শেখ হাসিনা নির্বাচনে ‘সূক্ষ্ম কারচুপির’ অভিযোগ আনলেও ড. কামাল হোসেন তখন বিবিসিকে দেয়া এক সাক্ষাৎকারে বলেন, ‘নির্বাচন সুষ্ঠু হয়েছে।’
ড. কামাল হোসেনের ঘনিষ্ঠ বন্ধু অধ্যাপক আনিসুজ্জামান তাঁর আত্মজীবনী ‘বিপুলা পৃথিবী’ বইতে লিখেছেন, এর জের ধরে ড. কামাল হোসেনের গাড়ি আক্রান্ত হয় এবং তিনি কটুবাক্যের শিকার হন।
দলীয় সভানেত্রী শেখ হাসিনার কাছে দেয়া এক চিঠিতে ড. হোসেন নির্বাচনে পরাজয়ের পেছনে দলীয় কোন্দল এবং অতিরিক্ত আত্মবিশ্বাসের কথা তুলে ধরেন। এর ফলে তার এবং শেখ হাসিনার মধ্যকার দূরত্ব অনেকটা প্রকাশ্য হয়ে ওঠে। পরিস্থিতি এমন পর্যায়ে গিয়েছিল যে ড. কামাল হোসেনের পক্ষে তখন আওয়ামী লীগে টিকে থাকা বেশ কষ্টসাধ্য হয়ে উঠেছিল।
সে সময় আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভাকে কেন্দ্র করে আকস্মিকভাবে আওয়ামী লীগ সভানেত্রী শেখ হাসিনা সবগুলো জেলার সভাপতি এবং সাধারণ সম্পাদককে চিঠি দেন। সে চিঠিতে তিনি দলের ভেতর ষড়যন্ত্রকারীদের সম্পর্কে সজাগ থাকার জন্য সতর্ক করে দেন।
১৯৯২ সালের মার্চ মাসের প্রথম দিকে আওয়ামী লীগের বর্ধিত সভা অনুষ্ঠিত হয়। সে বর্ধিত সভায় ব্যাপক সমালোচনার মুখে পড়েন ড. কামাল হোসেন। ড. হোসেন হয়তো বুঝতে পারছিলেন তাকে ভিন্ন পথ দেখতে হবে। সেজন্য তিনি নাগরিক সমাজকে সম্পৃক্ত করে একটি মঞ্চ তৈরির চিন্তা-ভাবনা করতে থাকেন। (বিবিসি বাংলা, ৮ নভেম্বর ২০১৮)।
১৯৯২ সালের ১৯ জুন ‘গণতান্ত্রিক ফোরাম’ গঠন করেন ড. কামাল হোসেন। রাজধানীর সেগুনবাগিচায় এই ফোরামের আত্মপ্রকাশ উপলক্ষে অনুষ্ঠিত সমাবেশে যারা শুভেচ্ছা বক্তব্য রেখেছিলেন, তাঁদের মধ্যে সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করা অধ্যাপক আনিসুজ্জামানও ছিলেন। সেদিন গণতান্ত্রিক ফোরামের ১০ সদস্য বিশিষ্ট যে কমিটি গঠিত হয় সেখানে ড. কামাল হোসেন ছাড়াও সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামও ছিলেন। (অ্যাডভোকেট জহিরুল ইসলাম, বাংলাদেশের রাজনীতি: আওয়ামী লীগ ও আওয়ামী লীগ বিরোধী রাজনীতি)।
এরপর ১৯৯৩ সালের ২৮ অগাস্ট গঠিত হয় গণফোরাম। কমিটির সভাপতি হন ড. কামাল হোসেন। দলের সভাপতিমণ্ডলীর সদস্য হন ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম। পরে এই দলে যোগ দেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য আব্দুর রউফ এবং সবশেষ ২০১৮ সালে গণফোরামে যোগ দেন কমিটির আরেক সদস্য অধ্যাপক আবু সাইয়িদ।
সম্প্রতি রাজনীতি থেকে অবসরে যাওয়ার ঘোষণা দিয়েছেন ড. কামাল হোসেন। সক্রিয়ভাবে রাজনীতিতে যুক্ত না থাকলেও সম্মানজনক পদ হিসেবে তাকে গণফোরামের ‘ইমেরিটাস সভাপতি’ করা হয়েছে।
মরে গিয়ে বেঁচে গেলেন খন্দকার মোশতাক
একসময় বঙ্গবন্ধুর ‘অতি ভক্ত’ হিসেবে পরিচিত খন্দকার মোশতাক আহমদই যে বঙ্গবন্ধু হত্যার মাস্টার মাইন্ড—সেটি এখন প্রমাণিত। সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে তিনি ছিলেন তিন নম্বর সদস্য। সংবিধান প্রণয়ন প্রক্রিয়ায় তার অবদানও অনস্বীকার্য। সংবিধানের বেশ কিছু অনুচ্ছেদের ওপর তিনি গুরুত্বপূর্ণ মতামত দিয়েছেন। কিন্তু সংবিধান প্রণয়নের তিন বছর না যেতেই ঘাতকের গুলিতে সপরিবারে নৃশংসভাবে নিহত হন বঙ্গবন্ধু। পরবর্তীতে তদন্তে বেরিয়ে এসেছে, এই হত্যার নেপথ্য কুশীলব আসলে খন্দকার মোশতাক। বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলার একাধিক সাক্ষীর সাক্ষ্য ও আসামির জবানবন্দি থেকে জানা গেছে, পচাঁত্তরের মাঝামাঝি মোশতাকের ষড়যন্ত্র শুরু হয়। তিনি নিজে ও আত্মীয়দের মাধ্যমে সেনা সদস্যদের নিয়ে জাতির পিতাকে হত্যার পরিকল্পনা করতে থাকেন। এ সময় গাজীপুর, কুমিল্লাসহ ঢাকায় সহযোগীদের নিয়ে একাধিক বৈঠক করেন তিনি।
বঙ্গবন্ধুকে হত্যার মূল পরিকল্পনায় যে মোশতাক ছিলেন, তা স্পষ্ট হয় ১৯৭৫ সালের ১৫ অগাস্ট এই বর্বরোচিত হত্যাকাণ্ডের পরপরই। ওইদিনই মোশতাক নিজেকে রাষ্ট্রপতি ঘোষণা করেন এবং বঙ্গবন্ধুর খুনিদের ‘সূর্যসন্তান’ বলে আখ্যায়িত করেন। ক্ষমতায় বসে ১৯৭৫ সালের ২৬ সেপ্টেম্বর এ হত্যাকাণ্ডের বিচারের ওপর নিষেধাজ্ঞা দিয়ে মোশতাক ইমডেমনিটি (দায়মুক্তি) অধ্যাদেশ জারি, ‘জয় বাংলা’ স্লোগান পরিবর্তন করে ‘বাংলাদেশ জিন্দাবাদ’ স্লোগান চালু করেন। শুধু তাই নয়, তার শাসনামলেই চার জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, ক্যাপ্টেন মো. মনসুর আলী এবং এএইচএম কামারুজ্জামানকে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে হত্যা করা হয়। তাঁদের মধ্যে সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ ও কামারুজ্জামান ছিলেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য।
যদিও মোশতাকেরও শেষরক্ষা হয়নি। ক্ষমতা গ্রহণের মাত্র ৮৩ দিনের মাথায় ১৯৭৫ সালের ৫ নভেম্বর খালেদ মোশারফের পাল্টা অভ্যুত্থানে ক্ষমতাচ্যুত হন তিনি। জিয়াউর রহমানের ক্ষমতা গ্রহণের পর মোশতাক প্রথমে বন্দি থাকলেও ১৯৭৬ সালে তাকে মুক্তি দেওয়া হয়। মুক্ত হয়ে ‘ডেমোক্রেটিক লীগ’ নামে নতুন রাজনৈতিক দল গড়তে গিয়ে ব্যর্থ হন। পরে সামরিক শাসককে অপসারণের ষড়যন্ত্রে লিপ্ত থাকার অভিযোগে তাকে আবারও গ্রেপ্তার করা হয়। তার বিরুদ্ধে দুটি দুর্নীতির অভিযোগ আনা হয়। আদালত তাকে পাঁচ বছরের শাস্তি দেন। জেল থেকে মুক্তিলাভের পর তিনি সক্রিয় রাজনীতি শুরু করেন। তবে সফলতা পাননি। বঙ্গবন্ধু হত্যাকাণ্ডের ২১ বছর পর ১৯৯৬ সালের ২ অক্টোবর হত্যা মামলা দায়ের করা হয়। যদিও এর ৭ মাস আগে, ওই বছরের ৫ মার্চ খন্দকার মোশতাকের মৃত্যু হয়। যে কারণে বঙ্গবন্ধু হত্যা মামলায় বিচারের হাত থেকে তিনি ‘মরে গিয়ে বেঁচে যান’।
বঙ্গবন্ধুর জীবদ্দশাতেই ‘বিতর্কিত’ নুরুল ইসলাম মঞ্জুর
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য মোহাম্মদ নুরুল ইসলাম মনজুর বঙ্গবন্ধুর মন্ত্রিসভায় যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী ছিলেন। কিন্তু দুর্নীতির অভিযোগে ১৯৭৫ সালের ২১ জুলাই বহিষ্কৃত হন। তবে এরকমটিও শোনা যায় যে, তৎকালীন বন্যা নিয়ন্ত্রণ ও পানি উন্নয়ন মন্ত্রী এবং বঙ্গবন্ধুর ভগ্নিপতি আবদুর রব সেরনিয়াবাতের সঙ্গে বিরোধের কারণে তাঁকে অপসারণ করা হয়। তাঁদের দুজনের মধ্যে বরিশাল জেলাকেন্দ্রিক প্রভাব বিস্তারকে কেন্দ্র করে দ্বন্দ্ব ছিল।
অগাস্ট ট্র্যাজেডির পর মোশতাক আহমদের সরকারে রেলপথ ও যোগাযোগ প্রতিমন্ত্রী হিসাবে যোগ দেন নুরুল ইসলাম মনজুর। পরবর্তীতে খন্দকার মোশতাকের ‘ডেমোক্রেটিক লীগ’ হয়ে তিনি বিএনপিতে যোগ দেন। সবশেষ ২০০১ সালে বিএনপি থেকে নির্বাচন করে পরাজিত হন।
১৯৯৯ সালে কে এম ওবায়দুর রহমান এবং শাহ মোয়াজ্জেম হোসেনের সঙ্গে নুরুল ইসলাম মনজুরকেও ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বরের জেল হত্যা মামলায় গ্রেপ্তার করা হয়। যদিও ২০০৪ সালে বিএনপি ক্ষমতায় থাকাকালীন আদালতের রায়ে তিনি খালাস পান।
জাতীয় পার্টিতে শেখ আবদুর রহমান
১৯৭৫ সালে সপরিবারে বঙ্গবন্ধু নিহত হওয়ার পরে স্থানীয় জনগণের চাপে মুসলিম লীগের প্রার্থীকে পরাজিত করার জন্য বাগেরহাট পৌরসভা নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করেন সংবিধান প্রণয়ন কমিটির সদস্য শেখ আবদুর রহমান। মাত্র ৭৫৫ ভোটের ব্যবধানে তিনি চেয়ারম্যান নির্বাচিত হন। এরপর বাগেরহাট সদর উপজেলার প্রথম চেয়ারম্যানও নির্বাচিত হন তিনি। পরবর্তীতে জাতীয় পার্টিতে যোগ দেন এবং ১৯৮৪ ও ১৯৮৬ সালের নির্বাচনে বাগেরহাট-২ আসন থেকে তিনি জাতীয় পার্টি থেকে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। ১৯৯১ সালের পঞ্চম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি জাতীয় পার্টির মনোনয়ন নিয়ে বাগেরহাট-২ আসন থেকে পরাজিত হন।
বাদল রশীদ: এমপি থেকে উপজেলা চেয়ারম্যান
সংবিধান প্রণয়ন কমিটিতে ড. কামাল হোসেন এবং ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলামের মতো খ্যাতনামা আইনজীবী থাকলেও এই কমিটির সদস্যদের মধ্যে বাদল রশীদই একমাত্র ব্যক্তি, যাঁর নামের সঙ্গে ‘বার অ্যাট ল’ ব্যবহৃত হতো। ১৯৭৩ সালে অনুষ্ঠিত প্রথম জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি কুষ্টিয়া-৬ আসন থেকে আওয়ামী লীগের প্রার্থী হিসেবে সংসদ সদস্য নির্বাচিত হন। কিন্তু ১৯৭৯ সালে দ্বিতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে আওয়ামী লীগের মালেক গ্রুপ থেকে প্রতিদ্বন্দ্বিতা করে হেরে যান। ১৯৮৬ সালে অনুষ্ঠিত তৃতীয় জাতীয় সংসদ নির্বাচনে তিনি চুয়াডাঙ্গা-১ আসন থেকে স্বতন্ত্র প্রার্থী হিসেবে নির্বাচন করে হেরে যান। এর চার বছর পরে উপজেলা পরিষদ নির্বাচনে অংশ নিয়ে জয়ী হন বাদল রশীদ। যদিও এর পরের বছরই বিএনপি ক্ষমতায় এসে উপজেলা পদ্ধতি বাতিল করে। ফলে বাদল রশীদ উপজেলা চেয়ারম্যান হিসেবে বেশিদিন কাজ করতে পারেননি। এর মধ্যে তিনি অসুস্থ হয়ে পড়েন এবং ১৯৯৩ সালে মৃত্যুবরণ করেন।
শেষ বয়সে কিছুটা সমালোচিত সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত
বহুল আলোচিত, সমালোচিত ‘এক-এগারো’ বাংলাদেশের রাজনীতির একটি টার্নিং পয়েন্ট। সেনা নিয়ন্ত্রিত এই তত্ত্বাবধায়ক সরকারের আমলে প্রধান দুই দলের অনেক নেতাই সংস্কারপন্থি হিসেবে চিহ্নিত হলে পরবর্তীতে তাঁরা দলে গুরুত্বপূর্ণ পদ হারান। সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত ছিলেন তাঁদের অন্যতম। আওয়ামী লীগের সভাপতিমণ্ডলী থেকে সরিয়ে তাঁকে নেয়া হয় উপদেষ্টামণ্ডলীতে। তবে ২০০৮ সালের নির্বাচনে শেখ হাসিনার নেতৃত্বে আওয়ামী লীগ সরকার গঠন করলে মেয়াদের শেষ দিকে রেলপথ মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব পান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। কিন্তু এই দায়িত্বেই তাঁর দীর্ঘ ক্যারিয়ারে সবচেয়ে বড় কলঙ্কের দাগ লাগে। তাঁর এপিএসের গাড়ি থেকে ৭০ লাখ টাকা উদ্ধারের ঘটনায় সমালোচনার ঝড় ওঠে দেশজুড়ে। সেই ঝড় এলোমেলো করে দেয় সুরঞ্জিতের অনেক অর্জন। সমালোচনার মুখে মন্ত্রণালয় হারান তিনি। পদত্যাগপত্র দিলেও প্রধানমন্ত্রী তা গ্রহণ করেননি। বাকি মেয়াদে ছিলেন দপ্তরবিহীন মন্ত্রী। এই অবহেলা আর অসুস্থতায় সবকিছু থেকে কিছুটা বিচ্ছিন্ন হয়ে যান সুরঞ্জিত সেনগুপ্ত। দুর্নীতি দমন কমিশনের তদন্তে তিনি নির্দোষ প্রমাণিত হলেও এরকম একজন বর্ষীয়ান রাজনীতিবিদ এবং অভিজ্ঞ পার্লামেন্টারিয়ানের মৃত্যু হয় অনেকটা অভিমান বুকে নিয়ে।
চারজন জীবিত, তিনজন নিহত
সংবিধান প্রণয়ন কমিটির ৩৪ সদস্যের মধ্যে এখনও (নভেম্বর ২০২৩) চারজন জীবিত। তাঁরা হলেন কমিটির সভাপতি ড. কামাল হোসেন, ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম, অধ্যাপক আবু সাইয়িদ এবং আব্দুল মুন্তাকীম চৌধুরী। কমিটির সদস্য এবং জাতীয় নেতা সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ এবং এ এইচ এম কামারুজ্জামান নিহত হয়েছেন ঢাকা কেন্দ্রীয় কারাগারে ১৯৭৫ সালের ৩ নভেম্বর। কমিটির বাকি সদস্যদের স্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছে। কেউ বার্ধক্যজনিত কারণে। কেউ দীর্ঘদিন অসুখে ভুগে।
——————————————————————————————————-
আমীন আল রশীদ
https://bangla.bdnews24.com/opinion/sy71g6q9rp
Published : 04 Nov 2023, 12:47 PM
আন্তর্জাতিক খ্যাতিসম্পন্ন আইন বিশেষজ্ঞ, সাবেক মন্ত্রী ও বিশিষ্ট রাজনীতিবিদ ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম মহান স্বাধীনতা আন্দোলন ও বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের একজন শীর্ষ সংগঠক এবং প্রথম সারির সৈনিক । তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘোষণাপত্র রচয়িতা ও স্বাধীন বাংলাদেশের অন্যতম সংবিধান প্রণেতা।
ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানের দীর্ঘদিনের ঘনিষ্ঠ সহচর ছিলেন। অসহযোগ আন্দোলনের দিনগুলোতে বঙ্গবন্ধুর বাসভবনে সার্বক্ষণিক কর্মরত ছিলেন। মুক্তিযুদ্ধের সময় বঙ্গবন্ধুর নেতৃত্বে বাংলাদেশের প্রথম নির্বাচিত সরকারের প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের প্রধান সহায়ক ও উপদেষ্টা হিসেবে দায়িত্ব পালন করেন। এছাড়াও তিনি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রবাসী সরকার গঠনে উদ্যোগী ভূমিকা রাখেন।
ব্যারিস্টার এম আমীর-উল ইসলাম ১৯৭০ সালের ঐতিহাসিক নির্বাচনের পর গঠিত আওয়ামী লীগের সংসদীয় দলের হুইপ ছিলেন। তাজউদ্দীন আহমেদের সঙ্গে তিনি সীমান্ত পাড়ি দিয়ে ভারতে যান। দিল্লিতে গিয়ে প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তাজউদ্দীন আহমেদসহ সাক্ষাৎ করে যোগাযোগ স্থাপন করেন। ভূমিকা রাখেন প্রবাসী মুজিবনগর সরকার গঠনে। ১০ এপ্রিলের স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র তাঁরই প্রণয়ন করা। স্বাধীনতার পর বাংলাদেশের সংবিধান প্রণয়ন উপ-কমিটির সদস্য ছিলেন। খ্যাতিমান এই আইনজীবী এখন অবসর জীবনযাপন করছেন। সম্প্রতি তাঁর একটি অডিও-ভিজুয়্যাল সাক্ষাৎকার গ্রহণ করা হয়। সাক্ষাৎকারটি নিয়েছেন সাংবাদিক ও গবেষক আজিজুল পারভেজ। সাক্ষাৎকার নেয়ার সময় তার সঙ্গে আরও উপস্থিত ছিলেন ঢাকা প্রকাশ পত্রিকার প্রধান সম্পাদক মোস্তফা কামাল ও সহকারী সম্পাদক ড. সারিয়া সুলতানা।
অনুস্বর: আপনারা কখন বুঝলেন পাকিস্তানিরা বাঙালিদের ক্ষমতায় যেতে দেবে না?
আমীর-উল ইসলাম: মার্চ মাসে এসে ষড়যন্ত্র আমরা বুঝতে পারি। সে সময় আমরা আমাদের খসড়া সংবিধান তৈরি করে ফেলেছি। অ্যাসেম্বলির যখন বৈঠক বসবে সেই বৈঠকে আমরা সেটা পাশ করে দেব। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে যখন আমরা আমাদের কাজগুলো গুছিয়ে এনেছি, সেই সময় (১ মার্চ ১৯৭১) ঢাকার পূর্বানী হোটেলে কনস্টিটিউয়েন্ট অ্যাসেম্বলি ও প্রোভিনশিয়াল অ্যাসেম্বলির এমপিদের বৈঠক ডাকা হয়েছে। পার্টির হুইপ হিসেবে আমি তাদের খাবার-দাবারের ব্যবস্থা করেছি। এ রকম একটা পরিস্থিতিতে একজন একটা রেডিও নিয়ে আসলো। সেখানে ঘোষণা করা হচ্ছে- অনির্দিষ্টকালের জন্য অধিবেশন স্থগিত করা হয়েছে। এটা হচ্ছে ইয়াহিয়া খানের ঘোষণা। ৩ মার্চ অধিবেশন বসার কথা ছিল।
সেই দিন স্টেডিয়ামে ক্রিকেট খেলা হচ্ছিল। সেখান থেকে দর্শক সবাই বেরিয়ে এল। শহরের অলি-গলি থেকে একের পর এক মিছিল আসতে লাগল। তারা স্লোগান দিচ্ছে- ‘ছয়দফা না এক দফা-এক দফা এক দফা।’ ‘তুমি কে আমি কে-বাঙালী বাঙালী’, ‘বীর বাঙালী অস্ত্র ধর-বাংলাদেশ স্বাধীন কর’, ‘তোমার আমার ঠিকানা-পদ্মা মেঘনা যমুনা’।
তখন ওইখানে বসেই একটা বিবৃতি লিখে ফেললাম। সেখানে বলা হলো, ইয়াহিয়ার ঘোষণা বিশ্বাসঘাতকতা। এটাকে আমরা প্রত্যাখ্যান করছি। সেই সঙ্গে বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমানকে আমরা সকল ক্ষমতা অর্পণ করলাম। জনগণের প্রতিনিধিরা জনগণের নেতা নির্বাচন করলেন। এখন থেকে বঙ্গবন্ধু যে নির্দেশ দেবেন সেই নির্দেশ এই সভার সিদ্ধান্ত বলে পরিগণিত হবে। তারপর জোরদার আন্দোলন শুরু হলো।
অনুস্বর: পাকিস্তানি বাহিনী আক্রমণ চালালে কী করতে হবে সে ব্যাপারে কি কোনো পরিকল্পনা ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: একটা পরিকল্পনা যে ছিল সেটা তো বঙ্গবন্ধুর ৭ই মার্চের ভাষণেই জনগণকে জানিয়ে দিয়েছিলেন। সারা বাংলাদেশেই ছড়িয়ে পড়েছে ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।… তোমাদের যা কিছু আছে তাই নিয়ে শত্রুর মোকাবেলা করতে হবে…।’ তিনি ৭ই মার্চে যে দিকনির্দেশনা দিয়েছেন সেটিই আমাদের মুক্তিযুদ্ধের নির্দেশনা বলে মনে করি।
অনুস্বর: মুক্তিযুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে তা কীভাবে পরিচালিত হবে, কারা নেতৃত্ব দেবেন- সে রকম কোনো পরিকল্পনা কি আপনারা করেছিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: সেগুলো তো আমাদের যে নেতৃত্ব ছিল, সেই নেতৃত্ব হচ্ছে বঙ্গবন্ধু এবং তার সঙ্গে যে চারজন নেতা ছিলেন- সৈয়দ নজরুল ইসলাম, তাজউদ্দীন আহমদ, এ এইচ এম কামরুজ্জামান ও এম. মনসুর আলী। এরাই ছিলেন আমাদের হাইকমান্ড। এরাই বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে বসে সিদ্ধান্ত নিতেন। সে সময় তারাই দেশ চালাচ্ছিলেন। তারা যেটা বন্ধ থাকবে বলতেন, সেটাই বন্ধ থাকত। কোনটা কোন সময় খোলা থাকবে সেটা তারা যা বলতেন তাই হতো।…ইতিমধ্যেই পশ্চিম পাকিস্তান থেকে আমরা পূর্ব পাকিস্তান আলাদা হয়ে গেছি। সেই দিক থেকে বলতে গেলে মার্চ মাস থেকেই স্বাধীনতার প্রস্তুতি সৃষ্টি হয়ে গেছে।
অনুস্বর: পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা সফল না হলে কী করতে হবে সেটা নির্ধারণ হয়েছিল কিনা?
