বছর পাঁচেক আগে মিসরে ঘুরতে গিয়ে হঠাৎ ইসরাইলে ঢোকার প্রবল ইচ্ছে হলো আমার। নানা কারণ ছাড়াও ইতিহাস পাঠে জেনেছিলাম যে, ১৯৭১ সালের ২৬-এ মার্চের মাত্র ৩৩-দিনের মাথায় ইসরায়েল সর্বপ্রথম স্বীকৃতি দেয় বাংলাদেশকে ২৮-এ এপ্রিল ১৯৭১। ১৯৭২ সালের ৪-ঠা ফেব্রুয়ারি ইসরায়েল বাংলাদেশকে ২য়-বারের মত আনুষ্ঠানিকভাবে পুনরায় স্বীকৃতি প্রদান করে। এর কারণ ছিল ইসরায়েল বাংলাদেশের জনগণের সংগ্রামের সাথে তাদের মিল খুঁজে পেয়েছিল হয়তো কিন্তু বাংলাদেশ দুটো স্বীকৃতিকেই অস্বীকার করে পরপর। বিষয়টা বিস্ময়কর ছিল আমার কাছে। তাই মিসরের প্রোগ্রাম সর্টকাট করে, ইসরাইলি দূতাবাসে গেলাম ভিসা লাগাতে, যাতে বৈধভাবে ঢুকতে পারি বিশ্বের এ ছোট অথচ নানা বিচারে শক্তিধর আলোচিত রাষ্ট্রটিতে। মিসরিয় এক ফেসবুক বন্ধুর সহযোগিতায় দুতাবাস খুুঁজে পেতে কষ্ট হলোনা খুব একটা আমার।
মনে অসিম সাহস, আতঙ্ক নিয়ে ১২/০৫/২০১৫ তারিখ আগালাম মিসরের ‘আরিশ’ থেকে ‘তাবা-রাফা’ বর্ডার পোর্টে। এটা মিসর-ইসরাইল ‘তাবা’ বর্ডারে, যার ইহুদি নাম Eilat, ইসরাইলের দক্ষিণ সীমান্তের খান ইউনুসের কাছে। এটা মুলত একটা ল্যান্ডপোর্ট, অনেকটা বাংলাদেশ-ভারত বেনাপোলের মত। আকাবা কোস্টে ঢোকার জন্যে এ বর্ডারে ১৫-দিনের ভিসা দেয়া হয় সাধারণত (ছবি- ১)।
মুখে বাঙালি চেহারা দেখে, বেশ কিছুক্ষণ নীরিক্ষণ করে পাসপোর্ট ‘এক্সিট’ সিল দিলো মিসরিয় ইমেগ্রেশন অফিসার। এবার ইসরাইলে ঢোকার পালা। মিসর থেকে ইসরাইলের ইলাত তথা তাবা বর্ডারে Welcome to Israel লেখা বিশাল ইমিগ্রেশন হল দেখে বুক কেঁপে উঠলো আমার (ছবি- ২)।
এতো বেনাপোল পোর্ট নয়, যেন সিঙ্গাপুর-ব্যাংকক এয়ারপোর্ট (ছবি-৩)। খুব কম মানুষ পার হয় এ পোর্ট দিয়ে। আমিসহ মাত্র ৩-জন দেখলাম ইমিগ্রেশনে। এ বর্ডার দিয়ে ৭৫-মিসরিয় পাউন্ড বা ৯৬-ইসরাইলি শেকেল টোল দিয়ে গাড়ি নিয়ে ঢোকারও ব্যবস্থা আছে এ পোর্টে। একজন ইউরোপিয়ান নারীকে দেখলাম মিসর থেকে ইসরাইলের ভূমিতে ঢুকেই চুম্বন করছে ইসরাইলের মাটি (ছবি-৪)। কথা বলে জানলাম, “ফরাসি ইহুদি নারী এই প্রথম ইসরাইলে ঢুকে তাদের ধমীর্য় রীতি অনুসারে চুম্বন করলো তাদের পবিত্র ভূমি ইসরাইলকে”। ইহুদি মানুষের এ ধর্মপ্রীতি আর দেশপ্রীতি দেখে অভিভুত হলাম আমি। আমার পোসপোর্ট ভিসা ঘাটাঘাটি করে অবশেষে ১২ মে ২০১৫ ঢুকতে পারলাম ইলাতের তাবা বর্ডার দিয়ে ইসরাইলে (ছবি-৫)
আমার প্লান ছিল ভূমধ্য সাগরের পার ধরে তেলআবিবের দিকে এগুবো আমি সপ্তপদি জনপথ দেখতে দেখতে। তারপর আবার ফিরবো এ বর্ডার দিয়েই ইজিপ্টে । কারণ মিসর থেকেই আমার কোলকাতা রিটার্ন ফ্লাইট। খান ইউনুসে ঢোকার আগে ইসরাইলি ১ম জনপদ ‘তাল আস সুলতানে’ যাত্রা বিরতি করলাম একরাত। এখানে কটা ফিলিস্তিন বসতির সাথে বাস করছে আফ্রিকা থেকে আগত গরিব ইহুরিরা। এটা মুলত দরিদ্র এলাকা। ভূমধ্যসাগরে মাছ ধরে জীবিকা এখানের মানুষদের। তবে সরকারি দপ্তর, স্কুল, হাসপাতাল সবই আছে ‘তাল আস সুলতানে’। ওখানে একরাত বিরতি দিয়ে এগুতে থাকলাম Al Qarya as Suwaydiya গ্রামে। এটাও মুলত আরবি ভাষিক এলাকা। কিছুটা গম, খেজুর উৎপাদনের চেষ্টা হচ্ছে এ এলাকাটিতে। যা মূলত করে সুদান আর নাইজেরিয়া থেকে আগত আরবি ভাষিক ইহুদিরা। সাগরের তীর ঘেষে উত্তরে এগুতে থাকি আমি নানাভাবে। ‘রনি সালেহ’ নামক ছোট জনপদে গিয়ে পেলাম FSH Land of Fish রেস্টুরেন্ট নামের একটা খাবারের দোকান। মুূলত ভূমধ্য সাগরের তাজা মাছ রান্না করে, ফ্রাই করে, ভুনা করে কিংবা স্টিমে সেদ্ধ করে খাওয়া যায় এখানে। সাথে ভাত কিংবা রুটি। একটা উসর মরু এলাকাকে কিভাবে সুন্দর বন্দর বানিয়েছি ইসরাইল তা দেখে বিস্ময়ে চোখ জুড়িয়ে যায় আমার। অনেক রাত অবধি একাকি সাগরতীরে রেস্টুরেন্টের চেয়ারে বসে থাকি আমি এ অচেনা নগরে (ছবি-৬)।
সমুদ্র তীরের এ ছোট গ্রামে রাতে থেকে পরদিন আবার চলতে চলতে পৌঁছি Al Mawasi এলাকায়। ভূমধ্য সাগর থেকে পাইপ লাইনে পানি এনে, তা শোধন করে ঐ পানির সাহায্য পুরো এলাকাটি করা হয়েছে কৃষি প্রধান। গম, টমেটো, সবজির ক্ষেত দেখে চোখ জুড়িয়ে গেলো আমার (ছবি-৭,৮)। মুলত আফ্রিকা থেকে আসা দরিদ্র ইহুদিরা কৃষিকাজ করছে এ এলাকাতে। al bala গ্রামে দেখলাম প্রচুর খেজুর গাছ। মুলত এখানের মূল বসতির আরব মুসলমানরা চাষ করছে খেজুরের। পাশের az zawada গ্রামেও দেখলাম এখানের ফিলিস্তিনি মুসলিমরাও চাষ করছে খেজুরের। খেজুর গাছে ওঠার জন্যে সরকার দিয়েছে বিশেষ সিঁড়ির মত যন্ত্র, যা ব্যবহার করছে মুসলিম খেজুর চাষিরা (ছবি-৯)। যদিও রাতে তেলআবিব টিভিতে দেখলাম পুরো ইসরাইলের তাপমাত্রা তখন – “জেরুজালেমে-68°, অ্যাশডড-68°, এলাট-81°, তেল আবিব-70°, নাজারথ-65°, নেতানিয়া-70°, পেটাহ টিকোয়া-68°, বাট ইয়াম-70°, বিয়ারশিবা-64°, বেনে বেরাক-70°, রামলা-68°, রামাত গান-70°, রিশন-লেজিয়ন-68°, হোলোন-70° এবং হাইফা-69°।
Image 7, 8 & 9
এসব কৃষি খামারে ঘুরে আর খেজুর গাছের আরব মুসলিমদের সাথে আলাপ করে, আবার দুদিন পর ছুটলাম ভূমধ্যসাগরের তীর ঘেসে আরো ১০-কিমি উত্তরে Ben-Gurion University। এটা নাগেভ নামক ছোট্ট শহরে। নিজের পরিচয় দিয়ে ভেতরে ঢুকলাম ভার্সিটিটা দেখতে। মাত্র ২০০-এর মত শিক্ষার্থী বিশাল এ ভার্সিটিতে। মানুষজন না পেয়ে ক্লান্ত হয়ে আবার পাড়ি দিলাম পাশের কৃষি প্রধান nusairat আর al muqaraka গ্রামের দিকে। একটা লেটুস পাতার ক্ষেতে কাজ করছিল এক নিগ্রো নারী। ভাষা ভিন্ন হওয়ার কারণে সব কথা বুঝিনি তার। তারপরো সে বললো, “তানজানিয়া থেকে এসেছে সে, তার নাম কুতি হিদাই। ইহুদি ধর্ম অনুসারি সে” (ছবি-১০)। এ এলাকার কৃষি কাজ দেখে মনেই হলোনা, এটা একটা মরু এলাকা। কি ফল নেই এ এলাকাতে? এভোকোডা, কলা, আপেল, চেরি, পাম, আঙুর সবই ফলে এ এলাকায়। এমন তাপমাত্রায় তারা কিভাবে আঙুর বা শীত প্রধান দেশের ফল ফলাচ্ছে কঠোর পরিশ্রমে, তা দেখে বিস্মিত হলাম আমি (ছবি-১১)। নুসাইরাত নামক একটা ছোট্ট গ্রামের পোস্ট অফিস দেখে ‘ভিমরি খাওয়ার’ পালা আমার। ঢাকা বা কোলকাতার জিপিও এতো সুন্দর নয়! চমৎকার মনোরম এ ইসরাইলি ডাকঘরে কাজ করতে দেখলাম এক আরব মুসলমানকে। সালামালেকুম দিয়ে কথা বললাম তার সাথে আরবিতে। ডাকটিকেট কিনে কোলকাতা এক বন্ধুর ঠিকানায় একটা চিঠি পোস্ট করলাম এ অচেনা গাঁ থেকে। এ ইচ্ছেতে যে, দেখি চিঠিটা কত দিনে পৌঁছে কোলকাতা (ছবি-১৩)।
Photo 10
Photo 11
Photo 12
Photo 13
এ এলাকার ‘পেটাহ তিকাহ’ একটা মোটামোটি বড় শহর। বিমানবন্দর আছে এ ছোট শহরটিতে। প্রত্যকেটি গাঁয়ের সড়কেও সুন্দর সাইনবোর্ড লাগানো, যাতে আরবি, ইংরেজি আর হিব্রু ভাষাতে লেখা বিভিন্ন জনপদের নাম। পোস্ট অফিসে চিঠি পোস্ট করতে গিয়ে পরিচয় হয়েছিল আরব মুসলিম উমার আবদাল্লার সাথে। আমি বাঙালি, অনেক দূর থেকে ইসরাইল দেখতে এসেছি, শুনে প্রায় ২০-কিমি দূরের “আল-সারাহ” গ্রামে যেতে বললেন তিনি। যেটি হযরত ইব্রাহিম নবীর স্ত্রী বিবি সারাহর জন্মস্থান হিসেবে তার নামেই পরিচিত। ঐ গ্রামে যাওয়ার সড়কটির নামও সারা স্ট্রিট (ছবি-১২)। কিন্তু গ্রামটতে কোন মুসলিম বা কথা বলবো, এমন কাউকে পেলাম না আমি ঘন্টা দুয়েক ঘুরেও। তাই কেবল ২/৪-টা শূন্য ঘর দেখে চলে আসতে হলো আমাকে কিছুটা বিমর্ষ হয়ে।
মোট ৮-দিন ইসরাইলে ঘুরে জানলাম ইসরায়েলের রাষ্ট্রভাষা দু’টি৷ আধুনিক হিব্রু ভাষা এবং আরবি৷ হিব্রু ভাষার কথা তো সবাই শুনেছি আমরা কিন্তু ‘আধুনিক হিব্রু’ বলতে ঠিক কি বোঝানো হচ্ছে, তা হয়তো অনেকেই বুঝতে পারবোনা৷ এই ভাষাটি গত ১৯-শতকের শেষভাগ পর্যন্তও বিকশিত হয়েছে বিশ্বে৷ আরেকটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় হলো, আধুনিক হিব্রুর শেকড় প্রাচীন হিব্রু হলেও, এখন এ ভাষায় ইংরেজি, স্লাভিচ, আরবি এবং জার্মানসহ অনেকগুলো বিদেশি ভাষার প্রভাব রয়েছে বেশ৷ ওখানে সব স্কুলে সবার জন্যে আরবি আর হিব্রু শেখা বাধ্যতামূলক। ইসরাইলের ভেতরে গেলে বোঝা্ই যায়না যে, এ দেশটির বর্ডারের প্রতিবেশি দেশগুলোর সাথে কত খারাপ সম্পর্ক তাদের। বরং ভেতরের আরবরা কাজ করে ইসরাইলি ইহুদিদের সাথে এক সাথেই সরকারি দপ্তরে, রাস্তায়, বাজার, শপিং মল আর বাণিজ্যালয়ে।
দেশটির ভেতরের মুসলমানরা ভালই আছে দেখলাম। ইসরাইলের মোট ৮৫,০২,৯০০ মানুষের মধ্যে ৬৩,৬৩,৭০০ জন ইহুদি (৭৪.৯%), ১৭,৬৬,৫০০ জন (২০.৯%) আরব মুসলিম, ১৩০,০০০ ইথিওপিয়ান ইহুদি। এ ছাড়া ২% আরব খৃস্টান, ১.৫% দ্রুজ মুসলিম ও ইরানি বাহাই ধর্মের লোক বিদ্যামান। মাথাপিছু আয় ৩৫,৩৪৩ আমেরিকান ডলার। টাকার নাম সেকেল, আর পয়সা হচ্ছে আগোরা। ১-সেকেলের নোটে দেখলাম এক আরব মুসলিমের ছবি, যে কিনা ইসরাইল আরব মুসলিমদের মিলেমিশে থাকার কথা বলে “শহীদ” হন (ছবি-১৪)। দেশটির সরাসরি ডায়ালিং কোড +৯৭২। ইসরাইলের প্রধান জেলাগুলো হলো :- জেরুজালেম যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, উত্তর নাজারেথ যার জনসংখ্যা ৬৭% ইহুদি ও ৩২% মুসলিম, হাইফা যার জনসংখ্যা ৬৯% ইহুদি ও ২৫% মুসলিম, রামাল্লা যার জনসংখ্যা ৮৮% ইহুদি ও ৮% মুসলিম, তেলআবিব যার জনসংখ্যা ৯৩% ইহুদি ও ১% মুসলিম, বীরসেবা যার জনসংখ্যা ৭৪% ইহুদি ও ২০% মুসলিম, জুডিয়া ও সামারিয়া যার জনসংখ্যা ৯৮% ইহুদি ও ২% মুসলিম।
Photo 14
৮-দিন শেষে আবার ফিরতে হলো তাবা বর্ডারে। কারণ পরের দিন মিসর থেকে আমার কোলকাতা ফ্লাইট। ইসরাইলের মাটি থেকে মিসরের বর্ডারে পা দিতেই কেমন এক মৃত্যু নৈশব্দের মতো কষ্টপথ আগলে ধরে আমায় সন্তর্পণে। নিজের বোধ আমায় তাড়িত করে অনেকক্ষণ। আর সুখভরা রাতপরীর দেশে উড়ে চলা অবোধ বালিকার মতো প্রশ্ন করে আমায়, ইসরাইলি ইহুদি আর আরব মুসলমানরা কি মিলেমিশে থাকতে পারেনা এ পৃথিবীতে? সিনাই বীরসেবা গাজাস্ট্রিপে ভর দুপুরের তপ্ত রোদে দুখভরা সুখনাশক মৃত্যু বিকেলে হাঁটতে থাকি এক গনগনে আগুনে কষ্টের ভেতর আমি কিন্তু এ প্রশ্নের জবাব খুঁজে পাইনা এ ত্রিভুবনের কোথাও!
[লেখা বিষয়ক নোট : ছবি সব নেট থেকে নেয়া। বাংলাদেশী পাসপোর্টে ইসরাইলে যাওয়া অসম্ভব বিধায়, ভ্রমণ কাহিনীটি কাল্পনিক] https://www.facebook.com/JahangirHossainDDMoEduGoB
The Financial Action Task Force (FATF) is the global money laundering and terrorist financing watchdog. The inter-governmental body sets international standards to prevent these illegal activities and the harm they cause to society. As a policy-making body, the FATF works to generate the necessary political will to bring about national legislative and regulatory reforms in these areas.
IPRI Infolytics | Pakistan has so far achieved 26/27 targets of #FATF. Based on the non-compliance data, 🇵🇰 is as compliant as US and more compliant than India & China. Yet, it continues to be in the grey list raising serious concerns of discrimination & politicization of #FATFpic.twitter.com/X5CIwj9vdM
— Islamabad Policy Research Institute (@IPRI_Pak) July 1, 2021
জায়েদ ভাইয়ের বাসায় শাজাহানের গান শুনেছিলাম।সালটা ২০১৭ হবে, তখন জায়েদ ভাই থাকতেন উত্তরায়। তার এক সপ্তাহ পরে আমার অফিসে এসেছিলেন। গান নিয়ে অনেক কথা হয়েছিল। এখন মধ্যপ্রাচ্যের কোন এক দেশে থাকেন। ওখানকার গজল সমঝদারদের কাছে খুব জনপ্রিয়। (ছবিটা আমার। কারন …
১৯২০ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় অধ্যাদেশ জারী করা হয়।
ধর্ম-বর্ণ-লিঙ্গ নির্বিশেষ সবার জন্য ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ভর্তির সুযোগ অবারিত রাখা হয়েছিল।
১৯২১ সালের ১লা জুলাই যখন ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় যাত্রা শুরু করে, সেসময় বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষার্থী ছিলেন ৮৪৭ জন, যাদের মধ্যে একমাত্র ছাত্রী ছিলেন লীলা নাগ।
শুরুতে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে সমাজের এলিট পরিবারের বা ইংরেজি শিক্ষায় শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন।
মধ্যবিত্ত, নিম্ন-মধ্যবিত্ত এবং ধর্মীয়ভাবে রক্ষণশীল পরিবারের মেয়েরা পড়তে আসতেন না।
শুধু মুসলমান পরিবারই নয়, অনেক হিন্দু শিক্ষিত পরিবারের মেয়েরাও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আসতেন না।
১৯২৫ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রথম মুসলিম ছাত্রী ফজিলতুন নেসা গণিত বিভাগে এমএসসিতে ভর্তি হন।
১৯২৭ সালে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম স্থান দখল করে বিশ্ববিদ্যালয় স্বর্ণপদক পেয়েছিলেন তিনি। পরে তিনি ইংল্যান্ডে উচ্চশিক্ষা নিয়ে ফিরে এসে শিক্ষকতা পেশায় যোগ দেন।
১৯২১ সালে মাত্র একজন নারী শিক্ষার্থী ভর্তি হয়েছিল যে বিদ্যাপীঠে,
১৯২৭ সালে সেখানে ছাত্রী ছিলেন নয়জন।
ছাত্রী সংখ্যা আস্তে আস্তে বাড়তে থাকে।
১৯৩৪-৩৫ সালে ছাত্রী ছিলেন ৩৯ জন।
১৯৪৫-৪৬ সালে ৯০ জন ছাত্রী ভর্তি হন।
১৯৬৭-৬৮ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ছাত্রীর সংখ্যা ছিল ১,৩৩৬ জন।
২০১৯ সালে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মোট শিক্ষার্থী সংখ্যা ৪৩ হাজার ৩৯৬জন। এর মধ্যে ছাত্রীর সংখ্যা ১৩ হাজার ১৯৫ জন।
মোট ১৯৯২জন শিক্ষকের মধ্যে এখন নারী শিক্ষকের সংখ্যা ৬৬৮জন।
১৯২১ সালে কলা ও বিজ্ঞান অনুষদ, এবং আইন বিভাগ নিয়ে শুরু হওয়া ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে মোট শিক্ষক ছিলেন ৬০ জন।
যাদের মধ্যে নারী শিক্ষক ছিলেন না একজনও। বিশ্ববিদ্যালয়ের অন্য কোন পদেও সে সময় নারী কর্মী ছিলেন না।
ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার শুরু ১৮৫৭ সালের সিপাহী বিদ্রোহের পর। ১৮৫৭ সালে ভারতের বড় লাট লর্ড ক্যানিং ‘দ্য অ্যাক্ট অফ ইনকরপোরেশন’ পাশ করে তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠা করেন।
বিশ্ববিদ্যালয়গুলো হল কোলকাতা, বোম্বে এবং মাদ্রাজ বিশ্ববিদ্যালয়। এর আগে থেকেই ভারতবর্ষে উচ্চশিক্ষার ব্যবস্থা ছিল কিন্তু এই তিনটি বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপন করা হয় ইউরোপিয় মডেলে।
অন্যান্য বিশ্ববিদ্যালয়ের মত কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের মান ছিল উঁচু। আর এই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষার্থীরা ছিলেন মূলত পশ্চিম বঙ্গের উঁচুতলার হিন্দু সন্তানরা।
১৯০৫ সালে বঙ্গভঙ্গের আগে অবিভক্ত বাংলায় ১৯টি কলেজ ছিল। তার মধ্যে পূর্ব বাংলায় নয়টি। তবে সেটাই পর্যাপ্ত ছিল বলে মনে করেননি তখনকার পূর্ব বাংলার মানুষ।
কেন পূর্ববঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রয়োজন ছিল:
১৯০৫ সালে বাংলা প্রেসিডেন্সি ভাগ করে পূর্ববঙ্গ ও আসাম নামে নতুন এক প্রদেশ করা হয়। যার প্রচলিত নাম বঙ্গভঙ্গ।
পূর্ববঙ্গে পিছিয়ে পরা জনগোষ্ঠী বিশেষ করে সংখ্যাগরিষ্ঠ মুসলমানদের সামনের দিকে এগিয়ে নিয়ে আসা ছিল এই উদ্যোগের একটি অংশ।
বঙ্গভঙ্গের এই সময়টা ছিল খুব অল্প সময়ের জন্য, মাত্র ছয় বছর। কারণ এর মধ্যেই পশ্চিম বঙ্গের হিন্দু নেতারা প্রবল আন্দোলন করেন এই বঙ্গভঙ্গের।
এদিকে মুসলমান নেতারা নতুন প্রদেশ হওয়াতে শিক্ষাসহ নানা সুবিধা পাবেন এই আশায় উজ্জীবিত হন।
কিন্তু গোটা ভারতবর্ষে হিন্দু সংখ্যাগরিষ্ঠ এবং তাদের বিরোধিতার মুখে ১৯১১ সালে বঙ্গভঙ্গ রদ করা হয়।
ফলে মুসলমানদের ক্ষোভ আরো পুঞ্জিভূত হতে থাকে। তারা মনে করে অর্থনৈতিক বৈষম্যের সাথে সাথে শিক্ষা ক্ষেত্রেও তারা বৈষম্যের শিকার হচ্ছেন।
লেখক এবং গবেষক সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বই এ লিখেছেন “কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের ওপর বাঙালী মুসলমানদের ক্ষোভ ছিল ১৯০৫- এ পূর্ব বাংলা এবং আসাম প্রদেশ গঠনের অনেক আগে থেকেই। … ক্ষোভের কারণ শুধু হিন্দু প্রাধান্য নয়, শিক্ষাক্রমে হিন্দুধর্ম প্রাধান্য পাওয়ায় মুসলমানদের মধ্যে অসন্তোষ দেখা দেয়”।
যারা বিরোধিতা করেছিলেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার সবচেয়ে বিরোধী হিসেবে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর নাম সৈয়দ আবুল মকসুদের ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বইতে উঠে এসেছে। হিন্দু সম্প্রদায়ের কিছু লোকজনও ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেন বলে উল্লেখ করা হয়।
ভারতের ভাইসরয় লর্ড হার্ডিঞ্জ ১৯১২ সালে তাঁর ঢাকা সফর শেষে কলকাতা প্রত্যাবর্তন করলে ১৯১২ সালের ১২ ফেব্রুয়ারি ড. রাসবিহারী ঘোষের নেতৃত্বে একটি প্রতিনিধিদল তার সাথে সাক্ষাৎ এবং ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতামূলক একটি স্মারকলিপি পেশ করেন।
এসংক্রান্ত বিভিন্ন বইতে উঠে এসেছে, লর্ড হার্ডিঞ্জ স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায়ের কাছে জানতে চেয়েছিলেন, কী মূল্যে অর্থাৎ কিসের বিনিময়ে তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় স্থাপনের বিরোধিতা থেকে বিরত থাকবেন?