আমীর-উল ইসলাম: আলোচনা তো হলো না। আলোচনার নামে কালক্ষেপণ করা হলো। ইয়াহিয়া খান সামরিক বাহিনী নিয়ে বাঙালির উপর একটি যুদ্ধ চাপিয়ে দিল।
অনুস্বর: পাকিস্তানিদের সঙ্গে আলোচনা সফল না হলে, যুদ্ধ শুরু হয়ে গেলে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে যাবেন, এ রকম একটি প্রস্তাব কি আপনারা দিয়েছিলেন? কোন প্রেক্ষাপটে বঙ্গবন্ধু আত্মগোপনে না গিয়ে বাড়িতেই থাকার সিদ্ধান্ত নিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু কখনো আত্মগোপনে যান নি। জীবনেও না। উনাকে বলেছিলাম, আপনাকে আমাদের সঙ্গে যেতে হবে কারণ আপনার জীবনের উপর হামলা হতে পারে। কিন্তু উনি যেতে রাজি হলেন না। তিনি কখনো গোপনে কোথাও গিয়ে পালিয়ে থাকেন নি। রাজনৈতিক জীবনে না, ব্যক্তিগত জীবনেও না।
আমাদের আশঙ্কা ছিল উনার জীবনের উপর হামলা হতে পারে। উনি (বঙ্গবন্ধু) যখন যাবেন না এ রকম পরিস্থিতিতে কী করা যায় তার জন্য তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গেলাম। বললাম, আপনাকে আমাদের সঙ্গে আসতে হবে। বঙ্গবন্ধু যখন আসলেন না তখন আপনাকে তাঁর অনুপস্থিতিতে অবস্থা মোকাবিলা করার জন্য তাঁর পক্ষে নেতৃত্ব দিতে হবে। গাইড করতে হবে।
উনি খুব ইতস্তত করছিলেন। তাঁকে বললাম, আপনার উপরেও হামলা হতে পারে। অতএব আপনার জীবনের নিরাপত্তার জন্যও যাওয়া দরকার। এমন সময় বিডিআর ক্যাম্প থেকে লোক চলে আসলো, বলল, আপনারা চলে যান, পাকিস্তানিরা আমাদের বন্দী করে ফেলেছে, আমাদেরকে নিরস্ত্র করে ফেলেছে। তখন তিনি কনভিন্সড হলেন। বুঝতে পারলেন বড় রকমের একটা সংকট সৃষ্টি হবে।
বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধের যে সময় সেই সময়ে তার প্রেজেন্টস ও লিডারশিপ, অন দ্য ফিল্ড থাকলে, উনার ঐতিহাসিক গুরুত্ব অনেক গুণ বেড়ে যেত। উনি বুঝতে পারতেন পরিস্থিতি।
উনি (বঙ্গবন্ধু) কখনোই ভাবতে পারেন নি যে, বাংলাদেশের কোনো মানুষ বা তাদের কোনো বাহিনী তাঁকে এবং তার পরিবারকে হত্যা করতে পারবে। আমার মনে হয় সেটা ঘটত না। পরিচালনার সময় তিনি থাকলে তখন যুদ্ধ পরিচালনার সময় কী ঘটেছিল, যুদ্ধের সময় কী অবস্থা ছিল, কী ষড়যন্ত্র হয়েছিল, সব কিছু তার জানা থাকত।
অনুস্বর: আত্মগোপনে যাবেন না, এ ব্যাপারে আপনাদের সঙ্গে কোনো আলোচনা হয়েছিল কী?
আমীর-উল ইসলাম: আমরা যখন উনার সঙ্গে আলোচনা করেছি, আপনাকে আমাদের সঙ্গে (আত্মগোপনে) থাকতে হবে। তিনি বলেছেন, আমি কখনো পালিয়ে যাব না। আত্মগোপন করবো না। এটা উনার চরিত্রের মধ্যে ছিল না। সিংহের মতো যার সাহস, সেই সাহস নিয়ে তিনি কখনো পালিয়ে…।
মুক্তিযুদ্ধের সময় পরিচালনার ক্ষেত্রে উনার কমান্ড যদি সরাসরি থাকত, উনি যদি ইন্ডিয়াতে যেতেন, তিনি জানতেন কার কী অবস্থা, কে কি অবস্থায় আছে, কার কী মানসিকতা- তিনি বুঝতে পারতেন। উনি বুঝতে পারতেন, কার কি যোগ্যতা, কার কি মূল্যায়ন হওয়া দরকার। ফারুক-রশীদদের তিনি চিনতে পারতেন। শত্রু-মিত্র চিনতে পারতেন।
অনুস্বর: ২৫ মার্চের পর বাংলাদেশের প্রতিনিধি হয়ে আপনারা ভারত গেলেন, প্রধানমন্ত্রী ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে দেখা করলেন সেই স্মৃতি যদি বলেন।
আমীর-উল ইসলাম: আমরা যখন তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়ে কুষ্টিয়া হয়ে গেছি, তখন তৌফিক-ই-ইলাহী চৌধুরী ও এসপি মাহবুবের (মাহবুব উদ্দিন আহমেদ) সঙ্গে আমাদের ঝিনাইদহতে দেখা। ওদেরকে বললাম, আপনারা আমাদের প্রতিনিধি হিসেবে ওপারে যাবেন এবং ওদেরকে বলবেন। বাংলাদেশের দুই জন উচ্চ পর্যায়ের নেতা শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে আলোচনার জন্য ভারতে আসতে চান। তারা তখনই যাবেন যদি তাদের রাষ্ট্রীয় মর্যাদায় গ্রহণ হয়। এটা ইচ্ছা করেই বললাম, কারণ প্রাইম মিনিস্টার ছাড়া তো এটা কেউ বলতে পারবে না। বিএসএফ-এর অফিসার তো এটা সম্পর্কে কিছু বলতে পারে না। সে এটা তার চিফের কাছে দিল্লীতে পাঠালেন। বিএসএফ-এর চিফ ছিলেন নেগেন্দ্র সিং । উনি এটা পাঠালেন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর কাছে। উনার একটা সুবিধা ছিল, উনি এক সময় মি. নেহরুর চিফ অব সিকিউরিটি ছিলেন। সেই সূত্রে শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে তার আগে থেকেই পরিচয় ছিল। তখন শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাকে বলেন, ‘ইউ গো ইয়রসেলফ টু রিসিভ দেম। অ্যান্ড বেঙ্গলিজ আর নট অ্যাজ টলার্স ইউ আর। বাট দে আর ভেরি টল ইন দ্য থটস।’ এই যে আমরা পাঠালাম, যে প্রধান তার সঙ্গেই আমাদের কথা বলতে হবে।
তারপর একটি ভিআইপি গাড়ি এল। আমাদের সোজা কলকাতা বিমানবন্দরে নিয়ে গেল। বিমানবন্দর তখন ব্ল্যাক আউট করে দেওয়া হয়েছে, যাতে কাদের নিয়ে যাওয়া হচ্ছে সেটা কেউ না জানতে পারে। আমাদের নিয়ে যাওয়া হলো বিএসএফ-এর একটি কার্গো প্লেনে করে। দিল্লীতে পৌঁছলাম ভোর বেলা। ঘুটঘুটে অন্ধকার। সেখান থেকে একটি ভালো গাড়িতে করে আমাদের দুইজনকে নিয়ে গেল রাষ্ট্রীয় গেস্ট হাউসে।
আমরা তো ক্ষুধায় তৃষ্ণায় কাতর অবস্থা। তারা খাবার আনার চেষ্টা করল, কিন্তু ব্যবস্থা করতে পারল না। বিএসএফ অফিসার গোলক মজুমদার তার কাছে রাখা কিছু টোস্ট দিল। তখন খাওয়া তো দূরের কথা। আমাদের গা থেকে তখন গন্ধ বেরুচ্ছে। এক কাপড়ে আছি কয়েকদিন ধরে। গোলক মজুমদার তার একটি গাউন দিল। যেটা গোটা শরীর ঢেকে দিল। তারপর গোসল করে খেলাম।
দিল্লীতে দেখা হলো শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধীর সঙ্গে। উনিও এক্সপেক্ট করছিলেন, বঙ্গবন্ধু আসবেন। উনি প্রথমেই জিজ্ঞেস করলেন, ‘হাউ ইজ শেখ মুজিব?’ আমরা বললাম, ‘আমরা যখন এসেছি তখন তিনি ভালোই আছেন, তিনিই সবাইকে নির্দেশ দিচ্ছেন। উনি সার্বিকভাবে নেতৃত্ব দিচ্ছেন, সে জন্য তিনি আসতে পারেন নি। তিনিই আমাদের পাঠিয়েছেন, ইনস্ট্রাকশন দিয়েছেন। সে জন্যই আমরা এসেছি।’
সম্ভবত তারপরই জানা গেল, বঙ্গবন্ধুকে অ্যারেস্ট করে নিয়ে গেছে। তখন আর কিছুই গোপন থাকল না।
অনুস্বর: স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণাপত্র রচনার পরিকল্পনাটা কীভাবে এলো?
আমীর-উল ইসলাম: ইতিহাসে আছে। আমেরিকান ইনডিপেন্ডেন্সে সেখানেও তো আছে ঘোষণা, ‘ডিক্লারেশন অব ইনডিপেন্ডেন্স’। পৃথিবীতে দুইটিই আছে। একটি আছে আমেরিকার যুদ্ধের সময়। আর দ্বিতীয়টি আমাদের। আমাদেরটা বোধহয় অনেক বেটার ওদের চাইতে। এই রকম কিছু করবো এটা বর্ডার পার হওয়ার আগেই করে নিয়ে গিয়েছিলাম।
অনুস্বর: মুজিবনগর সরকারের উপদেষ্টা ছিলেন মওলানা ভাসানী। তার ভূমিকা কেমন ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: মাওলানা ভাসানী কলকাতায় এসেছিলেন এবং আরও চারজনসহ আমাদের সাপোর্ট দিয়েছিলেন। উপদেষ্টা হিসেবে উনাদের ইনভলভ্্ করা, তাদের ওই ধরনের কোনো ভূমিকা ছিল না। সব পার্টি যে যুক্ত রয়েছে, সবার যে সহযোগিতা আছে, সেটাই দেখানো। কিন্তু ভাসানী সাহেব আসামসহ বিভিন্ন জায়গায় ঘুরেছেন। চায়নিজদের সঙ্গে উনার একটা সম্পর্ক ছিল। আবার চায়না তো আমাদের বিরুদ্ধে ছিল। মাওলানা সাহেবকে আমাদের সঙ্গে রাখাটা দরকার ছিল।
অনুস্বর: মাওলানা ভাসানীর চলাফেরা কি নিয়ন্ত্রিত ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: থাকাটা স্বাভাবিক। উনি তো ভারতবিরোধী ছিলেন। চীনের সঙ্গে উনার সম্পর্ক। চীন-পাকিস্তান একজোট হয়েছে। যুদ্ধ তো আমাদের তাদের বিরুদ্ধে।
অনুস্বর: পাকিস্তানি বাহিনীর আত্মসমর্পণ সম্পর্কে যদি কিছু বলেন। ওই অনুষ্ঠানে কী জেনারেল ওসমানীর উপস্থিত থাকার কথা ছিল?
আমীর-উল ইসলাম: ওরা তো বাংলাদেশ বাহিনীর কাছে সারেন্ডার করবে না। যুদ্ধে যারা হেরেছে তারা, যুদ্ধে যারা বিজয়ী হয়েছে তাদের কাছে সারেন্ডার করেছে। অন্য কারও কাছে তো আত্মসমর্পণ করবে না। আমি যদি পাকিস্তানি হতাম আমিও তো বাঙালির কাছে সারেন্ডার করতাম না। আমি তো জেনারেল অব পাকিস্তান। সারেন্ডার করতাম, ওই যুদ্ধে যে নেতৃত্ব দিয়েছে, নেতৃত্ব দিয়েছেন জেনারেল অরোরা। তার কাছেই তো সারেন্ডার করেছে।
ওসমানী সাহেবের উপস্থিত থাকা দরকার ছিল। কিন্তু তিনি চলে আসলেন সিলেটে। সেখানে গিয়ে তার প্লেনে একটা গুলি লাগল। তার সঙ্গে সেক্রেটারি ছিলেন বঙ্গবন্ধুর পুত্র শেখ কামালও। গুলি লাগার কারণে তিনি আর সেখানে উপস্থিত হতে পারেন নি। তা না হলে উনি উপস্থিত থাকতে কোনো ডিফিকাল্টি তো ছিল না।
অনুস্বর: শোনা যায়, খন্দকার মোশতাক আহমেদ মুক্তিযুদ্ধ চলাকালেই ষড়যন্ত্রে মেতেছিলেন। পাকিস্তানের সঙ্গে কনফেডারেশন করতে চেয়েছিলেন?
আমীর-উল ইসলাম: বঙ্গবন্ধু জেলখানায়। তখন আমি শার্ন ম্যাকব্রাইট নামক পৃথিবী বিখ্যাত একজন জ্যুরিস্ট; তার সঙ্গে আমার পরিচয় ছিল যখন ব্যারিস্টারি পড়ছিলাম লন্ডনে। তার কাছে আমি একটি চিঠি লিখলাম, বঙ্গবন্ধুকে জেলে রাখার বিষয় এবং তার জীবন রক্ষা করার বিষয়টা নিয়ে। বঙ্গবন্ধু ইজ দ্য ইলেক্টেড লিডার অব ফিফটি মিলিয়ন পিপল অব বাংলাদেশ। তিনি রাষ্ট্রের প্রেসিডেন্ট। তাকে আমরা প্রেসিডেন্ট বানিয়েছি। তাকে বন্দি করে রাখা যায় কি-না।
রাষ্ট্রপ্রধানকে বন্দি করে রাখা যায় কি-না। তখন উনি বললেন, এটা করতে পারে না। একজন রাষ্ট্র প্রধানকে এটা করতে পারে না। তার ভালো উত্তরটি প্রধানমন্ত্রীকে দেখালাম। তিনি কোয়াইট হ্যাপি। তিনি বললেন, মোশতাককে দেখান, তিনি তো পররাষ্ট্রমন্ত্রী। মোশতাকের কাছে যখন গেছি, তখন দেখি তার বাসায় অনেক লোকজন। বেশ সময় লাগল দেখাতে। লোকজন যাওয়ার পর অপিনিয়নটা দেখিয়ে বললাম, প্রধানমন্ত্রী বলেছেন এটা আপনাকে দেখানোর জন্য।
উনি দেখে উত্তর দিলেন, ‘ইউ হ্যাভ টু চুজ, হোয়েদার ইউ ওয়ান্ট শেখ মুজিব অর ইউ ওয়ান্ট বাংলাদেশ’। আমি বললাম, ‘বাংলাদেশ উইল রিমেইন ইনকমপ্লিট উইদাউট বঙ্গবন্ধু, অ্যান্ড বঙ্গবন্ধু উইল রিমেইন ইনকমপ্লিট উইদাউট বাংলাদেশ। সো আই হ্যাভ টু হ্যাভ বোথ। তার টেস্টটা তো তখনই হয়ে গেল।
আগরতলায় বাংলাদেশ সরকার গঠনের জন্য বৈঠক বসেছে। সেখানে নেতা আছেন। এমপিরা আছেন। জেনারেল ওসমানীও এসেছেন। মোশতাকও এসেছেন, সেখানে যখন সরকার গঠনের বিষয়ে জানানো হলো, তিনি বললেন, তাকে যেন সৌদি আরবে পাঠিয়ে দেওয়া হয়, তিনি হজ্ব করতে যাবেন। তাকে যেহেতু প্রধানমন্ত্রী বানানো হয় নি। অভিমানেই তিনি সেটা বললেন। অনেক রাত হয়েছে, সেটা শুনে ঘুমিয়ে পড়লাম। পরদিন কমপ্রোমাইজ হলো তাকে ফরেন মিনিস্টার বানালে তিনি রাজি হবেন। যাতে বিদেশ যেতে পারেন। যখন জাতিসংঘে আমাদের প্রতিনিধি গেল, তখন তাকে পাঠানো হয় নি। হি ওয়াজ এক্সপ্লয়টেড। যাতে বাইরে যেতে না পারে। বাইরে গেলে তো.. অলরেডি সিআইএ-এর সাথে তার যোগাযোগ ছিল।
অনুস্বর: মুক্তিযুদ্ধের দিনগুলোতে প্রধানমন্ত্রী তাজউদ্দীন আহমদের সঙ্গে তো আপনি ঘনিষ্ঠভাবে ছিলেন। তার মূল্যায়ন যদি করেন।
আমীর-উল ইসলাম: তিনি খুব সিম্পল পারসন। নিজেকে কখনো নেতা হিসেবে প্রজেক্ট করতেন না। আমি আর উনি একই ঘরে থাকতাম। খুবই সিম্পল ঘর। ছোট দুইটি চৌকি। ওইখানে আমরা শুইতাম। উনি বসতেন যে চেয়ারে সেটাতে হাতল ছিল না। আরেকটা চেয়ারে হাতল ছিল। সেইটাতে বঙ্গবন্ধুর ছবিটা রাখতেন। এটা অনেকটা মনে পড়ে, রাম যখন বনবাসে, লক্ষণ তখন রামের পাদুকা সিংহাসনে রেখে রাজ্য চালাতেন। আমিও তাকে বলতাম, আপনি তো লক্ষণের ভূমিকা পালন করছেন। ও রকম একটা মানুষ পাশে থাকা মানে বিরাট একটা…। জ্ঞান-গরিমা, অর্থনীতি, ইতিহাস, লেখাপড়া। শ্রীমতি ইন্দিরা গান্ধী তাকে খুবই সম্মান করতেন, তার চারিত্রিক বৈশিষ্ট্যের জন্যে।
অনুস্বর: স্বাধীনতার তো পঞ্চাশ বছর হলো। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রে এই রাষ্ট্রের যে লক্ষ্য স্থির করেছিলেন, তার কতটুকু বাস্তবায়ন হলো?
আমীর-উল ইসলাম: জাস্ট উল্টোটা হচ্ছে। আমি যেটা লিখেছিলাম, প্রক্লেমেশন অব দ্য ইন্ডিপেন্ডেন্ট, যার ভিত্তিতে বাংলাদেশ সৃষ্টি হলো। তিনটি কথা ছিল। রাষ্ট্র হবে ইকুয়ালিটি; এখানে সাম্য থাকবে। হিউম্যান ডিগনিটি থাকবে; মানবিক মর্যাদা। আরেকটা হচ্ছে- সোস্যাল জাস্টিস; সামাজিক ন্যায়বিচার।
সামাজিক মর্যাদাটা কি আছে? খবরের কাগজ খুললেই দেখা যায়, মহিলাদের উপর কী রকম নির্যাতন হচ্ছে। শিশুদের উপর পর্যন্ত ব্যাভিচার হচ্ছে। হিউম্যান ডিগনিটি কোথায়? এটা তো জাতীয় অপরাধ। আমরা কি সেই বাংলাদেশ তৈরি করতে পেরেছি? পারি নাই।
অনুস্বর: এই না পারার ব্যর্থতাটা কাদের?
আমীর-উল ইসলাম: কপালের। ব্যর্থতা আমাদের কপালের। বঙ্গবন্ধুর তো মৃত্যু হওয়ার কথা না। উনি যদি তাজউদ্দীন সাহেবকে পাশে রাখতেন, কিছুই হতো না তার। যাই করতেন তাজউদ্দীন সাহেবকে নিয়েই যদি করতেন। কিন্তু মোশতাকের ষড়যন্ত্রে তাজউদ্দীন সাহেব দূরে সরে গেল।
অনুস্বর: মুক্তিযোদ্ধাদের স্বপ্নের বাংলাদেশ প্রতিষ্ঠার জন্য কী করা উচিৎ?
আমীর-উল ইসলাম: প্রথমত খাঁটি মানুষ তৈরি করা। শিক্ষাব্যবস্থার আমূল পরিবর্তনের মাধ্যমে যোগ্য মানুষ তৈরি করতে হবে। দেশপ্রেম জাগ্রত করতে হবে। সবার মধ্যে মানবিক বোধ তৈরি করতে হবে।
অনুস্বর:আমাদের সময় দেওয়ার জন্য অসংখ্য ধন্যবাদ।
আমীর-উল ইসলাম: ধন্যবাদ।
বিশেষ সাক্ষাৎকার: ‘বঙ্গবন্ধু মুক্তিযুদ্ধে সরাসরি নেতৃত্ব দিতে পারলে শত্রু-মিত্র চিনতেন’ – ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম
আজিজুল পারভেজ10 June, 2022
ক্লাসিক গান।
সাধারন কথা, অসাধারন সুর ও আয়োজন।
Movie/album: Dillagi (1949)
Singers: Suraiya Jamaal Sheikh
Tu meraa chaand, Main teri chandani
Main teraa raag,Tu meri raagini
Tu meraa chaand, Main teri chandani
Main teraa raag, Tu meri raagini
Hoooo ooooo oooo,
nahin dil ka lagana Koi dillagi,
koi dillagi
Nahin dil ka lagana Koi dillagi
koi dillagi
Saath hi jina,Saath hi marna
Ulfat ki hai reet,Haan ulfat ki hai reet
Saath hi jina, saath hi marna
Ulfat ki hai reet,Haan ulfat ki hai reet
Pyaar ki murali haradam Gaaye
teri lagan ke geeeeeet
Pyaar ki murali haradam,Gaaye
teri lagan ke geet
Main teraa raag,Tu meri raagini
Tu meraa chaand,Main teri chandani
Hoooo ooooo oooo,
nahin dil ka lagana Koi dillagi,
koi dillagi
Bhool na jaanaa, Rut ye suhaani
Ye din aur ye raat, Haaaaaaaaaan
ye din aur ye raat
Bhool na jaanaa,Rut ye suhaani
Ye din aur ye raat
Haaaaaaan…. ye din aur ye raat
Jab tak chamake chaand Sitaare
dekho chhuute na saath
Jab tak chamake chaand Sitaare
dekho chhuute na saath
Tu meraa chaand,Main teri chandani
Main teraa raag, Tu meri raagini
Hoooo ooooo oooo,
nahin dil ka lagana Koi dillagi,
koi dillagi
অবাধ ও নিরপেক্ষ নির্বাচন, রেডিও-টেলিভিশনসহ সব রাষ্ট্রীয় প্রচারমাধ্যমকে স্বাধীন ও স্বায়ত্তশাসিত সংস্থায় পরিণত করা,
নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বী সব রাজনৈতিক দলের প্রচার-প্রচারণায় অবাধ সুযোগ নিশ্চিত করা,
জনগণের মৌলিক অধিকার সংরক্ষণ,
বিচার বিভাগের স্বাধীনতা, নিরপেক্ষতা ও আইনের শাসন নিশ্চিত করা
এবং মৌলিক অধিকারের পরিপন্থী সব আইন বাতিল করা—এগুলো ছিল স্বৈরাচার এরশাদের বিরুদ্ধে আওয়ামী লীগের ৮ দল, বিএনপির ৭ দল ও বামপন্থীদের ৫–দলীয় মোট তিন জোটের রূপরেখার দাবি।
jaaan,
তুই আজ ধরা, ছোঁয়া, রাগ, অভিমান, ভালোবাসা সকল কিছুর ঊর্ধ্বে চলে গেছিস। আমি যতই তোকে ডাকি, তুই আর কোনদিন বলবি না, ” hae jaan bolo”
আমি আর কখনো তোর গলা শুনব না। জীবন কত নিষ্ঠুর শিক্ষা দিয়ে দিলো আমাদের বল। আমার পোস্ট, স্টোরির একজন ও ভিউয়ার হলে সেটা তুই ছিলি। আজকে আমার এই লেখা ও তোকে আর স্পর্শ করবে না।
আমি অনেক কপাল করে তোকে পাইছি, আল্লাহ যেন এমন কপাল কাউকে না দেয়।
২০ জুন ২০২১,
তুই প্রথম আমাকে বললি তোর আমাকে ভালো লাগে। আমি টিপ পরি তাই তুই একটা ফেসবুক পোস্ট করলি টিপ নিয়ে। আমি ভাবলাম আতরা ফাতরা ছেলে তুই, খালি খালি ফ্লার্ট করতেছিস, তারওপর পড়াশোনায় ডাব্বা। এরকম ছেলের সাথে কথা বলতে আম্মু নিষেধ করে দিছে।
এরপর ইনবক্সে অনেক ফ্লার্ট চলল তোর…….
অক্টোবর ২০২১
করোনার পরে আমাদের টার্ম ফাইনাল শুরু। সেবার ফিজিক্স পরীক্ষার প্রশ্ন ভীষণ কঠিন, আমি হিমসিম খাচ্ছিলাম এনসার করতে। চোখ পরল তোর দিকে, দেখি বেঞ্চে থুতনি দিয়ে অসহায় এর মত তাকিয়ে আছিস খাতার দিকে। মায়া লাগল, আহারে লিখতে পারছিস না। রিটেক কোর্স টা এই বছর পাশ করলি।
২৫ নভেম্বর ২০২১,
তুই আমাকে বিকেলে কল করলি অর্পা কই তুই। ভার্সিটি ডে আমি বের হব না কেনো, জোরাজোরি করেও বের করতে পারলি না। আমি একটু পরে কল দিয়ে বললাম আমি বের হব, তুই ততক্ষণে শীববাড়ি চলে গেছিস। সেদিন বের হওয়া হলো না। পরেরদিন হলের নিচে তোর আগের হরনেট টা নিয়ে এসে কল দিলি, নাম। আমি তো অবাক এ পাগল বলে টা কি, এভাবে বাইকে চড়ে যাব সবাই কি বলবে! তুই তো নাছোড়বান্দা। নামতে বলছি নাম। তারপর আর কি নামলাম। গেলাম বার্গার খেতে। নাগা নিয়ে তোর সে কি নাকের জ্বল চোখের জ্বল এক হয়ে গেলো। এরপর আস্তে আস্তে শুরু হলো আমাদের ডেটিং পিরিয়ড।
১০ ফেব্রুয়ারি ২০২২,
তুই প্রপোজ করলি তাও এটা বলে যে আজকে থেকে সব মেয়ে বাদ, তুই আমার সেটেল হওয়া অবধি ওয়েট করবি। আমি তোকেই বিয়ে করব। সেদিন আমরা ভীর- জারা সিনেমাটা দেখছিলাম।
আমরা একবছর একদম উথাল পাথাল প্রেম করলাম।এরপর আমাদের লাগল একদিন মহা ক্যাচাল। ব্যাচমেট, কেউ কাউকে গুনলাম না। যাহ থাকবই না।
আমি কেঁদে একদম একাকার। তুই তো মুখ বোঝা এমনিই। কাউকে বলতে পারলি না খালি সিগারেট আর সিগারেট।
১২ দিন পর আমরা আর পারলাম না। সব ভেঙে চুরে কান্না কাটি শেষে আমি তোকে তপন দার দোকানে জড়ায়ে ধরলাম।
এরপর তিন মাস একদম একের প্রেম চলল। তারপর আবার লাগল, এবার ও কেউ কাউকে পাত্তা দিলাম না। করলাম ব্রেকআপ।
টিকল না ৭ দিন ও।
তারপর আবার সব ঠিক করে র্যাগ এর আগে লাগল মহা ক্যাচাল। তুই কনভেইনার সে কি ব্যস্ত। আমি তো পাই ই না।
৯ অক্টোবর ২০২৩,
তোর জন্মদিন, আমি রান্না করে রাখলাম তুই র্যাগ নিয়ে দৌড়াতে গিয়ে আর রান্না খাওয়ার সময় হলো না। সে কি অভিমান আমার। এই নিয়ে দিলাম র্যাগ এর আগে আগে সব শেষ করে। তখন একটা বাজে অবস্থাই হলো আমাদের, একেতো র্যাগ তারওপর জুনিয়র নিয়ে ভুল বোঝাবুঝি। কেউ কারো মুখ দেখি না।
কিন্তু ভেতর তো পুরে ছাড়খার।
২৩ নভেম্বর ২০২৩,
তোর কল আসল, আমি ধরলাম না। সাগরে বললাম তোর বন্ধুকে বলবি আমাকে আর কল না দিতে। তুই সে কত বার কল, ম্যাসেজ। শেষে অনলাইন থেকে একটু কল দিয়ে হ্যালো হ্যালো শুনলি।
তখন তোর কি বাজে অবস্থা।
৩০ নভেম্বর ২০২৩,
রিফাহর জন্মদিন শেষে কাদের ভাই এর দোকানে গিয়ে দেখি তুই বসা, দেখেই আমি সরে চলে আসলাম। তুই আমাকে এক ঝলক দেখে চুপচাপ বের হয়ে বাইক এমন টান দিলি। আমি বুঝতে পারলাম যে জ্বলতেছে তাও আমি নরম হলাম না। একঘন্টা পর শুনি তুই রুপসা গিয়ে বাইক নিয়ে পরে গেছিস। কি যে কষ্ট টা পেলাম, তাও মন নরম হলো না।
১ ডিসেম্বর ২০২৩,
আননোন নম্বরের কল,
-হ্যালো কে
-আমি
শুনেই বুঝলাম আমার ছোট মানুষ টা।
হ্যাঁ বল
তুই একটু হলরোডে আয়, আমি প্রমান করে দিব জুনিয়র এর সাথে আমার কিছু নাই।
আমি এক্সিডেন্ট করছে দেখে আর আটকাতে পারলাম না, গেলাম। মুখের দিকে তাকায়ে কি মায়া লাগল।
কিছুক্ষন পরে আমার হাত ধরে, হাঁটুতে মাথা দিয়ে বললি
,” তোরে ছাড়া আমার শান্তি লাগে না। তুই পুরা আম্মুর মত। আমার সব আছে, শান্তি নাই, অর্পা তোর ফেরত আসা লাগবে না। আমি তোর বাসায় প্রস্তাব দেব ৬ মাস পর “
আমি তখনো চুপ।
– আচ্ছা শামীম চৈতির মত বিয়ে করে ফেলি তাহলে লুকায়ে।
আমি জানি দুজনের কেউ ই রেডি না বিয়ে করতে। তাও, কেউ কাউকে ছাড়া থাকতে পারি না। কেনোভাবেই হারাতে দেব না।
আমি টাইম চাইলাম (যদিও নাটক)
১৩ ডিসেম্বর ২০২৩,
আমি সিলেট যাব, মেহরাব কে বলে রাখছিলাম। মুগ্ধকে বললাম আমি সিলেট যাব। এখন ও ও যাবে। আমার জন্য হেলমেট কিনল। স্নিগ্ধ, জিদান ওদের ও রাজি করালো।
সেদিন আমাকে মেইনগেইট থেকে বাইকে চড়ায়ে সেই সাস্ট অবধি নিয়ে গেলো। কি কষ্ট টাই না হইছিলো একা একা এতদূর ড্রাইভ করতে! চোখ গুলো লাল হয়ে গেছে। তাও সারাপথ কত কথা বললাম আমরা দুজন দুজনের সাথে।
১৫ ডিসেম্বর ২০২৩,
আমরা শ্রীমঙ্গল গেলাম, রাতে ট্রুথ এন্ড ডেয়ার খেলায় কত কত সত্যি বের হয়ে আসল তোর। আমি যে মাইর টা দিলাম……………
পরেরদিন আমাকে খুলনা নামায় দিলি।
২৯ মার্চ ২০২৪,
আমি ঢাকা গেলাম। আজমপুর যেখানে তোর লাশ টা পরে ছিলো। আমি ওখানে নামলাম। পরেরদিন তুই, আমি, স্নিগ্ধ, আদ্রিতা গেলাম শপিং এ। নিজে খুঁজে খুঁজে আমাকে পছন্দ মত দুইটা জামা কিনে দিলি। ট্রায়াল রুম থেকে বের হলেই তোর চোখে মুখে হাসি। jaaan কি সুন্দর লাগছে তোকে! আর তোর বরাবর এর প্রিয় মি. মানিকের বার্গার।ওটা তো আমাকে তুই খাওয়াবিই।
১১ মে ২০২৪,
রক এন্ড রিদম এর কনসার্ট। আমি আতিফ আসলামের টায় যেতে পারি নি। এটাতে যাবই। জিদান, স্নিগ্ধ, রাহাত ওরাও আসবে। গেলাম সবাই। গেটে ঢুকতে মারামারির মত শুরু হলে, তুই সে কি আমাকে বারবার হাত দিয়ে সরায়ে দিচ্ছিস। তোর গায়ে ধাক্কা লাগতেছে। আমার গায়ে যেন না লাগে। ঢুকলাম কোনোভাবে। কতবার জড়ায়ে ধরলাম, চুমু খাইলাম। শেষে অনি হাসান পূর্নতা বাজাবে আর মিজান গাইবে। আমি দেখি না। তুই আমাকে বললি কাঁধে বস। আমিও আর দুনিয়ায় চিন্তা না করে বসলাম কাঁধে চড়ে। তুমি সেই পূর্নতা আমার অনুভবে”” শুনলাম তোর কাঁধে বসেই। সেদিন সারারাত ঢাকা শহরে চড়ে বেড়াইলাম। হাতিরঝিল এসে আমি মুগ্ধর পিঠে হ্যালান দিয়ে বসে আছি। জিদান বললো,” অর্পার ই ভালো”
হ্যাঁ আসলেই জিদান। আমার ই ভালো ছিলো দিন।
পুরান ঢাকার কত খাবার দাবার খেলাম আমরা। টিএসসি তে স্নিগ্ধর সাথে গ্যান্জাম করলাম। পরেরদিন বিকেলে আমাকে বাসে তুলে দিলি তুই।
২১ জুন ২০২৪,
অঙ্কুরের বিয়েতে তোকে সারপ্রাইজ দিতে গেলাম। তুই আগেই টের পেয়ে গেছিলি। মন খারাপ আমার তাও তুই বললি, “jaaan ami ter pai nai.”
আন্টি আমাকে গরুর মাংস মুখে তুলে দিতে দিতে বলল দুই ছেলের একসাথে বউ আনব………।
আমি একটু সরে এসে তোর মুখে একটা খেজুর দিতে যাব তখনি দীপ ভাইয়া আর ভাবী সামনে পরে গেলো। তুই ও আচমকা দেখিয়ে বললি এইযে ভাইয়া, ভাবী। আমি লজ্জা পেলে ভাবী আমাকে নিয়ে একটু মজা করল।
খাইতে বসার আগে আমি বলে দিছিলাম সাদা পাঞ্জাবী, হলুদ লাগে না যেন। ঠিক ই লাগল। তুই দূর থেকে হাত উঁচু করে দেখায়ে বললি হলুদ লেগে গেছে অর্পা।
আমি দিলাম ঝাড়ি।
কিছুক্ষন পরে তুই নিচে নেমে গেলি লিফট ধরে ওই টাই তোকে আমার শেষ দেখা। কেনো যেন তাকায়ে ছিলাম তোর দিকে সেদিন তুই ও একটা হাসি দিয়ে আমাকে ফেলে নেমে গেলি।
jaaan মনে আছে তোকে আমি একটা ডাইরি লিখে দিছি। হাফ আমার লেখা, আমাদের কত ছবি সেখানে। বাকিটা আমি তোকে লিখতে বলছিলাম। জীবন আমাদের ওই ডাইরির কটা পেজের থেকেও ছোট তাই না বল?
কত তোলা তোলা করে ভালোবাসছিস আমায় তুই। এত ছোটাছুটির পরেও আমার কাছে এসে সব ঠান্ডা তোর। আমার এত মেজাজ, এর রাগ, সব কেমন চুপ করে সহ্য করে গেছিস। কোনদিন আমাকে একটা বাজে কথা বলিস নি। উঁচু গলায় কথা বলিস নি। আল্লাহ!!! কি আদর, কি আদর। কত যত্নে আমাকে তুই রাখতি মুগ্ধ একবার মনে করে দেখ।
আজকে তুই বীরের মত সবার মনে বেঁচে আছিস। জান আমি তো আগেই জানতাম তুই বীর। তুই আমার মুগ্ধ। আমার একটাই মুগ্ধ ছিলো।
এখন আর আর্তনাদ করি না। I am so proud of you jaaan.
I mean you are a hero. A great soul.
আমার কাছে তুই তো একটা বাচ্চা। যেই মাথায় তোর গুলি টা লাগলো মুগ্ধ, আমি কত সহস্র বার হাত বুলায়ে দিছি, আদর করে দিছি।আজকে আর আমি তোকে ছুঁতে পারি না। কিন্তু তুই তো নাকি আর আমার একার নাই, পুরো দেশের হয়ে গেছিস।
মেনে নিলাম।
সারাজীবন তো তোর আদর সোহাগের ভাগ কাউকে দেই নি, আজকে তাই কাউকে পাচ্ছি না যাকে জিজ্ঞেস করতে পারি তোমার কি একই হাহাকার!
আমার মুগ্ধ আর নেই।
“কিন্তু তুই আমাকে পূর্ন করে দিয়ে গেলি মুগ্ধ।
একটা ছবি কেবল আমি আমার টাইমলাইন এ রাখতে চাই আমাদের। দয়া করে আমাকে আর মুগ্ধকে সবাই রেসপেক্ট করবেন। আমি এই পোস্ট টা হাজার বার দেখতে চাই।
আমি একদিন রাগ করছি, তুই নিচে বসে আমাকে মানাচ্ছিস। এক হাত দিয়ে আমার গাল টেনে ধরে বসে আছিস আমার হাঁটুর কাছে।
এত আদরে রেখে আজকে কেমন দেশের হয়ে গেলি!