শেষ পর্যন্ত স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য চারটি নতুন অধ্যাপক পদ সৃষ্টির বিনিময়ে তার বিরোধিতার অবসান করেছিলেন। পরবর্তীতে স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের জন্য শিক্ষক নিয়োগে সহযোগিতা করেন।
তার সঙ্গে ছিলেন স্যার নীলরতন সরকার।
কেন এই বিরোধিতা?:
কথা সাহিত্যিক এবং প্রাবন্ধিক কুলদা রায় তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা ও রবীন্দ্রনাথ’ নামক প্রবন্ধে লিখেছেন মূলত-বিরোধিতা করেছিলেন তিন ধরনের লোকজন-
এক. পশ্চিমবঙ্গের কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, ঢাকায় বিশ্ববিদ্যালয়টি প্রতিষ্ঠিত হলে পশ্চিমবঙ্গের মুসলমানদের কোনো লাভ নেই। পূর্ববঙ্গের মুসলমানদেরই লাভ হবে। তাদের জন্য ঢাকায় নয় পশ্চিমবঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয় হওয়াটাই লাভজনক।
দুই. পূর্ব বাংলার কিছু মুসলমান-তারা মনে করেছিলেন, পূর্ব বঙ্গের মুসলমানদের মধ্যে ১০০০০ জনের মধ্যে ১ জন মাত্র স্কুল পর্যায়ে পাশ করতে পারে। কলেজ পর্যায়ে তাদের ছাত্র সংখ্যা খুবই কম। বিশ্ববিদ্যালয় হলে সেখানে মুসলমান ছাত্রদের সংখ্যা খুবই কম হবে।
পূর্ববঙ্গে প্রাইমারী এবং হাইস্কুল হলে সেখানে পড়াশুনা করে মুসলমানদের মধ্যে শিক্ষার হার বাড়বে। আগে সেটা দরকার। এবং যদি বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠিত হয় তাহলে মুসলমানদের জন্য যে সরকারী বাজেট বরাদ্দ আছে তা বিশ্ববিদ্যালয়েই ব্যয় হয়ে যাবে। নতুন করে প্রাইমারী বা হাইস্কুল হবে না। যেগুলো আছে সেগুলোও অর্থের অভাবে বন্ধ হয়ে যাবে। সেজন্য তারা বিশ্ববিদ্যালয় চান নি।
তিন. পশ্চিমবঙ্গের কিছু হিন্দু মনে করেছিলেন যে, ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় হলে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাজেট বরাদ্দ কমে যাবে। সুতরাং কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় চলবে কীভাবে? এই ভয়েই তারা ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিরোধিতা করেছিলেন।
রবীন্দ্রনাথ ঠাকুর কি বিরোধিতা করেছিলেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিষ্ঠায় রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের ভূমিকা কী ছিল সেটা নিয়ে বিস্তর লেখা-লেখি হয়েছে বছরের পর বছর ধরে।
যারা বলেছেন তিনি এর বিরোধিতা করেছিলেন তারা স্বপক্ষে দালিলিক কোন তথ্য প্রমাণ দেন নি।
সেই সময়কার সামাজিক এবং রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা এবং রবীন্দ্রনাথের সেই সময় যাদের সাথে উঠা-বসা ছিল তাদের কয়েকজন ছিলেন এই বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার বিপক্ষে।
তাই অনেকেই সহজ সমীকরণ মিলিয়ে লিখেছেন তিনিও এর বিপক্ষেই ছিলেন।
সৈয়দ আবুল মকসুদ তাঁর ‘ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে ও বাংলাদেশের উচ্চশিক্ষা’ বই এ লিখেছেন “শ্রেণীস্বার্থে রবীন্দ্রনাথও ছিলেন কার্জনের (লর্ড কার্জন) ওপর অতি ক্ষুব্ধ। কার্জনের উচ্চশিক্ষাসংক্রান্ত মন্তব্যের তীব্র বিরূপ প্রতিক্রিয়া দেখা দেয় কলকাতার হিন্দু সমাজে। তাতে রবীন্দ্রনাথও অংশগ্রহণ করেন। তিনি যে প্রতিক্রিয়া প্রকাশ করেন,তাতে কিছু ছিল যুক্তি, বেশির ভাগই ছিল আবেগ এবং কিছু ছিল ক্ষোভ”।
আবার যারা রবীন্দ্রনাথ বিরোধিতা করেননি বলেছেন তাঁরা এর স্বপক্ষে বেশ কিছু ঘটনা এবং এবং দিন তারিখের কথা উল্লেখ করেছেন।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের বাংলা বিভাগের অধ্যাপক বিশ্বজিৎ ঘোষ বলেছেন ” কেউ কেউ কোনো প্রমাণ উপস্থিত না করেই লিখিতভাবে জানাচ্ছেন যে, ১৯১২ খ্রিষ্টাব্দের ২৮ মার্চ কলকাতায় গড়ের মাঠে রবীন্দ্রনাথের সভাপতিত্বে এক বিরাট জনসভা হয়। ও রকম একটি সভা অনুষ্ঠিত হয়েছিল বটে, কিন্তু তাতে রবীন্দ্রনাথের উপস্থিতি ছিল অসম্ভব, কেননা সেদিন তিনি কলকাতাতেই ছিলেন না। ১৯১২ সালের ১৯ মার্চ সিটি অব প্যারিস জাহাজযোগে রবীন্দ্রনাথের বিলাতযাত্রার কথা ছিল। তাঁর সফরসঙ্গী ডাক্তার দ্বিজেন্দ্রনাথ মিত্র জাহাজে উঠে পড়েছিলেন, কবির মালপত্রও তাতে তোলা হয়ে গিয়েছিল; কিন্তু আকস্মিকভাবে ওইদিন সকালে রবীন্দ্রনাথ অসুস্থ হয়ে পড়েন। পরে মাদ্রাজ থেকে তাঁর মালপত্র ফিরিয়ে আনা হয়। কলকাতায় কয়েক দিন বিশ্রাম করে ২৪ মার্চ রবীন্দ্রনাথ শিলাইদহে চলে আসেন এবং ২৮ মার্চ থেকে ১২ এপ্রিলের মধ্যে সেখানে বসে ১৮টি গান ও কবিতা রচনা করেন”।
আবার সেই সময়কার সামাজিক, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট বিবেচনা করে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক এবং গবেষক তৌহিদুল হক বলছিলেন ” ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠার ক্ষেত্রে যে তিন শ্রেণীর মানুষ বিরোধিতা করেছিলেন তাদের মধ্যে আমরা রবীন্দ্রনাথকে তৃতীয় কাতারে রাখতে চাই। কারণ তারা ছিলেন পশ্চিমবঙ্গের উচ্চবর্ণের কিছু হিন্দু সমাজ। তাঁদের সাথে বিশেষ করে কোলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য স্যার আশুতোষ মুখোপাধ্যায় আর রাজনীতিক সুরেন্দ্রনাথ ব্যানার্জীর সাথে রবীন্দ্রনাথের একাধিকবার বৈঠক,আলোচনা হয়েছে শিলাইদহ যাওয়ার আগেও।এ থেকে আমরা অনুধাবন করতে চাই সেখানে পূর্ববঙ্গের সার্বিক উন্নতি নিয়ে তাদের মধ্যে আলোচনা হতে পারে। তবে এরও কোন স্পষ্ট তথ্য প্রমাণ নেই”।
যারা পক্ষে কাজ করেছিলেন:
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় বিরোধিতা যে হয়েছিল নানা পক্ষ থেকে সেটা ইতিহাস ঘাটলে তথ্য পাওয়া যায়।
কিন্তু এই বিশ্ববিদ্যালয়ের যে আবশ্যকতা রয়েছে সেটা বোঝাতে এবং প্রতিষ্ঠার ব্যাপার অগ্রণী ভূমিকা পালন করেছিলেন যাঁরা তাদের কথা না বললেই নয়।
এ ক্ষেত্রে বিশেষভাবে উল্লেখযোগ্য ঢাকার নবাব স্যার সলিমুল্লাহ। কিন্তু, হঠাৎ করে ১৯১৫ সালে নবাব সলিমুল্লাহের মৃত্যু ঘটলে নবাব সৈয়দ নওয়াব আলী চৌধুরী শক্ত হাতে এই উদ্যোগের হাল ধরেন।
অন্যান্যদের মধ্যে আবুল কাশেম ফজলুল হক উল্লেখযোগ্য।
ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় প্রতিষ্ঠায় পূর্ব বাংলার হিন্দুরাও এগিয়ে এসেছিলেন।
এদের মধ্যে ঢাকার বালিয়াটির জমিদার অন্যতম। জগন্নাথ হলের নামকরণ হয় তাঁর পিতা জগন্নাথ রায় চৌধুরীর নামে।
_________________________ ফারহানা পারভীন, বিবিসি বাংলা, ঢাকা ১ জুলাই ২০১৮ https://www.bbc.com/bengali/news-44609891
বাংলা একাডেমীর হিসেব মতে ২০১৪ সালে বইমেলাতে বই বিক্রি হয়েছে ২৫ কোটির টাকার মত।
২০১৫
হুমায়ূন আহমেদ থাকতে তার বই দেড় থেকে দুই লাখ কপি অনেক প্রকাশকরাই বিক্র করত।
দেশে বর্তমানে প্রায় ৫৫০ থেকে ৬০০টি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান রয়েছে। বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির ২০১৩ সালের বইয়ের তালিকায় ১১৮টি সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের নাম অন্তর্ভুক্ত করা হয়েছে।
সাম্প্রতিক কয়েক বছরে এসব প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলো থেকে চার হাজারের বেশি বই প্রকাশিত হয়েছে। বছরের হিসেবে দেখা যায় প্রায় ১২ থেকে ১৫ লাখ কপি বই বিক্রি হয়।
২০১৭
অসমাপ্ত আত্মজীবনী’ প্রকাশের পর শুধু এর মূল প্রকাশনা সংস্থা থেকেই দুই লাখ ত্রিশ হাজার কপি বিক্রি হয়েছে বইটি।
২০১৮
বর্তমানে দেশে সব ধরনের প্রকাশনা মিলিয়ে কেবল প্রতিষ্ঠানের সংখ্যাই আড়াই হাজারেরও বেশি। এর মধ্যে ১৭০টিরও বেশি জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান প্রতিবছর বই মেলাতেই সাড়ে ৩ হাজারের বেশি বই প্রকাশ করছে।
আগে একটি বই ১০০০ থেকে ৫০০ কপি ছাপলেও বিক্রি হয়ে যেতো এক মাসেই। যদিও অনেক বইয়ে ছাপানোর ক্ষেত্রেই ৩০০ কপির নিচে চলে এসেছেন তারা।
লেটার প্রেসের যুগেও বহু বই ছাপা হতো ১২৫০ কপি। এখন তারাই ৫০০ কপি থেকে ৩০০ কপিতে নেমে এসেছে। কিন্তু একটি বই এখনকার বাজারদর অনুযায়ী ৩০০ কপি বিক্রি হলেই কেবল ব্যয় উঠে আসে, কোনো মুনাফা হয় না।
কলকাতার, আসাম, ত্রিপুরা, মণিপুরকে আমরা বই বিক্রির লক্ষ্য করতে পারি।
বাংলাদেশ জ্ঞান ও সৃজনশীল প্রকাশক সমিতির সদস্য ১৭০। সদস্য নয় এমন সৃজনশীল প্রকাশনা
প্রতিষ্ঠানকে ধরলে প্রায় ২০০ হবে।
এক একটি প্রতিষ্ঠানের ৫ থেকে ৩০ লাখ টাকা পর্যন্ত বিনিয়োগ রয়েছে। ছোট প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানগুলোর বিনিয়োগ ৫ থেকে ১০ লাখ টাকা। বড় প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের ২০ থেকে ৩০ লাখ টাকা বিনিয়োগ আছে।’ সৃজনশীল প্রকাশকরা বাংলাদেশ পুস্তক প্রকাশক ও বিক্রেতা সমিতিরও সদস্য। ‘বর্তমানে দেশে পাঠ্যবই ও গাইড বইসহ সব ধরনের পুস্তক প্রকাশনা প্রতিষ্ঠানের সংখ্যা প্রায় আড়াই হাজার। বিক্রেতাসহ এ সমিতির সদস্যসংখ্যা প্রায় ২৮ হাজার।’
বাংলা একাডেমি জানাচ্ছে যে, এবার বইমেলায় মোট ৭০ কোটি ৫০ লাখ টাকার বই বিক্রি হয়েছে। যা গতবার ছিল ৬৫ কোটি টাকা। এছাড়াও বাংলা একাডেমি মোট ১ কোটি ৫১ লাখ ২৪ হাজার টাকার বই বিক্রি করেছে। মেলায় নতুন বই এসেছে ৪৫৯১টি।
মেলায় এবার ছোট বড় ৪৫০টি প্রকাশনা প্রতিষ্ঠান অংশ নিয়েছিল। বাংলা একাডেমির প্যাভিলিয়ননসহ ২৫টি প্যাভিলিয়ন ছিল এবছরের মেলায়। ইউনিট ছিল ৭৫০টি। শিশুতোষ বই প্রদর্শনের জন্য গেল কয়েক বছরের মতো ছিল আলাদা একটি কর্নার। লিটলম্যাগের জন্যও ছিল স্বতন্ত্র ব্যবস্থা।
এট একটা ছোট সিনেমা। শর্ট ফিল্ম। আদনান মুতানসির এর লেখা চিত্রনাট্য ও পরিচালনা।
আমার কালেক্শানে কেন রেখেছিলাম ঠিক মনে নাই। আজ আবার খুলে দেখলাম। নতুন ছবি, খুব কাঁচা। আমাকে যদি বলতো একটা কিছু বানাও, আমি হয়তো এভাবেই বানাতাম। এরচে ভাল কিছু হোত না।
অন্যের কোন সৃষ্টি যখন দেখি তখন বড় পন্ডিতের চোখ দিয়ে বিচার করি। মনে রাখি না এটা একটা কাঁচা সমাজের একজনের হাতেকলমের কাজ। সমাজ ও দেশটার সবকিছুতেই কাঁচা কাজের ছাপ থাকবে। এছাড়া ব্যতিক্রম যদি কিছু দেখি সেটা অসাধারণ প্রতিভার কাজ, যাদের সংখ্যা খুব কম।
Editorial Note of the 4th issue of White Board, a regular publication of the Centre for Research and Information. “As Bangladesh looks to consolidate its position as a middle-income country, it is time to move on from referring to the …
Pandit Bhimsen Gururaj Joshi 4 February 1922 – 24 January 2011) was an Indian vocalist from Karnataka, in the Hindustani classical tradition. He is known for the khayal form of singing, as well as for his popular renditions of devotional …
Recent polls suggest that 68% of Bangladeshis get their news from the TV — and only 2% from newspapers, 4% from the internet and 4% from social media!
Who currently owns these TV stations?
The Centre for Governance Studies (CGS) report provides details of the ownership of most of the 30 currently operating TV stations — which make clear two very obvious points.