…… যে মুজিব ৩ মার্চের মিটিংয়ে (যেখানে তিনি স্বয়ং উপস্থিত ছিলেন) ছাত্রনেতাদের দ্বারা স্বাধীন বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলনের দৃশ্য দেখেছিলেন এবং সেদিন থেকে সেই পতাকা ঢাকার ক্যান্টনমেন্ট ও গভর্নর হাউস ছাড়া সকল সরকারি-বেসরকারি অফিস আদালতে শোভা পাচ্ছিল, সে পতাকা, ‘তিনিই জনসভায় উত্তোলনের ব্যাপারটি নাকচ করে দিলেন। উত্তেজনা ধীরে ধীরে কুণ্ডলী পাঁকিয়ে জমা হচ্ছিল। তিনি মঞ্চে আরোহণ করলেন। একটি ঘোষণার জন্য অপেক্ষমাণ বিশাল জনসমুদ্রের দিকে তাকালেন। (বঙ্গবন্ধু শেখ) মুজিব তাঁর স্বভাবসুলভ বজ্রকণ্ঠে শুরু করলেন। কিন্তু ধীরে ধীরে কন্ঠস্বর নিচুতে নামিয়ে আনলেন বক্তব্যের বিষয়বস্তুর সাথে খাপ খাইয়ে নেওয়ার জন্য। তিনি একতরফা স্বাধীনতা ঘোষণা করলেন না। কিন্তু ২৫ মার্চে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় পরিষদের অধিবেশনে যোগদানের বিষয়ে চারটি শর্তারোপ করলেন। এগুলো হলো: (এক) মার্শাল ল’ তুলে নিতে হবে। (দুই) জনগণের প্রতিনিধিদের হাতে ক্ষমতা হস্তান্তর করতে হবে। (তিন) সেনাবাহিনী ব্যারাকে ফিরিয়ে নিতে হবে। (চার) বাঙালি হত্যার কারণ খুঁজে বের করার জন্য বিচার বিভাগীয় তদন্ত কমিটি গঠন করতে হবে।
বক্তৃতার শেষ দিকে তিনি জনতাকে শান্ত এবং অহিংস থাকার উপদেশ দিলেন। যে জনতা সাগরের ঢেউয়ের প্রচণ্ড আবেগ নিয়ে রেসকোর্সে ভেঙে পড়েছিল- ভাটার টানধরা জোয়ারের মতো তারা ঘরে ফিরে চলল…
(বাঙালির জাতীয় রাষ্ট্র, কাজী আরিফ আহমেদ, পৃষ্ঠা ১৫৬)
৭০ বা ৭১ এর উত্তাল সময়ে ডক্টর কামাল হোসেন আওয়ামীলীগ ও শেখ মুজিবরের সাথে খুবই ঘনিষ্ট হয়ে রাজনৈতিক কাজ করেছেন। ৭ মার্চের ভাষণ নিয়ে ডক্টর কামাল যা লিখেছেন এটা নিচে দেখি। পরে বাকি আর কে কি দেখেছেন বা বুঝেছেন সব বিবেচনা করে নিজের ভাবনা ঠিক করতে পারবো।
৭ মার্চের ঐতিহাসিক ভাষণটি ছিল মাত্র ১৯ মিনিটের। এর কার্যকর ঘোষণাটি ছিল: ‘এবারের সংগ্রাম আমাদের মুক্তির সংগ্রাম, এবারের সংগ্রাম স্বাধীনতার সংগ্রাম।’ সুনির্দিষ্টভাবে তোলা হলো জনগণের প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন বাতিলের দাবি। (ভাষণের পর প্রেস বিজ্ঞপ্তির জন্য) যখন লিখিত বিবৃতি প্রকাশ করা হলো, তখন তাজউদ্দীন আহমদ তা সংশোধন করে এই দুটি দাবি আরও নির্দিষ্টভাবে সন্নিবেশ করেছিলেন। স্পষ্টত স্বাধীনতাই ছিল সুনির্দিষ্ট লক্ষ্য এবং সত্যিকার অর্থে এটি ছিল স্বাধীনতার ঘোষণা। কিন্তু ইতিমধ্যে সেনাবাহিনী নামানো হয়েছে এবং স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়ামাত্র তারা যাতে আক্রমণ পরিচালনা করতে পারে, সে জন্য তারা নগরীর বিভিন্ন স্থানে অবস্থান নিয়েছে।
তখন বঙ্গবন্ধু স্বাধীনতার আনুষ্ঠানিক ঘোষণা দেওয়ার ব্যাপারটি সতর্কতার সঙ্গে এড়িয়ে গেলেন।
এখানে উল্লেখ করা দরকার যে ৬ মার্চ রাতে একজন ব্রিগেডিয়ার বঙ্গবন্ধুর দপ্তরে সাক্ষাৎ করেন। তিনি ইয়াহিয়ার কাছ থেকে বার্তা এনেছিলেন যে ইয়াহিয়া শিগগিরই ঢাকায় আসার এবং বাঙালিদের সন্তুষ্ট করা যাবে, এমন একটি সমঝোতায় পৌছানোর আশাবাদ ব্যক্ত করেছেন।
সেটা ছিল একটা কৌতূহলোদ্দীপক বার্তা। প্রতীয়মান হলো, রেডিও ঘোষণার মাধ্যমে যে আঘাত ইয়াহিয়া হেনেছিলেন, তাকে একটু লঘু করা এবং একই সঙ্গে ৭ মার্চ অনুষ্ঠেয় জনসভায় বঙ্গবন্ধু যে সিদ্ধান্ত নেবেন, তাকে একটু নরম করার চেষ্টা করা। ইয়াহিয়ার নিজের জন্যও সেটা একটা অজুহাত খাড়া করার চেষ্টা ছিল। কারণ, যদি স্বাধীনতার ঘোষণা দেওয়া হয়, তাহলে ইয়াহিয়া যাতে বিশ্বদরবারে বলতে পারেন যে তিনি একটি শান্তিপূর্ণ সমঝোতার জন্য ঢাকায় যাওয়ার প্রস্তাব দিয়েছিলেন: কিন্তু বঙ্গবন্ধু সেই সুযোগ না দিয়ে একতরফা স্বাধীনতার ঘোষণা দিলেন এবং এভাবে তাঁর শক্তি প্রয়োগকে অনিবার্য করে তুলেছিল। ৭ মার্চ বঙ্গবন্ধু যে আনুষ্ঠানিকভাবে স্বাধীনতার ঘোষণা দেননি, সেটাও ছিল এর অন্যতম কারণ।
কামাল হোসেনঃ বাংলাদেশ স্বাধীনতা ও ন্যায়ের সন্ধানে
প্রথম প্রথমা বাংলা সংস্করণ
পৃষ্ঠা ১২৪
৭০ এর নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যা গরিষ্ঠ আসনে জয়লাভ করার পর সংবিধান রচনায় হাত দেয়। এটা ছিল এলএফও ‘র নির্দেশনা মেনে কিন্তু ৬ দফার উপর ভিত্তি করে রচনার চেষ্টা।
১৯৭১ এর ২৭ জানুয়ারী ভুট্টোর নেত্রীত্বে পিপিপির নেত্রীবৃন্দ ঢাকা আসেন শেখ মুজিব ও আওয়ামীলীগের কাছ থেকে ৬ দফা বুঝতে ও সম্ভাব্য সংবিধান ও সরকার গঠন নিয়ে আলোচনা করতে। সফর শেষে সাংবাদিক সম্মেলনে ভুট্টোকে যখন তাঁকে প্রশ্ন করা হয়েছিল আওয়ামী লীগ তার বর্তমান নিরঙ্কুশ সংখ্যাগরিষ্ঠতাবলে একটি সংবিধান প্রণয়নে সক্ষম হবে কি না, ভুট্টো তখন বলেছিলেন:
আইনানুগভাবে বলতে গেলে সে পথ তাদের খোলা আছে। কিন্তু যে প্রশ্নের মীমাংসা হওয়া প্রয়োজন তা হলো সংবিধান কী প্রক্রিয়ায় পাস হবে; সাধারণ সংখ্যাগরিষ্ঠতা, নাকি দুই-তৃতীয়াংশ সংখ্যাগরিষ্ঠতায়। আমাদের ভৌগোলিক অবস্থানের কারণেই সংবিধান প্রণয়নের ব্যাপারটি যেহেতু স্বতন্ত্র বৈশিষ্ট্যসম্পন্ন, সেহেতু এ ক্ষেত্রে সংখ্যাগরিষ্ঠকে ঐকমত্যের ভিত্তিতে সংবিধান প্রণয়ন করতে হবে।
ঢাকা থেকে বিদায়ের প্রাক্কালে ভুট্টোর প্রতিনিধিদলের সদস্যরা ইঙ্গিত দিলেন যে তাঁরা পশ্চিম পাকিস্তানের অন্যান্য প্রদেশের তাঁদের দলের নেতাদের সঙ্গে আলোচনা করতে ফিরে যাচ্ছেন এবং ফেব্রুয়ারিতে আওয়ামী লীগের সঙ্গে পুনরায় আলোচনা করতে ঢাকায় ফিরবেন। যদিও পরবর্তীতে আপাত দৃশ্যমান গঠনমূলক প্রক্রিয়াটি আর বেঁচে থাকে নি।
জুলফিকার আলী ভুট্টো, তাঁর বই ‘দ্য গ্রেট ট্র্যাজেডি’তে (পাকিস্তান পিপলস পার্টি, করাচি, ১৯৭১) বাংলাদেশের মুক্তিযুদ্ধ শুরুর ঠিক আগের ঘটনাবলির বিবরণ দেন।
ঢাকা যাওয়ার পথে ১২ মার্চ [১৯৭১ সাল] প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান করাচি আসেন। আমি ১৪ তারিখে তার সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে আমাদের দলের অবস্থান পুনর্ব্যক্ত করি এবং সর্বশেষ ঘটনাবলির ব্যাপারে আমাদের অবস্থান বর্ণনা করি। আমি তাঁকে বলি যে ৭ মার্চ শেখ মুজিবুর রহমানের উপস্থাপিত দাবি চতুষ্টয় আমরা নীতিগতভাবে মেনে নিয়েছি। তবে অন্তর্বর্তীকালীন অথবা চূড়ান্ত, যেকোনাে মীমাংসা আমাদের সম্মতিতে হতে হবে। দেশের পশ্চিম অংশসহ সারা দেশের স্বার্থ সংরক্ষণের ব্যাপারে আমাদের দায়িত্ব রয়েছে। প্রেসিডেন্টকে জানানাে হলাে যে গুলিবর্ষণের ঘটনা তদন্ত ও সেনাবাহিনীর ব্যারাকে প্রত্যাবর্তন-সংশ্লিষ্ট দাবিগুলাে অবিলম্বে মেনে নেওয়া যেতে পারে। সামরিক আইন প্রত্যাহার এবং নির্বাচিত প্রতিনিধিদের কাছে ক্ষমতা হস্তান্তরের দাবি দুটোও আমাদের কাছে গ্রহণযােগ্য। তবে ক্ষমতা হস্তান্তর এবং সামরিক আইন প্রত্যাহারের পদ্ধতি একটি সাধারণ মতৈক্যের ভিত্তিতে নির্ধারণ করতে হবে। এ কারণে আমাদের অংশগ্রহণ ছাড়া আলােচনা সফল হতে পারে না। তাঁকে অবগত করা হলাে যে আমরা ঢাকা যেতে প্রস্তুত, যদি শেখ মুজিবুর রহমান আমাদের সঙ্গে অর্থবহ আলাপ-আলােচনা করেন।
যেকোনাে বাস্তবতার মানদণ্ডে, যুক্তিসংগতভাবে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিতকরণ-সংক্রান্ত ১ মার্চের ঘােষণার পর যে বিস্ফোরণােন্মুখ। প্রতিক্রিয়ার সৃষ্টি হয়, তা যথাযথ মনে হয় না। শেখ মুজিবুর রহমানের চরম প্রতিক্রিয়া ব্যক্ত করার কারণ অন্যত্র নিহিত ছিল। জাতীয় সংসদের মাধ্যমে সংবিধানসম্মত বিচ্ছিন্নতার পথ রুদ্ধ হয়ে যাচ্ছে উপলব্ধি করতে পেরে তিনি তার কৌশল পরিবর্তন করে সহিংসতার ওপর নির্ভর করার সিদ্ধান্ত নেন। দেশের পশ্চিমাঞ্চলের পরাজিত দলসমূহের মনােভাব তাকে উৎসাহিত করে। সেনাবাহিনী কার্যকরভাবে হস্তক্ষেপ না করায়, তার মনে হয় যে তার দাবিসমূহের বিষয়ে তাদের মৌন সম্মতি রয়েছে। পরিস্থিতির এতটা অবনতি ঘটে যে প্রেসিডেন্টের পূর্ব পাকিস্তান সফরের ঘােষণাকে কেন্দ্র করে শেখ মুজিবুর রহমান দম্ভের সঙ্গে মন্তব্য করেন, প্রেসিডেন্টকে বাংলাদেশের একজন অতিথি হিসেবে খােশ আমদেদ জানানাে হবে। এ প্রেক্ষাপটে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ১৫ মার্চ ঢাকার উদ্দেশে করাচি ত্যাগ করেন।
১৬ মার্চ রাতে প্রেসিডেন্ট আমাকে ১৯ মার্চ ঢাকায় আসার জন্য সংবাদ পাঠান। পরদিন আমি বার্তার জবাব দিই। ১৯ মার্চ ঢাকায় যাওয়ার ব্যাপারে আমার আগ্রহ সম্পর্কে তাকে আমি আশ্বস্ত করে শর্তারােপ করি যে আলােচনায় শেখ মুজিবুর রহমানের অংশগ্রহণ থাকতে হবে। প্রেসিডেন্ট যেহেতু আমাদের দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে পরিচিত ছিলেন, সেহেতু শুধু তাঁর সঙ্গে আরেক দফা আলাপের জন্য ঢাকায় গিয়ে কোনাে গুরুত্বপূর্ণ উদ্দেশ্য সফল। হবে না বলেই আমরা মনে করি। যা দরকার ছিল বা জরুরি ছিল তা হলাে, পিপলস পার্টি ও আওয়ামী লীগের মধ্যে সংলাপ এবং আমরা জানতে চেষ্টা করলাম যে এ রকম কোনাে সংলাপ অনুষ্ঠিত হবে কি না। আমি এ বিষয়ে। ব্যাখ্যা চাইলাম—যে ব্যাখ্যার কথা আমি করাচিতে ১৮ মার্চে আয়ােজিত আমার সংবাদ সম্মেলনে উল্লেখ করেছিলাম। ইতিমধ্যে ১৭ মার্চ প্রেসিডেন্টের প্রিন্সিপাল স্টাফ অফিসার আমাকে আরেকটি বার্তা পাঠিয়ে জানান যে প্রেসিডেন্টের সঙ্গে আলােচনার জন্য আমার ঢাকায় সফর করা প্রয়ােজন। তার। মতে, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে প্রেসিডেন্টের আলাপের ফলে এ ধরনের আলােচনা আবশ্যক হয়ে পড়েছে। আমাকে ঢাকায় ডাকা হচ্ছিল প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাতের উদ্দেশ্যে, শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে আলােচনার জন্য নয়, এটা অবহিত হওয়ার পর আমরা সবিনয়ে আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করি।
প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমানের কয়েকটি বৈঠক এবং ঢাকায় দেশের পশ্চিমাঞ্চলের কতিপয় রাজনীতিবিদের কার্যকলাপে বেশ কিছু সন্দেহের উদ্ভব হয়। সংবাদপত্র মিথ্যা বিবরণ আর ওই মুহূর্তে ছড়ানাে গুজবে পরিপূর্ণ ছিল। কখনাে কখনাে প্রকাশিত হচ্ছিল যে আলােচনায় সন্তোষজনক অগ্রগতি হচ্ছে না। আবার অন্য সময় দৃঢ়তার সঙ্গে দাবি করা। হচ্ছিল যে সাফল্যজনক আলাপ-আলােচনা প্রায় সমাপ্তির পথে এবং পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে বাদ দিয়ে একটি অন্তর্বর্তীকালীন সরকার গঠিত হতে যাচ্ছে। প্রেসিডেন্টের আইন উপদেষ্টাদের ঢাকায় তলবের ফলে এসব গুজব বিশ্বাসযােগ্যতা অর্জন করে। ঢাকায় তাদের অবস্থান জানান দিচ্ছিল যে একটি অন্তর্বর্তীকালীন শাসনতন্ত্র প্রণীত হচ্ছে। অনিশ্চয়তা ও কায়েমি স্বার্থবাদীদের গভীর চক্রান্ত বিবেচনা করে আমি ১৮ মার্চ প্রেসিডেন্টকে এক বার্তা পাঠাই। যাতে আমি উল্লেখ করি যে ঢাকার গুরুতর পরিস্থিতি আমরা সতর্কতার সঙ্গে পর্যবেক্ষণ করছি। উপরন্তু দেশের পশ্চিমাঞ্চলের সংখ্যাগরিষ্ঠ দল হিসেবে জনগণের প্রতি আমাদের কর্তব্য হলাে, তাদের যথাযথ প্রতিনিধিত্ব নিশ্চিত হচ্ছে কি না, সেদিকে নজর রাখা এবং পরিস্থিতির অন্তর্বর্তীকালীন বা চূড়ান্ত মীমাংসায় পাকিস্তান পিপলস পার্টিকে বাদ রাখার যেকোনাে উদ্যোগ প্রতিহত করা। পাকিস্তান পিপলস পার্টির কাছে গ্রহণযােগ্য নয়, এমন কোনাে ব্যবস্থা গ্রহণ করলে তা মুখ থুবড়ে পড়বে। কারণ, পাকিস্তানের পশ্চিমাঞ্চলের জনগণ তা মেনে নেবে না। আমাদের এ সুবিদিত অবস্থান আমি পুনর্ব্যক্ত করি।
প্রেসিডেন্টের তরফ থেকে ১৯ তারিখ সন্ধ্যায় এক বার্তা পেলাম, যাতে বলা হয়েছে যে উপদেষ্টাদের নিয়ে আমি যেন সত্বর ঢাকার উদ্দেশে রওনা হই। বার্তায় উল্লেখ ছিল, শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্ট ও আমার সঙ্গে আলােচনায় রাজি হয়েছেন। আমাদের শর্ত পূরণ হওয়ায় আমি আমন্ত্রণ গ্রহণ করলাম। পরিস্থিতি পর্যালােচনা এবং ঢাকার জন্য আমাদের সারসংক্ষেপ প্রস্তুতের জন্য ২০ তারিখ সকালে করাচিতে আমি পিপলস পার্টির হাইকমান্ডের এক জরুরি সভা ডাকলাম। সংবিধান বিশেষজ্ঞ এবং আমার কয়েকজন সহকর্মীসহ ২১ তারিখ সকালে আমরা ঢাকার উদ্দেশে যাত্রা করলাম। আমাদের প্রস্থানের (ঢাকার পথে) মধ্য দিয়ে উদ্বিগ্ন জাতির দৃষ্টি ঢাকার দিকে নিবদ্ধ হলাে। এমনকি রাস্তার মানুষও জানত যে বিষয়াদি চরম আকার ধারণ করেছে। পরবর্তী কদিনের মধ্যে ঢাকা পাকিস্তানের ভাগ্য নির্ধারণ করবে। বিকেল সাড়ে চারটায় আমরা ঢাকা পৌছালাম। এটা ছিল জরুরি অবতরণ। কারণ, আমাদের বহনকারী বােয়িং বিমানের চারটির মধ্যে দুটি ইঞ্জিন যাত্রাপথে বিকল হয়ে যায়। পূর্ব পাকিস্তানের ওপর দিয়ে উড্ডয়নকালে এবং বিমান অবতরণের সময় ঢাকার সবুজ ভূমি দেখে আমি এক অবর্ণনীয় অনুভূতিতে বিহ্বল হয়ে পড়ি। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে আমাদের এ দেশ, আমাদের এ জনগণ, যারা পাকিস্তান সৃষ্টিতে বীরত্বপূর্ণ অবদান রেখেছিল, তা প্রকৃত অর্থে বিচ্ছিন্নতার দ্বারপ্রান্তে উপনীত। আমি কল্পনা করতে পারিনি যে আমাদের বাহাত্তর মিলিয়ন দেশবাসী পাকিস্তান। থেকে বিযুক্ত হয়ে যাচ্ছে। আমি বিশ্বাস করতে পারছিলাম না যে গেল কয়। বছরে এত বেশি ক্ষোভের সঞ্চার হয়েছে যে আমাদের ভাইবােনেরা দেশের বিরুদ্ধে বিদ্রোহ করতে পারে, যার জন্য অনেকেই রক্ত দিয়েছেন। দেশভাগের সময় পাকিস্তান পূর্ব পাঞ্জাব, পশ্চিম বাংলা এবং আসামকে হারায়। জম্মু ও কাশ্মীর প্রদেশ ভারতের দখলে চলে যায়। আর এখন, দুই যুগ বাদে, আমাদের দেশের সবচেয়ে জনবহুল অংশের ভাগ্য অনিশ্চিত হয়ে পড়েছে।
বিমান থেকে অবতরণের পর আমরা সামরিক বাহিনীর লােকজন দ্বারা। পরিবেষ্টিত হই, বিমানবন্দরে প্রহরারত জওয়ানরা এবং সেনানিবাস ও এর আশপাশে আশ্রয় গ্রহণকারী শরণার্থীরা [বিহারি] আমাদের অভিনন্দিত করে। এই শরণার্থীদের দুর্দশা এবং তাদের মর্মবিদারক কাহিনি কখনাে ভােলা যাবে না। নিরাপত্তাবেষ্টনীর মধ্য দিয়ে আমাদের ভিআইপি অপেক্ষাগারে আনার পর ব্রিগেডিয়ার আরবাব খান [ব্রিগেডিয়ার জাহানজেব আরবাব, ঢাকাস্থ ৫৭ ব্রিগেডের অধিনায়ক] জানালেন, সেনাবাহিনী আমাদের ঢাকা অবস্থানকালে যে ব্যবস্থাপনা করেছিল, তার দায়িত্ব আওয়ামী লীগ গ্রহণ করেছে। শেখ মুজিবুর রহমান দৃঢ়তার সঙ্গে চাচ্ছিলেন যে তার দল আমাদের দেখভাল করবে। আওয়ামী লীগের কর্মীরা বিমানবন্দরে কয়েকটি ট্যাক্সি নিয়ে এসেছিলেন। এই আয়ােজনে আমার কিছু সহকর্মী উদ্বিগ্ন হলেন। তবে, আমি এই সদিচ্ছামূলক প্রস্তাবটিকে তাঁর ফেসভ্যালুর কারণে গ্রহণ করতে আগ্রহী ছিলাম। যাহােক, জনৈক কর্নেল পরামর্শ দেন যে সতর্কতামূলক ব্যবস্থা হিসেবে হােটেল পর্যন্ত সেনাবাহিনীর নিরাপত্তায় যাওয়া নিরাপদ হবে। আমরা অচিরেই বুঝতে পারলাম, এটা একটা যথাযথ পরামর্শ ছিল। হােটেলে আসার পথে আমরা এক বৈরী সংবর্ধনার মুখােমুখি হই, যা পূর্বপরিকল্পিত বলে মনে হলাে। হােটেলের লবিতে আওয়ামী লীগের কর্মীরা গালিগালাজপূর্ণ চিক্কার আর মাস্তানিতে মত্ত ছিলেন। কিছু সময়ের জন্য হােটেলকক্ষে যাওয়ার লিফট আটকে রাখা হলাে। আমরা হােটেলকক্ষে আগমনের পর ব্রিগেডিয়ার আরবাব খান আওয়ামী লীগের দেওয়া সংবর্ধনার বিষয়ে তাঁর সদর দপ্তরকে অবহিত করেন। এরপর মুজিবুর রহমানকে জানানাে হয় যে আওয়ামী লীগের কর্মীদের পর্যাপ্ত ব্যবস্থা গ্রহণের ব্যর্থতা বিবেচনা করে সেনাবাহিনী আমাদের ঢাকায় অবস্থানের দায়িত্ব পুনরায় গ্রহণ করেছে।