সাংবাদিক কি এক্টিভিস্ট হতে পারে, এই প্রশ্ন আমার মাঝে বহুদিন থেকেই। সত্য ন্যায়ের পক্ষে, নারী অধিকারের পক্ষে বা স্বাধীনতার পক্ষে – এসব বলে কোন সাংবাদিক কি নিজের ভুমিকা নির্বাধারণ করতে পারে? আজ Shaugat Ali Sagor এর একটা পোস্ট পড়লাম। তিনি লিখেছেন-
কানাডীয়ান মিডিয়া আপনার লেখাটা খুলে দেখার আগে আপনার সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্ট এর দিকে নজর দেয়। ওখানে আপনি কী করেন, কী লিখেন, সেইগুলোর ভেতর দিয়ে ঘুরে এসে আপনার লেখাটা খুলে বসেন।’ – এইটুকু শুনে চমকে উঠেছিলাম। কানাডার কর্পোরেট অফিসগুলোর নিজস্ব সোশ্যাল মিডিয়া নীতিমালা আছে, সাংবাদিকদেরও আছে,কিন্তু লেখা ছাপা হওয়া না হওয়ার সাথে লেখকের, সাংবাদিকের সোশ্যাল মিডিয়া একাউন্টের সম্পর্ক কী?সেই সম্পর্কটাই ব্যাখ্যা করছিলেন রজার বেলগ্রেভ, টরন্টো স্টারের কলামিষ্ট।অভিবাসী সাংবাদিকদের কানাডয়িান জার্নালিজমের ধারায় তৈরি করতে ‘নিউ কানাডীয়ান মিডিয়ার (এনসিএম) এর প্রশিক্ষণ কর্মসূচীর কথা এর আগেও বলেছিলাম। ’তা হলে কানাডীয়ান মিডিয়া বাইরের লেখকদের (যারা প্রতিষ্ঠানে চাকুরীরত নন) লেখা কিভাবে মূল্যায়ন করে? মানে কোন লেখাটা ছাপা হবে, কোন লেখাটা ছাপা হবে না- এই সিদ্ধান্তটা কি ভাবে হয়!’- প্রশ্নটা আসলে আমাদের সবারই মনের প্রশ্ন। আমরা মানে- আমাদের যাদের পরিচয়- এথনিক সাংবাদিক, পলিটিশিয়ানদের অনেকেই এখন ‘কালচারাল মিডিয়া’ নামেও ডাকে। আমরা যারা কানাডীয়ান মুলধারার পত্রপত্রিকায় আমাদের লেখা ছাপ হোক- তেমন স্বপ্ন দেখি, তাদের জন্য তো অতি গুরুত্বপূর্ণ প্রশ্ন।কিন্তু লেখা দেখার আগে লেখকের সোশ্যাল মিডিয়ার দিকে তারা নজর দেয় কেন? কারো লেখা প্রকাশের আগে কানাডীয়ান মিডিয়া নিশ্চিত হতে চায়, যিনি লিখছেন, যে বিষয়ে লিখছেন, এই বিষয়ে তিনি এক্টিভিজম করছেন কী না। যেই বিষয় নিয়ে কেউ সোশ্যাল মিডিয়ায় এক্টিভিজম করছেন- সেই বিষয় নিয়ে তার লেখা প্রকাশ না করার নীতিমালা কঠোরভাবে অনুসরণ করে কানাডীয়ান মিডিয়া।টরন্টো স্টারের রিপোর্টারদের জন্য যে লিখিত নীতিমালা আছে, তাতে স্পষ্ট উল্লেখ আছে, একজন সাংবাদিক একই সাথে সংবাদ এবং সাংবাদিক- দুই ভূমিকায় অবতীর্ণ হতে পারবেন না। যিনি সাংবাদিক তিনি কেবল সাংবাদিকতাই করবেন, সংবাদ হবেন না, তিনি যখন সংবাদ হয়ে উঠবেন- তখন তার সাংবাদিকতার ইতি। এক্টিভিজমকে সংবাদ হিসেবে দেখে তারা, ফলে এক্টিভিষ্টকে সংবাদ কিংবা সংবাদপত্রের লেখক হিসেবে তারা অনুমোদন করে না। এক্টিভিষ্টের সাংবাদিক হওয়ায় সমস্যা কোথায়? সমস্যা আছে। একজন এক্টিভিষ্ট একটি পক্ষের হয়ে তার লড়াইটা করেন। কিন্তু সাংবাদিককে কোনো পক্ষের হলে চলে না। তিনি যখন কোনো পক্ষের হয়ে যান- তখন তিনি আর সাংবাদিক থাকেন না, তখন তিনি হয়ে যান এক্টিভিষ্ট।
বড় পর্দায় দেশের পাঁচ দাপুটে পরিচালক অনিমেষ আইচ, অমিতাভ রেজা, মোস্তফা সরয়ার ফারুকী, তৌকীর আহমেদ ও বদরুল আনাম সৌদের মুভি ভয়ংকর সুন্দর, আয়নাবাজি, ডুব, হালদা ও গহীন বালুচর দেখলাম।মুভি থিয়েটারে প্রতিটাই দেখতে গিয়ে মনে হয়েছে এতো সিনেমা না, নাটকের ছড়াছড়ি। অথচ তাদের তৈরি টেলিভিশনের বেশীর ভাগ নাটক আমার মনে হয় যেন একেকটা সিনেমা। এদের তৈরি টেলিভিশনের সেরা “সিনেমা” গুলোর কয়েকটি আমাদের রায়ান্স হলে প্রদর্শন করবো ভাবছি।
ড. কামাল হোসেন। আইনজীবী, রাজনীতিবিদ কলকাতা থেকে ঢাকায় এসে যে মেধাবী শিক্ষাজীবনের শুরু, আইনজীবী হিসেবে যে যাত্রাপথ, সেই পথে আছে অনেক চড়াই-উৎরাই। আছে অনেক বিপদ ও বিপত্তি। সেই উত্থানপতনকে সঙ্গে নিয়েই জীবনের পথচলা। এ পথেই জড়িয়ে গেছেন এই ভূখন্ডে রাজনীতির সঙ্গে। ইতিহাসের সঙ্গে। রাজনীতিবিদদের সঙ্গে। হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী, বঙ্গবন্ধু শেখ মুজিবুর রহমান, তাজউদ্দীন আহমদের সান্নিধ্যে ঋদ্ধ ড. কামাল হোসেন জড়িয়ে আছেন বাংলাদেশের জন্ম ইতিহাসের নানান পর্বে। তরুণ আইনজীবী হিসেবে ঐতিহাসিক আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলার আসামিদের পক্ষে লড়েছেন। অংশ নিয়েছেন বিখ্যাত রাউন্ডটেবিল কনফারেন্সে। স্বাধিকার আন্দোলনের সেই উত্তাল দিনগুলোতে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন বঙ্গবন্ধু, তাজউদ্দীন আহমদসহ আওয়ামী লীগ নেতৃবৃন্দের সঙ্গে। ২৫ মার্চ ক্র্যাকডাউন, ধানমন্ডির ৩২ নম্বরে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে কথোপকথন, পাকিস্তানি সেনাদের হাতে বন্দি, অতঃপর যুদ্ধ শেষে বঙ্গবন্ধুর সাথেই স্বাধীন দেশে ফিরে আসা। পরবর্তীতে স্বাধীন বাংলাদেশে আইনমন্ত্রী হিসেবে সংশ্লিষ্ট থেকেছেন বাংলাদেশের সংবিধান রচনার কাজে। পররাষ্ট্রমন্ত্রী হিসেবেও নতুন দেশের আর্ন্তজাতিক সম্পর্ক গঠনের নানান বাঁকে থেকেছেন সম্পৃক্ত।
সাপ্তাহিক : প্রথমে আপনার শৈশব সম্পর্কে জানতে চাই। ড. কামাল হোসেন : আমার জন্ম কলকাতায়, ১৯৩৭ সালের ২০ এপ্রিল। যদিও আমাদের পারিবারিক সংযোগ ছিল বরিশালের সঙ্গে। আমার দাদা সৈয়দ সা’দত হোসেন ছিলেন সায়েস্তাবাদের জমিদার। সাদু মিয়া নামেই তিনি পরিচিত ছিলেন। আমার বাবা ডা. আহম্মদ হোসেন ছিলেন এমবিবিএস ডাক্তার। কলকাতা প্রেসিডেন্সি কলেজে কয়েকজন মুসলমান ছাত্রের মধ্যে তিনি ছিলেন অন্যতম। ১৯২৯ সালে তিনি ডাক্তারি পাশ করেন। তখন থেকেই কলকাতায় তার প্র্যাকটিস শুরু। আমার চাচা মুহম্মদ আহসান সাহেব বরিশালেই থেকে গেলেন। উচ্চশিক্ষার দিকে যাননি। বাবা ওখানকার জমিদারি দলিলপত্র করে চাচাকে দেখাশোনার দায়িত্ব বুঝিয়ে দিয়ে বললেন, আপনি জমিদারি, বিষয় সম্পত্তি দেখাশোনা করেন আর আমি শহরে প্র্যাকটিস করি। বাবা সবসময় আমাকে বলতেন, দেখ আমি ডাক্তার হলাম। আমি সেই জমিদারি নির্ভর জীবন কাটাতে চাইনি। লেখাপড়ার ওপর খুব গুরুত্ব দিয়েছি। আমি চাই তোমরাও যেন জমিদারি নির্ভর হয়ে না থাক। লেখাপড়া কর, জ্ঞান অর্জন কর। নিজের পায়ে দাঁড়িয়ে একটা সম্মানজনক আত্মনির্ভরশীল পেশাজীবী হিসেবে নিজেকে গড়ে তোল। বাবা এটা একদম অন্তর থেকে বিশ্বাস করতেন এবং নিজে করে দেখিয়েছেন। তাই তিনি সিএসপি পরীক্ষা দিতে আমাদের কখনোই উৎসাহিত করেননি।
সাপ্তাহিক : প্রথম ঢাকা এলেন কবে? ড. কামাল হোসেন : আমরা প্রথম ১৯৪৭ সালে ঢাকা ভিজিট করলাম। এখানে আসার ব্যাপারে প্রস্তুতি নেয়ার জন্য। চূড়ান্তভাবে এসেছি ’৪৯-এ। যাওয়া-আসার মধ্যে কিছু সময় গেছে। এখানে এসে বাবা ঢাকা মেডিকেল কলেজে জয়েন করলেন। ঢাকা মেডিকেল কলেজের ডিপার্টমেন্ট অব ইলেকট্রোথেরাপি তার হাতেই গড়া।
সাপ্তাহিক : আপনারা কয় ভাইবোন? ড. কামাল হোসেন : আমরা এক ভাই এক বোন। বোন আহমদী বেগম। তিনি এখান থেকেই গ্র্যাজুয়েশন করেছিলেন।
সাপ্তাহিক : এখানে এসে কোথায় থাকলেন? ড. কামাল হোসেন : বেইলি রোডের কাছে গুলফেশান বিল্ডিং প্রতিষ্ঠিত হয় ’৫০ সালে। তখন আমরা এখানকার বাসিন্দা। এখন যেখানে আমার বাড়ি তখন সেখানটায় আমবাগান ছিল। গুলফেশানে থাকাকালীন বাবা বললেন এখানে কিছু জায়গা-জমি দেখি। ’৫৪ সালে আমাদের সেই বাড়িটা করা হয়েছে। আর যেখানে এখন আমি থাকি সেটা ’৫৬-৫৭ সালে করা।
সাপ্তাহিক : যখন বাংলাদেশে আসলেন তখন তো আপনি স্কুলের ছাত্র। ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ, স্কুলের ছাত্র। আমি এসে সেন্ট গ্রেগরিতে ভর্তি হলাম। ম্যাট্রিক পরীক্ষা দিলাম ’৫১ সালে।
সাপ্তাহিক : সেই সময়ে আপনার সহপাঠী কারা ছিলেন? ড. কামাল হোসেন : অধ্যাপক আনিসুজ্জামান সাহেব ছিলেন। আর খুব সম্ভবত অধ্যাপক সিরাজুল ইসলাম চৌধুরী সাহেবও থাকতে পারেন। তারপর আমার এক বছরের সিনিয়র ছিলেন শহীদ বুদ্ধিজীবী গিয়াসউদ্দিন সাহেব। কলেজে আমরা আবার একসঙ্গে হলাম। সেন্ট গ্রেগরি কলেজ পরে নটর ডেম কলেজ হলো। প্রথমে লক্ষ্মীবাজারে একটা ছোট দোতলা বাড়িতে ছিল সেন্ট গ্রেগরি কলেজ। শহীদ গিয়াসউদ্দিন সাহেবও গেলেন আমার এক বছর আগে। ’৫৩ সালে সেন্ট গ্রেগরি কলেজ থেকে আমি ইন্টারমিডিয়েট পরীক্ষা দিলাম। ইউনিভার্সিটিতে আসলাম। আমাকে তারা বলল যে, আমরা তোমাকে স্কলারশিপ দিতে চাই। ফুল স্কলারশিপে তুমি আমেরিকায় যেতে পার। আর দুই বছরে তুমি বিএ অনার্স করতে পার অনায়াসে। এটা খুবই অ্যাট্রাকটিভ প্রোপোজাল ছিল বলে আমি সেটা গ্রহণ করলাম। তখন বয়স ছিল মাত্র ১৬ বছর। ১৬ বছর বয়সে তখনকার ছেলের সাত সমুদ্র পার হওয়া সহজ ছিল না। মা-বাবার একমাত্র ছেলে, এটা তাদের জন্য একটা ঝুঁকিপূর্ণ ব্যাপার ছিল। আমি আমার বাবা-মাকে এখনো ধন্যবাদ দিতে চাই যে, তারা আমাকে এত কম বয়সে ছেড়ে বলেছিলেন যে, তুমি চাইলে যাও।
সাপ্তাহিক : আপনার মা কি কিছু করতেন? ড. কামাল হোসেন : আমার মা কোনো পেশাজীবী ছিলেন না। কিন্তু তিনি আমাদের গড়ে তুলেছেন সঠিকভাবে। আশ্চর্যের বিষয় হলো, তিনি যে মন এত শক্ত করলেন এবং বললেন, যাও, এটা ভাবাই যায় না। অথচ আমি তার একটিমাত্র ছেলে। মা-বাবা সবসময় লেখাপড়া এবং আত্মনির্ভরশীল হওয়ার ওপর ভীষণ গুরুত্ব দিয়ে এসেছেন এবং আমিও দিয়ে এসেছি সারাজীবন। আমি তিন বছর মন্ত্রী ছিলাম। এ ছাড়া আমার জীবনে আমি কোনো কাজে বেতন নিই নাই। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নিয়েছি। তবে সবসময়ই চেয়েছি স্বাধীনভাবে থাকব।
সাপ্তাহিক : ম্যাট্রিক এবং ইন্টারমিডিয়েটে আপনার রেজাল্ট কেমন ছিল? ড. কামাল হোসেন : ম্যাট্রিকে আমি বোধহয় ২০-এর মধ্যে ছিলাম। সেহেতু মেরিট স্কলারশিপ নিয়ে কলেজে ভর্তি হয়েছিলাম এবং কলেজে কোনো বেতন দিতে হয় নাই। আর আইএ-তে তো আমি ফার্স্ট হলাম।
সাপ্তাহিক : ম্যাট্রিক পাস করার পর সায়েন্স না পড়ে আর্টসে গেলেন কেন? ড. কামাল হোসেন : ঐ যে আইনজীবী হব বলে। এটা তো বহু আগে থেকেই আমার ইচ্ছা ছিল। সবসময় ভেবেছি স্বাধীন পেশায় যেতে হবে। স্বাধীনভাবে কিছু করতে হবে।
সাপ্তাহিক : স্বাধীন পেশার ক্ষেত্রে আইন পেশাকেই বেছে নিলেন, কোনো প্রেরণা কি কেউ ছিল? ড. কামাল হোসেন : আমার মামার দিক থেকে আত্মীয় বিচারপতি ফজলে আকবর ছিলেন সমগ্র পাকিস্তানের সর্বশেষ প্রধান বিচারপতি। ’৭১-এ উনি রিটায়ার্ড করার পর মারা গেলেন। ব্যারিস্টার হয়েও তিনি ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন। ’৪৭-এর আগে তিনি খুলনার ডিস্ট্রিক্ট জজ ছিলেন। উনি ঢাকা হাইকোর্টের প্রথম রেজিস্ট্রার হলেন। কলকাতায় এলে তিনি আমাদের বাসায় বসে হাইকোর্টের যত ফাইল, কাগজ ইত্যাদি সংগ্রহ করে বান্ডেল করে রাখতেন। এসব নিয়ে কাজ করতেন। পরে সেগুনবাগিচার নাসিম ভিলায় থাকতেন। ওনাকে দেখে দারুণভাবে অনুপ্রাণিত হয়েছি। অন্যদিকে বাবার দিক থেকে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আমাদের একটা আত্মীয়তাও ছিল, আবার বন্ধুত্বও ছিল। উনি চিকিৎসার জন্য বাবার কাছে আসতেন। ওনাকে দেখেও কিছুটা উৎসাহিত হলাম। উনি এবং আমার মামা দুজনই আমাকে লিংকনস’ইন-এ চিঠি দিয়েছেন যে, এই ছেলেকে ভর্তি করা যেতে পারে। এই দুইজন খুব অনুপ্রাণিত করেছেন। বাবার মুখে শুনেছি যে, আমাদের বংশের পূর্বপুরুষরা, দাদার দাদারাও নাকি জুডিশিয়াল লাইনেই ছিলেন। এটা মনে হয় একেবারে জেনেটিক ব্যাপার। তাছাড়া সবসময় স্বাধীন পেশা চাইতাম, সেটাও একটা ব্যাপার । সাপ্তাহিক : আপনি দেশের বাইরে পড়তে গেলেন। তারপর… ড. কামাল হোসেন : আমি নটরডেম ইউনিভার্সিটিতে দুই বছরে ইকোনমিক্সে অনার্স করলাম। সাপ্তাহিক : ইকোনমিক্সে আপনার আগ্রহটা ছিল কেন? ড. কামাল হোসেন : ওখানে গিয়ে যখন চয়েজ করতে হয়েছে যে আমি ল’ করব, কোন সাবজেক্ট ভালো হবে। তখন যেহেতু একটা আইডিয়া ছিল যে, আমাদের উন্নয়নের প্রয়োজন আছে, ইকোনমিক্সের মধ্য দিয়ে উন্নয়নের ইস্যুগুলো বোঝা যাবে, আলাপ করা যাবে। তখন ইকোনমিক্স আমার কাছে গুরুত্ব পেল। পড়তে গিয়েও বেশ ভালো লাগল। বেশ ইন্টারেস্টিং। যখন আমি নটরডেমে ভালো রেজাল্ট করলাম, এরপর তারা আমাকে ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে গ্রাজুয়েট স্কুলে এ্যাডমিশন দিল। কিন্তু আমি বলেছি যে, আমি ইংল্যান্ডে অ্যাডমিশন অ্যাপ্লাই করে রেখেছি। ওটা পেলে কিন্তু আমি ‘ল’ পড়তে সেখানে যাচ্ছি। আমি ইউনিভার্সিটি অব মিশিগানে ইকোনমিক্সে মাস্টার্স কোর্স করলাম। সেখানে থাকতে থাকতে সোশ্যাল সায়েন্স রিসার্চ কাউন্সিলের স্কলারশিপও পেয়েছি। সেটা পাবার পর ওরা আমাকে গ্রাজুয়েট স্টুডেন্টশিপ দিয়েছে যাতে হার্ভার্ডে গিয়ে পিএইচডি করতে পারি। এখানে একটা কনশাস চয়েস করতে হয়েছে যে, আমি হার্ভার্ডে ইকোনমিক্সে পিএইচডি করব, না, স্কলারশিপ পেয়ে ল’ পড়তে যাব অক্সফোর্ডে। এরপরে অক্সফোর্ডে ভর্তি হয়ে গেলাম। সেটা ১৯৫৫ সাল। সাপ্তাহিক : এটার ব্যাকগ্রাউন্ড কি এরকম হতে পারে যে, সেটা হচ্ছে ’৩৭ থেকে ’৫২ এই সময়টাতে বাংলাদেশের রাজনীতি, রাজনৈতিক প্রেক্ষাপট এগুলো আপনাকে আন্দোলিত করেছে? ড. কামাল হোসেন : অবশ্যই। ’৫২ তো আমাদের ওপরে সবচেয়ে বেশি প্রভাব ফেলেছে। ভাষা-মতিন সাহেব, বাংলাদেশ ব্যাংকের সাবেক ডেপুটি গভর্নর আমার খালাত ভাই সৈয়দ আলী কবীরের খুব কাছের বন্ধু ছিলেন। তাঁর স্ত্রী সিদ্দিকা কবীর রান্নার অনুষ্ঠানের সুবাদে দেশ বিখ্যাত। ইন্টারমিডিয়েট পড়ার সময় সৈয়দ আলী কবীরের মাধ্যমে আমি মতিন সাহেবের কাছ থেকে কী কী বই পড়া যায় বা পড়া উচিত সে বিষয়ে কিছু পরামর্শ নিতাম। উনি আমাকে রেফারেন্স বইগুলো দিতেন। যখন ভাষা আন্দোলন চলছিল তখন মতিন সাহেব আমাকে বলতেন যে, দ্যাখ আমরা আন্দোলন করছি, তুমি চিঠিপত্তর পাঠানোর জন্য এই খামগুলো লেখ। ভাষা আন্দোলনে আমার ভূমিকা ছিল মতিন সাহেবের আদেশে কিছু খাম লেখা। এটা নিয়ে আমি খুব গর্ববোধ করি। সাপ্তাহিক : তখন আপনি নিজেই ঠিক করলেন যে আপনি ল’ পড়তে যাবেন? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ, এটা আমার বহু আগে থেকে মনস্থির করা। নটর ডেমে যখন গেছি তখন থেকে চিঠিপত্র অক্সফোর্ডে পাঠাচ্ছি যে, আমি ভর্তি হতে চাই। সাপ্তাহিক : যখন আপনি গ্রাজুয়েশন নিলেন সে সময় আপনার বন্ধু-বান্ধব কারা ছিলেন? আপনার সহপাঠীদের মধ্যে বিখ্যাত কারা ছিলেন? ড. কামাল হোসেন : ১৯৫৪ সালে যুক্তরাষ্ট্রে প্রথম পাকিস্তান স্টুডেন্টস অ্যাসোসিয়েশন গঠন করার একটা উদ্যোগ নেয়া হলো। তখন পুরো যুক্তরাষ্ট্রে বাঙালি ছিল হাতেগোনা মাত্র ৫-৬ জন। সেই কনভেনশনে আমি গেলাম। শিকাগোতে হয়েছিল ওই কনভেনশন। আমার সঙ্গে সেখানে দেখা হলো প্রফেসর নুরুল ইসলামের। উনিও তখন হার্ভার্ডে পড়ছেন। সেখান থেকে উনি এসেছেন। আরেকজন এসেছেন অ্যারিজোনা থেকে তিনি রেজাই করিম পরিবারের সদস্য। আর কনভেনশনে আসেননি কিন্তু ওদের মুখে শুনলাম যে, কলাম্বিয়া ইউনিভার্সিটিতে তখন ছিলেন জি. ডব্লিউ চৌধুরী। আর ছিলেন ঢাকা ইউনিভার্সিটির লাইব্রেরিয়ান আহমাদ হোসেন সাহেব। এই কয়েকজন বাঙালির হিসাব পেলাম, যারা তখন আমেরিকাতে আছেন। আরও ছিলেন মোয়াজ্জেমুল হক। উনি আর দেশে ফেরেননি। আরেকজন ছিলেন ড. হাবিবুজ্জামান, যার সঙ্গে শিকাগোতে দেখা হলো। উনি দিল্লীতে বিশ্ব স্বাস্থ্য সংস্থায় চাকরি করতেন। বাংলাদেশের এই ৫-৬ জনকেই দেখলাম, আউট অব টু হানড্রেড থ্রি হানড্রেড। পাকিস্তানি যারা ছিলেন, পরে তাদের ভেতর যারা নাম করেছেন তাদেরই একজন মুনীর আহম্মেদ খান। শিকাগোতে তখন তিনি ফিজিক্সের ছাত্র ছিলেন। তিনি পাকিস্তান স্টুডেন্ট অ্যাসোসিয়েশনের প্রথম প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন। আমিও এই কমিটিতে ছিলাম। সাপ্তাহিক : সহপাঠী বিখ্যাত আর কে কে ছিলেন? ড. কামাল হোসেন : ইন্টারেস্টিং বিষয় হলো নটর ডেমে আমেরিকানদের মধ্যে সে সময় যারা ছিল তাদের মধ্যে পরে যে সবচেয়ে বিখ্যাত হলো তার নাম রিচার্ড অ্যালেন। সে আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হয়েছিলেন। আমেরিকায় ওদের ডিবেটিং সোসাইটির সদস্য ছিলাম। ইন্টার ইউনিভার্সিটি বিতর্ক প্রতিযোগিতায় যোগদান করেছি, নটর ডেম ইউনিভার্সিটির পক্ষেও ডিবেট করেছি। এভাবে আমেরিকার নানান জায়গায় একটু ঘোরার সুযোগ হয়েছে। নটর ডেমে আমার খুব ভালো বন্ধু ছিল পিটার। সে গ্রিক। কাজ করছিল ইসলামিক স্টাডিজে, ইসলামিক আর্কিটেকচারে। মিশিগান তো ডেট্রয়েড-এর কাছে। সে সময় ওখানকার পত্রিকায় বিজ্ঞাপন দিয়েছে লাইসেন্সধারী ছাত্ররা যদি গাড়ি ডেট্রয়েড থেকে ক্যালিফোর্নিয়া পর্যন্ত চালিয়ে নিয়ে যেতে পারে তো তাদের পেট্রোল খরচও দেয়া হবে, আর কিছু লামসামও দেয়া হবে। আমরা সুন্দর একটা সুযোগ পেলাম। আমাদের দুজনেরই ড্রাইভিং লাইসেন্স ছিল। দুজনই লাইসেন্স নিয়ে হাজির হলাম। একটা নতুন ফোর্ড গাড়ি আমাদের দেয়া হলো। সেই গাড়ি চালিয়ে ডেট্রয়েট থেকে ক্যালিফোর্নিয়া প্রায় ২০০০ মাইল গিয়েছি। মিশিগান থেকে ইন্ডিয়ানা, ইন্ডিয়ানা থেকে ইলিনয়, ইলিনয় থেকে মিনেসোটা, কানসাস, নিউ মেক্সিকো, কলেরাডো। আরো কত জায়গা! প্রায় সারা আমেরিকা ঘুরেছি। আমরা প্রতিদিন ৬-৭ ঘণ্টা ড্রাইভ করতাম, তারপর ঘুমাতাম। কখনো আমার বন্ধু, কখনো আমি- এভাবে পালা করে গাড়ি চালাতাম। এটা ছিল খুবই চমৎকার অভিজ্ঞতা। পুরো যাত্রা শেষ করতে ১৪ দিন সময় লেগেছে। সাপ্তাহিক : এরপর ইংল্যান্ড গেলেন কখন? ড. কামাল হোসেন : জাহাজ ধরে আটলান্টিক পাড়ি দিয়েছি। জাহাজে পার হয়ে লন্ডন থেকে ফ্লাইট নিয়েছি। সম্ভবত আগস্ট-সেপ্টেম্বর মাসে ইংল্যান্ডে গিয়েছি। ইংল্যান্ডে তখন প্রফেসর রেহমান সোবহান সাহেব ছিলেন আমাদের সমসাময়িক। উনি ক্যামব্রিজে আর আমি ছিলাম অক্সফোর্ডে। ’৫৩ থেকে ’৫৫ সালে ছিলাম আমেরিকা। এরপর ’৫৫-৫৭ সালে ফার্স্ট ডিগ্রি শেষ করলাম। ’৫৭-৫৮ বিসিএল পোস্ট গ্রাজুয়েট কোর্স করলাম অক্সফোর্ডে। অক্সফোর্ডে আমি ফার্স্ট ডিগ্রি করার পরে আমাকে প্রস্তাব দেয়া হলো যে, তুমি কুইন্স কলেজের পার্টটাইম টিউটর হয়ে যাও। কুইন্স কলেজে ভালোই সম্মানি পেতাম। দেশ থেকে প্রায় কোনো টাকা নেয়ার প্রয়োজন হতো না। আর বিসিএল করার পরে আমাকে ওখানকার নাফিল কলেজে রিসার্চ স্টুডেন্টশিপ দিল। ওখানে সাধারণত ইকোনমিক্স, পলিটিক্যাল সায়েন্স, স্ট্যাটিসটিক্সের ডিগ্রিধারীরা যায়। কিছু আইনজীবীও তারা নেয়। আমাকে আইনজীবী হিসেবে সিলেক্ট করা হলো। আমার অবস্থার অসাধারণ উন্নতি হলো। থাকা, খাওয়া সবই ফ্রি। হাতে তখন এত টাকা ছিল যে আমি বাড়িতে বলেছি আমার কোনো টাকার দরকার নেই। আমি বার পরীক্ষা দেব এবং সেটা আত্মনির্ভরশীল হয়ে করব। করেছিও। আমার রিসার্চ স্টুডেন্টশিপ ছিল, কিছু শিক্ষকতাও করেছি। টিউটোরিয়ালের জন্য ছাত্র পাঠানো হতো কুইন্স কলেজ থেকে। সেই কাজগুলো করি আমি ’৫৮-৫৯-এ। ’৫৮-এ বিসিএল করলাম। ’৫৮-৫৯-এ আমার পিএইচডির রিসার্চের প্রথম ধাপ। সাপ্তাহিক : পিএইচডি করলেন কেন? ড. কামাল হোসেন : প্রথমত, আমি আত্মনির্ভরশীল হয়ে নিজের খরচায় বার-এট-ল করতে চেয়েছি। বাড়ি থেকে যেন আমাকে টাকা নিতে না হয়। সেটা নিশ্চিত করলাম। আরেকটা হলো যখন এটা পাওয়া যাচ্ছে একটা অভিজ্ঞতা হবে। আর বার-এট-ল করার জন্য তো ওই সময় একটা ফ্রি টাইম থাকে। বার-এট-ল পরীক্ষার জন্য দুই একমাস লাগে। কিন্তু থাকতে হয় এক বছর। কারণ এক বছর এটেন্ডেন্ট দিতে হয় লিংকস-ইন-এ। মজার ব্যাপার হলো তিনটা টার্ম থাকে, প্রত্যেক সময় খেয়ে খাতা সই করতে হয়। ডাইনিং টার্ম বলে ওটাকে। যেহেতু ডাইনিং টার্ম, খাওয়ার জন্য অনেক সময় নষ্ট হয়। সেই সময়টা আমি কাজে লাগিয়েছি। স্যার হামফ্রি ওয়ালডগ আমার সুপারভাইজার ছিলেন, পরে তিনি ওয়ার্ল্ড কোর্টের প্রেসিডেন্ট হলেন। আমি বললাম যে, দেখেন আমার তো বার-এট-ল হয়ে গেছে, পড়াশোনাও করেছি, জ্ঞান অর্জনও কিছু করেছি। আমার পিএইচডি’র বিশেষ কোনো প্রয়োজন ছিল না। আমি তো প্র্যাকটিস করব। তিনি বললেন, না না, বল কি তুমি তো ভালো কাজ করছ! ঠিক আছে আমি ব্যবস্থা করে দিচ্ছি। তোমাকে যে ফেলোশিপ দিয়েছে এটাকে তারা খণ্ড খণ্ড দিতে থাকবে। কোর্টে ছুটি হলে দু-তিন মাস তুমি এখানে এসে প্রত্যেক সামারে কাজ করে তিন বছরের মধ্যে পিএইচডি সেরে নিতে পারবে। এত ভালো অফার, তাই আমি এটা গ্রহণ করলাম। সাপ্তাহিক : পিএইচডি শেষ করলেন কবে? ড. কামাল হোসেন : ’৬১-তে বোধহয় সামারের দিকে আমি যাওয়ার উদ্যোগ নিয়েছি কিন্তু সময় করতে পারিনি। ’৬৩-তে আমি লন্ডনে গিয়েছি। ম্যাটেরিয়াল নিয়ে লেখা শুরু করলাম। ’৫৯ থেকে তখন প্রায় ৪ বছর হয়ে গেছে। ’৬৪-এ পাঁচ বছর হয়ে গেছে। তিন বছরের জায়গায় পাঁচ বছর। তখন স্যার হামফ্রি আমাকে লিখলেন যে, দেখ আমি আর পারছি না। আমি ফ্যাকাল্টিকে বলে বলে তোমার ম্যাক্সিমাম যেটা ছুটি দেয়া যায় তা ইতোমধ্যে দেয়া হয়ে গেছে। এখন তুমি এসে ৪-৬ মাস যদি কাটাও তবে থিসিস শেষ করে, সাবমিট করে ডিগ্রি নিয়ে যেতে পার। তাকে বললাম, ঠিক আছে আমি চলে আসব। আমি ’৬৪-এর এপ্রিল মাসে গিয়েছি। আর সেপ্টেম্বর মাসে থিসিস সাবমিট করেছি। অক্টোবর মাসে ভাইভা পরীক্ষা হয়েছে। সাপ্তাহিক : পিএইচডির বিষয় কী ছিল? ড. কামাল হোসেন : স্টেট সভরেন্টি অ্যান্ড ইউনাইটেড নেশনস চার্টার্ড। এটার জন্য আমি স্যার হামফ্রির কাছে কৃতজ্ঞ। উনি যেভাবে আমাকে সুযোগটা করে দিলেন, ভাবাই যায় না। সাপ্তাহিক : আপনি এরপরে কবে দেশে ফিরে আসলেন, প্র্যাকটিস শুরু করলেন? ড. কামাল হোসেন : ১৯৫৯ সালের ১৬ নবেম্বর। গত ২০০৯-এ পুরো ৫০ বছর হয়েছে। সাপ্তাহিক : ’৫৯-এ এসে কি বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে পরিচয় হলো? ড. কামাল হোসেন : এটা ’৬০-৬১ সাল হবে। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব প্রথম যখন আসলেন। সাপ্তাহিক : আপনি কি নিজেই কাজ শুরু করলেন নাকি কারো সঙ্গে? ড. কামাল হোসেন : অরিজিন্যাল বলে একটা ফার্ম ছিল। এখনো আছে। সেটা শুরুর দিকের একটা ল’ ফার্ম। ওরা ঊনবিংশ শতাব্দীতে কলকাতায় ল’ ফার্ম করেছিল। ওদের একজন বাঙালি পার্টনার ওখান থেকে উদ্যোগ নিয়ে একটা ফার্ম করলেন। ’৫৯-এ বোধহয় ২-৩ বছর হয়েছে। ঐ ফার্মে ৫-৬ জন আইনজীবী ছিলেন। আমার সঙ্গে দেখা হলে আবদুল আহমেদ বললেন, তুমি আমার এখানে জয়েন কর না কেন। জয়েন করলাম। ওখানে দুজন ইংলিশ আইনজীবীও ছিলেন। জাস্টিস মোহাম্মদ হোসেনও ছিলেন। খুবই বিখ্যাত একজন মানুষ। যিনি পরে হাইকোর্টের শ্রদ্ধাভাজন জজ হিসেবে স্বীকৃত হলেন। আমরা একই রুমে বসতাম। ওখানে আমি ১৯৫৯ থেকে ১৯৬২ পর্যন্ত ছিলাম। ওই পিরিয়ডে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে দেখা হতো। উনি এখানে এলে শান্তিনগরে মানিক মিয়ার ওখানে উঠতেন। আমি দু-একবার আমার বাবার সঙ্গে এয়ারপোর্টে গিয়েছিলাম উনাকে আনতে। ওনাকে রিসিভ করতেন মুজিব ভাই, মানিক ভাই আর আমার বাবা। আমি গেছি তাদের সঙ্গে। ওই সময়ে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আমার দেখা হতো। তখনকার মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে আমার দেখা হতো। ওনার সঙ্গে আমি খুব আগ্রহ নিয়ে কথা বলতাম। জানতাম যে উনি ’৫৪ সালে যুক্তফ্রন্ট নির্বাচনের মধ্যে দিয়ে শিল্পমন্ত্রী হলেন এবং সেটা স্বেচ্ছায় ছেড়ে দিলেন। মন্ত্রীত্ব ছেড়ে সংগঠক হিসেবে, সাধারণ সম্পাদক হিসেবে মাঠে ঘুরছেন। আমি ওনার প্রতি খুবই শ্রদ্ধা ও আকর্ষণবোধ করতাম। পরিস্থিতি তো তখন খুবই খারাপ ছিল, মার্শাল ল’ ছিল, রাজনীতি তখন নিষিদ্ধ, পার্টিগুলো নিষিদ্ধ ছিল। সাপ্তাহিক : এই সময়ের কোনো স্মৃতি কি মনে দাগ কেটে আছে? ড. কামাল হোসেন : সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের পেছনে এয়ারপোর্ট থেকে টিকটিকি (গোয়েন্দা বাহিনীর লোক) লেগে যেত। উনি একেক সময় বেশ মজা করতেন। বলতেন, পেছনে তো টিকটিকি লেগেছে, টিকটিকিগুলোকে আমরা একটু খেলা দেখাই, ড্রাইভার একটু ডানে কাটো, একটু বামে কাটো, ঘুরিয়ে নাও গাড়িটা, এভাবে করতে করতে শান্তিনগর আসা হতো। মুজিব ভাইকে প্রশ্ন করতাম, মার্শাল ল’ কতদিন চলবে? উনি বলতেন, এখানে মার্শাল ল’ কোনোদিনই চিরস্থায়ী হবে না। এটা পাঁচ বছর, খুব বেশি হলে দশ বছর, তারপর ওদের ছাড়তেই হবে। ’৬৯-এ আইয়ুব খান যখন বিদায় নিচ্ছেন, তখন মুজিব ভাইকে বলেছিলাম, আপনি কি করে অঙ্ক করে আমাকে ’৫৯ সালে বলেছিলেন যে, আয়ুবের আয়ু খুব বেশি হলে পাঁচ বছর না হয় ১০ বছর হবে। ঠিক দশ বছরে এসে ’৬৯-এর মার্চে আইয়ুব খান বাধ্য হয়েছিল মার্শাল ল’ তুলতে। আরেকটা ঘটনা মনে পড়ে। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব ভিডিও করতেন। ’৫৪-এর যুক্তফ্রন্ট নির্বাচন। ক্যামেরার ফ্রেমে অনেক লোক হাত তুলেছে। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব মুজিব ভাইকে বলছেন, এই হাতগুলো কি আবার উঠবে? মুজিব ভাই তখন বলেছিলেন, স্যার আপনি মাঠে নামেন, দেখেন না এর চেয়ে আরো দশগুণ উঠবে। এই যে তাঁর কনফিডেন্স লেভেল, সেটা অসাধারণ। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবকে উনি এভাবে উৎসাহিত করতেন। বলতেন, দেখেন না আমরা মাঠে নামলে কি অবস্থা হয়। সেই স্পিরিটটা আমাকেও খুব উৎসাহিত করেছে। মাঝেমধ্যে আমরা যেতাম সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের নিজের বাড়িতে। যেটা এখন ‘বিলিয়া’, ধানমণ্ডি ৭নং সড়কে। অনেক পরে, ’৬৩-তে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব মারা গেলেন। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে আমার শেষ দেখা ’৬৩-এর সেপ্টেম্বরে, লন্ডনে। তাঁর স্মৃতিকথার পাণ্ডুলিপি আমাকে দেখিয়েছিলেন। যেটা অনেক পরে আমরা উদ্ধার করেছি তাঁর ছেলের কাছ থেকে । ৬০-৭০ পাতা ওনার ডিকটেশন ছিল। তাঁর মৃত্যুর পর প্রায় ১শ’ সোয়াশ’ পাতা পেয়েছি। ঢাকা থেকে পরে আমরা এটা বই আকারে প্রকাশ করেছি। তিনি মারা যাবার পর মৃতদেহ এখানে আনা হলে লাখ লাখ মানুষ হয়েছিলÑ যেটা আমার কাছে একটা স্মরণীয় ব্যাপার। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। পাকিস্তান সুপ্রিমকোর্ট লাহোরে বসত কিন্তু এখানে বছরে দুইবার করে আসত। ঢাকায় জগন্নাথ হলে বসত। এটা তখন অ্যাসেম্বলি বিল্ডিং হিসেবে ব্যবহৃত হতো। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে শেষ কেস, সেটা খুব সম্ভবত সুপ্রিমকোর্টেরই কেস ছিল। নারায়ণগঞ্জের র্যালি ব্রাদার্সের নদীর ধারের জমি নিয়ে একটা কেস হয়েছিল। র্যালি ব্রাদার্সের পক্ষে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব ছিলেন, আমি ছিলাম উনার জুনিয়র হিসেবে। ঘটনাটি ’৬৩ সালের। উনি বললেন যে, আমি লাহোর যাচ্ছি, ওখানে আমার একটা হিয়ারিং আছে, দু-এক মাসের মধ্যে এখানে আবার আসব। গিয়েই উনি অ্যারেস্টেড হলেন। এটা সম্ভবত তাঁর জীবনের প্রথম গ্রেফতার হওয়া। সাপ্তাহিক : আপনি তো কিছুকাল ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়িয়েছেন? ড. কামাল হোসেন : আমি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে পার্টটাইম শিক্ষকতাও করেছি। ’৬১ থেকে পার্টটাইম শিক্ষকতা শুরু করি। প্রথমে আমি ইন্টারন্যাশনাল রিলেশন পড়াতাম। হিস্ট্রি অব ইন্টারন্যাশনাল ল’ পড়ানো শুরু করলাম। তার কিছুদিন পরেই জার্মানির একজন বিখ্যাত আন্তর্জাতিক ল-ইয়ার প্রফেসর ডাম এলেন ডিন হিসেবে। আমি খবর পেয়েছি যে, এসেই তিনি আমাকে খুঁজছেন। আমি গেলাম। বললেন, আমি শুনেছি তুমি ইন্টারন্যাশনাল ল’ বিষয়ে রিসার্চ করা লোক, তো তুমি ল’ ফ্যাকাল্টিতে নেই কেন? যদিও আমি ল’ ফ্যাকাল্টিতে যেতে চেয়েছি কিন্তু তখন আমাকে বলা হয়েছিল এই বিভাগে এখন জায়গা নেই। বিচারপতি হামুদুর রহমান তখন ভাইস চ্যান্সেলর। আমাকে বললেন যে, তুমি বিসিএল করেছ। অক্সফোর্ডে ডিগ্রি করেছ, ব্যারিস্টার হয়েছ, ইউনিভার্সিটিতে কেন আসবে? আমি বললাম, আপনি বুঝতে পারছেন না, আমি তো শিক্ষকতা দেশের বাইরেও করেছি। আমার শিক্ষকতা করার একটা বিশেষ আগ্রহ আছে। বললেনÑ না, না, না তুমি গিয়ে প্র্যাকটিস কর। উনি আমাকে এভাবে দূরে রাখলেন। প্রফেসর ডাম বললেন, ‘না। তুমি স্পেশালাইজড লোক, আমি তোমাকে ল’ ফ্যাকাল্টিতে চাই। আমি দুই সেকশন নেব, তুমি দুই সেকশন নেবে। তারপর আমি ’৬৮ সাল পর্যন্ত ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষকতা করেছি। সাপ্তাহিক : ঢাকা বিশ্ববিদ্যারয়ের খ্যাতিমান শিক্ষক অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে আপনার যোগাযোগ কেমন ছিল? ড. কামাল হোসেন : খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলাম তার। খুবই শ্রদ্ধা করতাম। রাজ্জাক সাহেব তো আমাদের সকলের স্যার। ঢাকা ইউনিভার্সিটিতেই তার সঙ্গে আমার প্রথম দেখা হয়েছে। আনিসুজ্জামান, খান সারওয়ার মুরশিদ, মোশারফ হোসেন, মুস্তাফা নূরউল ইসলাম, ড. মল্লিক, জিল্লুর রহমান সিদ্দিকী এঁদের নিয়ে আমাদের একটা ঘনিষ্ঠ সার্কেল ছিল সে সময়। আনিসুজ্জামানের সঙ্গে আমার ঘনিষ্ঠতা ছিল। আমরা বন্ধু ছিলাম। আনিসের মাধ্যমে স্যারের সঙ্গে পরিচিত হলাম। স্যার বলতেন, তুমি অক্সফোর্ড থেকে বিসিএল করেছ, তোমাকে শিক্ষকতা করতেই হবে। এসব বার-টার বাদ দাও। উনি খুব উৎসাহ দিতেন, বলতেন, পিএইচডি শেষ না করে এসেছ, তোমাকে শেষ করতেই হবে। আমি দেখি তোমার জন্য প্লেনের ব্যবস্থা করে দেব। ট্রাভেল ফেলোশিপ নিয়ে দেব ইত্যাদি। এভাবে সেই ’৬৪ সালে তার আশীর্বাদ নিয়ে আমি ৬ মাসে পিএইচডি শেষ করে এলাম। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমাদের এই গ্রুপটা খুবই লাইভলি গ্রুপ ছিল। মানে শিক্ষকদের মধ্যে যাদেরকে মনে করা হতো যে, না, এরা মার্শাল ল’ মানে না। তখন আমাদের বিরুদ্ধে রিপোর্টও হয়েছে যে, এরা কমনরুমে বসে মার্শাল ল’এর বিরুদ্ধে কথা বলে। আমাদেরকে সেটা আবার বলাও হয়েছে যে, তোমাদের বিরুদ্ধে রিপোর্ট হচ্ছে। খান সারওয়ার মুরশিদ সে সময় একটা পত্রিকা বের করতেন ‘নিউ ভ্যালুজ’ নামে। পত্রিকাটা আমাকে আকৃষ্ট করেছিল। কিছু লেখাও দিয়েছি সেখানে। পত্রিকাটিকে কেন্দ্র করে, কমনরুমে ডিসকাশন সার্কেলও ছিল আমাদের। সেখানে রাজ্জাক সাহেবের সঙ্গে সম্ভবত প্রথম পরিচয়। সেটা আনিসুজ্জামানই করিয়ে দেয়। মার্শাল ল’ হওয়ার পর-পর রাজ্জাক স্যার হার্ভার্ডে চলে গিয়েছিলেন ভিজিটিং ফেলো হিসেবে। দেড় বছরের মধ্যে উনি সেখানে বসে পেপার লিখেছেন, ‘ডিফেন্স এ্যান্ড ডেমোক্র্যাসি’ নামে। তিনি বলেছেন, গবেষণাতে দেখা যায় কোনো দেশে মিলিটারি ডিফেন্স বাজেট যখন ৩০-৪০ শতাংশর উপরে চলে যায় তখনই সিভিলিয়ান গভর্নমেন্ট অকেজো হয়ে যায়। তখন ওইসব দেশে মার্শাল ল’ হয়। হার্ভার্ডের এই রিসার্চটা আমাদের ডিসকাশন সার্কেলে পরে দিয়েছিলেন তিনি। গোয়েন্দা সংস্থার কাছে এটা রিপোর্ট হয়েছে। ওনার বিরুদ্ধে বিশেষ করে বলা হলো যে, উনি এসব কাজ করছেন। সেভাবে সবাই একটু সতর্ক হলাম যে, আমাদের ওপর এ রকম একটা নজর রাখা হচ্ছে। তার খুবই ঘনিষ্ঠ ছিলেন ড. মাজহারুল হক। প্রফেসর মোজাফ্ফর আহমেদ চৌধুরীও ঘনিষ্ঠ ছিলেন। আর তাঁর দাবা খেলার বন্ধু ছিলেন প্রফেসর কাজী মোতাহার হোসেন। আমাদের মুজিব ভাইও বলতেন, উনি তো আমাদের সকলের স্যার, আমারও স্যার। স্বাধীনতার পর ১৯৭৩ সালে ঢাকা ইউনিভার্সিটি অর্ডিন্যান্স হওয়ার সময় তাদের অবদান ছিল। তারা সব করে দিলেন। মুজিব ভাই তখন বলেছিলেন, এই যে এত অটনমি (স্বায়ত্তশাসন) দেয়া হলো, এটা কি হজম করতে পারবে ইউনিভার্সিটি? এটা তার দূরদর্শিতা। বললেন, স্যাররা করে দিয়েছেন তো আমিও কিছু বলতে পারি না, তোমারও কিছু বলার কথা না। আমি ল’ মিনিস্টার হিসেবে বলেছি, সবই স্যাররা করে দিয়েছেন। আমাদের কী বলার থাকবে? সব ব্যাপারে তো নির্বাচন হয়, হেড অব ডিপার্টমেন্ট, ডিন, ভাইস চ্যান্সেলর। তখন মুজিব ভাই বলেছিলেন, এতগুলো ইলেকশন কি হজম করা যাবে? সাপ্তাহিক : সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সঙ্গে তো আপনি কাজও করলেন, কাছে থেকেও দেখেছেন, তার পেশাজীবন সম্পর্কে যদি বলেন। ড. কামাল হোসেন : প্রথম তো তাকে রোল মডেল হিসেবে দূর থেকে দেখেছি। তিনি বিসিএল করেছেন, আমিও বিসিএল করব। ব্যারিস্টার হয়েছেন, আমিও হব ইত্যাদি। আর তার সার্টিফিকেট নিয়ে ভর্তি হয়েছি ওখানে। উনি যখনই এখানে আসতে লাগলেন আমি অ্যাটেন্ড করতাম। কয়েকটা কেসে তিনি নিজে বলতেন, বিশেষ করে বিনা বিচারে যাদের আটক করা হয়েছে সেসব ক্ষেত্রে। সবচেয়ে স্মরণীয় ঘটনা ছিল মওলানা ভাসানী যখন আটক হলেন। এটা ’৬১ অথবা ’৬২ সালের কথা। ভাসানী অনশনে চলে গেলেন। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবকে বলা হচ্ছে যে, আপনি ওনার পক্ষে দাঁড়ান। আমিও অতি আগ্রহের সঙ্গে গেছি। তিনি গেলে তো পাঁচ-দশজন তরুণ এমনিই জুটত। সম্ভবত সেটা শুক্রবার ছিল। তখন তো শুক্রবারে কোর্ট বসত। শনি-রবি ছুটি ছিল। তিনি খুবই নাটকীয়ভাবে বললেন যে, আমাদের প্রবীণ নেতাকে মার্শাল ল’-এ আটক করেছে ধানমণ্ডির কোনো বাড়িতে। উনি অনশনে আছেন। এখন তো আমি চাই যে, ওনার ইমিডিয়েটলি রিলিজ অর্ডার হয়ে যাক। তার জীবনের ব্যাপারে আমাদের একটা দায়িত্ব আছে। কোর্ট বার বার বলছে যে, দেখুন, আজ তো শুক্রবার, এখন তো প্রায় দুটো বাজে। কি করে আজকে আমরা উনাকে ছেড়ে দিই? রাষ্ট্রপক্ষকে তো কিছু বলার একটা সুযোগ দিতে হবে। একটা দিন তো যেতে হবে, সোমবার প্রথম আওয়ারে দেখা যাবে। তখন তিনি বললেন, আমি আর কিছুই বলছি না, হয়ত আপনাদের আর কষ্ট করা লাগবে না। সোমবারে আপনারা হয়ত তাঁর জানাজায় যেতে পারবেন! এই কথা শুনে জজ সাহেব খুব অসহায় বোধ করলেন। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব এ রকম কথা বললেন! আমরাও খুব নার্ভাস হয়ে গেলাম। আমি বললাম, না, এটা তো খুব সাংঘাতিক ব্যাপার, মওলানা সাহেব যদি অন্তরীণ অবস্থায় মারা যান? সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব বললেন, এটা তো কোর্টে বলেছি। আমি কি মনে করেছি যে উনি মারা যাবেন? না। তবে দেখ এটার ইফেক্ট হবে, কালকেই ওনাকে ছেড়ে দেবে। সেটাই হলো। শনিবারে ভাসানীকে মুক্ত করে দেয়া হলো। মানে ভয় পেয়ে গেল যে, যদি কিছু একটা হয়ে যায় তো সরকারের ওপর এটার দায়িত্ব বর্তাবে। সাপ্তাহিক : সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের আইন পেশা সম্পর্কে কিছু ঘটনা যদি বলেন? ড. কামাল হোসেন : অনেকেই মনে করত, তিনি এত ব্যস্ত মানুষ, সারাদিন এত লোক তার কাছে আসছেন, রাজনৈতিক আলোচনা করছেন, তিনি নিজে বিভিন্ন জায়গার দাওয়াত গ্রহণ করছেন, এত ব্যস্ততার মধ্যেও তিনি ওকালতি করতেন কিভাবে? তিনি সাধারণত রাত এগারোটা-বারোটায় ফিরতেন। বলতেন যে, আমার বইগুলো রেখে যাও, ব্রিফগুলো রেখে যাও আমি রাতে পড়ব। সকালে গেছি, আমাকে বলছেন, হ্যাঁ, এই দশটা বই কেন দেয়া হয়েছে? এগুলো তো প্রাসঙ্গিক বই না। দশটার মধ্যে পাঁচটা ভালো, বাকিগুলো আমার খামোখা সময় নষ্ট করেছে, ইত্যাদি। বুঝতাম যে, উনি বইগুলোর লাইন বাই লাইন পড়েন। কোনটা প্রাসঙ্গিক কোনটা অপ্রাসঙ্গিক, সব উনি পড়েন। তারপর আলাদা করে রাখেন। যখন পড়েন, প্রত্যেক লাইন, দাড়ি, কমা পর্যন্ত মার্ক করেন। আমি নিজে বই পড়ার এই কায়দাটা ওনার কাছ থেকে শিখেছি। আমাকে বলতেন, বই দিয়ে কেস হয় না, কেস হয় ফ্যাক্ট-এর ওপরে। প্রত্যেক কেসের ফ্যাক্ট ইউনিক। প্রত্যেক কেসের বৈশিষ্ট্য আলাদা। এটার ওপরে আর্গুমেন্ট করবে। তারপর কোন আইনটা প্রাসঙ্গিক সেটা দেখাবে। আর কেসের ফ্যাক্ট বাদ দিয়ে যেই তুমি শুধু বই পড়া শুরু করবে, আসল জিনিস থেকে তোমার দৃষ্টি অন্যদিকে ঘুরে যাবে। আমার পেশাগত জীবনে আমি এই কথার অ্যাপ্লিকেশনটাও দেখেছি। সাপ্তাহিক : সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের কেস মুভ করার দু-একটা ঘটনা যদি বলতেন। ড. কামাল হোসেন : খুব বড় কেস ছিল চন্দ্রনাথ ফিল্মের। চন্দ্রনাথ ফিল্মকে দেখাবার অধিকার নিয়ে দুই ডিস্ট্রিবিউটরের মধ্যে লড়াই। দু’জনেই কন্ট্রাক্ট করেছে। চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেছে। দু’জনই বলছে যে, দেখানোর অধিকার আমার রয়েছে। সেই মামলার এক পক্ষে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব। সাবেক অ্যাটর্নি জেনারেল ফকির শাহাবুদ্দীন তখন ওনার জুনিয়র। আর আমি ওনাদের সঙ্গে ভিড়লাম। প্র্যাকটিসে তখন আমার দু’বছরও হয়নি। জাস্ট শোনার জন্য, বোঝার জন্য, শেখার জন্য তাদের সঙ্গে বসেছি। আর অন্য পক্ষে মামলা লড়তে করাচি থেকে এসেছেন বিখ্যাত আইনজীবী এসএ ব্রোহি সাহেব। ব্রোহি সাহেবের সঙ্গে যে জুনিয়ররা এলেন তাদের পেছনে তিন-চারজন পিয়ন প্রায় চারটা বড় বড় বইয়ের বান্ডিল নিয়ে আদালতে হাজির হলো। প্রায় ১০০টা বই হবে। আর সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের সামনে কোনো বই নাই। ক্লায়েন্টও খুব নার্ভাস হয়ে যাচ্ছেন, বলছেন, আপনারা এভাবে বই ছাড়া উপস্থিত হলেন। আপনাদের প্রিপারেশন আছে তো! আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। আমরাও সান্ত্বনা দিয়েছিলাম যে, সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব কোনো সময় তৈরি না হয়ে আদালতে আসবেন না। উনি মাথায় হাত দিয়ে চোখ বন্ধ করে শুনছেন। ব্রোহি সাহেব আইনের থিওরি, ফিল্মের ওপরে কী ধরনের রাইট হয়, কপিরাইট, এসব তাত্ত্বিক কথাগুলো বলছেন, সবাই খুব মনোযোগ সহকারে শুনছেন। আর আদালতকে বই দেখাচ্ছেন, প্রায় ২০টা-৫০টা বই। তার পরে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব দাঁড়িয়ে চোখ কচলিয়ে বললেন, মাই লর্ড আপনারা তো তাত্ত্বিক কথা খুব শুনেছেন, জ্ঞান যা অর্জন করার আমরা সবাই করেছি। কিন্তু এখন আসুন আমরা একটু কেসে ফিরে আসি। পুরো পরিবেশটাই মুহূর্তে ঘুরে গেল। এই যে আপনি ১৭ নং পেইজে একটু দেখেন, পেপার বুকে। এই যে চিঠি। তারপর উনি পর্যালোচনা করলেন লাইন বাই লাইন। এটা দাঁড়াবে না। এই ডকুমেন্টই দাঁড়াবে। এভাবেই তাঁর যুক্তিতর্ক শেষ করলেন। অবশেষে তিনি তার মক্কেলের পক্ষেই রায় পেয়ে গেলেন। ওই একটা ডকুমেন্টের ওপরেই রায় পেলেন। পরে উনি আমাদের বললেন যে, দেখ কেস দাঁড়ায় ফ্যাক্টের ওপরে। আইন তো ঠিকই আছে। কিন্তু আইনটা প্রয়োগ করার সময় যে ফ্যাক্ট সেসব ডকুমেন্ট দেখতে হবে। সাপ্তাহিক : উনি তো বড় আইনজীবী ছিলেন? কোর্ট সম্পর্কে উনার আচরণ কেমন ছিল? ড. কামাল হোসেন : শেখ মুজিব বোধহয় তখন জামিন অথবা যে কোনো পলিটিক্যাল কেসের জন্য একবার ম্যাজিস্ট্রেট কোর্টে গেছেন। সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব উনার পক্ষে আইনজীবী হিসেবে গেলেন। উনি ম্যাজিস্ট্রেটকে যে সম্মান দেখালেন, ম্যাজিস্ট্রেট পর্যন্ত দাঁড়িয়ে যায় এ রকম অবস্থা আর কি। আমাকে বললেন দেখ, কোর্ট তো কোর্ট। এ জন্য নিম্ন আদালতকে বেশি সম্মান দেখানো দরকার। যাতে ম্যাজিস্ট্রেট মনে করে একটা বড় দায়িত্ব নিয়ে এখানে বসে আছে। আমাদের একটা শিক্ষা হলো যে, সব কোর্টকে সম্মান দেখানো দরকার। এবং সেটা সিরিয়াসলি দেখানো দরকার। সাপ্তাহিক : মামলা নিয়ে আর কোনো স্মৃতি? ড. কামাল হোসেন : তার সঙ্গে একটা কেস-এর ঘটনা আমি স্মরণ করতে পারি। উনি বললেন যে, আমি করাচি হাইকোর্টে একটা কেস করব তুমি আসতে পার। করাচি গেলাম। চিফ জাজ স্যার জর্জ কনস্টিটিউশন দাঁড়িয়েছেন, ক্রিমিনাল কেসে কোনো একটা পয়েন্ট দাঁড়িয়ে আরগু করছেন। কনস্টিটিউশন বলছেন, আচ্ছা এর নজির ক্রিমিনাল প্রসিডিউর কেসের কোন সেকশনে? সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব বললেন, মাই লর্ড আপনি প্রতিদিন এই কেসগুলো শুনানি করছেন, কোন সেকশনে এটা তো আপনি আমার চেয়ে ভালো জানবেন। সবাই তখন হেসে দিতে বাধ্য হলো। ওনার সঙ্গে শেষ কেসের ঘটনাটা বলি। নারায়ণগঞ্জে নদীর ধারে একটি সরকারি জমি বেদখল সংক্রান্ত একটি মামলা। আমাকে বললেন, নারায়ণগঞ্জ গিয়ে মাঠপর্যায়ে ঘটনাটা দেখে আস। ওই সাইটটা যে নদীর ধারে সেটা ওই নদীর ভেতরে থাকলে তো ওটা সরকারি হয়। আর যদি ঐখানে নদীর টাইডাল এফেক্ট না থাকে তো এটা যার জমি তার থাকে। আমরা অনেক ছবি তুললাম ওখানে। অনেক ছবি নিয়ে আসলাম, এই হলো নদী, এই হলো জমি, এই হলো র্যালি ব্রাদার্সের বিল্ডিংগুলো ইত্যাদি। তখন তিনি বললেন, ফটোগ্রাফ ঠিক আছে কিন্তু তুমি এখন ফটোগ্রাফে যা আছে তা ভাষায় লেখ। আর ভাষায় এমনভাবে স্পষ্ট করে লেখ যেটা পড়লেই মূল ছবিটা আমার চোখের সামনে ভেসে ওঠে। যদি ঠিকমতো ড্রাফ্ট করতে পারা যায় তাহলে ছবির সাহায্য নেয়ার প্রয়োজন নাই। এভাবে ড্রাফটিং শিখলাম ওনার কাছে। আমি ড্রাফ্ট করলাম। উনি প্লেনে উঠে লাহোর চলে গেলেন। লাহোরে গিয়ে জেলে বন্দি হলেন। জেলখানা থেকে চিঠি আসল আমার কাছে। ওই কেস সম্পর্কে এই পয়েন্ট, এই পয়েন্ট, এই পয়েন্ট ডেভেলপ কর, আমি এসে শুনানি করব। ওনার আর আসা হলো না। উনি জেল থেকে বেরিয়ে চিকিৎসার কারণে বৈরুতে গেলেন। ৫ ডিসেম্বরে বৈরুতে মারা গেলেন। সাপ্তাহিক : আপনার নিজের স্বাধীনভাবে প্র্যাকটিস করার অভিজ্ঞতাটা তখন থেকে হলো? ড. কামাল হোসেন : ’৬৩-তে ওনার মৃত্যুর পরে তো আওয়ামী লীগের পুনর্জন্ম হলো ’৬৪-এর ডিসেম্বরে। ’৬৫-এ পাক-ভারত যুদ্ধ হলো। যুদ্ধের পরেই তো ৬ দফা পেশ করা হলো। তখন থেকেই পত্রপত্রিকায় আমার নাম উঠল বিভিন্ন কেসের কারণে। ইত্তেফাককে বাজেয়াপ্ত করা হয়েছে ১৯৬৬ সালের ৭ জুন। সাপ্তাহিক : ইত্তেফাকের মামলার ঘটনাটা বলবেন? ড. কামাল হোসেন : ইত্তেফাকের সম্পাদক মানিক মিয়াকেও অ্যারেস্ট করা হলো। মুজিব ভাইকেও অ্যারেস্ট করল, পত্রিকাও বাজেয়াপ্ত হলো। তখন যে সব আইনজীবী প্রথমেই এর মধ্যে জড়িত হলেন তার মধ্যে আমিও ছিলাম। ব্যারিস্টার আমীর-উল ইসলাম ছিলেন, ফকির শাহাবুদ্দিন, কে এস নবীও ছিলেন। মানিক মিয়ার বড় ছেলে ব্যারিস্টার মইনুল হোসেন তখনই এসেছেন পড়াশোনা শেষ করে। তিনিও এসেছেন বাবার পক্ষে লড়তে। আমরা জেলে দেখা করতে গেলাম। মুজিব ভাইয়ের পক্ষেও আমরা দাঁড়ালাম। যেটা স্মরণীয় ঘটনা যে মানিক ভাই আর ইত্তেফাকের পক্ষে আইনি লড়াই করতে পাকিস্তান থেকে মাহমুদ আলী কাসুরীকে আনা হলো। উনি খুব উঁচু মানের আইনজীবী ছিলেন। ব্রোহি বা মনজুর কাদের যেমন নামকরা আইনজীবী তিনিও সেরকম। উনি তিন দিন কেস চালালেন ইত্তেফাকের পক্ষে। চতুর্থ দিনে উনি বললেন যে আমার সুপ্রিমকোর্টে ডাক পড়েছে আমি তো আগামীকালকে থাকতে পারছি না। শুনানি মুলতবি করা হোক। তখন চিফ জাস্টিস ছিলেন বিএ সিদ্দিকী। উনি বললেন, কেন আপনার জুনিয়র যারা আছেন তারা কেস করবে। ওনারা তো সব ব্রাইট জুনিয়র। আমি তো সঙ্গে সঙ্গে নার্ভাস হয়ে পড়েছি যে এত বড় কেস মাহমুদ আলী কাসুরী চারদিন চালিয়েছেন, উনার অনুপস্থিতিতে আমার ওপরে পড়লে আমি সেটা কিভাবে ম্যানেজ করব? চিফ জাস্টিস বললেন, নো নো, তুমি কেন করতে পারবে না, কর। কাসুরী সাহেব বললেন, হ্যাঁ করতে পারলে কর তুমি। বলে উনি চলে গেলেন। বোধহয় দু’তিন দিন আমি চালালাম। পরে আমাদের পক্ষে রায় হলো। এটা এ কারণে বলছি যে কোর্টের রিপোর্টে চিফ জাস্টিস সার্টিফিকেট দিলেন যে কাসুরী যাওয়ার পরে কামাল হোসেনও কেসটা ভালোই চালিয়েছে। সাপ্তাহিক : সেটা আপনার ক্যারিয়ারে ব্রেক থ্রু হলো নিশ্চয়ই। ড. কামাল হোসেন : অবশ্যই। সাংঘাতিক ব্রেক থ্রু। আমি নিজে খুব ফিল করি। তখন প্র্যাকটিসে এসেছি মাত্র ছয় বছর। ছয় বছরে এই লিফটা আমার জন্য টার্নিং পয়েন্ট ছিল। তারপরে ফার্স্ট বার কাউন্সিল ইলেকশন হলো। সবাই বলল যে তুমি দাঁড়াও। আমি বললাম ছয় বছরের অভিজ্ঞতা নিয়ে আমি দাঁড়াব! ওখানে যারা দাঁড়াচ্ছেন তাদের সবাই ৩০ বছর, ২৫ বছর অভিজ্ঞতাসম্পন্ন আইনজীবী। আসাদুজ্জামান সাহেব, আতাউর রহমান খান সাহেব, মির্জা গোলাম হাফিজ সাহেব, সৈয়দ আজিজুল হক। এরা সবাই আমার বয়সেও বড়, অনেক সিনিয়র। আমাকে বলছে যে, তুমিও দাঁড়িয়ে যাও। মনে রাখবার মতো ঘটনা। বার কাউন্সিলে মেম্বার পদে আমি নির্বাচিতও হয়ে গেলাম। তখন তো এদিক থেকে বার কাউন্সিলে নির্বাচিত হলে অটোমেটিকলি পূর্ব পাকিস্তান, পশ্চিম পাকিস্তান বার কাউন্সিল মিলে হয়ে যেত। তখনকার সিনিয়রদের উদারতার কথা বলি, আমি ভীষণভাবে তাদের কাছ থেকে সমর্থন পেয়েছি। ফলে ’৬৭, ’৬৮, ’৬৯ সালে পূর্ব পাকিস্তান বার কাউন্সিলে আমাকে ওরা ভাইস চেয়ারম্যান করে দিলেন। আতাউর রহমান, আসাদুজ্জামান সাহেব, ফরিদ আহমদ সাহেবও ওই কাউন্সিলে নির্বাচিত হয়েছিলেন। পরবর্তী টার্মে আমাকে ওরা নির্বাচিত করে নিলেন। আর পাকিস্তানের শেষ বার কাউন্সিল অর্থাৎ ’৬৯-’৭০ অল পাকিস্তান বার কাউন্সিল নির্বাচনে সবাই মিলে আমাকে নির্বাচিত করলেন। ’৭১ সালে আমি যখন এখানে ধরা পড়েছি, জেলে গেছি, আই ওয়াজ সিটিং ভাইস চেয়ারম্যান অফ অল পাকিস্তান বার কাউন্সিল। সবাই বললেন, তুমি ভাইস চেয়ারম্যান। বার তুমি ভালো বোঝ, তুমি বার কাউন্সিলে থাক। আমরা তো অন্য বিষয় নিয়ে ব্যস্ত থাকি। বার কাউন্সিলে প্রথম তৈরি হলো কোড অব কন্ডাক্ট। ’৬৮-’৬৯-এ আমি সেটা ড্রাফ্ট করেছি। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধু আপনাকে খুব অল্প বয়সেই আইন মন্ত্রণালয়, পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিয়েছিলেন। সে সময় তো আপনি আপনার প্রফেশনের জায়গাটায় একেবারে চূড়ায় ছিলেন। ড. কামাল হোসেন : আমরা তরুণ আইনজীবীরা সাহসিকতারও পরিচয় দিয়েছি। তাছাড়া কিছু ভালো আইনজীবী বাম রাজনৈতিক দল, যেমন ন্যাপে ছিলেন। কিছু ডানে ছিলেন, যেমন মুসলিম লীগ। আওয়ামী লীগের মধ্যে সোহ্রাওয়ার্দী সাহেব অবশ্য সামনে ছিলেন। আবদুস সালাম, জহির উদ্দিন সাহেব ছিলেন নামকরা আইনজীবী। আর আমরা হাইকোর্ট পর্যায়ে খ্যাতি পেলাম বিশেষ করে ইত্তেফাক মামলার ইস্যুতে। আর হেভিয়েস কপার্স মামলায়। তারপরে যখন আগরতলা মামলা শুরু হলো তখন আমাদের ফ্রন্ট লাইনে আসতে হলো। তখন একটা ভয়ভীতি ছিল। অনেকে এসে বারবার আমাদের কানের কাছে বলেছে, একটু চিন্তা-ভাবনা কর। তোমাদেরও আসামি করে দেবে। সিএসপিদেরও করেছে, ওমুককে করেছে। তোমাদের মতো আইনজীবীদের আসামি করতে খুব বাধবে না তাদের। আমরা সেটাকে উপেক্ষা করেছি। আগরতলা ষড়যন্ত্র মামলায় বিখ্যাত আইনজীবী টমাস উইলিয়াম কিউসি আসলেন লন্ডন থেকে। তাকে আমরা অ্যাসিস্ট করলাম, রিট পিটিশন করে দিলাম। উইলিয়াম নিজেই বললেন যে না আমি তো মুখপাত্র হয়ে কাজটা করেছি মাত্র। আগরতলার কেসেও যাওয়া শুরু করলাম। ওখানে তো সালাম খান সাহেব বঙ্গবন্ধুর পক্ষে প্রথমে জেরা করলেন। আমাকে নিয়োগ দেয়া হলো এই মামলার অন্যতম আসামি সার্জেন্ট জহুরুল হকের পক্ষে। আটক অবস্থায় গুলিবিদ্ধ হয়ে জহুরুল হক শহীদ হলেন। কোর্টে যাওয়া হতো, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা সাক্ষাৎ হতো, এটা শেষের দিকে। ২১শে ফেব্রুয়ারিতে কেসটাই কলাপ্স হলো। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন যে, আমি চাই যে আগরতলা কেসে তুমি আমার জন্য ফাইল কর। আমি টমাস উইলিয়ামের সঙ্গে হাইকোর্টে অলরেডি অ্যাপিয়ার করেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন যে, আমি চাই এই কেসে তুমি আস। বঙ্গবন্ধুর যুক্তি হলো আমার কাছ থেকে যদি কোনো রাজনৈতিক নির্দেশনা বা বক্তব্য বাইরে যেতে হয়, কাউকে কিছু বলতে হয়, আমি চাই যে তুমি এখানে থাক। আমার কাছে থাক। এসব ব্যাপারে তোমাকে দরকারি মনে করি। এইভাবে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে ঘনিষ্ঠতা শুরু হলো। সাপ্তাহিক : আইনজীবী থেকে ক্রমশ রাজনৈতিক ঘটনাবলির সঙ্গে জড়িয়ে পড়লেন? ড. কামাল হোসেন : আমি একটু বিস্তারিত বলতে চাই। ’৬৯-এ রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স বসল। প্রস্তাবটা আসল যে এখান থেকে নেতারা যাবে, শেখ মুজিবকেও ওখানে সবাই আশা করছে যে উনি যাবেন। না হলে তো গোলটেবিল বৈঠক অসম্পন্ন থাকবে। তখন বঙ্গবন্ধু প্রথম আমাকে বললেন যে, পশ্চিম পাকিস্তানিদের বল জেল থেকে অন্তত তাজউদ্দীনকে ছাড়তে। তাজউদ্দীন এসব ব্যাপারে আমার প্রতিনিধি হিসেবে কথা বলতে পারবে। ওই প্রস্তাবটা দেয়ার পর তাজউদ্দীন ভাই ছাড়া পেলেন। বঙ্গবন্ধু তো নাটকীয়ভাবে বেরুলেন, মানে কেস উইথড্র হয়ে। কিন্তু তাজউদ্দীন ভাই তো এই কেসের আসামি ছিলেন না। ওনাকে অন্য কেসে অথবা ৬ দফার ব্যাপারে ধরেছিল। ওনাকে ছাড়ল আর আমাকে তখন বঙ্গবন্ধু (তখন অবশ্য মুজিব ভাই বলতাম) বললেন যে, তুমি এখন তাজউদ্দীনের সঙ্গে অ্যাটাচড। যা কিছু করবে তাজউদ্দীনের সঙ্গে কথা বলে করবে। সাপ্তাহিক : রাউন্ড টেবিল বৈঠকে অংশ নেবার কাহিনীটা… ড. কামাল হোসেন : তখন রাউন্ড টেবিলে যাওয়ার কথা উঠল। চারিদিকে পলিটিক্যাল প্রেসার তখন বাড়ছে। আন্দোলনও বেশ জোরদার হয়ে উঠেছে। আমরা লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি যে দেখ, এখন এটা চলতে পারে না। কারণ বাই দ্যাট টাইম কনস্টিটিউশন আইদার রিভাইভ হতে যাচ্ছে অথবা হয়েছে। ইমারজেন্সি উইথড্র হতে যাচ্ছে। আমাদের কথা হলো এই স্পেশাল ট্রাইব্যুনাল চলতে পারে না। কেননা এটা অসাংবিধানিক। এটা উইথড্র করতে হবে। তখন মুজিব ভাই বললেন যে, আমি গোলটেবিল বৈঠকে যেতে পারি যদি বিনা শর্তে কেস উইথড্র করে। আর সবাইকে জেল থেকে ছাড়তে হবে। লিগ্যাল নোটিশটা ব্রোহি সাহেবও দেখেছেন, সই করেছেন। ওনার অনুমোদন নিয়ে দিয়েছি। মনজুর কাদেরের হাতেও কপি গিয়েছে। মনজুর কাদের ছিলেন রাষ্ট্রের পক্ষের আইনজীবী। মনজুর কাদের তখন বুঝতে আরম্ভ করেছেন যে, একটা নতুন পর্বে জিনিসগুলো চলে এসেছে। বলেছেন ঠিক আছে, ইয়েস ইয়েস আমি এটা পাকিস্তান গভর্নমেন্টকে দেব, এটা বিবেচনাযোগ্য। রাউন্ড টেবিলে মিজান চৌধুরী সাহেব, নজরুল ইসলাম সাহেব এ রকম দু’-একজন গেছে। বঙ্গবন্ধু আমাদের বললেন যে তোমরা এই নোটিশের বেসিসে ইসলামাবাদে যেখানে বৈঠক হচ্ছে ওখানে যাও। গিয়ে বল যে আমরা তো এই লিগ্যাল নোটিশ দিয়েছি। নোটিশের বেসিসে কেস উইথড্র কর। তাজউদ্দীন ভাই, আমীর-উল ইসলাম ও আমি- আমরা তিনজন তখন সেখানে গেছি। তাজউদ্দীন সাহেব ওখানে বলেছেন যে, আমার লিডার রাউন্ড টেবিল বৈঠকে আসবেন তবে বিনা শর্তে মুক্ত হয়ে এবং তার সব কেস প্রত্যাহার করতে হবে। উনি বন্দি হয়ে গোলটেবিল বৈঠকে আসবেন না। আমি পাকিস্তানের রাষ্ট্রপক্ষের আইনজীবী মনজুর কাদেরের সঙ্গে ওখানে দেখা করেছি যেহেতু ইতোপূর্বে লিগ্যাল নোটিশ তাকে দিয়েছিলাম। ল’মিনিস্টার এসএম জাফরের কাছে আছে সেই নোটিশ। আমরা তার সঙ্গেও যোগাযোগ করলাম। তখন তিনি বললেন যে, দেখুন কেস তো এভাবে তোলা যাবে না। শেখ মুজিবুর রহমান সাহেব আসুক, আলোচনার প্রেক্ষিতে আমরা হয়ত মামলাটা তুলতে পারি। আমরা বললাম যে, আমাদের ওপর পরিষ্কার নির্দেশনা আছে যে, কেস প্রত্যাহার না হলে বঙ্গবন্ধু আসবেন না। ওরা বলল যে, দেখুন আমরা তো বলছি যে, ওনার আসার ব্যবস্থা আমরা করে দিচ্ছি। আলোচনা হবে তারপর ওনাকে জেল থেকে ছাড়া হবে। আমরা তৎকালীন পূর্ব পাকিস্তানে ফিরে আসলাম। বঙ্গবন্ধু বললেন যে, ঠিক আছে। এরপর পাকিস্তান থেকে ফোন আসা শুরু হলো। আইনমন্ত্রী জাফর সাহেব ফোন করে বললেন, আচ্ছা ঠিক আছে ওনাকে জামিন দিয়ে দেয়া হবে। মামলার দু’জন জজ চলে এসেছেন ইতোমধ্যে। কোর্টও বসে গেছে। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, জাফর সাহেব ফোন করে এ কথা বলেছেন। সাপ্তাহিক : আপনাদের লাহোরে অবস্থানকালীন সে সময়ের কোনো স্মৃতি মনে পড়ে? ড. কামাল হোসেন : লাহোরে ছোটখাটো ঘটনাগুলো যেমন- আজগর খানও আমাদের সঙ্গে দেখা করলেন, এয়ারপোর্টে আসলেন। তাজউদ্দীন ভাইকে বললেন যে, আপনাদের রাজনৈতিক অবস্থান ঠিক আছে। আমরাও সমর্থন করি যে শেখ মুজিবকে সসম্মানে আসতে দিলেই কেবল তিনি আসবেন। সাপ্তাহিক : তারপর কি বঙ্গবন্ধু মুক্ত হলেন কারাগার থেকে? ড. কামাল হোসেন : ফিরে এসে শুরু হলো জামিনের নাটক। বঙ্গবন্ধু সরাসরি বললেন যে, না এটা হবে না। আবার আইনমন্ত্রী জাফর সাহেব ফোন করছেন। জেনারেল মোজাফ্ফর উদ্দীন জিওসি আমাকে নিয়ে যাচ্ছেন ফোনের কাছে। বলছেন যে, তোমরা তো বেল নিলে না। আমি বললাম, এটা তো আগেই বলা হয়েছিল যে আমরা জামিন চাইব না। আমরা চাই আন-কনডিশনাল উইথড্রল্ অব দি কেস। নিঃশর্তভাবে মামলাটা তুলে নিতে হবে। তখন উনি আমাকে বলছেন যে, বিমানবাহিনী প্রধান নূর খান, ইজ অলরেডি সিটিং অন দি এয়ারপোর্ট উইথ এ প্লেন। সঙ্গে অ্যাডমিরাল খান, সে ডিফেন্স মিনিস্টার না হোম মিনিস্টার কি যেন ছিল। তিনিও আছেন সেখানে। আমি ম্যাসেজ পাঠাচ্ছি। আমীর-উল ইসলাম ম্যাসেজগুলো নিচ্ছেন। আমি টেলিফোনে কথা বলছি। তারপর প্রস্তাব দিল যে, আচ্ছা শেখ মুজিব জামিনে যাবেন না? সেটা সম্মানজনক না? তো অলরাইট। উই উইল ওপেন দ্য জেল গেইট, ইউ ক্যান ওয়াকআউট। সাপ্তাহিক : এই প্রস্তাবের পর আপনারা কি করলেন? ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধুকে জানালাম ওরা এই প্রস্তাব দিয়ে বলছে যে, জেলের গেট খুলে দেবে আর আপনি চলে যেতে পারেন, গাড়ি এসে আপনাকে এয়ারপোর্টে নিয়ে যাবে। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, এ রকম বে-আইনি কাজ আমি করতে পারি? আমি তো এখন বন্দি। কোনো অর্ডার হবে না, কিছু হবে না, গেট খুলে দেবে আমি ওয়াক আউট করব। এটা হয় নাকি! সাপ্তাহিক : সে সময় আর কোনো উল্লেখযোগ্য ঘটনা মনে পড়ে? ড. কামাল হোসেন : আরেকটা বড় ঘটনা বলতে ভুলে গেছি। যেদিন আমরা ইসলামাবাদ থেকে ফিরেছি এই কোর্ট বসানোর আগে, এয়ারপোর্টে এসে শুনলাম যে, যেখানে ওরা বন্দি আছেন সেখানে গুলি হয়েছে। সার্জেন্ট জহুরুল হক আর ফজলুল হক দুইজন আহত, সম্ভবত একজন নিহত। উত্তপ্ত অবস্থা ওখানে। সে উত্তপ্ত অবস্থার মধ্যে আমরা কোর্টে এসেছি। ফেরার পথে দেখি রাস্তায় আগুন জ্বলছে। সেক্রেটারিয়েটের রোডটার উল্টো দিকে কোনো মন্ত্রীর বাড়ি ছিল। কার্জন হলের দিকে কোনার বাড়িটা আগুনে জ্বলছে। ওখান থেকে গাড়ি দিয়ে পার হয়ে যাচ্ছি। বাংলা একাডেমীর কাছের একটা বাড়িতে জজ সাহেবরা ছিলেন। অতিথি ভবন ছিল কয়েকটা। সেখানেও আগুনে জ্বলছে। আরো কিছুদূর অগ্রসর হলাম। শেরাটনের (বর্তমানে রূপসী বাংলা) উল্টো দিকে টুইন হাউস ছিল। ঢাকার নওয়াব হাছান আসকারী। তিনি ছিলেন ইস্ট পাকিস্তান মুসলিম লীগের প্রেসিডেন্ট। ওখানে গিয়ে দেখছি যে, ওই বাড়িটাও জ্বলছে। তখন শেরাটন হোটেলের নাম ছিল ইন্টারকন্টিনেন্টাল হোটেল। দেখি যে হাছান আসকারী সাহেব লুঙ্গিপরা অবস্থায় দাঁড়িয়ে আছেন। পুরো পরিবার ওনার পাশে রাস্তার ফুটপাথে দাঁড়িয়ে আছে। বাড়িতে আগুন জ্বলছে। আমি সালাম দিলাম, দেখি ওনার চোখে পানি। বললেন, দেখ আমার বাড়ি পুড়ে যাচ্ছে। বললাম, গাড়িতে ওঠেন। সবাইকে সার্কিট হাউসে পৌঁছে দিয়ে এলাম। এটা হলো তখনকার প্রতিক্রিয়া। অবস্থা আর কন্ট্রোল করা যাচ্ছে না। সাপ্তাহিক : সে সময় সার্জেন্ট জহুরুল হককে গুলি করা হলো কেন? ড. কামাল হোসেন : জহুরুল হককে গুলি করা হয়েছে এই অজুহাতে যে, তিনি পালাচ্ছিলেন। এটা একদম বাজে কথা, পালানোর প্রশ্নই উঠে না। জাস্ট মেরে ফেলতে চেয়েছে। এটার একটা ইতিহাস আছে। ফজলুল হক, জহুরুল হক দুইজনকে গুলিবিদ্ধ অবস্থায় নিয়ে আসা হয়েছে সিএমএইচ-এ, কর্নেল আলী ছিলেন সার্জন। উনিই ইতিহাসটা বলেছেন আমাকে। তিনি গুলিবিদ্ধ দুইজনের উদ্দেশে বললেন, আমি কর্নেল আলী বলছি, একজনকে বাঁচানো যাবে। এই সময়ের মধ্যে দুটো অপারেশন করা যাবে না। দুজনের মধ্যে শুধু একজনকে বাঁচাতে পারি। তখন জহুরুল হক বললেন, ফজলুল হককে নিয়ে যান। অপারেশন করেন। আমি বাঁচতে চাই না। মানে একজনকে নিতে হলে ওকে নেন। ও আমার চেয়ে বয়সে কম অথবা তার লেস ইনজুরড। আর ফজলুল হক বলছেন যে, না ওকে আপনি নেন। কর্নেল আলী তখন গুলি দেখে জাজ করেছেন যে কার বাঁচার সম্ভাবনা বেশি। উনি ফজলুল হকের অপারেশন করেন। ফলে উনি বেঁচে গেছেন। আর জহুরুল হক মারা গেলেন। বঙ্গবন্ধুর কাছে গেলে উনি বললেন, পাকিস্তানিদের কথা শুনলে তো আমার অবস্থা জহুরুল হকের মতোই হবে। আমি যদি পাকিস্তানি জেনারেলদের কথামতো জেল থেকে বেরিয়ে ওদের প্লেনে উঠে যাই তবে ওরা পেছন থেকে গুলি করবে। বলবে উনি পালিয়ে যাচ্ছিলেন। আমার তো সবচেয়ে অসম্মানজনক মৃত্যু হবে। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধু রাজনৈতিক দূরদৃষ্টির পরিচয় দিলেন, দারুণভাবে। ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ, অবশ্যই অসাধারণ দূরদৃষ্টি। ওই সময়ে উনি সব বুঝতে পেরেছেন। ভবিষ্যৎ দেখেছেন। তাৎক্ষণিকভাবে সিদ্ধান্তের পর সিদ্ধান্ত নিয়েছেন। একদিকে ওনার জীবন বাজি রাখতে হয়েছে। অন্যদিকে রাজনৈতিক হুমকি দিচ্ছে পাকিস্তানিরা। বলা হচ্ছিল যে, এই যে সার্জেন্ট জহুরুল হককে মেরে ফেলেছে এর ফলে আমাদের সৈন্যদের মধ্যে একটা অস্থিরতা, অস্থিতিশীল অবস্থা বিরাজ করবে। দেখ কী হয়ে যায়। আমরা কিছু জানি না। আমরা তো ওনার নিরাপত্তার জন্য ওনাকে প্লেনে তুলে নিয়ে আসতে চাচ্ছি। বঙ্গবন্ধুও তখন হাসতে হাসতে বলেছেন, আমি তো মুসলমান, কপালে লেখা আছে আমার মৃত্যু কখন ঘটবে। নির্দিষ্ট সময়ের এক সেকেন্ড আগেও মৃত্যু হবে না, এক সেকেন্ড পরেও হবে না। যদি আমার মৃত্যু এখানে থাকে হবে। বঙ্গবন্ধু বললেন, ওদেরকে বলে দাও যে, হুমকির মুখে আমাকে দিয়ে কিছু করানো যাবে না। আমরা জেনারেল মোজাফ্ফর উদ্দীনকে জানিয়ে এসেছি উনি এসব ব্যাপারে অনড়। তখন জেনারেল বলেছেন, এ পর্বটা শেষ। কিন্তু এয়ারপোর্ট রোড দিয়ে তো হাজার হাজার মানুষ আসছে। স্লোগান দিচ্ছে ‘জেলের তালা ভাঙব, শেখ মুজিবকে আনব।’ পরিস্থিতি আরো খারাপ হচ্ছে। মানুষ ফুঁসে উঠতে শুরু করেছে। তখন সেই অফিসার বললেন, এর মধ্যে না গিয়ে আমি মাইক দিচ্ছি, জিপ গাড়িগুলো দিচ্ছি, ওখানে গিয়ে এয়ারপোর্টের কাছে যারা আসছে তাদেরকে আপনারা বোঝান। আমি কথা দিচ্ছি আগামীকাল বারোটার দিকে সম্মানজনকভাবে বঙ্গবন্ধুকে মুক্ত অবস্থায় তার বাসভবনে পৌঁছে দেয়া হবে। বঙ্গবন্ধুকে সব খুলে বললাম। উনি বললেন যে, হ্যাঁ ঠিক আছে এটা করতে পার। আমরা চাই না যে এখানে রক্তপাত হোক। তারা কথা দিয়েছে। বঙ্গবন্ধুও মেনে নিয়েছেন যে না রক্তপাত এড়িয়ে চল। আন্দোলনরত বাঙালিরা যদি এখন না থামে তাহলে ক্যান্টনমেন্টওলারা গুলি করবে। এ ছাড়া উপায় নেই। তখন আমাদের কর্মীদের বুঝিয়ে বলা হলো। সাপ্তাহিক : কর্মীদের বুঝিয়ে বলতে কে কে গিয়েছিলেন? ড. কামাল হোসেন : কে কে ছিল এ মুহূর্তে নাম মনে নেই। ক্যান্টনমেন্টের সামনে গিয়ে মাইকিং করে উত্তেজিত জনতাকে শান্ত করতে গিয়েছিলেন রাজনৈতিক কর্মীরাই। পরের দিনই পাকিস্তানি জেনারেল আমাকে ফোন করে বললেন যে, আমি নিজে ড্রাইভ করে জিপটাকে রানওয়ের ওপর দিয়ে ক্রস করে ধানমণ্ডি গিয়ে শেখ মুজিবকে ওনার ৩২ নম্বরের বাসায় দিয়ে এসেছি। তোমরা ওখানে গিয়ে ওনাকে পাবে। তখন হাজার হাজার লোক ধানমন্ডি ৩২ নম্বরে জড়ো হয়েছে। একটা পর্ব ওখানে শেষ হলো। তারপরে শেখ মুজিবুর রহমান বললেন যে, আমি তো এভাবে রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে লাহোরে যাব না। আমি যেহেতু এখানে জাতীয় প্রতিনিধিত্ব করছি, আমি একটা পাবলিক মিটিং করব রেসকোর্সে, তারপরে যাব। ‘সম্মিলিত ছাত্র সংগ্রাম পরিষদ’ সেই সভার আয়োজন করল। ওখানেই ‘বঙ্গবন্ধু’ হিসেবে সাড়ে সাত কোটি মানুষের প্রতিনিধি হিসেবে ওনাকে সংবর্ধিত করা হলো। এটা একটা স্মরণীয় সভা হয়েছিল। উনি বঙ্গবন্ধু অভিধা পেলেন। বললেন আজকে ঐক্যবদ্ধ জাতির মুখপাত্র হিসেবে আমি গোলটেবিল কনফারেন���সে যাচ্ছি। জনগণের দাবি নিয়ে যাব এবং এই দাবি সবাই মিলে আদায় করব। ওখানে যাওয়ার ব্যবস্থা করা হলো। উনি আমাকে বললেন তোমাকেও যেতে হবে। সেখানে সংবিধানের বিষয়ে আলোচনা হবে, তোমাকে ওখানে দরকার। সাপ্তাহিক : আপনার তো তখন অল্প বয়স। আপনার ওপর বঙ্গবন্ধুর এই নির্ভরতা তৈরি হলো কিভাবে? এটা কি আগরতলা মামলায় আপনার ভূমিকার কারণে? ড. কামাল হোসেন : আগের মামলার একটা সম্পর্ক তো ছিলই। তারপর ’৬৬ থেকে আস্তে আস্তে আমাদের কাছে আসার একটা প্রক্রিয়া চলেছিল। সাপ্তাহিক : তখন তো আপনি সমগ্র পাকিস্তান বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান? ড. কামাল হোসেন : সেই বছরে আমি পাকিস্তান বার কাউন্সিলের ভাইস চেয়ারম্যান। ’৭১-এর মার্চেও আমি সেই পদে ছিলাম। প্রস্তুতি নিয়ে বঙ্গবন্ধু রাউন্ড টেবিল কনফারেন্সে রওনা হলেন, দিন দুয়েক পর আমিও রওনা হলাম। আমরা প্রথমে লাহোরে থেমেছি। এখানে একজনের কথা বলি। তাঁর নাম মালিক গুলান জিলানি। আমাদের ওপর পাকিস্তানি সেনাদের আক্রমণের প্রতিবাদ করে তিনি ’৭১ সালে ওখানে জেল খেটেছেন। উনি ওখানকার একজন স্বতন্ত্র এমএনএ ছিলেন। খুবই সরল, স্বাধীনচেতা মানুষ। সব সময় মার্শাল ল’র প্রতিবাদ করেছেন। সেই কারণেই মুজিব ভাইয়ের সঙ্গে তার সম্পর্ক গড়ে ওঠে। তিনি বাঙালিদের বন্ধু, মুজিব ভাইয়ের বন্ধু। উনি ওখানকার খুবই অবস্থাপন্নদের একজন ছিলেন। সেখানে তাঁর বিরাট বাড়ি ছিল। ওটা ছিল আমাদের জন্য একটা হলটিং প্লেস। উনি রিসিভ করে মুজিব ভাইকে নিয়ে যেতেন। সাপ্তাহিক : আপনারা কারা কারা গেলেন? ড. কামাল হোসেন : দুই ভাগে ভাগ হয়ে কিছু কিছু করে গিয়েছি। শামসুর রহমান জনসন, খান সারওয়ার মুরশিদ, আমীর-উল ইসলামও ছিলেন। উল্লেখযোগ্য এদেরই কথা মনে পড়ছে। আরো ২-১ জন হতে পারে। আমার কাজ ছিল স্টেটমেন্টগুলো ঠিক করা, প্রেসকে ব্রিফ করা ইত্যাদি। উনাদের সাহায্য পেয়েছি। আর তাজউদ্দীন ভাই তো মূলত আমাদের অভিভাবক ছিলেন। সাপ্তাহিক : তাজউদ্দীন সাহেব ছাড়া পলিটিক্যাল লিডার আর কে কে গিয়েছিলেন? ড. কামাল হোসেন : যতদূর মনে পড়ছে সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, কামারুজ্জামান সাহেব, মিজান চৌধুরী ছিলেন। খুব সম্ভবত মোমিন সাহেবও ছিলেন। পূর্ব পাকিস্তান থেকে আর যারা গেলেন তার মধ্যে ছিলেন নুরুল আমিন সাহেব। হামিদুল হক চৌধুরী সাহেবও। ফরিদ আহমেদ সাহেবও ছিলেন কি না আমার মনে নেই। চিফ জাস্টিস মাহবুব মোর্শেদও গেলেন। উনি রিটায়ার্ড করেছেন, মানে উনি রিজাইন করেছিলেন। পলিটিক্যাল পার্টির লোক না হয়েও তারা কিন্তু আন্দোলনের সামনে দাঁড়িয়েছিলেন। এয়ার মার্শাল আজগার খান কাউন্টার পার্টি হিসেবে পশ্চিম পাকিস্তানে দাঁড়িয়েছিলেন। একজন রাজনীতিবিদ না হয়েও আন্দোলনের একদম প্রথম কাতারে ছিলেন। লাহোরে আমরা গেলাম। মুজিব ভাই আমাকে বললেন যে, দেখ আমাদের জন্য খুব গুরুত্বপূর্ণ হলো পূর্ব বাংলার পক্ষে ‘একটা কণ্ঠ’ হয়ে একইভাবে সবাই যেন কথা বলি। যদি আমরা পাঁচজন, পাঁচ রকমভাবে কথা বলি এটা তো আমাদের জন্য দুর্বলতা হবে। তুমি অন্তত দেখ, নুরুল আমিন সাহেবের সঙ্গে লেগে থাক। ওরা সবাই একই বিল্ডিং-এ। ওটাকে তখন পূর্ব পাকিস্তান হাউজ বলত। একই জায়গায় থাকতাম সবাই। সাপ্তাহিক : নুরুল আমিন সাহেব তখন মুসলিম লীগের নেতৃস্থানীয়? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ, অবশ্যই। আমি গিয়ে ওনাকে বললাম যে দেখেন, আমরা আপনাকে শ্রদ্ধা করি। ভাষা আন্দোলনের সময় আপনার ভূমিকা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য হয়নি। মানুষ আপনাকে শক্তভাবে একটা শাস্তি দিয়েছিল। আপনি সিটিং চিফ মিনিস্টার হিসেবে পদচ্যুত হলেন। বলেছিলাম, দেখেন আপনি মুখ্যমন্ত্রী হয়েও ভালো ইলেকশন করতে দিলেন। আর পরাজয়কে আপনি মেনে নিলেন। এভাবে ওনাকে কনভিন্স করেছিলাম। পরবর্তী স্টেজে বোঝা যায় যে কত ইমপর্টেন্ট ছিল ওনাকে এভাবে বোঝানো। সাপ্তাহিক : এটা তো খুবই গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপার… ড. কামাল হোসেন : খুবই গুরুত্বপূর্ণ। আর ওনার সঙ্গে কিছুটা পরিচয় ছিল। তার ছেলে আনোয়ারুল আমিন, ব্যাংকার ছিলেন, তার সঙ্গে আমাদের একটা সামাজিক সম্পর্ক ছিল। সেই সূত্র ধরে নুরুল আমীন সাহেবকে বললাম, আমরা ইয়াংরা মনে করি আপনারা মুরব্বি, আপনারা এক সুরে কথা বলবেন, একে অন্যকে সমর্থন করবেন। দেখেন দেশে ঐক্য গড়ে উঠেছে। আমাদের ঐক্যকে সঠিকভাবে কাজে লাগানোর এটা একটা ঐতিহাসিক সুযোগ। মঞ্জুর কাদিরের সঙ্গে কথা হতো। উনি তখন পাকিস্তানের ফরেন মিনিস্টার। উনি আগরতলা মামলার সরকারি পক্ষের আইনজীবী হিসেবে এখানে ছিলেন। আমি একটা কথা বলতে ভুলে গেলাম যে, যেদিন রাস্তায় আগুন জ্বলছে। আমি খাজা হাসান আসকারীকে ইন্টারকন্টিনেন্টালে পৌঁছে দিয়ে আসছি তখন মঞ্জুর কাদিরের টেলিফোন কল পেয়ে হোটেলে ফিরে এসেছি। তখন মঞ্জুর কাদির সাহেব ঐ হোটেলে ছিলেন। তিনি আমাকে বললেন যে আমি এখানে নিরাপদ বোধ করছি না। তখন আমি আমার গাড়িতে ওনাকেও সেন্ট্রাল সার্কিট হাউসে পৌঁছে দিলাম। যেতে যেতে উনি বললেন, যে দেখ ভাই মামলা-টামলা তো শেষ, জনগণের বিচার হয়ে গেছে। এরপর আর অন্য কোনো বিচার হয় না। এই আগরতলা ট্রায়ালকে জনগণ প্রত্যাখ্যান করছে। সাপ্তাহিক : মঞ্জুর কাদের সাহেব কি এখানকার লোক ছিলেন? ড. কামাল হোসেন : না না উনি পাঞ্জাবের খুব বিখ্যাত লোক ছিলেন। ওনার বাবা বোধহয় কোর্টের জজ ছিলেন। পাকিস্তানের আইনজীবীদের প্রথম ৪-৫ জনের মধ্যেও একজন ছিলেন। তারপর পাকিস্তানের পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলেন। ওনার সঙ্গে আমি যোগাযোগ রাখতাম। খুব সম্ভবত আমরা হোটেলে মিট করতাম। ওখানকার কি হচ্ছে না হচ্ছে আমি জাস্ট ফিডব্যাকের জন্য তার কাছে পরিস্থিতি সম্পর্কে জানতে চাইতাম। বলতাম, দেখেন আমরা তো চাচ্ছি একটা ঐকমত্যে পৌঁছে সংবিধানকে সংশোধন করে একটা গ্রহণযোগ্য জায়গায় নিতে। আপনি তো সরকারি আইনের ব্যাপারে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। আপনার তো ভূমিকা থাকবে সেখানে। আর জাফর সাহেব ছিলেন পাকিস্তানের ল’মিনিস্টার। আপনাদের দুই জনের তো প্রধান ভূমিকা থাকবে এ ব্যাপারে। উনি সেদিক থেকে দেখলাম যে, সহযোগিতা করছেন। প্রথম দুয়েকটা দিন ভালোই লাগল। মনে হচ্ছিল যে জিনিসটা ইতিবাচকভাবে চলছে। সবাই বলেছেন, আমরা শান্তিপূর্ণভাবে একটা নিষ্পত্তি করতে চাই। প্রথম প্রথম একই সুরে উভয় পক্ষ থেকে বক্তব্য দেয়া হলো। তারপর যখন মূল কথাগুলো সামনে আনা হলো, তখন দেখা গেল, যে ছয় দফার ভিত্তিতে আঞ্চলিক শাসনের দাবি সামনে চলে এলো তখন তারা কিছু কিছু প্রশ্ন তোলা শুরু করল। মঞ্জুর কাদির তখন আমাকে বললেন যে, দেখ আমাকে তো তোমাদের সার সংক্ষেপ দিয়েছে। একটা জিনিস আমার যেন কেমন লাগছে, তোমরা বলছ দুই প্রদেশের আলাদা দুইটা মুদ্রা হবে। এটা কি খুব বেশি চাওয়া হলো না? আমি তখন বললাম, আমাদের তো এর সঙ্গে সঙ্গে একটা বিকল্পও ছিল যে একটা মুদ্রা থাকলে আইন করে দেয়া হবে যে দুই অংশে অর্থনৈতিক পলিসি আলাদা হবে। ওখানে যে সেন্ট্রাল ব্যাংকের শাখা আছে, সেটা নিয়ে সেন্ট্রাল ব্যাংককে দুই অংশ করা হবে। একটা পশ্চিম পাকিস্তানের জন্য, আরেকটা পূর্ব পাকিস্তানের জন্য। মনিটরি পলিসি, মুদ্রাকে কেন্দ্র করে যেসব নীতিনির্ধারণ করা হবে সেটা আলাদা আলাদাভাবে হবে। কারেন্সি একই হোক। তখন উনি বললেন, এটা তো আমার সার সংক্ষেপে নেই। এটা নিয়ে আমি আপত্তি জানিয়ে বললাম, যেহেতু উপদেষ্টা হিসেবে আপনার উপদেশ তারা নিচ্ছে তো সারসংক্ষেপ যদি সঠিক না হয় তাহলে আপনি সঠিক উপদেশ দেবেন কিভাবে। তখন আমি আমাদের পুরো টেক্সটা এনে ওনাকে দিলাম। মঞ্জুর কাদিরের কাছ থেকে শুনলাম যে একটা মিটিং হয়েছে আইয়ুব খানের মন্ত্রী ও উপদেষ্টাদের। বলা হয়েছে যে, না কোনো রকমের মীমাংসা হবে না। প্রচার করে দেন নির্বাচনের পরে যা হয় দেখা যাবে। পরের দিন সকালে যখন ওরা রাউন্ড টেবিলে গেলেন, মঞ্জুর কাদেরের চেহারায় দেখলাম বিষণœতা। তিনি কিছু জানালেন না। আমি ছুটে গেছি, পৌঁছে দেখি ওরা বেরিয়ে আসছেন। খুব শর্ট সেশন হয়েছে। আমি কাছে যেতেই বঙ্গবন্ধু বললেন, হলো না, আমাদের এখন নিজেদেরই সিদ্ধান্ত নিতে হবে। আজকে ৩টার মধ্যে একটা প্রেস কনফারেন্স ডাক। তখন বাজে প্রায় দুপুর ১২টা। বঙ্গবন্ধু আরো বললেন, দেখ নূরুল আমিন সাহেব কিন্তু কথা রেখেছেন। উনি আমাদের কথা সমর্থন করেছেন। জাস্টিস মোর্শেদও সমর্থন করেছেন। আরেকটি স্মরণীয় ঘটনার কথা বলি। তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে যখন আমরা প্রথম গিয়েছিলাম, প্লেন থেকে নেমেছি। ছাত্ররা সব বিমানবন্দরের রানওয়েতে। তাজউদ্দীন ভাইকে ওরা কাঁধে তুলে নিল। পশ্চিম পাকিস্তানের ছাত্ররা তাজউদ্দীন ভাইকে কাঁধে তুলল- এটা বিরাট ঘটনা। ওই সময়ে তাজউদ্দীন ভাইকে কাঁধে নিয়ে ওরা বলছে যে, ‘আইয়ুব কুত্তা হে’-এটা ইন্টারেস্টিং। পাঞ্জাবি ছেলেরা আমাদেরকে বলছে যে বল, ‘আইয়ুব কুত্তা হে’। সাপ্তাহিক : এটা কত সালের দিকে? ড. কামাল হোসেন : ’৬৯-এর রাউন্ড টেবিলের সময়। যেদিন রাউন্ড টেবিল শেষ হয় সেই দিন দেখলাম যে আইয়ুব খান মাথা নত করে বেরুচ্ছে। চেহারাটা একদম শুকিয়ে গেছে। তার কাপড়ও মনে হচ্ছে মলিন। তার শরীরটাও ছোট হয়ে গেছে। আগে সে বুক ফুলিয়ে চলত, তখন একদম মাথা নত করে, একজন পরাজিত সৈনিকের মতো বেরুচ্ছে। যদিও আমাদের দাবি মানে নাই কিন্তু দাবি না মেনে বিজয়ের কোনো রকম ভাব দেখা গেল না। অন্যদিকে আপসহীন আন্দোলনের একটা নেতা হিসেবে বঙ্গবন্ধু আত্মবিশ্বাস নিয়ে ফিরলেন। তার মনোভাব এরকম- ঠিক আছে আমাদেরকে ন্যায্য পাওনা দিল না, আমরা টেবিলে আলোচনায় সমাধান পেলাম না, আন্দোলনের মাধ্যমে আদায় করতে হবে। বললেন, ঢাকায় ফোন কর। সাপ্তাহিক : প্রেস কনফারেন্সের জন্য? ড. কামাল হোসেন : না না। প্রেস কনফারেন্সের ঘোষণা আগে করা হয়েছে বেলা ৩টায়। তখন প্রায় বেলা ১টা। বললেন মানিক মিয়াকে ফোন কর। ফোনে মানিক মিয়াকে বললেন, দেখেন আমরা তো বলেছিলাম যে এই আমাদের দাবি। এ নিয়ে আলোচনা হয়ে তারপরে একটা খসড়া দাঁড় করানো হবে। কিন্তু শেষ মুহূর্তে এটাকে তারা পণ্ড করে দিল। আমরা এটাকে প্রত্যাখ্যান করে বলেছি যে, শুধু নির্বাচন হবে। ওরা বলল যে, এটা না মানলে নির্বাচনে যাব না। এটা গ্রহণযোগ্য না। যেহেতু আমি তখন মুজিব ভাইয়ের পাশে দাঁড়ানো তাই টেলিফোনের সব কথা শুনছি। অপর প্রান্ত থেকে মানিক মিয়া বললেন, ঠিক আছে। এটা সঠিক সিদ্ধান্ত। এখানে লাখ, লাখ মানুষ পথে নেমেছে। এটাই সঠিক সিদ্ধান্ত। এটা মানুষের কাছে গ্রহণযোগ্য, সমর্থনযোগ্য। সাপ্তাহিক : তারপর প্রেস কনফারেন্স… ড. কামাল হোসেন : আমরা প্রেস কনফারেন্সের প্রস্তুতি নিলাম। গণমাধ্যমকে জানালাম যে আমরা আলোচনা প্রত্যাখ্যান করলাম। কেন প্রত্যাখ্যান করলাম তার ব্যাখ্যাও দিলাম। খুবই তাড়াহুড়ো করে এসব কাজ করতে হলো। সাপ্তাহিক : এই কাজগুলো কে করছেন, এই যে প্রেসের জন্য লেখালেখি? ড. কামাল হোসেন : তাজউদ্দীন ভাইয়ের তত্ত্বাবধানে সব হয়েছে। আর বিশেষ করে ইংরেজি ড্রাফটিং আমাকে করতে হতো। যেহেতু ইন্টারন্যাশনাল প্রেস কনফারেন্স, সেই কাজটা মূলত আমার দায়িত্ব ছিল। আর আমাদের মোহাম্মদ হানিফ, যিনি পরে ঢাকার মেয়র হলেন তিনি আমাদের সেক্রেটারি হিসেবে টাইপ করতেন, ডিকটেশনও নিতেন। দেশি-বিদেশি সংবাদ মাধ্যমের সবাই আসল এই প্রেস কনফারেন্সে। বঙ্গবন্ধু বললেন, আমরা আমাদের জনগণের পক্ষে যে দাবি নিয়ে এসেছিলাম সেটা মানা হয়নি। দেশের মানুষ এটা গ্রহণ করবে না। আমরা বিশ্বাস করি যে আন্দোলনের মাধ্যমে দাবি আদায় করব। পরের দিন আমরা ফিরে আসলাম। ঢাকায় পুরনো এয়ারপোর্টে নেমে দেখি লাখ লাখ মানুষ। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধু রাউন্ড টেবিল কনফারেন্স শেষ করে প্রেস কনফারেন্স করেই কি চলে এলেন? ওখানে রাজনৈতিক নেতাদের সঙ্গে আর কোনো কথা হলো? ড. কামাল হোসেন : প্রেস কনফারেন্সের রাতে আইয়ুব খান বঙ্গবন্ধুকে ডিনারে দাওয়াত দিলেন। তিনি গেলেন ওখানে। আমরা অপেক্ষা করছি। এসে হেসে হেসে আমাদের বললেন, খুব খাওয়ালো। তারপরে প্রস্তাব দিল যে আমি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে যাই। আমি কী এখন গ্রহণ করতে পারি ওদের প্রস্তাব! বলেছে আপনি প্রাইম মিনিস্টার হয়ে এসব ছয় দফা বাস্তবায়ন করবেন। বললাম না, সেটা আমার পক্ষে সম্ভব না। এটা বরং আপনি মেনে নেন ইলেকশন হোক। তখন আইয়ুব বললেন যে, আমি কী করে করব। বঙ্গবন্ধু ফিরে এসে বললেন, তোমরা বসে ৬ দফার ভিত্তিতে কিভাবে কনস্টিটিউশনে কোন কোন ধারা চেঞ্জ করতে হবে দেখ। আমার বাসায় বসে কাজটা আমরা শুরু করলাম। এই সার্কিট হাউস রোডে আমরা থাকতাম একটা দোতলা বাড়ির নিচতলায়। সেখানে তাজউদ্দীন ভাই চলে আসতেন, আমীর-উল ইসলাম, আর আইন যারা ভালো জানতেন তারা আসতেন। মূল কাজ আমরা করতাম অন্যরা দেখতেন। পরামর্শ দিতেন। কাজ শেষ করতে সেবার এক সপ্তাহের মতো সময় লেগেছিল। ২৪ মার্চ তো বোধ হয় মার্শাল ল’ হয়ে গেল। ফিরে এসেছি বোধহয় ১৩-১৪ তারিখ। রাতদিন খেটে এটা করা হলো। মিজান চৌধুরী তখন অল পাকিস্তান-এর এমএলএ। ৬ জন এমএলএ বোধহয় বাঙালি ছিল, তখন ওনাকে দিয়ে আমরা পাঠালাম। অন্য বাঙালিরা তো মুসলিম লীগের হাততোলা এমএলএ ছিল। নেক্সট সেশনে আইয়ুব খানের কাছে ওটা মিজান ভাই নিয়ে যাবেন। মুজিব ভাই তখন আমার বাসায় বসা, তাজউদ্দীন ভাই বসা। এসেছেন এ ব্যাপারে সবাই মিলে আলাপ-আলোচনা করতে। তখনই ছুটে একজন এসে বললেন, রেডিও শোনেন, রেডিও শোনেন। মার্শাল ল’ হয়ে গেছে। আইয়ুব খান নাই, ইয়াহিয়া খান এখন ফ্রন্টে। সাপ্তাহিক : ক্ষমতায় পালাবদল ঘটেছে? ড. কামাল হোসেন : ইয়াহিয়া খান ক্ষমতা নিয়ে নিয়েছে। বঙ্গবন্ধু বললেন তাড়াতাড়ি তৈরি হই আজকে তো নিতে আসবে ওরা। বলে বাসায় চলে গেলেন। তাজউদ্দীন ভাই গেছেন তখন সন্ধ্যা ৭-৮টা হবে। অন্ধকার হয়ে গেছে। কীভাবে যে পরিবেশ চেঞ্জ হয়। ধানমন্ডি ৩২ নম্বর তখন দেখলাম নীরব। যে ৩২ নম্বরের চারপাশে সবসময় হাজার হাজার মানুষ থাকত। তখন একদম নীরব। মার্শাল ল’র ঘোষণার সঙ্গে সঙ্গে রাস্তাগুলো একদম খালি। ৩২ নম্বরে গিয়ে দেখলাম, ওপরের বারান্দায় বঙ্গবন্ধু বসা, ব্যাগ-ট্যাগ বাঁধা। বলল, তোমার ভাবি তো এসব ব্যাপারে খুব অভিজ্ঞ। ছাত্রনেতারা আসছে। বঙ্গবন্ধু ওদেরকে বললেন, মানুষ এটা মেনে নেবে না। আমাদের আন্দোলন এখন যে পর্যায় এসেছে আন্দোলন আর পেছনে ফিরবে না। এটা সামনের দিকেই যাবে। সারারাত চলে গেল পাকিস্তানের সেনাবাহিনী ওনাকে নিতে আসেনি। মার্শাল ল’ হবে আর উনাদের বাসায় পুলিশ আসবে না। এটা ব্যতিক্রমধর্মী ঘটনা। লিস্ট অনুযায়ী উনি তো ১ নম্বর পলিটিক্যাল লিডার, লিস্টে থাকবেই। পরের দিন পত্রপত্রিকায় আসা শুরু করল যে, না ইয়াহিয়া পলিটিক্যাল একটা এপ্রোচ নেবে। তখনই লোকজন এসেছে ওনার কাছে। কি কথা হয়েছে জানি না। তিনি এসে বললেন যে মনে হয় ইলেকশন দিয়ে দেবে। সাপ্তাহিক : এরকম অবস্থায় আপনারা রাজনৈতিক অবস্থান