আমি সেদিন সন্ধ্যা ৭টা ৩০ মিনিটে প্রেসিডেন্ট ভবনে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। প্রেসিডেন্ট আমাকে জানান, ১৬ থেকে ২০ তারিখ নাগাদ তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে অনেকগুলাে বৈঠক করেছেন। অগ্রগতি বিবেচনা করে শেখ মুজিবুর রহমান ১৮ তারিখে এক সংবাদ সম্মেলনে ভাষণ দেন, সেখানে তিনি উল্লেখ করেন যে আলােচনায় অগ্রগতি হয়েছে। ফলে আওয়ামী লীগ এবং প্রেসিডেন্টের বিশেষজ্ঞরা প্রস্তাবিত সাংবিধানিক সমঝােতার ব্যাপারেও আলােচনা করেন। প্রেসিডেন্ট আওয়ামী লীগ নেতার দেওয়া প্রস্তাবের বিষয়ে আমাকে অবহিত করেন।
প্রস্তাবটির মূল বৈশিষ্ট্যগুলাে হলাে, অবিলম্বে সামরিক আইন প্রত্যাহার করা এবং কেন্দ্রীয় সরকারের ক্ষমতা হস্তান্তরের প্রক্রিয়াকে বাধাগ্রস্ত না করেই পাঁচটি প্রদেশে ক্ষমতা হস্তান্তর করা। এ প্রস্তাব অনুযায়ী বর্তমানে প্রেসিডেন্ট যেরূপ আছেন, তদ্রুপ অথবা তিনি ইচ্ছা পােষণ করলে জনপ্রতিনিধি ব্যতীত অন্যদের মধ্য থেকে উপদেষ্টাদের নিয়ে কেন্দ্রীয় সরকার পরিচালনা করতে থাকবেন। এই মর্মেও প্রস্তাব দেওয়া হয় যে শুরুতে জাতীয় সংসদ দুটো কমিটিতে বিভক্ত করা যেতে পারে। একটি পশ্চিম পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের সমন্বয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, অন্যটি পূর্ব পাকিস্তানের নির্বাচিত প্রতিনিধিদের নিয়ে বাংলাদেশের জন্য গঠিত। পশ্চিম পাকিস্তানের কমিটি ইসলামাবাদে এবং বাংলাদেশের জন্য গঠিত কমিটি ঢাকায় বৈঠকে মিলিত হবে। কমিটিদ্বয় নির্ধারিত সময়ের মধ্যে নিজ নিজ প্রতিবেদন তৈরি এবং জাতীয় সংসদে তাদের প্রস্তাবাদি পেশ করবে। অতঃপর জাতীয় সংসদের কাজ হবে প্রস্তাবগুলাে আলােচনা ও বিচার-বিবেচনা করে পূর্ব ও পশ্চিম পাকিস্তানের একত্রে বসবাসের পদ্ধতি খুঁজে বের করা। একটি অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থাধীনে, যা হবে ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রের এক সংশােধিত রূপ, পূর্ব পাকিস্তানকে ছয় দফার ভিত্তিতে স্বায়ত্তশাসন দেওয়া হবে এবং পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলাের ১৯৬২ সালের শাসনতন্ত্রে দেওয়া ক্ষমতার অনুরূপ ক্ষমতা থাকবে। তবে প্রেসিডেন্টের অনুমােদন সাপেক্ষে এবং পারস্পরিকভাবে গ্রহণযােগ্যতার ভিত্তিতে তারা স্বাধীনভাবে স্বায়ত্তশাসনের প্রয়ােজনীয় পরিধি নির্ধারণ করবে। গােটা পরিকল্পনাটি একটি রাষ্ট্রপতির ফরমানের মাধ্যমে প্রকাশিত হবে।
প্রস্তাবটি বর্ণনা করার পর প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান আমাকে বলেন, তিনি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে এটা পরিষ্কার করেছেন যে প্রস্তাবে তার সম্মতিদান প্রথমত আমার সম্মতিসাপেক্ষ। তবে তিনি অধিকতর তুষ্ট হবেন যদি পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতারাও তাদের সম্মতি দেন। প্রেসিডেন্ট আমাকে আরও জানান, তিনি নেতৃতাদের কাছ থেকে প্রস্তাবে তাদের সম্মতিদানের নিশ্চয়তাজ্ঞাপক চিঠি নিতে ইচ্ছুক। তাঁর মতে, এ ধরনের পত্র প্রস্তাবিত পদক্ষেপ গ্রহণে তাঁকে বাড়তি কর্তৃত্ব প্রদান করবে।
প্রস্তাবটি ছিল সুদূরপ্রসারী ও তাৎপর্যপূর্ণ। তবে পূর্ব পাকিস্তানের তখনকার পরিস্থিতি নিয়ে আলােচনায় অগ্রগতি সাধিত হওয়ার উপযােগী নয়। অচলাবস্থা নিরসন করতে পারে, এমন প্রচেষ্টাকে আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করতে হবে। এসব প্রস্তাব নিয়ে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের সঙ্গে আমার প্রাথমিক আলােচনা হয়। আমি তাঁকে জানাই যে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে পরামর্শ করার পর সবকিছু বিবেচনা করে আমি আমার মতামত তাঁকে পাঠাব। আমার প্রস্থানের আগে প্রেসিডেন্ট আমাকে জানান যে পরদিন বেলা ১১টায় প্রেসিডেন্ট ভবনে তাঁর সঙ্গে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার সাক্ষাৎকারের সময় নির্দিষ্ট করা আছে। এ পরিকল্পনাটিতে বিপদের ঝুঁকি আছে। আমি সবে ঢাকা এসে ঘটনাবলি সরাসরি প্রত্যক্ষ করছি। চিন্তাভাবনার জন্য কিছুটা সময় চাইলাম। হােটেলে ফিরে আসার পর সহকর্মীদের ‘দুই কমিটি প্রস্তাব সম্পর্কে অবহিত করি। তারা আশঙ্কা প্রকাশ করে পরামর্শ দেয় যে প্রস্তাবটি গ্রহণ করা আমার জন্য সমীচীন হবে না। কারণ, এতে দুই পাকিস্তানের বীজ নিহিত রয়েছে। তাদের প্রতিক্রিয়া, যা কিনা আমার প্রতিক্রিয়ার অনুরূপ ছিল, জেনে স্বস্তিবােধ করলাম। আমরা আরও ঐকমত্যে পৌছাই যে একান্ত আলাপচারিতা অথবা পত্র বিনিময়ের মাধ্যমে এ ধরনের গুরুত্বপূর্ণ ও সুদূরপ্রসারী কোনাে চুক্তিতে আসা যায় না। এটা জনসাধারণকে সম্পূর্ণ ওয়াকিবহাল করে সম্প্রতি নির্বাচিত সংসদে উত্থাপিত ও তাদের দ্বারা অনুমােদিত হতে হবে। দুই বা ততােধিক রাজনৈতিক নেতা আইন প্রণয়ন ও সংবিধান রচনার দায়িত্বে থাকা গােটা সংসদের অস্তিত্ব উপেক্ষা করতে পারেন না।
২২ তারিখ সকালে নির্ধারিত সময়ের মিনিট কয়েক আগে আমি প্রেসিডেন্ট ভবনে পৌছাই। শেখ মুজিবুর রহমান দ্রুততার সঙ্গে ১১টায়। এলেন। আমরা একে অন্যকে সম্ভাষণ জানিয়ে কিছু আনুষ্ঠানিক বাক্যালাপ করি। তারপর আমাদের প্রেসিডেন্টের কাছে নিয়ে যাওয়া হয়। আবারও আনুষ্ঠানিক সম্ভাষণ বিনিময় হয়। শেখ মুজিবুর রহমান বিমানবন্দর থেকে হােটেলের গমনপথে এবং হােটেলের অভ্যন্তরে যা ঘটেছে, তার জন্য দুঃখ প্রকাশ করে বললেন, তিনি জনতার আবেগ প্রশমিত করার চেষ্টা করেছেন। তবে আবেগ তীব্র হওয়ায় প্রতিটি ব্যক্তিকে নিয়ন্ত্রণ করা কষ্টকর। জবাবে বললাম, এরূপ বিষয়াদি আমাকে বিব্রত করেনি। কারণ, আমার লক্ষ্য হলাে একটি সন্তোষজনক মীমাংসায় পৌছা। অন্য কিছুতেই কিছু এসে যায় না। তারপর শেখ মুজিবুর রহমান প্রেসিডেন্টের দিকে মুখ ফিরিয়ে তাকে জিজ্ঞেস করলেন যে আওয়ামী লীগের প্রস্তাবগুলােতে তিনি চূড়ান্ত অনুমােদন দিয়েছেন কি না। প্রেসিডেন্ট তাঁকে স্মরণ করিয়ে দেন যে এতে আমারও সম্মত হওয়া আবশ্যক এবং সে কারণেই আমি এই আলােচনায় অংশ নিচ্ছি। এ পরিপ্রেক্ষিতে মুজিবুর রহমান মন্তব্য করেন, প্রস্তাবগুলাে প্রেসিডেন্টকে প্রদত্ত হয়েছে বিধায় আমাকে রাজি করানাে প্রেসিডেন্টের ব্যাপার এবং তিনি আরও বলেন, জনাব ভুট্টো প্রস্তাবসমূহে নীতিগতভাবে সম্মত হলে তারা আনুষ্ঠানিক আলােচনা করতে পারেন। তবে তার আগে আলােচনা হবে অনানুষ্ঠানিক ধরনের। প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিয়ে তিনি সংবাদমাধ্যমকে জানাবেন যে তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করেছেন এবং ভুট্টোও সেখানে। উপস্থিত ছিলেন। প্রেসিডেন্ট জবাব দিলেন, এটাই যথেষ্ট নয়। কিন্তু শেখ মুজিবুর রহমান অবিচল রইলেন। আলােচনার পুরাে সময় শেখ মুজিবুর রহমান নম্র, তবে স্নায়বিক চাপে ছিলেন। স্নায়বিক চাপ নিরসন করতে প্রেসিডেন্ট হালকা নাশতাসহ কফি পরিবেশনের আদেশ দিলেন। কফি পানের ঠিক পরপরই আওয়ামী লীগ নেতা বললেন যে তার তাড়া আছে। কারণ, তাঁর জনৈক সহকর্মী ওই দিন প্রত্যুষে ইন্তেকাল করেছেন। এরপর তিনি উঠে দাঁড়িয়ে প্রেসিডেন্টের কাছ থেকে বিদায় নিলেন এবং আমি তাঁর সঙ্গে গাড়ি পর্যন্ত গেলাম।
বেরােনাের সময় আমরা সামরিক সচিবের কক্ষে গেলাম। সেখানে জেনারেল মােহাম্মদ ওমর (জাতীয় নিরাপত্তা বাহিনীর প্রধান, জেনারেল। ইসহাক, প্রেসিডেন্টের সামরিক সচিব, নৌ এডিসি বসে ছিলেন। শেখ মুজিবুর রহমান আমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়ে তাঁদের কক্ষটি ছেড়ে দিতে বললেন। তাঁর দৃষ্টিভঙ্গির এ আকস্মিক পরিবর্তনে আমি কিছুটা বিস্মিত হলাম। তিনি আমাকে জড়িয়ে ধরে তার পাশে বসালেন। তিনি বললেন, পরিস্থিতি খুবই গুরুতর এবং তা উত্তরণ করতে আমার সহায়তা তার দরকার। এ পর্যায়ে কক্ষটিতে আড়িপাতার ব্যবস্থা নেওয়া হয়ে থাকতে পারে ভেবে আমরা বারান্দা দিয়ে হেঁটে ভবনের পশ্চাদ্দিকে প্রেসিডেন্টের কক্ষের পেছনের দহলিজে
বসলাম।
শেখ মুজিবুর রহমান সামরিক সচিবের কক্ষে বলা কথার পুনরুক্তি করে বললেন, পরিস্থিতি এখন এত দূর এগিয়েছে যে ফিরে আসার উপায় নেই। তাঁর মতে, আমার জন্য প্রকৃষ্ট পথ হলাে তাঁর প্রস্তাবে সম্মত হওয়া। তিনি জোর দিয়ে বললেন, আর কোনাে বিকল্প নেই। আমাকে বললেন, এখন তিনি উপলব্ধি করতে পেরেছেন যে পিপলস পার্টিই পশ্চিম পাকিস্তানে একমাত্র শক্তি, পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য রাজনীতিবিদেরা তাঁর সময়ের অপচয় করেছে। স্বতঃপ্রবৃত্ত হয়ে জানালেন, মাত্র একটি প্রদেশে প্রতিনিধিত্বকারী খান আবদুল ওয়ালী খান ব্যতীত অন্য সবাইকে তাঁর সঙ্গে সাক্ষাৎকালে তিরস্কৃত করেছেন। বললেন, এখন তিনি সুনিশ্চিত যে আমাদের দুজনের মতৈক্যে আসা অত্যাবশ্যক। বললেন, পশ্চিম পাকিস্তানে আমি যা চাই, করতে পারি, তিনি আমাকে সমর্থন করবেন। বিনিময়ে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁকে একাকী ছেড়ে দিতে হবে এবং আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের বাস্তবায়ন নিশ্চিত করতে তাঁকে সাহায্য করতে হবে। তিনি আমাকে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হওয়ার প্রস্তাব দেন, পূর্ব পাকিস্তানের তত্ত্বাবধান তিনি করবেন। তাঁর মতে অচলাবস্থা থেকে বেরিয়ে আসার এটাই একমাত্র পথ। সেনাবাহিনীর ব্যাপারে তিনি আমাকে সতর্ক করে দিলেন এবং আমাকে তাদের বিশ্বাস না করার জন্য বললেন। তারা যদি প্রথমে তাকে ধ্বংস করে, পরে আমাকেও বিনাশ করবে। জবাবে বললাম, আমি বরং সেনাবাহিনীর দ্বারা পুরােপুরি ধ্বংস হব, ইতিহাসের দৃষ্টিতে নয়। তিনি তাঁর প্রস্তাবমতাে প্রথমে দুটি কমিটি গঠনের ব্যাপারে রাজি হতে আমাকে চাপ দেন। তিনি আরও বলেন, বর্তমান অবস্থায় জাতীয় সংসদের পক্ষে একক সংগঠনরূপে মিলিত হওয়া অসম্ভব, এটা অনির্দিষ্টকালের জন্য মুলতবি করা সমীচীন হবে। তিনি আমার সঙ্গে আবার সাক্ষাৎ করতে আগ্রহ দেখালেন এবং আমাদের মধ্যে গােপন বৈঠকের আয়ােজন করবেন বলে জানালেন। ইত্যবসরে আমি যেন গােলাম মােস্তফা খারকে তার (শেখ মুজিব) সঙ্গে যােগাযােগ রাখতে বলি; পরদিন খারকে তাঁর বাড়িতে নেওয়ার জন্য তিনি আমার কাছে লােক পাঠাবেন।
আমি শেখ মুজিবুর রহমানের কাছে ব্যাখ্যা করলাম যে জাতীয় সংসদের অধিবেশন স্থগিত করার অনুরােধটি আমি সরলভাবে বিশ্বাস করেছিলাম, বিপরীতে তাঁর প্রতিক্রিয়া ছিল অপ্রয়ােজনীয়ভাবে সহিংস। মাত্র কয়েক দিন বাদে অনুষ্ঠিতব্য জাতীয় সংসদের অধিবেশন এখন তিনি আর চাচ্ছেনই না। প্রেসিডেন্টের সঙ্গে তাঁর আলাপ-আলােচনা এবং আমার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তা, সংসদ অধিবেশন বিষয়ে আমার আগের দেওয়া পরামর্শগুলাের প্রয়ােজনীয়তাকে সমর্থন করছে। আমি তাকে জানালাম যে এ কারণেই আমি দুটি সংখ্যাগরিষ্ঠ দলের মধ্যে পূর্বালােচনার ওপর জোর দিয়ে আসছিলাম। কিন্তু এই উদ্দেশ্যে আমাদের নেওয়া সব উদ্যোগই তিনি পরিহার করেন। যদিও সংসদ অধিবেশন স্থগিতের জন্য আমার দেওয়া যুক্তিযুক্ত প্রস্তাব সম্পর্কে তিনি ভ্রান্ত ধারণা পােষণ করে এর ভুল ব্যাখ্যা করেছিলেন, তথাপি ঘটনাপ্রবাহ আমার আগের অবস্থান সমর্থন করছিল। তাকে বললাম, আমি অবশ্যই তার প্রস্তাব আন্তরিকতার সঙ্গে বিবেচনা করব এবং একটি ন্যায্য মীমাংসায় উপনীত হতে সম্ভাব্য সবকিছু করব। তবে প্রস্তাবটির যেকোনাে চূড়ান্ত রূপ জাতীয় সংসদে অনুমােদিত হওয়া উচিত। প্রয়ােজনে প্রেসিডেন্টকে এ বিষয়ে ফরমান জারির কর্তৃত্ব দিয়ে সংসদে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া যেতে পারে। তাঁকে আরও জানালাম, সংসদের বাইরে প্রস্তাবসংশ্লিষ্ট কোনাে পত্রদানে আমি প্রস্তুত নই। আমি ব্যক্তি হিসেবে অথবা। আমার দলের পক্ষ থেকে এ দায়িত্ব নিতে পারি না, যেখানে সংসদে ইতিমধ্যেই। জনপ্রতিনিধিরা নির্বাচিত হয়েছেন এবং তারা অপেক্ষায় আছেন তাদের অধিকার। অনুযায়ী এই দায়িত্ব পালনের জন্য। শেখ মুজিবুর রহমান খুব তাড়াতাড়ি বিষয়টি অনুধাবন করলেন। জবাবে তিনি বললেন, ‘সঠিক বলেছেন। আমিও কোনাে চিঠি দেব না। তবে চিঠি দেওয়ার বিষয়টি আপনাকেই আগে অস্বীকার করতে হবে, আমি আপনাকে অনুকরণ করব।’
শেখ মুজিবুর রহমান কোনাে প্রকার সংসদ অধিবেশন, এমনকি সংক্ষিপ্ত অধিবেশনের ধারণাও প্রত্যাখ্যান করেন। যেকোনাে রকমের আয়ােজনের মাধ্যমেই হােক না কেন, জাতীয় সংসদ অধিবেশন ছাড়াই তিনি তার প্রস্তাবের ওপর সিদ্ধান্তে উপনীত হতে দৃঢ় সংকল্পবদ্ধ থাকলেন। এসব অভিমত জানিয়ে তিনি বেরিয়ে যাওয়ার জন্য দাঁড়ালেন। তাঁর সঙ্গে আমি গাড়ি পর্যন্ত গিয়ে বিদায় জানালাম। আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে এটাই আমার শেষ সাক্ষাৎকার।
প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের জানান, তিনি প্রেসিডেন্টের সঙ্গে সাক্ষাৎ করেছেন এবং আমি আলােচনায় উপস্থিত ছিলাম। তার উদ্যোগে আমাদের মধ্যে অনুষ্ঠিত পৃথক আলােচনার ব্যাপারে তিনি কিছু উল্লেখ করেননি। হােটেলে প্রত্যাবর্তনের পর সংবাদ প্রতিনিধিরা জিজ্ঞেস করেন যে শেখ মুজিবুর রহমান ও আমার মধ্যে কোনাে আলাদা আলােচনা হয়েছিল কি না। আমি উত্তরে জানাই যে প্রেসিডেন্ট ভবন ত্যাগের পর শেখ মুজিবুর রহমান সাংবাদিকদের যে ধারণা দিয়েছেন, আমি তার বিরােধিতা করতে চাই না।
শেখ মুজিবুর রহমানকে বিদায় জানানাের পর আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানের কাছে ফিরে গেলাম। তিনি তার সেলুন থেকে সম্ভবত আমাদের লক্ষ করছিলেন। প্রেসিডেন্ট আমাদের একান্ত আলাপকে ‘হানিমুন’ (মধুচন্দ্রিমা) বলে অভিহিত করে বিস্ময় প্রকাশ করলে আমি তাকে বললাম, এ ধরনের কথােপকথন রাজনীতিরই অংশ। আলােচনার গােপনীয় বিষয়গুলাে এড়িয়ে। গিয়ে বর্তমান সংকটের সঙ্গে সংশ্লিষ্ট অংশগুলাের বিবরণ প্রেসিডেন্টকে জানালাম। আওয়ামী লীগ নেতার প্রস্তাবের পরিপ্রেক্ষিতে আমার সুচিন্তিত মতামত তাকে জানালাম। আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে জানিয়ে দিই যে আমি [শেখ মুজিবের] প্রস্তাবিত পরিকল্পনার অংশীদার হতে পারি না। কারণ, এটার অর্থ দুই পাকিস্তানের অনিবার্যতা। এই পরিকল্পনায় এটিই আমার প্রধান আপত্তি ছিল। তবে এতে আরও কিছু মারাত্মক ত্রুটি ছিল। এর মধ্যে জাতীয় সংসদের বিনা অনুমােদনে অন্তর্বর্তীকালের জন্য পশ্চিম পাকিস্তানের প্রদেশসমূহে আলাদাভাবে স্বায়ত্তশাসন চালু করলে বিষয়টি পরবর্তী সময়ে অনুমােদন করানাে দুঃসাধ্য হবে। তা ছাড়া ওই সময় পাকিস্তানে চালু আইনগুলাের উৎস আর প্রেসিডেন্টের ক্ষমতার ভিত্তি ছিল সামরিক আইন। সামরিক আইন প্রত্যাহারের ঘােষণা দেওয়া হলে প্রেসিডেন্ট এবং কেন্দ্রীয় সরকার তাদের আইনি কর্তৃত্ব ও অধিকার হারাবে। অতএব, জাতীয় সংসদ প্রতিষ্ঠা করে জাতীয় পর্যায়ে সার্বভৌম ক্ষমতার নতুন উৎস সৃষ্টি না করলে একটি (সাংবিধানিক) শূন্যতা দেখা দেবে। যদি এ ধরনের কোনাে জাতীয় (কর্তৃত্বের) উৎস ছাড়া প্রস্তাব মােতাবেক প্রদেশগুলাের হাতে ক্ষমতা ছেড়ে দেওয়া হয়, তবে প্রতিটি প্রাদেশিক সরকার কার্যত (ডি ফ্যাক্টো) এবং আইনানুগভাবে (ডিজুরাে) সার্বভৌম মর্যাদা লাভ করতে পারে। এটা কেবল আইনগত নয়, প্রায়ােগিক সমস্যাও বটে। শেখ মুজিবুর রহমানের লক্ষ্য হলাে বাস্তব ও আইনতগত—উভয় দিক থেকেই পূর্ব পাকিস্তানের নিয়ন্ত্রণ গ্রহণ করা। এরূপ হলে কোনাে কিছুই পূর্ব পাকিস্তানের বিচ্ছিন্ন হয়ে যাওয়া ঠেকিয়ে রাখতে পারবে না। সেদিক থেকে দেখতে গেলে পশ্চিম অঞ্চলের প্রদেশগুলােও স্বাধীনতা ঘােষণার পর্যায়ে পৌঁছাতে পারে। শুরুতে দুটি কমিটি স্বতন্ত্রভাবে বৈঠকে মিলিত হলে (দেশের) দুই অঞ্চলের মধ্যকার মেরুকরণ ত্বরান্বিত হতাে। বিভক্ত এবং একক সংগঠন হিসেবে অধিবেশনে বসার সম্ভাবনা না থাকায় জাতীয় সংসদ এই মেরুকরণে বাধা দিতে পারত না। মূলত এসব কারণেই [শেখ মুজিবের প্রস্তাব যে অবস্থায় ছিল, তাতে। সম্মতিদানে আমার অপারগতা প্রকাশ করি।
যাহােক, পাকিস্তানের সংহতি রক্ষার প্রয়ােজনে আমি একটি সমঝােতা খুঁজে বের করার উদ্দেশ্যে বলি যে আমরা অন্তর্বর্তীকালীন ব্যবস্থা হিসেবে প্রেসিডেন্টের ফরমানের আওতায় একটি আলােচনাভিত্তিক মীমাংসায় পৌছাতে সম্মত আছি, যদি তা জাতীয় সংসদ দ্বারা অনুমােদিত এবং তাদের প্রদত্ত অধিকারবলে করা হয়। এ ছাড়া আমরা এটাও প্রয়ােজনীয় মনে করি। যে কেন্দ্রের ওপর ন্যস্ত বিষয়গুলাে নির্ধারণ করা এবং পরবর্তী সময়ে কী প্রক্রিয়ায় কেন্দ্রীয় সরকার পুনরায় কাজ শুরু করবে, তা নির্ধারণ করার জন্য একক সংগঠন হিসেবে সংসদের প্রথম অধিবেশনে বসা উচিত। যখন কেন্দ্রীয়। বিষয়াদি নির্ধারিত হয়ে যাবে, তখন কমিটিদ্বয়ের দায়িত্ব হবে জাতীয় ছত্রচ্ছায়ার আওতায় তাদের পরবর্তী বিষয়গুলাে সীমিত রাখা। কমিটি দুটো প্রথমেই পৃথক বৈঠকে বসলে এ ধরনের কোনাে বাধ্যবাধকতা থাকবে না।
প্রেসিডেন্টকে পরামর্শ দিই যে তিনি তাঁর কর্তৃত্ব ও প্রভাব কাজে লাগিয়ে শেখ মুজিবুর রহমানকে এ ধরনের একটি সমঝােতায় সম্মত করাবেন। কদিনের মধ্যেই সংসদ অধিবেশনের আয়ােজন করে সপ্তাহখানেকের মধ্যে এসব স্থির করা যেতে পারে। এটা আশা করা যায় যে শেখ মুজিবুর রহমানও [তার দাবিতে] কিছু সমন্বয় সাধন করবেন, যা জাতীয় ঐক্য রক্ষার পাশাপাশি তাঁকে তাঁর দাবির প্রধান অংশ প্রদান করবে। প্রেসিডেন্ট বিকেল ৪টা ৩০ মিনিটে তাঁর বিশেষজ্ঞদের সঙ্গে এসব প্রশ্ন নিয়ে বিস্তারিত আলােচনা করার জন্য আমাকে অনুরােধ করেন। সেইমতাে আমি আমার সংবিধান ও রাজনৈতিক উপদেষ্টাদের নিয়ে প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের সঙ্গে দেখা করি। এ সভায় আমরা আওয়ামী লীগের প্রস্তাবের নিহিতার্থ নিয়ে বেশ লম্বা আলােচনা করি। তা ছাড়া মীমাংসার ধরন সম্পর্কেও আমাদের নিজস্ব মতামতের পুনরাবৃত্তি করি।
২৩ মার্চ প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান পশ্চিম পাকিস্তানের অন্য নেতাদের সঙ্গে দেখা করেন। আমাকে জানানাে হয়, প্রেসিডেন্ট এ আলােচনায় অন্যান্য বিষয়ের সঙ্গে কেন্দ্রীয় সরকারের ওপর ন্যস্ত বিষয়াদি নির্ধারণ করতে সংসদের প্রয়ােজনীয়তার ওপর আমার মতামতগুলাে আলােচনা করেছিলেন। পরে আমাকে বলা হয়, বেলুচিস্তানের জনৈক নেতা বলেছেন যে দুটি কমিটি থাকলে পাঁচটি থাকতে পারবে না কেন? তবে তারা সবাই আমার আপত্তিসমূহ মেনে নিয়ে জাতীয় সংসদ ছাড়া কোনাে স্থায়ী মীমাংসা প্রত্যাখ্যান করেন। আমি যখন ২৩ মার্চ মাহমুদ আলী কাসুরীসহ [পিপিপি নেতা] অন্য সহকর্মীদের প্রস্তাবিত পরিকল্পনাসহ আমাদের সিদ্ধান্ত তাঁদের অবহিত করতে পাঠাই, তখন তাঁরা এ বিষয়টি জোরালােভাবে পুনর্ব্যক্ত করেন।
২৩ ও ২৪ মার্চ আওয়ামী লীগ ও প্রেসিডেন্টের উপদেষ্টাদের মধ্যে বেশ কয়েকটি দীর্ঘ বৈঠক অনুষ্ঠিত হয়। এসব আলােচনায় আওয়ামী লীগ তাদের মূল প্রস্তাবে সংশােধন আনে। এখন তারা দুটি কমিটির বদলে দুটি সাংবিধানিক সম্মেলন (কনভেনশন) চায়। তারা চায় সাংবিধানিক সম্মেলনদ্বয় শুধু প্রস্তাবনাসংবলিত প্রতিবেদন নয়, বরং দুটো শাসনতন্ত্রের খসড়া জাতীয় সংসদে পেশ করবে। পরবর্তী সময়ে সংসদ ‘পাকিস্তান কনফেডারেশন’-এর জন্য অধিবেশনের মাধ্যমে দুটো সংবিধানকে একত্রে করবে। আওয়ামী লীগ প্রথমবারের মতাে পাকিস্তানের জন্য কনফেডারেশনের প্রস্তাব দেয়। নতুন পরিকল্পনামতে, প্রদেশগুলােতে কেন্দ্রীয় সরকারের কোনাে নিয়ন্ত্রণ বা ক্ষমতা। থাকবে না, এমনকি জরুরি অবস্থায়ও না। বস্তুতপক্ষে, তারা একটি স্বতন্ত্র দেশ চায়। আওয়ামী লীগের সাধারণ সম্পাদক তাজউদ্দীন আহমদ ২৪ তারিখে এই মর্মে এক সংবাদ বিবৃতি দেন যে প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে আওয়ামী লীগ তাদের চূড়ান্ত অবস্থান জানিয়ে দিয়েছে এবং অধিকতর আলাপ-আলােচনার আর কিছু নেই।
২৩ মার্চ ছিল পাকিস্তান দিবস। ৩১ বছর আগে এদিনে উপমহাদেশের মুসলমানদের জন্য পৃথক আবাসভূমির প্রয়ােজনীয়তা ব্যাখ্যা এবং সার্বভৌম রাষ্ট্র পাকিস্তানের দাবি করে লাহাের প্রস্তাব গৃহীত হয়েছিল। ৩১ বছর পর আমরা আমাদের স্বপ্ন ও তার ওপর নির্মিত স্বপ্নসৌধ ভেঙে চুরমার হওয়া প্রত্যক্ষ করতে যাচ্ছি। এ ঐতিহাসিক দিনে আমরা জাতীয় আবেগ প্রদর্শনের পরিবর্তে পাকিস্তানিদের প্রতি পাকিস্তানিদের ঘৃণা প্রত্যক্ষ করলাম। এদিনে জাতীয় বিজয়ানন্দের বদলে ছিল টানটান উত্তেজনা। সবচেয়ে বেদনাদায়ক ছিল সব ভবনশীর্ষে পাকিস্তানি পতাকা সগর্বে পতপত করে ওড়ার বদলে সরকারি ভবন, প্রতিষ্ঠানসমূহসহ সর্বত্র প্রথমবারের মতাে আমরা বাংলাদেশের জাতীয় পতাকা উত্তোলিত দেখলাম। এদিন বেসামরিক বাহিনী এবং পাকিস্তানের বাঙালি যুবকদের পাকিস্তানের শক্তি ও ক্ষমতা প্রদর্শন করে কুচকাওয়াজ করার বদলে আমরা স্থানীয় যুবকদের এবং নবসৃষ্ট বেসামরিক বাহিনীকে বাংলাদেশের সৈনিক হিসেবে সশস্ত্র কুচকাওয়াজ করতে দেখলাম। শেখ মুজিবুর রহমান স্বয়ং তাঁর বাসভবনে বাংলাদেশের পতাকা উত্তোলন করলেন।
আমরা যারা যৌবন থেকে পাকিস্তানের ভাবধারায় মন্ত্রমুগ্ধ ছিলাম এবং যারা স্বদেশে ও বিদেশে উভয়ত নিষ্ঠার সঙ্গে পাকিস্তানের সেবা করেছি, তাঁদের জন্য এটা এক বেদনাদায়ক দৃশ্য। ঘটনাবলি সত্যিই সময়ের সঙ্গে তাল রাখার চেয়েও দ্রুতগতিতে অগ্রসর হচ্ছিল। যেভাবেই হােক একটা সিদ্ধান্তে পৌঁছাতে হব। আমরা এক গিরিচূড়ার খাড়া পিঠে। আমাদের হয় পিছিয়ে আসতে হবে, না হয় সামনে এগিয়ে পতিত হয়ে ছিন্নবিচ্ছিন্ন হতে হবে। এটা আত্মােপলব্ধির মুহূর্ত, হিসাব-নিকাশের সময়। এটা এক ভয়াবহ বিষয় যে আমাদের দেশবাসীর ভাগ্য এবং ভবিষ্যৎ তিন জোড়া হাতে সমর্পিত এবং আল্লাহ তাঁর প্রজ্ঞায় আমাকে তাদের একজন মনােনীত করেছেন।
২৪ তারিখ সকালে আমি আবার প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও তার প্রধান স্টাফ অফিসার লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে দেখা করি। আমি তাকে বলি যে একটি মীমাংসায় উপনীত হওয়ার সময় সম্ভবত নিঃশেষ হয়ে। গেছে এবং বিনা বিলম্বে একটি সিদ্ধান্ত নেওয়া প্রয়ােজন। তাঁকে জানালাম, আমার কতিপয় দলীয় নেতাকে পশ্চিম পাকিস্তানে ফেরত পাঠানাে হয়েছে, যেহেতু আমি মনে করি যে এ চরম সংকটময় মুহূর্তে সেখানে তাদের উপস্থিতি জরুরি। এ ছাড়া শেখ মুজিবুর রহমানের অনড় ও অনমনীয় মনােভাবের দরুন আমার দলের অবশিষ্টদের ঢাকা অবস্থানে তেমন লাভ নেই। তবু আমরা থেকে যাওয়ার সিদ্ধান্ত নিলাম। কারণ, গােলাম মােস্তফা খারকে লােক মারফত জানানাে হয়েছিল যে ওই রাতে প্রহরীসহ তাঁকে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাৎ করতে নেওয়া হবে।
২৪ তারিখ রাতে শেখ মুজিবুর রহমানের সঙ্গে সাক্ষাতের সময় খার তাকে উত্তেজিত দেখতে পান। তিনি খারকে জানান, চট্টগ্রামে ভীষণ গােলযােগ হয়েছে, কিছুসংখ্যক সামরিক কর্মকর্তা বিশৃঙ্খল হয়ে পড়েছে। পরিস্থিতি বিস্ফোরণােন্মুখ হওয়ায় তিনি খারকে বলেন, আমি যেন অবশ্যই তার প্রস্তাবে একমত হয়ে পূর্ব পাকিস্তানকে তাঁর ও তাঁর জনগণের হাতে ছেড়ে দিয়ে পশ্চিম পাকিস্তানের প্রধানমন্ত্রী হই। খার শেখ মুজিবুর রহমানকে বলেন, তিনি এটা আমাকে অবহিত করবেন, তবে পাকিস্তানকে বিভক্ত করার প্রস্তাবে আমি সম্মত হব কি না, তাতে তিনি তার সন্দেহ প্রকাশ করেন। খার প্রস্থান। করার আগে মুজিবুর রহমান বলেন, তারা যােগাযােগ রক্ষা করবেন এবং ২৫ তারিখ রাতে সাক্ষাতের জন্য তাঁকে পুনরায় নিয়ে আসতে কাউকে পাঠানাে হবে।
জনাব তাজউদ্দীন আহমদের চূড়ান্ত শর্তসহ সর্বশেষ অগ্রগতি নিয়ে আলােচনা করার উদ্দেশ্যে ২৫ তারিখ সকালে আমাদের দলের সাধারণ সম্পাদক জে এ রহিম ও গােলাম মােস্তফা খারকে নিয়ে আমি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খান ও লেফটেন্যান্ট জেনারেল পীরজাদার সঙ্গে সাক্ষাৎ করি। ২৫ তারিখ অপরাহে প্রেসিডেন্টের সহকারীরা আওয়ামী লীগের চূড়ান্ত প্রস্তাবের ব্যাপারে আমাদের উপদেষ্টাদের অবহিত করেন।
আনুমানিক রাত আটটায় শেখ মুজিবুর রহমানের দূত খারকে নিতে আসেন। নতুন কোনাে অগ্রগতি সাধিত না হওয়ায় খার দূতকে বলেন, তার [দূতের] নেতাকে অবহিত করার মতাে নতুন কিছু তার (খারের কাছে নেই। সুতরাং সাক্ষাৎকার স্থগিত রাখাই শ্রেয়। ২৬ তারিখ সকালে করাচির উদ্দেশে যাত্রার আগে আমরা আবার প্রেসিডেন্টের সঙ্গে দেখা করতে পারি এবং যদি কোনাে উল্লেখযােগ্য অগ্রগতি থাকে, তবে আমরা থেকে যেতে পারি এবং ওই দিন সন্ধ্যায় তিনি আওয়ামী লীগ নেতার সঙ্গে দেখা করবেন। দূত অবশ্য খারকে জানান যে প্রেসিডেন্ট ইতিমধ্যে সন্ধ্যা সাতটায় ঢাকা ত্যাগ করেছেন। এটা সঠিক কি না, তা জানার জন্য আমরা প্রেসিডেন্ট ভবনে ফোন করি, যদিও এর সঠিকতা নিশ্চিত করতে পারলাম না।
এদিন সন্ধ্যায় শেখ মুজিবুর রহমান চট্টগ্রামসহ কয়েকটি স্থানে সামরিক বাহিনীর কার্যকলাপের প্রতিবাদে ২৭ মার্চ সাধারণ ধর্মঘটের ডাক দিয়ে একটি বিবৃতি দেন। আমার মনে পড়ে যে আমার সহকর্মীদের সঙ্গে এ নিয়ে আলােচনায় বলেছিলাম, এ রকম চরম সংকট মুহূর্তে এ ধরনের আহ্বান বিস্ময়করভাবে ভঙ্গুর, নাকি এটা ছিল ইচ্ছাকৃত ও পরিকল্পিত?
আনুমানিক রাত ১০টা ৩০ মিনিটের দিকে রাতের খাবার খাওয়ার পর আমরা কক্ষে গেলাম। এক ঘণ্টা পর গুলির আওয়াজে আমরা সচকিত হয়ে উঠি। কয়েকজন বন্ধু আমার কামরায় আসে। আমরা সেনাবাহিনীকে অভিযান চালনারত দেখলাম। তিন ঘণ্টা এ অভিযান প্রত্যক্ষ করলাম। কয়েকটি স্থানে অগ্নি প্রজ্বলিত হতে দেখা যায়। দ্য পিপল পত্রিকার অফিস গুঁড়িয়ে দিতে দেখা গেল। এই স্থানীয় ইংরেজি দৈনিকটি সেনাবাহিনী এবং পশ্চিম পাকিস্তানের বিরুদ্ধে স্কুল এবং অনিয়ন্ত্রিত প্ররােচনায় প্রশ্রয় দিয়ে আসছিল। দিগন্ত বহ্নিমান হওয়ার সঙ্গে সঙ্গে আমার চিন্তা অতীত ও ভবিষ্যতের দিকে মােড় নিল। আমাদের ভাগ্যে কী আছে, তা ভেবে বিস্মিত হই। এখানে চোখের সামনে। আমার নিজের মানুষের মৃত্যু ও বিনাশ দেখতে পেলাম। স্বাভাবিক চিন্তা করা কষ্টকর হয়ে পড়েছে। আমার মনে অনেক চিন্তার উদয় হচ্ছিল। আমরা কি এমন অবস্থানে চলে এসেছি, যেখান থেকে প্রত্যাবর্তনের আর কোনাে পথ নেই—অথবা সময়ের সঙ্গে সঙ্গে ক্ষত নিরাময়ের পর পাকিস্তানের ইতিহাসে এক নতুন অধ্যায়ের শুরু হবে? কী করে আশা করি যে এ প্রশ্নের জবাব আমার জানা।
২৬ তারিখ সকাল ৮টায় কর্নেল সাইদ আমাদের বিমানবন্দরে নিয়ে যেতে আসেন। হােটেলের লবি থেকে বেরিয়ে যাওয়ার সময় বিদেশি সাংবাদিকেরা চারদিক থেকে ঘিরে আমাকে কতগুলাে প্রশ্ন করেন। আমি জবাব দিতে অস্বীকার করি। বিমানবন্দরের পথে কর্নেল সাইদ জানান, শেখ মুজিবুর রহমানকে রাত ১টা ৩০ মিনিটে তাঁর বাসভবন থেকে গ্রেপ্তার করে বর্তমানে। সেনানিবাসের একটি স্কুলে আটক রাখা হয়েছে। আমি কর্নেল সাইদকে তার। সঙ্গে শােভনীয় আচরণ করতে বললাম। তাঁকে স্মরণ রাখতে বললাম, যা কিছু ঘটেছে এবং যা কিছু শেখ মুজিব সমর্থন করে থাকুন না কেন, তিনি একজন জননেতা এবং সম্মানিত ব্যক্তি। এটা লােকদেখানাের মতাে শােনালেও আমি। আন্তরিকতার সঙ্গেই কথাটি বলেছিলাম। কর্নেল সাইদ আশ্বস্ত করেন যে আওয়ামী লীগ নেতাকে ভালােভাবে দেখাশােনা করা হবে এবং যথাযথ সম্মান দেখানাে হবে। বিমানবন্দরে যাওয়ার পথে বাড়ির ছাদ থেকে বাংলাদেশের পতাকা নামিয়ে নিতে দেখলাম এবং রাস্তায় প্রতিবন্ধকতাও দেখলাম। ঢাকা ত্যাগের সময় পুনরায় আমাকে ভবিষ্যতের চিন্তা তাড়া করতে থাকে। প্রার্থনা করলাম, ঘটনার এ মােড় পরিবর্তন যাতে এক দীর্ঘায়িত অন্তর্ঘাতী সংঘাতে। পরিণত না হয়। প্রত্যাশা করলাম, সাধারণ মানুষের দেশপ্রেম যেন ওজস্বিতা নিয়ে পুনরাবির্ভূত হয় এবং দুঃস্বপ্ন ও ফ্যাসিজম তিরােহিত হয়।
পশ্চিম পাকিস্তানে আমাদের নিরাপত্তা নিয়ে যথেষ্ট উদ্বেগ ছিল। করাচি প্রত্যাবর্তনের পর এক কোলাহলমুখর জনতা সন্ধ্যা ৬টা ৩০ মিনিটে করাচি বিমানবন্দরে আমাদের স্বাগত জানায় এবং আমাকে বক্তৃতা দেওয়ার জন্য পীড়াপীড়ি করে। কিন্তু বক্তৃতাদানের মতাে মনের অবস্থা আমার ছিল না। তবু অবস্থা সামলে নিয়ে বললাম, অবশেষে আল্লাহর রহমতে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে। আন্তরিকভাবে আমি আশা ও প্রার্থনা করছিলাম যে আমি যেন সঠিক হই। ভবিতব্যই বলবে পাকিস্তান রক্ষা পেয়েছে না পরাজিত হয়েছে। তবে এটুকু নির্বিঘ্নে বলা যায় যে সরকার ২৫ মার্চ রাতে অভিযান শুরু না করলে পরদিন আওয়ামী লীগ বাংলাদেশের স্বাধীনতা ঘােষণা করত। এর জন্য সবকিছু প্রস্তুত রাখা হয়েছিল। তাদের সশস্ত্র প্রস্তুতি, শৃঙ্খলা বাহিনীগুলাের একত্রকরণ এবং রাস্তাসমূহে সৃষ্ট প্রতিবন্ধকতাগুলাে এর চাক্ষুষ প্রমাণ। ২৭ তারিখে আহূত সাধারণ ধর্মঘট স্পষ্টতই সরকারকে বিপদে ফেলার একটি কৌশল ছিল। তাদের উদ্দেশ্য ছিল ২৬ মার্চ শুক্রবার বাদ জুমা বাংলাদেশের স্বাধীনতার ঘােষণা দেওয়া।
২৬ মার্চ সন্ধ্যায় প্রেসিডেন্ট জাতির উদ্দেশে ভাষণ দেন। তিনি আমাদের দেশের হতভম্ব জনসাধারণকে জানান যে আওয়ামী লীগকে বেআইনি ঘােষণা করা হয়েছে, দেশের অবস্থা নিয়ন্ত্রণে না আসা পর্যন্ত সামরিক আইন কঠোর করা হবে। প্রেসিডেন্ট বলেন, পূর্ব পাকিস্তানে শেখ মুজিবুর রহমানের কার্যকলাপ দেশদ্রোহের শামিল। তিনি আওয়ামী লীগ নেতা ও তার দলকে পাকিস্তানের শত্রু হিসেবে আখ্যায়িত করেন, যারা পূর্ব পাকিস্তানকে পাকিস্তান। থেকে বিচ্ছিন্ন করতে চেয়েছিলেন। তিনি আরও বলেন, তাদের অপরাধের শাস্তি বিধান করা হবে। প্রেসিডেন্ট জনসাধারণকে আশ্বস্ত করেন যে যত তাড়াতাড়ি সম্ভব, পরিস্থিতি অনুকূল হওয়ামাত্রই গণতন্ত্র পুনরুদ্ধার করা হবে।
———————————————————————————————–
The Great Tragedy by Zulfikar Ali Bhutto, September 1971, Pakistan
অনুবাদ : মাহফুজুর রহমান সিদ্দিক
বাংলা অনুবাদ প্রকাশিত মতিউর রহমান সম্পাদিত বই ১৯৭১ : শত্রু ও মিত্রের কলমে
ইতিহাসের প্রতিটা বাঁকের সাথে সাথে কোন একটা দেশের মানুষের মন জগতের পরিবর্তন ঘটে, পরিবারগুলোর গঠন, রীতিরও পরিবর্তন হতে থাকে।
আমরা দেখি ১৯৪৭ এর পরের পরিবার আগের সময়ের মতন না। ১৯৭১ এর পরেরটা আগেরটার মতন থাকে নাই। এসবই আজকের মানুষের মন গঠনে খুব বড় ভূমিকা পালন করেছে। আজকের রাজনীতি গড়ে উঠেছে এই মনের গড়নের উপরে।
এমন যদি হোত ১৯৪৭ এর ভাংগা গড়ার মর্মান্তিক চিত্রটা অনুপস্থিত। দেশটাকে ১৯৭১ এর রক্তাক্ত সময় পার করতে হয় নাই। সমাজ চলেছে বহতা নদীর মতন ১৯০৫ এর বাংলার উপর দাঁড়িয়ে।
তবে বাংলার এই মানুষ আজ অন্য মানুষ হোত।
পতনের সময় সংবিধান ও নিয়ম ভাঙতে পারলে গঠনের সময় কেন নয়?
এটা এখন খুব চালু স্লোগান।
সরকার চালাচ্ছে যাঁরা তাঁদের জন্য একথা মানায় না। এটা সঠিকও না। গড়তে হবে নিয়ম মেনে। হতে পারে সেই নিয়ম প্রচলিত পচা নিয়ম বা নতুন কোন বিপ্লবী নিয়ম। বিপ্লবী কোন নিয়ম এখানে নেই এটা মাথায় রাখতে হবে। তাই পচা নিয়মের উপরেই ভরসা করতে হবে।
গড়াটা মজবুত ও টেকসই করার জন্য কিন্তু নিয়ম একটা লাগবেই।
আবেগ দিয়ে সরকার চলবে না।
বিচিত্রা ২২ জুন ১৯৭২
কাজী আনোয়ার হোসেন
ছেলেটাকে পিটিয়ে মারল লোকগুলো। এই সেগুন বাগানে, একশো চল্লিশ নম্বর বাড়ীর সামনে, রাজার তেমাথায়। গতকাল তেরই মে, শনিবার, বেলা বারোটায়।
দোষী মনে হচ্ছে আমার নিজেকে।
দোতালায় বসে লিখছিলাম। সকাল সোয়া দশটা। টাশশ করে একটা পিস্তলের আওয়াজ। তারপর হৈ চৈ। বারান্দায় বেরিয়ে দেখার চেষ্টা করলাম। গাছপালার জন্যে দেখা যাচ্ছে না। তিরিশ গজ দূরে রাস্তার ঐ তেমাথায় গোলমাল।
আবার এসে লিখতে বসলাম। কিন্তু চিৎকার বেড়েই চলেছে। আবার বারান্দায় এলাম। রাস্তার লোকজনকে জিজ্ঞেস করলাম, বলল—দুজন ডাকাত ধরা পড়েছে। খানায় ফোন করেই ক্যামেরা নিয়ে ছুটলাম, ছবি তুলব ডাকাতের।
দেড়শো-দুশো লোক জড়ো হয়ে মারছে। অনেককে জিজ্ঞেস করলাম—কি ব্যাপার? কেউ সঠিক কোন জবাব দিতে পারল না। আসলে কি হয়েছে কেউ জানেই না ঠিকমত! টুকরো টুকরো জানা গেল: বঙ্গবন্ধু এভিনিউয়ে কোন এক ব্যাঙ্ক লুট করে পালাচ্ছিল তিনজন হাইজ্যাক করা গাড়ী নিয়ে, ব্যাঙ্কে একজনকে গুলি করে মেরে রেখে এসেছে, বাধা দেয়ার চেষ্টা করায় একজন ট্রাফিক পুলিশকে গুলি করে হত্যা করেছে, পিছু ধাওয়া করেছিল পুলিশ—দিশে হারিয়ে রাস্তায় গাড়ী চাপা দিয়ে মেরেছে দুজনকে, কলেজ অব মিউজিকের সামনে একটা রিক্সাকে ধাক্কা মেরে উল্টে ফেলে দিয়ে গাড়ী থেকে নেমে দৌড় দিয়েছে, পালাবার সময় গুলি ছুড়েছে রিভলভারের, একজন পালিয়ে গেছে, বাকি দুজন ধরা পড়েছে, লোকজন মারছে ওদেরকে। কেউ বলল ওরা রাজাকার, কেউ বলল বিহারী, কেউ বা বলছে নক্সালাইট, আলবদর।
ঠেলাঠেলির মধ্যে আরেকটু এগিয়ে ছবি তুলতে শুরু করলাম। দেখলাম একজন সাদা ইউনিফরম পরা ট্রাফিক পুলিশ দাঁড়িয়ে আছে কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে। হাতে একটা রিভলভার।
এই নিরিবিলি এলাকায় এত লোক কোথা থেকে জড়ো হয়ে গেল বুঝতে পারলাম না। সবাই মারছে। ডাল ভেঙ্গে নিয়েছে কেউ কাঁঠাল গাছের, এরই মধ্যে মোটা একটা মুগুর সংগ্রহ করে ফেলেছে একজন কোথা থেকে। কিল, ঘুষি, লাথি, কনুই চলেছে এন্তার। উন্মত্ত হয়ে উঠেছে লোকগুলো। একটা কণ্ঠস্বর শুনা গেল—ছুরি লইয়া আয়, জবো কইরা ফালামু শালারে।
মারের চোটে রাস্তায় শুয়ে পড়ল সিদ্দিক। রোববারের কাগজ দেখে ওর নামটা জানতে পারলাম। নীল হয়ে গেছে মুখ, গা। কুঁকড়ে পড়ে আছে মাটিতে, থামছে না মার।
এদের প্রতি পাঠকের সহানুভূতি আনার চেষ্টা করছি না। আমি শুধু বলতে চাই, কেউ জানে না কেন ওদের মারা হচ্ছে। দিকবিদিক জ্ঞান হারিয়ে ফেলেছে সবাই। মেরেই চলেছে নেশাগ্রস্তের মত।
ক্যামেরার স্ট্র্যাপ ছিঁড়ে গেল ধাক্কাধাক্কিতে। ওদিকে প্রাণ বাঁচানোর তাগিদে পাঁচিল টপকে মহিলা পরিষদের অঙ্গনে লাফিয়ে পড়েছে অপর ছেলেটা। নাম ফারুক। ত্রিশ চল্লিশ জন ঢুকে পড়ল পিছু পিছু। শিলা বৃষ্টির মত পড়ছে কিল ঘুষি। আরো কয়েকটা লাকড়ি সংগ্রহ করে ফেলেছে জনতা, ততক্ষণ রক্তে ভেসে যাচ্ছে ফারুকের সর্বাঙ্গ। হঠাৎ দেয়ালের পাশে কয়েকটা কয়েকটা দশ ইঞ্চি ইটের সন্ধান পেল জনতা। তাই দিয়ে মারতে শুরু করল দমাদম।
ক্যামেরা হাতে আমাকে দেখে হয়ত ফারুক মনে করল আমি সাংবাদিক, হয়ত সাহায্য পাবে আমার কাছে। ছুটে এসে ঝাঁপিয়ে পড়ল আমার বুকে।
‘বাঁচান, ভাই। আমারে বাঁচান।’
চোখের একপাশ ফেটে গেছে, নাক মুখ দিয়ে রক্ত বেরোচ্ছে দরদর করে। সুন্দর, স্বাস্থ্যবান ছেলেটা—বিশ বছর বয়স হবে—বিবর্ণ হয়ে গেছে চেহারা, অসহায়, কাতর দৃষ্টি আমার মুখের ওপর। অসীম আকুতি ওর ওই দুই চোখে। হাঁপাচ্ছে। রক্তের ছোপ লেগে গেল আমার সার্টে, ঠিক বুকের কাছে। খামচে ধরেছিল, ছিঁড়ে গেল গেঞ্জিটা টান লেগে। ছিনিয়ে নিয়ে গেল ওকে ক্রুদ্ধ জনতা।
পারলাম না। বাঁচাতে পারলাম না আমি ফারুককে। নিজের চুল ছিঁড়তে ইচ্ছে করছে এখন। আমি জানতাম না মারা যাবে ছেলেটা। তখন বুঝতে পারলে হয়ত চিৎকার করে মানুষকে বোঝাবার চেষ্টা করতাম, বলতে পারতাম—বিচার পাওয়ার অধিকার আছে ওর। হয়ত আমার কথা শুনত কেউ কেউ। হয়ত কিছুটা কমত মারের পরিমাণ। অনেক কিছুই মনে হচ্ছে এখন। যদি বলতাম, ঠিক আছে, কে কে মারতে চাও, এসো, কিন্তু মরে গেলে দায়ী হতে হবে তোমাদের—যদি বলতাম, খবর্দার কেউ ওর গায়ে হাত দেবে না, পুলিশের হাতে জ্যান্ত তুলে দিতে হবে ওকে পুরো দলের খবর বেরোবে ওর কাছ থেকে—কিম্বা সত-আট জন লোক সংগ্রহ করে নিয়ে যদি রুখে দাঁড়াতাম, দু-চার ঘা পড়ত আমার পিঠে, কিন্তু তাহলে হয়ত বেঁচে যেত ছেলেটা। কার না জানি চোখের মণি।
অনেক কিছুই তাবছি এখন, অনেক কিছুই করা যেত, কিন্তু কিছুই করতে পারিনি। মেরে যে ফেলবে, একথা ভাবতেই পারিনি আসলে। ভেবেছি, নিশ্চয় কিছু একটা দোষ করেছে, আমি জানি না, কিন্তু যারা মারছে তারা কি কিছুই না জেনে মারছে। ভেবেছি, পুলিশ আসছে, পুলিশের হাতে তুলে দিলেই ঝঞ্জাট শেষ। নিষ্ক্রিয় দর্শকের ভূমিকা পালন করেছি আমি। দায়িত্বজ্ঞানহীনের কাজ করেছি। রাত আড়াইটা-তিনটা পর্যন্ত ফটোগুলো ডেভেলপ ও প্রিন্ট করে পরদিন এ নিয়ে লিখতে বসলেই এ অপরাধ বোধ থেকে মুক্তি পাওয়া যায় না। কিছু না কিছু চেষ্টা করা উচিত ছিল আমার।
এলো পুলিশ। কিন্তু তখনো মেরে চলেছে ওরা। কাছে এগোনো যাচ্ছে না ভিড় ঠেলে। মনে হল, ক্ষিপ্ত জনতার হাবভাব ঠিক বুঝতে না পেরে দৃঢ় ভূমিকা গ্রহণ করতে দ্বিধা করছে পুলিশ। দেখলাম পুলিশের সামনেই টেনে-হিঁচড়ে মহিলা পরিষদের সিঁড়ি থেকে রাস্তায় নামিয়ে আনছে ওরা ফারুককে।
ভাবলাম, তবু পুলিশ নামের গুণ আছে, অবস্থা আয়ত্তে আনতে অসুবিধে হবে না। হাঁপ ছেড়ে ফিরে এলাম বাসায়। মিনিট দশেক পরই ছুটে এল নীচতালার চাকরটা। বলল—মেরেই ফেলেছে একজনকে।
‘কীভাবে মারল? পুলিশ কি করছে?’
একটাকে নিয়ে চলে গেছে পুলিশ। আর আরেকটাকে (ফারুক) নিতে পারেনি। দম ছিল কিছুটা, গলায় পা দিয়ে দম বের করে দিয়েছে লোকেরা।
ছুটলাম আবার।
মরে পড়ে আছে ফারুক। পরনে শুধু জাঙ্গিয়া। সার্ট খুলে নিয়ে গেছে কেউ। প্যান্টটা কেন হাঁটুর নীচ পর্যন্ত টেনে নামান হয়েছে বোঝা গেল না। রাস্তার ওপর চিৎ হয়ে পড়ে আছে লাশটা। পাশে পড়ে আছে ছেঁড়া একটা কাঁঠাল পাতা।
বুকটা ধরে আসতে চায়। অন্যায় করেছি আমরা ফারুকের উপর। যত দোষই করে থাকুক, থানা আছে, পুলিশ আছে, আইন আছে, আদালত আছে—আমার আপনার মতই বিচার পাওয়ার অধিকার ছিল ওর। এমন একটি জনতা ওর বিচার করল, আসল ঘটনা সম্পর্কে যাদের স্পষ্ট কোন ধারণাই নেই। এর নাম জনতার বিচার।
পুলিশ সূত্রের উল্লেখ করে আসল ঘটনাটা ছাপা হয়েছে রোববার এই পত্রিকাতেই। আপনি নিশ্চয়ই পড়েছেন? জানা গেল: ব্যাঙ্ক লুট করেনি ওরা, গাড়ীটা হাইজ্যাক করা কি না তাতে সন্দেহ আছে, ব্যাঙ্কের কাউকে গুলি করে খুন করেনি ওরা, ট্রাফিক পুলিশ নিহত হয়নি ওদের গুলিতে, এবং রাজাকার বা আলবদরের কেউ ছিল না ওরা। ব্যাপারটা অন্য কিছু।
স্বাধীনতার পর দ্রব্যমূল্য অনেক বেড়েছে, প্রাণের মূল্যই কি শুধু কম থাকবে?
শিক্ষার্থীরা, দ্রুতই রাজনীতির প্রধান শক্তি হয়ে সামনে আসুন।
ছাত্র জনতার সফল আন্দোলনের পর সরকার গঠন নিজে করলেন না, তবু করালেন। কিন্তু আপনারাতো আজ নীরব সুশীল হয়ে লুকিয়ে আছেন।
সরকারকে কার হেফাজতে রাখলেন? সেনাবাহিনী? নাকি অরক্ষিত?
এখন বিএনপি জামাতের গ্রিন সিগন্যাল ছাড়া কমিশন সদস্য বাড়াতে পারছেনা। কিছু দলের মাঠের হম্বিতম্বি তে শিক্ষা কমিটি বাতিলই করে দিল?
শিক্ষার্থীরা, আপনারা মাঠ ছেড়ে দিচ্ছেন কেন? আপনাদের সাথে মানুষ থাকবে, যেমন করে আগেও ছিল।
“বিপ্লব” করলেন আপনার ভ্যানগার্ড কোথায়? আপনার ব্রিগেড কোথায়? “বিপ্লব” করলেন আপনি আর ওইটা পাহাড়া দিবে অন্যজন। এটা কখনো হয় নাকি?
আগস্টের ৫ তারিখে আপনাদের কি দুর্দান্ত অথোরিটি? সামরিক বাহিনীর প্রধানকে সরকার গঠনের উদ্যোগকে জনগণের সামনে প্রকাশ্যে ফিরিয়ে দেন। একটা রাগী, নিজ শক্তির গর্বে উজ্জীবিত সামরিক বাহিনী বিনা বাক্যব্যায়ে তা আবার মেনে নেয়।
কেন? কারণ আপনাদের পিছনের শক্তিটাকে পরিমাপ করে।
কয়েকঘন্টার মাঝে সুপ্রিমকোর্টের কাজ বন্ধ করে দিয়ে সেদিনেই তাদের নামিয়ে দেয়া, এগুলোতো বিপ্লবের ক্লাসিক্যাল উপাদান।
আনসার দমন, বন্যার ত্রানে মানুষকে জাগিয়ে তোলা – এগুলো সব দুর্দান্ত নজীর। সমাজের অন্য সব শক্তি আপনাদের পিছনের শক্তির সামনে মাথা নত করে আছে। সবার মানে পতিত আওয়ামীলীগ, ভারত, সামরিকবাহিনীর, বিএনপি জামাত, সবার একটাই টেনশন।
আপনাদের পিছনের শক্তিকে যদি আপনারা একটা দলীয় কাঠামোর মাঝে সংঘবদ্ধ করে ফেলেন। এটা হবে সবার জন্য সর্বনাশ।
যাই হোক। সবার সম্মিলিত চেষ্টায় আপনাদের রাশটা কিছুটা টেনে ধরতে পেরেছে।
যখন কোন বই কেনার কথা ভাবি দেশে বিদেশে যেখানেই থাকি অনলাইনে অর্ডার করে ফেলি। ঢাকায় আমার কাজের ঠিকানায় ডেলিভেরি দেয়।
বইটা হাতে পেয়ে প্রথম কাজ হয় পিডিএফ করে আমাকে জানিয়ে দেয়া যে বইটা আমার পড়ার জন্য অনলাইনে দিয়ে দেয়া হয়েছে।
ছাপানো বইটার ডেলিভারী হাতে পাবার ২/৩ ঘণ্টার মাঝেই আমি পড়তে পারি সে আমি এয়ারপোর্ট বা হোটেল বা দূরের কোন ভ্রমনেই থাকিনা কেন।
এভাবে আমার একটা অনলাইন লাইব্রেরি গড়ে উঠেছে। চাইলে আপনিও বই পড়তে পারেন।
সমন্বয়ক আবদুল কাদের
কোটা সংস্কারকে উদ্দেশ্য করে আন্দোলন গড়ে উঠেছিল; কিন্তু সরকার পরিস্থিতি ঘোলাটে করলে আন্দোলন ভিন্ন দিকে মোড় নেয়। তারই ধারাবাহিকতায় নয় দফার অবতারণা হয়।
আমরা শান্তিপূর্ণভাবে কর্মসূচি চালিয়ে যাচ্ছিলাম; কিন্তু ১৬ তারিখ মঙ্গলবার আবু সাঈদ সহ ৬ জন যখন শহীদ হয়, ঐদিন রাত ১২ টায় সামনের সারির সমন্বয়করা মিলে আমরা একটা অনলাইন মিটিং করি। মিটিং-এ প্রথম এজেন্ডা-ই ছিল, আজকে যে ছয়জন শহীদ হইলো, এই ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার কি না? তখন সবাই হই হই করে বলে উঠে, ছয়টা লাশের বিনিময়ে শুধু কোটা সংস্কার হতে পারে না। পরবর্তীতে দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা করা হয়। এই আলোচনায় স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগের দাবিসহ আরো কিছু দাবি দাওয়া উঠে আসে। বলে রাখা ভালো, আমরা এতোদিন “বাংলা ব্লকেড” থেকে শুরু করে রাষ্ট্রপতির কাছে স্মারকলিপি পেশ সহ নানান সফট এবং হার্ড কর্মসূচী নিয়ে মাঠে অবস্থান করেছিলাম; কিন্তু সরকারের পক্ষ থেকে একেবারে নির্বিকার-নির্লিপ্ত মনোভাব পরিলক্ষিত হয়েছিল। আলাপ-আলোচনার দ্বারধারে নাই সরকার, কেবল হাইকোর্টে কাঁধে বন্দুক রেখে চুপচাপ দেখে যাচ্ছিল। কিন্তু পরিস্থিতি যখন বেগতিক হয়ে যায়, ৬ জন শহীদ হয়, ঐদিনই সরকার আলোচনার জন্য তোড়জোড় শুরু করে দেয়, আমাদেরকে বিভিন্ন মাধ্যমে চাপ দিতে থাকে আলোচনায় বসার জন্য। কিন্ত আমরা আলোচনার আহ্বানকে বারাবরের মতোই প্রত্যাখ্যান করে নিজেদের দৃঢ় অবস্থান প্রকাশ করি। যদিও ভিতর বাহির থেকে আলোচনায় বসার নানারকম চাপ আসছিল।
সরকার সংলাপের আহবান ফরমালি জানিয়েছিল কিন্ত সেটার প্রেক্ষিতে আমরা আমাদের অবস্থান ফরমালি ক্লিয়ার করি নাই। ক্লিয়ার করার সুযোগও পাই নাই। বুধবার গায়েবানা জানাযায় ঢাবি ক্যাম্পাসে পুলিশ আমাদের উপর গুলি চালায়, আমি সহ কয়েকজন আহত হই। হান্নান মাসউদ গুলিবিদ্ধ হয়। তখন থেকেই আমরা আন্দোলন পরিচালনা করে যাবার স্বার্থে কৌশলী অবস্থান নিয়ে গ্রেফতার এড়ানোর সিদ্ধান্ত নেই। যদিও সরকারের সংলাপকে প্রত্যাখ্যান করে মঙ্গলবার রাতে আমরা কিছু দাবি দাওয়া ঠিক করেছিলাম কিন্তু পরবর্তীতে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করে যে সেই দাবিগুলো ফাইনাল করবো সে সময় পাইনি। তবে আমরা বৃহস্পতিবার মাঠের কর্মসূচি ( কমপ্লিট শাটডাউন) দিয়ে নিজেদের অবস্থান ক্লিয়ার করেছিলাম।
বৃহস্পতিবার আমি আর আসিফ ভাই এক বাসা থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে ভিন্ন ভিন্ন গন্তব্যে চলে যাই। ঐদিন ১৮ তারিখ রাতেই ইন্টারনেট বন্ধ করে দেয় সরকার। আমরাও কর্মসূচি চলমান রাখতে, গ্রেফতার এড়াতে বার বার জায়গা পরিবর্তন করে বেড়াচ্ছি। কারো সাথে তেমন কোনো যোগাযোগ করতে পারতেছি না।
আন্দোলনের শুরুতেই নাহিদ ভাই আমাকে ডেকে নিয়ে এক লোকের সাথে মিট করায় এবং পরবর্তীতে আন্দোলনের পারপাসে একাধিকবার ঐ লোকের সাথে যোগাযোগ হয়; পরবর্তীতে জানতে পারি তিনি ঢাবি শিবিরের ছাত্র আন্দোলন বিষয়ক সম্পাদক ছিলেন। কিন্ত তখনও শিবিরের সভাপতি এবং সেক্রেটারির সাথে ঐভাবে যোগাযোগ হয় নাই।
শুক্রবার যাত্রাবাড়ি এলাকায় যখন আন্দোলন করছিলাম তখন শিবিরের ঢাবি সেক্রেটারি ফরহাদ ভাই আমাকে ফোন দিয়ে বলল- “আন্দোলনরত কয়েকজন সমন্বয়ক সরকারের মন্ত্রীদের সাথে আলোচনায় বসতে যাচ্ছে, এতো এতো শহীদের রক্তের সাথে বেইমানী করতেছে তারা। আন্দোলন শেষ হয়ে যাবে। কিছু দাবি-দাওয়া দিয়ে আন্দোলন চালিয়ে যেতে হবে, মানুষের সাথে বেইমানি করা যাবে না।”
আমি সম্মতি জানাই। আমাদের তো আগেই অবস্থান ছিল আন্দোলন চালিয়ে যাওয়ার। তাছাড়া মঙ্গলবার রাতের মিটিংয়ে ঠিক করা কিছু দাবি দাওয়া আমার মাথায় আছে।
আন্দোলন চালিয়ে নেয়ার মতো মাঠে কোনো সিনিয়র নাই। আসিফ-নাহিদ ভাইকে গুম করে রেখেছে। আমি সাত-পাঁচ না ভেবে রিস্ক নেওয়ার সিদ্ধান্ত নিই। ঐদিন জুমার নামাজের পর পরই যাত্রাবাড়ীতে কয়কজন শহীদ হয়, সবগুলা আমার চোখের সামনেই ঘটতেছে। মানুষকে পাখির মতো গুলি করে মেরে ফেলতেছে, এটা আমি কোনোভাবেই মেনে নিতে পারতেছিলাম না। তাছাড়া দীর্ঘদিন জেল-জুলুম, হামলা-মামলার শিকার হয়ে হাসিনার এমন অবিচারের বিরুদ্ধে কথা বলে গেছি; মাথা নত করি নাই। আমার পরিণতি কি হবে, সেটা ঘুনাক্ষরেও কল্পনা করি নাই। চোখের সামনে মানুষ মেরে ফেলতেছে, মানুষের কথা চিন্তা করে নিজের জীবনের কথা ভাবার সময় পাই নাই। গত ৪/৫ বছর ক্যাম্পাসে ছাত্রলীগ, ফ্যাসিবাদের বিরুদ্ধে দীর্ঘ লড়াই আমাদেরকে দৃঢ়তা ধরে রাখার শিক্ষাই দিয়েছে। দেশের এই ক্রান্তিলগ্নে হাল ধরার সিদ্ধান্ত নিই।
যাইহোক, কিছুক্ষণ বাদে শিবিরের সেক্রেটারি আমাকে আবারও ফোন দিল। বলতেছে, “কিছু দাবি দাওয়া খসড়া আকারে করছি, তোমার সাথে আলোচনা করি”৷ আমাদেরও যেহেতু আগেই আলোচনা হয়েছিল অনেকগুলো দাবির ব্যাপারে সেগুলো তখন উনার সাথে আলোচনা করে সমন্বিত ভাবে তৈরী হয় ৯ দফা।
তিনি একে একে কিছু দাবি বললেন। যেগুলা খুব কমন দাবিদাওয়া- যেমন: স্বরাষ্ট্রমন্ত্রীর পদত্যাগ, ছাত্র হত্যার সাথে জড়িত পুলিশ প্রশাসনকে বরখাস্ত, সন্ত্রাসীদের বিচারের আওতায় আনা, ভিসি’র পদত্যাগ। যেগুলা ৬ জন শহীদ হওয়ার পরে মঙ্গলবার রাতের বৈঠকের আলোচনাতেই আমরা ভেবেছিলাম। এছাড়া মানুষজনও সোশ্যাল মিডিয়ায় এমন কিছু দাবিদাওয়া জানিয়ে আসছিল। শেষের দিকে গিয়ে শিবিরের সেক্রেটারি একটা দাবি এড করল- “ক্যাম্পাসে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে” এটা আমি মানি নাই, দীর্ঘক্ষণ আলাপ আলোচনা হইলো। পরে আমি বললাম, ঢালাওভাবে ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করা যাবে না, এক্ষেত্রে লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধের কথা বলতে পারেন। পরে সেটাই ঠিক হইলো- “লেজুড়বৃত্তিক ছাত্ররাজনীতি নিষিদ্ধ করতে হবে”
এই হইলো নয় দফা তৈরির পেছনের গল্প। তবে নয় দফা প্রচার প্রসারে গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা রেখেছিল শিবির। যেহেতু নেট নাই, গোলাগুলি-কারফিউ’র মধ্যে জীবনের ঝুঁকি নিয়ে সশরীরে হাউজে হাউজে পৌঁছে দিয়েছে, বিদেশি সাংবাদিকদের কাছে পৌঁছানোর ব্যবস্থা তারাই করেছে।
আমাকে নতুন একটা সীম এবং মোবাইল কালেক্ট করার পরামর্শ দিল তারা। আমি স্টুডেন্ট এর বাসা থেকে সীম নিয়ে ঐ নাম্বারটা নয় দফা সংবলিত প্রেস বিজ্ঞপ্তির সাথে দিয়ে দিলাম। ঐদিন সন্ধ্যায় বাসা থেকে ৪-৫ কিলো দূরে হেটে গিয়ে পরিচিত সাংবাদিকদেরকে ফোন দিয়ে নয় দফার বিষয়টা জানাইলাম। টুকটাক ছাত্র রাজনীতি করার সুবাদে ক্যাম্পাসের সাংবাদিকদের সাথে আমার পরিচয় ছিল। তো ঐ রাতে তাদের অনেককে একটা একটা করে দফা বাটন ফোন দিয়ে ম্যাসেজের মাধ্যমে দাবিগুলা লিখে পাঠাইছি। পুরা নয়টা দাবী একসাথে ম্যাসেজে পাঠানো যায় না। কাউকে আবার মুখে বলে দিছি, সে লিখে নিছে। কেউ আবার রেকর্ড করে নিছে। কনফার্ম হওয়ার জন্য অনেকেই ফোন দিছে, এটা আসলেই আমি দিছি কি না। বিদেশি সংবাদমাধ্যমগুলাকেও ফোন দিয়ে কনফার্ম করা লাগছে, ‘আমার পক্ষ থেকে এটা যাচ্ছে, আপনাকে একজন পেনড্রাইভের মাধ্যমে পৌঁছে দিবে।’ এইভাবে চলল রাতের ১১ টা পর্যন্ত।
প্রতিদিন রাতের বেলায় বাসা থেকে দূরে চলে যেতাম। ফোন অন করে সাংবাদিকদের সাথে ২-৩ ঘন্টা কথাবার্তা বলে, তাদেরকে কনফার্ম করে, ফোন বন্ধ করে আবার বাসায় ফিরতাম। সিনিয়ররা গুম অবস্থায় ছিল, ইন্টারনেট বন্ধ থাকায় যোগাযোগ করা যাচ্ছিলো না বাকিদের সাথেও। এইভাবেই চলতে থাকলো। আমার বাসা ছিল যাত্রাবাড়ী থানার পাশেই। গ্রেপ্তারের আতঙ্ক, তারপরও বাসায় থাকতে হতো। শুরুতেই যাওয়ার
কোনো জায়গা ছিল না। কোনো রাত মসজিদে কাটাইছি, কোন রাত অর্ধেকটা বাহিরে কিংবা বাসার ছাদে কাটিয়ে শেষ রাতে বাসায় ফিরেছি।
এইতো ঐতিহাসিক নয় দফা, আমাদের নয় দফা,
ফ্যাসিস্ট হাসিনা থেকে মুক্তি লাভের সনদ!
২২ সেপ্টেম্বর ২০২৪, শনিবার।
https://www.facebook.com/permalink.php?story_fbid=pfbid0mQ4NKscFNVU6L7fW6rCdmBvgSXgDpXC8wQmN8Zb2FbEUthYwPa1eQmpA1xzGGXEtl&id=100013950997233
The man in the middle is Mahfuj Abdullah.
You can say he was the brains behind the Student Revolution. Mahfuj is known for his addabaji and erudition.
He knows about every political group and the political settlements we had since the Partition of British India.
He knows the mental make-up of every political leader in the country.
He has encyclopaedic knowledge of political events and why they succeeded or failed.
I know Mahfuj for over four years. He did a short journalistic stint while he was still a student of law at Dhaka University. His friends including Akhter Hossen or Akram Hossain, pictured here, were heavily involved in the student protest of 2018. Mahfuj was close involved but did not belong to any party. When Akhter and Nahid Islam, the face of the movement, launched Gonotantrik Chhatra Shakti ( Democratic Student Force), Mahfuj took an active interest in the party. They wanted to build a student movement free of any political connection.
When the High Court restored the quotas, Mahfuj, Akhter, Nahid, Asif and Baker Majumder saw the opportunity to organise a successful movement. Newly married Akhter stepped back for his legal practice. Mahfuj became the chief strategist. Nahid and Asif the faces of the movement and Baker the main organiser. But instead of turning the GCS the main frontliners of the movement, Mahfuj and the three came up with the idea to create an umbrella group called the Students Against Discrimination( SAD).
I met Mahfuj early in July when they just launched the Bangla Blockade protests. Mahfuj was hugely euphoric about the success. He wanted to bring in the women and they were pouring in from all corners. At a Shahbagh rally, he told me: Bhai, we came to Shahbagh today. Next month we will be in the Ganobhaban.” He kept his word, but it came five days later. But students said it happened on the 36th July.
Mahfuj’s big strategy was to fix the language of the movement. He worked aggressively to bring disparate group of protesters under the fold. He helped select more than 55 coordinators of SAD. The idea was that if Nahid or Asif or Sargis or Hasnat were arrested, there would be enough people to take the movement forward. They dropped any Islamist keaning student from the list of coordinator or anyone from the JCD, the student group of the BNP, so that the government and the ruling party can’t portray the SAD as a pro-BNP or pro-Jamaat group.
Mahfuj and Nasir Abdullah, a former Chhayra Federation chief, also kept the leftist student groups at bay. There are overwhelming perception among the centrist student that leftists are the B team of the BCL, the student group of the then ruling Awami League party. Only after the movement got some traction and widespread popularity that they brought the leftist groups into the movement. The Islamist students joined the movement only in the last three days of the protests.
In my last write-up about the SAD, I didn’t mention Kahguj’s name because of the pervasive fears that he will be arrested. His friend Akhter was arrested very early and Mahfuj was needed to show the direction from behind the scene. Mahfuj too went into hiding, changing homes every day. He also employed posse of people to ensure that the news of the movement and its every action plan are spread to social media and the local media.
After the overthrow of Hasina, Mahfuj also played a big role in the formation of the interim government. He was in the student negotiation team which held talks with the army chief and the president. Behind the scene they were also holding talks with all the political parties except Awami League to bring acceptable people to the interim government cabinet. Mahfuj thinks his job is still not done. They want to push crucial reforms to restore democracy and create institutions that ensure check and balance in the state. They also want to document every murder committed by Hasina’s security forces during the student carnage.
Right now, Mahfuj wants to get married and complete his masters in law. He is still worried about his security. When I called him at around 1pm, he said he just woke up after a long sleep. “I can see we have a long and hard journey ahead,” he said. “But first I need some sleep”
———–
By Shafiqul Alam, Ex AFP
Lee Kuan Yu wrote in the chapter Inside the Commonwealth Club of his book From third world to first The Singapore Story 1965-2000 about his experience during Ottawa meeting of Commonwealth Countries in 1973 .
Another person I remember from the Ottawa meeting was Prime Minister Sheikh Mujibur Rahman, the hero who had opposed Pakistan and led East Pakistan to independence as Bangladesh. He arrived in style at Ottawa in his own aircraft. When I landed, I saw a parked Boeing 707 with “Bangladesh” emblazoned on it. When I left, it was still standing on the same spot, idle for eight days, getting obsolescent without earning anything. As I left the hotel for the airport, two huge vans were being loaded with packages for the Bangladeshi aircraft. At the conference, Mujibur Rahman had made a pitch for aid to his country. Any public relations firm would have advised him not to leave his special aircraft standing for eight whole days on the parking apron. The fashion of the time was for leaders of the bigger Third World countries to travel in their own aircraft. All leaders were equal at the conference table, but those from heavyweight countries showed that they were more equal by arriving in big private jets, the British in their VC 10s and Comets, and the Canadians in Boeings. The Australians joined this select group in 1979, after Malcolm Fraser’s government purchased a Boeing 707 for the Royal Australian Air Force. Those African presidents whose countries were then better off, like Kenya and Nigeria, also had special aircraft. I wondered why they did not set out to impress the world that they were poor and in dire need of assistance. Our permanent representative at the UN in New York explained that the poorer the country, the bigger the Cadillacs they hired for their leaders. So I made a virtue of arriving by ordinary commercial aircraft, and thus helped preserve Singapore’s Third World status for many years. However, by the mid-l 990s, the World Bank refused to heed our pleas not co reclassify us as a “High Income Developing Country,” giving no Brownie points for my frugal travel habits. We lost all the concessions that were given to developing countries
Canadian Prime Minister Pierre Trudeau was the chair of the 2nd C’wealth Head of Govenment Conference held on 2 to 10 August 1973 .
Bangladesh and Bahama were integrated in the ornganisation after their libertaions. B’Desh enterded within 18 months of her independence.
On March 4, 1972, Biman spread its wings to international destinations with a weekly flight to London using a Boeing 707 chartered from British Caledonian.
.
১৯৭০ এর সাধারন নির্বাচনের একটা প্রধান টাস্ক ছিল পাকিস্তানের জন্য সংবিধান প্রণয়ন করা। তার সময় সীমা বেধে দেয়া হয় প্রথম অধিবেশন থেকে ১২০ দিন। নির্বাচনে আওয়ামীলীগ সংখ্যাগরিষ্ঠ প্রাপ্ত আসনের অধিকারি হিসাবে দ্রুতই সংবিধান প্রনয়নের কাজে নেমে পরে।
৩ জানুয়ারী ১৯৭১ ঢাকার রেসকোর্স মাঠে আওয়ামীলীগের বিশাল জনসভা অনুষ্ঠিত হয়। এ জনসভায় ৬দফা ও জাতির আত্মনিয়ন্ত্রণ অধিকারের প্রশ্নে নবনির্বাচিত জাতীয় পরিষদ ও প্রাদেশিক পরিষদের সদস্যদের গণশপথ গ্রহন করানো হয়। এ শপথ অনুষ্ঠানের কিছুদিন পরেই আওয়ামীলীগ সংসদীয় কমিটি সংবিধান রচনার উদ্দেশে একটি সাবকমিটি গঠন করে।
১ মার্চ ১৯৭১ সকালে আওয়ামীলীগ কেন্দ্রীয় কমিটির সভায় সংবিধান সাব কমিটি তাদের রচনা করা খসড়া সংবিধান পেশ করে। এই বৈঠকে পাঞ্জাবের মালিক সরফরাজ সহ পশ্চিম পাকিস্তানের কয়েকজন নেতা উপস্থিত ছিলেন।
কেন্দ্রীয় কমিটি খসড়া সংবিধানের অনুমোদন দেয় এবং শেখ মুজিব খসড়াটির প্রয়োজনীয় পরিবর্তন ও পরিবর্ধনের জন্য সংসদীয় কমটিকে দায়িত্ব দেয়।
২৩ মার্চ ১৯৭১ সন্ধ্যায় শেখ মুজিবর রহমানের পক্ষ থেকে খসড়া সংবিধানটি প্রেসিডেন্ট ইয়াহিয়া খানকে পেশ করা হয়। প্রেসিডেন্টের পক্ষ থেকে জানানো হয় যে খসড়ার মুল অংশ তাদের কাছে গ্রহনযোগ্য হয়েছে ও পরবর্তী বৈঠকে সিদ্ধান্ত চূড়ান্ত করা হবে। তার দুদিনের মাঝে ২৫ মার্চ সন্ধ্যায় সামরিক সরকার তাদের অপারেশন সার্চ লাইট শুরু করে এবং পাকিস্তানের সংবিধান নিয়ে কোন বৈঠক হয় নাই।
Draft CONSTITUTION OF THE FEDERAL REPUBLIC OF PAKISTAN (1971)
Preamble
In the name of Allah, the Beneficent, the Merciful, We, the peoples of the autonomous States of Bangla Desh, the Punjab, Sind, Pakhtunistan and Baluchistan,
Having by our common struggle against colonial rule attained the right of self determination,
In order to secure for ourselves and for our posterity the right to live in freedom and with
dignity and to establish a real, living democracy, wherein equality and justice, political, economic and social, would prevail,
Having had to struggle, since independence, against successive susrpers of the power, which rightfully belonged to the people,
Having now attained victory, as a result of the heroic sacrifices of the martyrs who laid down their lives in order to end exploitation of man by man, and region by region,
Resolving that the high ideals for which they laid down their lives shall be fundamental principles of the Constitution,
Further resolving that guarantees shall be embodied in this Constitution to enable the peoples of Pakistan, Muslims, Hindus, Buddhists, Christians Persians and of other religions to profess and practise their religion and to enjoy all rights, privileges and protection due to them as citizens of Pakistan, and in pursuance of this object to enable the Muslims of Pakistan, individually and collectively, to order their lives in accordance with the teachings of Islam as set out in the Holy Quoran and the Sunnah,
Affirming that the Constitution shall effectively guarantee supremacy of civil power, exercised through elected representatives of the people, over the armed forces and all military authorities;
Solemnly pledging that it is our sacred duty to abide by and to safeguard, protect and defend this Constitution and to maintain its supremacy, as the embodiment of the will of the people and the basis, freely determined by them, for living together in a federal State and striving together so that we may prosper and obtain our rightful place amongst the nations of the world and make our full contribution towards international peace and the progress and happiness of humanity..
IN THIS ASSEMBLY, this is and seventy-one, corresponding to the ……..day of……………. One thousand nine-hundred day of……….. 1391 Α. Η. and the…………… day of 1377 B.S., WE DO HEREBY ADOPT, ENACT AND GIVE TO OURSELVES THIS CONSTITUTION.
PART I-THE FEDERAL REPUBLIC AND ITS TERRITORIES.
The Republic and its territories
1 (1) Pakistan shall be a Federal Republic under the name of Federal Republic of
Pakistan, and shall be composed of the autonomous States of Bangla Desh, Punjab, Sind, Pakhtunistan and Baluchistan, and such other territories as may become included in
Pakistan, whether by accession or otherwise.
(2) The territories of each of the States as are included in Pakistan are specified in the
First Schedule.
Alteration of territories of States.
2. No bill providing for altering the limits of a State or increasing or diminishing the area of any State shall be introduced in the Federal Parliament, unless it has earlier been approved by the Assembly of the State concerned by the votes of not less than two-thirds of the total members of that Assembly.
PART III- DIRECTIVE PRINCIPLES OF STATE POLICY
1. ISLAM
(1) No law shall be repugnant to the injunctions of Islam as laid down in the Holy Quoran and Sunnah.
(2) Facilities shall be provided for the teaching of the Holy Quoran and Islamiat to the Muslims of Pakistan.
(3) Observance of Islamic moral standards should be promoted amongst the Muslims of Pakistan.
II- RIGHTS OF MEMBERS OF OTHER RELIGIOUS DENOMINATIONS
Members of all other religious denominations shall enjoy full rights of citizenship and in addition to the constitutional protection of their fundamental rights, their legitimate rights and interest shall be duly safeguarded in all spheres.
IIL ESTABLISHMENT OF A SOCIALIST ECONOMIC SYSTEM WITH A VIEW TO ACHIEVING A SOCIETY FREE FROM EXPLOITATION.
With a view to achieving a just and egalitarian society, free from exploitation of man by man, and of region by region, a socialist economic system shall be established.
IV. STATES RESPONSIBILITY TO ENSURE BASIC NECESSITIES OF LIFE, EMPLOYMENT, IMPROVEMENT IN THE STANDARD OF LIVING, AND SOCIAL SECURITY.
It shall be a fundamental responsibility of the State to ensure, through planned economic growths development:
(i) the provision to all citizens of the basic necessities of life, including food, clothing, shelter, education and medical care;
(ii) the right to work, that is, the right to guaranteed employment at a reasonable wage, having regard to the quantity and quality of work;
(iii) the right to reasonable rest, recreation and leisure;
(iv) the steady and sustained improvement in the standard of living, material and cultural, of the people;
(v) the provision of social security, through, inter alia, the extensive development of compulsory social insurance of industrial, office and professional workers;
(vi) the right to maintenance in old age.
V. RIGHTS OF WORKERS AND PEASANTS
It shall be a fundamental responsibility of the State of safeguard and promote the rights and interests of workers and peasants.
VI. EMANCIPATION OF THE RURAL MASSES FROM EXPLOITATION AND IMPROVEMENT IN THEIR QUALITY OF LIFE.
The rural masses shall be emancipated from exploitation by, among other measures, the total abolition of the Jagirdari, Zamindari and Sardari systems and the re-orientation of the land system in the interests of the actual tillers of land…..
XVIII. ECONOMIC BENEFITS OF FEDERAL EXPENDITURE
Every effort shall be made to ensure that the economic benefits of federal expenditure shall be equitably distributed among all the States in the Federation.
XIX. REPRESENTATION IN FEDERAL GOVERNMENT.
Steps shall be taken immediately to ensure that all the States in the Federation are represented, on the basis of the population of each State, in all spheres of the Federal Government.
XX. REPRESENTATION IN THE DEFENCE SERVICES
Every effort shall be made to ensure that, within the shortest possible time persons from all the States are represented, on the basis of population of each State in all branches of the Defence Services of the Federation and extraordinary measures, if necessary, shall be adopted to implement this Principle.
XXI. REGIONAL SELF-SUFFICIENCY IN DEFENCE
Having regard to the extraordinary geo-political situation of Pakistan, each of its, two regions shall be made self-sufficient in man, materials, training and logistic facilities, in order to defend itself.
XXII. DEVELOPMENT OF LANGUAGES AND CULTURES
Immediate measures shall be taken to ensure that Bengali, Urdu and the languages in use in a State, where appropriate, shall replace English in all walks of life. Every effort shall be made to encourage the Development of the language, literature and culture of every area in Pakistan.
XXIII. PROTECTION OF ANCIENT MONUMENTS.
It shall be the obligation of the State to protect every monument or place or objects of artistic or historic interest, declared by law to be of historic significance from spoliation, disfigurement, destruction, or removal, dispose or export, as the case may be.
XXIV. PROMOTION OF INTERNATIONAL PEACE AND SECURITY
The State shall endeavour to
(a) promote international peace and security;
(b) maintain just and honourable relations between nations.
(c) foster respect for international law and treaty obligations in the dealings of organised peoples with one another; and
(d) encourage peaceful settlement of international disputes.
XXV. STRUGGLE AGAINST IMPERIALISM, COLONIALISM AND APARTHIED.
Pakistan shall support the struggle of the oppressed people of the world against imperialism, colonialism and apartheid.
নাহিদ মাহফুজ মানে শিক্ষার্থীদের বলি – ভুল কইরেন না।
সরকারে আছেন বাইরেও আছেন ঠিকাছে। এই দুই ফ্রন্টের মধ্যে সরকারের বাইরের অংশটায় কিন্তু নাই হয়ে আছেন, যতটুকু আছেন ওই সরকারেই।
সরকারের আয়ু বড়জোর এক/দুই বছর, কারণ এটা অন্যের শক্তির উপর ভর করে দাঁড়িয়ে থাকা সরকার। তারপরও এসময়ের পরে ওখানে কোন কন্টিনিয়াশান নেই।
ফুলস্টপ। অনেক পরিশ্রমে যে মূল্যবান প্রস্তাবনা কমিশনগুলো দিয়ে বানালেন ওগুলো পরের সরকারের কাছে কাগজেই থাকবে।
আপনারাতো পরের সরাকারে নেই। রিটায়ার্ড।
আর যদি ভাবেন আবার আপনারা ডাকবেন, আর মানুষ আপনাদের ডাকে সাড়া দিবে। ওটা দিবেনা। যে আশা নিয়ে মানুষ এবার এতো ত্যাগ করলো, রাজনীতির অংশ হোল এগুলো সব ঝেড়ে ফেলবে। হতাশা থেকে।
একটা দুর্দান্ত রেইসের মাঝথেকে আপনাদের “অকারণে” গুটিয়ে নেয়াটা মানুষ স্বাভাবিক ভাবে নিবে না।
Follow Me