কি নিলেন? ড. কামাল হোসেন : তখন একটা প্রশ্ন সামনে আসল আমাদের যে আপসহীন অবস্থান ছিল, সংবিধান সংশোধনের আগে আমরা নির্বাচনে যাব না। আর আমরা সবসময় ধরে নিয়েছি পশ্চিমা শাসক গোষ্ঠী ইলেকশন করতে চায় আমাদের মধ্যে বিভক্তি সৃষ্টি করার জন্য। কিছু লোককে লোভ দেখিয়ে মন্ত্রী করবে, আমাদের যে মূল লক্ষ্য সেখান থেকে বিচ্যুতি ঘটাবে। যারা আপসহীন থাকবেন তারা আপসহীন থাকবেন। কিন্তু মূলত তাদের শক্তিটা কমে যাবে। ’৫৪-এর অভিজ্ঞতা তো এটাই। সেই কারণেই আমরা বলছি যে, না আগে সংবিধান সংশোধন, তারপর ইলেকশন। ওরা তখন ওই জিনিসটা বার বার বলেছিল, ইলেকশন ফার্স্ট। তখন আমরা চিন্তা-ভাবনা করে বললাম ঠিক আছে পপুলেশনের ভিত্তিতে হোক ইলেকশন। নেট ফিফটি ফিফটি। মনে রাখতে হবে যে ’৫৬-এর সংবিধানে বাঙালিদের পক্ষে একটা বিরাট কনসেশন দেয়া হয়েছিল। আমরা ৫৬% পপুলেশন কিন্তু সেন্ট্রাল অ্যাসেম্বলিতে আমাদের আসন সংখ্যা ছিল ৫০%। ৬% আমরা ছাড় দিয়েছিলাম। দুটো সমান না থাকলে একটা ফেডারেশন দাঁড়াবে না বলে। ১৯৫৬ থেকে বাই দ্যাট টাইম ১৯৬৯-৭০ এ এসে দেখা গেল যে আমরা ফিফটি ফিফটি করলাম কিন্তু এগ্রিমেন্ট ছিল যে সব কিছুর ব্যাপারে ফিফটি ফিফটি হবে। পার্লামেন্টের মধ্যে, স্পেশাল অ্যাসেম্বলির মধ্যে, সিভিল সার্ভিসের মধ্যে, ডিফেন্স সার্ভিসের মধ্যে সমান সমান হিস্যা হবে। কিন্তু বাস্তবে তা হলো না। ওটা কাগজেই থাকল। পশ্চিম পাকিস্তানে একটার পর একটা বিশ্ববিদ্যালয় হয়েছে। ইসলামবাদ গড়ে উঠল। আর এখানে সেকেন্ড ক্যাপিটাল যেটা সেখানে কয়েকটা মাত্র বিল্ডিং তৈরি হয়েছে। দুই পাকিস্তানের মধ্যে বৈষম্যটা সহজেই ধরা পড়ে। তখন এই ইস্যুগুলো সামনে আসল যে, আমরা ইলেকশনে গেলেই সমস্যার সমাধান পাবো। সাপ্তাহিক : কিন্তু সামরিক শাসনের মধ্যে নির্বাচনে যাওয়া? ড. কামাল হোসেন : মার্শাল ল’এর মধ্যে বেঁকে বসলে তো মার্শাল ল’ই থাকবে। তখন একটা নতুন চিন্তা এলো যে, লোকসংখ্যার অনুপাতে সংসদে আমাদের প্রতিনিধি হওয়া উচিত। সেই সংসদ আমাদের একটা নতুন সংবিধান দেবে যেখানে আমাদের যেসব নাব্য দাবি আছে তা পূরণ করবে। এটা মানুষ পছন্দ করবে, গ্রহণ করবে, আর পলিটিক্যালি আমরা সে শক্তি সঞ্চয় করব। তারা ঘোষণা করে বসল ঠিক আছে ওয়ান পারসন, ওয়ান ভোটের ভিত্তিতে ইলেকশন দেয়া হবে। কিন্তু একটা লিগ্যাল ফ্রেমওয়ার্ক অর্ডারের (এলএফও) নামে মার্শাল ল’র পরিসর ঘোষণা করা হলো। সে অনুসারে হাউস বসবে তবে যে পর্যন্ত চিফ মার্শাল ল’ অ্যাডমিনিস্ট্রেটর কনস্টিটিউশন স্বাক্ষর না করবেন ততক্ষণ পর্যন্ত তা কার্যকর হবে না। আর উনি যদি মনে করেন যে জাতীয় সংহতি খর্ব হবে তাহলে কার্যকর করবেন না। একটা বাড়তি চাপ রাখা আর কি! সাপ্তাহিক : মানে কর্তৃত্ব সামরিক শাসকদের হাতে রেখে দেয়া? ড. কামাল হোসেন : তখন সবচেয়ে কঠিন প্রশ্ন হলো যে এখন আমাদের কী করা উচিত। এলএফও গ্রহণ করে ইলেকশন করা মানে তো নাকে দাসখত দিয়ে নির্বাচন করা। যতটুকু মনে পড়ে তখন একটা ছোট পরিসরে বসা হলো সেখানে তাজউদ্দীন ভাই, সৈয়দ নজরুল ইসলাম সাহেব, মোশতাক সাহেবও ছিলেন। আরও ডাকা হলো কামরুদ্দিন আহমেদ সাহেব, পলিটিক্যাল সায়েন্সের প্রফেসর মুজাফ্ফর আহম্মেদ চৌধুরীকে। সাপ্তাহিক : অধ্যাপক আবদুর রাজ্জাক সাহেবকে কি ডাকা হতো? ড. কামাল হোসেন : এ ব্যাপারে হয়ত রাজ্জাক সাহেবকেও ডাকা হয়েছিল। অনেক সময় আমরা গিয়ে ওনার পরামর্শ নিয়ে এসেছি। তখন ভাবা হলো, যদি ইলেকশনে ’৫৪-এর মতো রেজাল্ট পাওয়া যায় তাহলে তারা সামনে দাঁড়াতে পারবে না। এটাকে অস্বীকার করতে পারবে না। এ রকম একটা বিবেচনা দাঁড়াল। বাস্তবে একটা বড় ঝুঁকি নিতে হয়েছে। সাপ্তাহিক : এই রিস্কেই আপনারা ইলেকশনে গেলেন? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ। এই রিস্কে আমরা ইলেকশনে গেলাম। সেটা তো একটা ঐতিহাসিক ইলেকশন। সব ওদের নিয়ন্ত্রণে। সরকার তাদের, প্রচার মাধ্যম তাদের। সামরিক শক্তি তাদের। টাকাÑপয়সা তারা দিয়ে যাচ্ছে, আর আমাদের কিছু নাই। শুধু আছে জনগণ। সাপ্তাহিক : আপনি নিজেও তো নির্বাচনে গেলেন? ড. কামাল হোসেন : আমি তো বঙ্গবন্ধুর চিফ ইলেকশন এজেন্ট ছিলাম। ঢাকা থেকে ওনার দুটো সিট। একটা তেজগাঁও, টঙ্গী আরেকটা পুরনো শহর চকবাজার। আর গোপালগঞ্জ ছিল হয়ত আরেকটা। গ্রেটার ঢাকা মানে নারায়ণগঞ্জ থেকে টঙ্গী পর্যন্ত ৪টা না ৫টা কনস্টিটিউয়েন্সি ছিল তখন। উনি বললেন, ইলেকশন পরিচালনার দায়িত্ব তুমি নাও। আমাদের এখানে যে অফিস সেটা ইলেকশন অফিস হবে। হানিফ তোমার অফিস চালানোর দায়িত্ব নেবে। তুমি টিম করে ক্যাম্পেইন চালাবে। প্রথম আমাকে দু’লাখ টাকা, পরে সব মিলিয়ে মোট পাঁচ লাখ টাকা দেয়া হলো। যে পোস্টার ছাপানো হয়েছিল সেটা গুনে গুনে দিতে হয়েছে যে এই ইউনিয়নের জন্য ১০০টা, ঐ ইউনিয়নের জন্য ১০০টা। আমাদের টাকায় কুলায় না কিন্তু আমাদের ছিল শত শত ভলানটিয়ার। শত শত ছেলেমেয়ে সকালে সন্ধ্যায় ওখানে জড়ো হয়। একটাই ভোটার লিস্ট আমরা কিনতে পেরেছি। তখনো তো ফটোকপি আসে নাই। বাংলাবাজার থেকে সাদা কাগজ আর কার্বন পেপার কিনে এনে ভোটার লিস্ট কপি করার কাজে ছেলেরা বসে গেছে। পেন্সিল, কাঠপেন্সিল, কার্বন পেপার, সাদা কাগজ। আর সেও খুব সস্তা। টাকা তো বাঁচাতে হবে। কার্বন পেপার তখন ভাগ করা যায়। একদম স্ট্রিট বাই স্ট্রিট, রাস্তা বাই রাস্তা, একেক রাস্তা একেক দিন ভোটার লিস্ট বিলি করা হচ্ছে। একটা টিমের সঙ্গে আমি, আর একটা টিমের সঙ্গে অন্য যারা ক্যান্ডিডেট ছিলেন। বঙ্গবন্ধু তো সারাদেশের। শেষে শহরে শুধু দুটো মিটিং করবেন। ছাত্রলীগ কর্মীরা তখন আমার সবচেয়ে প্রিয়। একদম নিঃস্বার্থভাবে সকাল থেকে রাত একটানা কাজ করেছে। পয়সার তো প্রশ্নই ওঠে না। আমি আধা পয়সা কাউকে দেই নাই। সাপ্তাহিক : আপনি নির্বাচনে গেলেন কীভাবে? ড. কামাল হোসেন : অনেকে বলেছে, তুমি ইলেকশন করছ না! আমি বলেছি, আমি কেমনে ইলেকশন করব। আমি তো জাস্ট পার্টির ওয়ার্কার একজন। যখন রেজাল্ট হয়ে গেল, রেজাল্ট নিয়ে সাংঘাতিক আনন্দ সারাদেশে। পূর্ব পাকিস্তানে দুটো ছাড়া সব সংসদীয় আসন আওয়ামী লীগ পেয়েছে। কোনো প্রার্থী দুই আসনে বিজয়ী হলে একটা রাখা যায়। তিনদিন-চারদিনের মধ্যে অন্যটা ছাড়তে হয়। বঙ্গবন্ধু বললেন, আচ্ছা এই যে একটা ফরম, আমি যেটা ছাড়ছি ওখানে তো একটা ক্যান্ডিডেট লাগবে, তুমি একটা সই করে আমাকে দিয়ে দিও। আমরা তোমাকে ওইখানে নমিনেশন দিচ্ছি। তখন তো আমি খুব অবাক হয়েছি এবং আনন্দ বোধ করেছি। তারপর আমি মনে করেছি নির্বাচনে প্রতিদ্বন্দ্বিতা হবে। অথচ কনটেস্টই হয়নি। বঙ্গবন্ধু সিট ছেড়েছেন আমি নমিনেটেড হয়েছি আর কেউ দাঁড়ায়নি ওখানে। আমি সঙ্গে সঙ্গে ইলেকটেড ঘোষিত হলাম। সাপ্তাহিক : এবার একটু প্রসঙ্গ পাল্টাই। আপনার ব্যক্তিগত জীবনের প্রসঙ্গে আসি। আপনি বিয়ে করলেন কবে? ড. কামাল হোসেন : ১৯৬৫ সালে। সাপ্তাহিক : আপনার বিয়েটা কিভাবে, কোথায় হলো? বিস্তারিত একটু বলবেন। ড. কামাল হোসেন : আমার স্ত্রীর বোনের এখানে বিয়ে হয়েছিল। ওনার হাজব্যান্ড ছিলেন বাঙালি। বাড়ি সাতক্ষীরা। ওরা এখানে পোস্টেড হলো বোধহয় ১৯৬১-তে। উনি নেভি থেকে রিটায়ার্ড করেছেন, নেভিতে কমান্ডার ছিলেন। অবসর নিয়ে বার্মা ইস্টার্নের অফিসার হিসেবে এখানে বদলি হলেন। ১৯৬১ সালে ওনার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। ওনার বাসায়ও যাওয়া-আসা হতো। উনি প্রেসিডেন্সি কলেজের ছাত্রও ছিলেন। সত্যজিৎ রায়, আবু সাঈদ চৌধুরী তারা সবাই একই ব্যাচের ছাত্র ছিলেন। লেখাপড়ার খুব শখ ছিল তাঁর। বললেন যে নেভিতে গিয়েছেন বাধ্য হয়ে, তার বাবা মারা যাওয়ায়। তার বাবা তখনকার বেঙ্গল এডুকেশন সার্ভিসে ছিলেন। বলতেন যে আমাদের তো বেঙ্গল সার্ভিসে যাওয়ার কথা কিন্তু যেহেতু বাবা মারা গেলেন আর নেভিতে রিক্রুটমেন্ট হলো, তখন আবার দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ হচ্ছিল সে কারণে সেখানে ঢুকেছেন। পরে উনি প্রথম সুযোগ পেয়ে সামরিক চাকরি ছেড়েছেন। ছেড়ে সিভিলিয়ান চাকরি নিয়ে এসেছেন। ইউনিভার্সিটিতে আমাদের যে সার্কেল ছিল তিনি সেখানে আসতেন। যখন আমরা আলোচনায় বসতাম আমাদের কমনরুমেও আসতেন। ‘নিউ ভ্যালুজ’ গ্রুপের উনি একজন অ্যাকটিভ মেম্বার হয়ে গেলেন। আর ওনার বাসাতে বৈঠকখানায় সবাইকে ডাকতেন। শেষে তো আমাদের একটা বসার জায়গা হয়ে গেল সেটা। এভাবে ওনার সঙ্গে আমাদের একটা ঘনিষ্ঠ সম্পর্ক গড়ে উঠল। ওনার নাম এরফান আহমেদ। হামিদা ওখানে বেড়াতে এসেছিলেন। সেখানেই তার সঙ্গে আমার পরিচয় হলো। আমার তো জাস্ট মাথায় থাকল যে এ রকম একজন আছেন আরকি। এটা ’৬২-র শেষে। আমার অসমাপ্ত থিসিসের জন্য ’৬৩-তে আমি বাইরে গেলাম। করাচি হয়ে গেলাম। করাচিতে হামিদার সঙ্গে দেখা হয়ে গেল। আমার স্ত্রীর ভাইও কিন্তু সিএসপি অফিসার ছিলেন। আমি যখন অক্সফোর্ডে ছিলাম তিনিও অক্সফোর্ডে ছিলেন। ওদের ফ্যামিলির সঙ্গে আমার খুব ভালো সম্পর্ক তৈরি হলো। তার ভগ্নিপতির সঙ্গে খুব ক্লোজ ফ্রেন্ডশিপ, আমাদের সার্কেলের মেম্বার। আর ঐ ভাইদের সঙ্গে তো আমার ওখানকার সম্পর্ক। ওদের বাসায় গেছি আবার দেখাও হয়েছে। ’৬৪-এর দিকে আমি যখন আবার থিসিস সাবমিট করতে যাই তখন হামিদা লন্ডনে। উনি কিছু একাডেমিক কাজের জন্য লন্ডনে ছিলেন। আবার দেখা হলো। তখন সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমাদের বিয়ে হওয়া উচিত। বিয়েটা ওখানেই হলো। কিন্তু আমরা সম্মত হয়েছি যে দেশে গিয়ে আবার এটাকে রিনিউ করা হবে। ১৯৬৫ সালের জানুয়ারিতে ফিরে ফ্যামিলির সঙ্গে রিনিউ করা হলো। সাপ্তাহিক : বিয়েটা হয়েছে কোথায়? ড. কামাল হোসেন : অক্সফোর্ডে। সাপ্তাহিক : হামিদা হোসেন কি অক্সকোর্ডে কাজ করতেন? ড. কামাল হোসেন : উনি ওখানে রিসার্চের কাজ করতেন। সাপ্তাহিক : তাদের পরিবারের অরিজিন কোথায়? ড. কামাল হোসেন : সিন্ধু প্রদেশ। একে অন্যকে জেনে, বুঝে আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি। খুব ভালো বন্ধুত্ব ছিল আমাদের মধ্যে। সাপ্তাহিক : তারপর আপনি এখানে চলে এলেন? ড. কামাল হোসেন : জানুয়ারির শেষের দিকে আমরা এখানে চলে এসেছি। প্রথম ধানমণ্ডিতে বাসা নিয়েছি। ৭ নম্বর রোডে লেকের পাশে ছোট ফ্ল্যাট। তারপরে এই সার্কিট হাউস রোডে এসেছি আমরা। সাপ্তাহিক : আপনার সন্তান ক’জন? ড. কামাল হোসেন : দু’জন। সারা এবং দিনা। দিনা লন্ডনে থাকত। এখন এখানে। সাপ্তাহিক : সারা হোসেন তো আইনজীবী। দিনা কী করছেন? ড. কামাল হোসেন : দিনা প্রিন্সটনে ডিগ্রি করল, তারপর নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটি গিয়ে এনথ্রোপলজি এবং ডকুমেন্টারি ফিল্ম মেকিংয়ে পড়ল। এটা খুবই ডেভেলপ ওখানে। বিশেষ করে নিউইয়র্ক ইউনিভার্সিটিতে। তার প্রফেসর বলেছিলেন যে তুমি এ লাইনে যদি পড়তে চাও ওখানে যাও। সঙ্গে এথনোগ্রাফিক্স ফিল্ম মেকিংও পড়তে পার। ডকুমেন্টারি তৈরি শিখে তারপরে পাবলিক ব্রডকাস্টিংয়ে (এডুকেশনাল টিভি) ইন্টার্নি হিসেবে যাও। চ্যানেল ১৩ নামে একটা চ্যানেল আছে। ওখানে দিনা জয়েন করল। জয়েন করার পর জানাল যে, ওখানে ভালোই করছি। আমাকে ওরা কাজও দিচ্ছে। কাজও ভালো লাগছে। আমাকে প্রত্যেক বছর জানায়, আমি প্রোগ্রেস করছি, শিখছি এবং আমাকে ওরা আরো সুযোগ দিচ্ছে। দেশে তো এটার কোনো সুযোগ নেই। গ্র্যাজুয়েট করে ’৯২ থেকে শিখেছে। ৫-৭ বছর হয়ে যাওয়ার পর এখন অ্যাসোসিয়েট প্রোডিউসার লেভেলে কাজ করছে। এভাবে সে একটা নতুন পথে গেল। আমাদের জীবনে তো এ ধরনের কোনো পরিকল্পনা ছিল না। টেলিভিশন, ডকুমেন্টারি, অ্যাসোসিয়েট প্রোডিউসার আমরা বুঝিও নি। সাপ্তাহিক : এবার আমরা ’৭১-এ দিকে চলে আসি। ’৭১-এর দুটো ঘটনা খুব গুরুত্বপূর্ণ। একটা হলো ২৫ মার্চ রাতে আপনাদের অবস্থান এবং পরে আপনার জেলে যাওয়া। ড. কামাল হোসেন : ২৫ মার্চ সন্ধ্যা পর্যন্ত আমরা চব্বিশ ঘণ্টা ইন দ্য পাবলিক আই। মানে ৩২ নম্বরের ছোট কক্ষে প্রতিদিন সকাল থেকে অনেক রাত পর্যন্ত কাটাতাম। আর প্রেস সবসময় আমাদের সঙ্গে কথা বলছে। আমাদের নেতৃবৃন্দ সারা দেশ থেকে টেলিফোনে কথা বলছে। আমরা কি কাজে ছিলাম এটা তো সবাই জানে। আমরা তিনজন তাজউদ্দীন ভাই আর তার সহায়ক হিসেবে আমি এবং আমীর-উল ইসলাম কাজ করতাম। আমীর-উল ইসলাম আর আমি পাশাপাশি থাকতাম। আমি যে বাড়িতে থাকতাম তার পাশের বাড়ির নিচের ফ্ল্যাটে ডা. হাবিবউদ্দিন সাহেব থাকতেন। তার বাড়ির একটা ফ্ল্যাটে থাকতেন আমীর-উল ইসলাম। প্রথমে আমি এলাম, তারপর আমীর-উল ইসলামকে বললাম যে, পাশের ফ্ল্যাটটা খালি হয়েছে। সে গ্রীন রোড থেকে এখানে চলে এলো। আমরা প্রতিবেশী হলাম। ২৫ মার্চ সারাদিন খবরগুলো আসছে যে, ট্যাংকগুলো ওখানে বের হচ্ছে। লাইন আপ হচ্ছে, ক্যান্টনমেন্টে থমথমে ভাব। শোনা যাচ্ছে যে ক্র্যাকডাউন হতে পারে। সারা জেলা থেকে খবর আসছে। তারা জানাচ্ছে, আমরা তো দেখছি এখানে আর্মি মুভ করবে। এক্ষেত্রে আমাদের কী করণীয়। আমাদের একটাই কথা ছিল যে বঙ্গবন্ধু তো ৭ মার্চেই বলেছেন, যার যা আছে তাই নিয়ে শত্র“র মোকাবেলা করতে হবে। যে মুহূর্তে ওরা মুভ করবে সে মুহূর্তেই আমরা স্বাধীন। বঙ্গবন্ধু ফোনে তো এগুলোই ইনস্ট্রাকশন দিয়েছিলেন। আমি মনে করি হাজার হাজার লোক বলবে যে এটাই আমরা পেয়েছি টেলিফোনে। কেউ বলবে না যে ইন্স্ট্রাকশন আমরা পাইনি। যে কারণে যারা বিভিন্ন জেলায় এসডিও ছিল, এসডিপিও ছিল, যারা নির্দেশ পেয়েছে তারা নেমেছে। ২৫ মার্চ সন্ধ্যা ৭টা-৮টার দিকে আমি বাসায়, তখন প্রেসম্যানরাও আসছে। ওয়াশিংটন পোস্টের খুব বিখ্যাত আমেরিকান প্রেসম্যান সেলিগ হ্যারিসন এসেছে কি হচ্ছে জানতে। প্রতিদিন সে ব্রিফিং নিত। আমি বললাম যে, সিন্স দে হ্যাভ এ্যাডপটেড ইনসেন অপশন। মিলিটারি নামছে। তখনি আমীর-উল ইসলাম সাহেব এসে বললেন যে তাড়াতাড়ি করেন! কেননা আমাদেরকে আগেই নির্দেশনা দেয়া ছিল যে পরিস্থিতির কোনো অবনতি ঘটলে আমি, তাজউদ্দীন ভাই, আমীর-উল ইসলাম এই তিনজন নিজেদের বাসা ত্যাগ করে পুরনো শহরে মুভ করব। সাপ্তাহিক : এটা আপনাদের আগের সিদ্ধান্ত? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ দুই-একদিন আগেকার। আমরা ফজলুল করিম সাহেবের বাড়ি দেখে রেখেছিলাম। ফজলুল করিম ছিলেন আওয়ামী লীগ ঢাকা সিটি প্রেসিডেন্ট। পরে মেয়র ক্যান্ডিডেট হয়েছিলেন। বংশালে ওনার বাসা। আর ইংলিশ রোডের কাছাকাছি ওনার আরেকটা বাড়ি ছিল। আমাদের বলা হলো শিফ্ট করতে হলে ওখানে ঐ বাড়িটায় তোমরা চলে যেও। আমরা আগে গিয়ে দেখেও এসেছিলাম ঐ বাড়িটা। আটটা সাড়ে আটটায় আমীর-উল ইসলাম এসেছে একটা ভক্সওয়াগন গাড়ি নিয়ে। বলল, উঠে যান, উঠতে উঠতেও দেখছি যে লোকজন আমাদের বাসায় আসছে। সিভিল সার্ভিসে যারা ছিলেন তারা আসছেন। সানাউল হক সাহেব বোধ হয় এসেছেন। ওনারা সব এই পাড়ায় ছিলেন। মাঝেমধ্যে ইনস্ট্রাকশন নিতেন। আমি বললাম যে, দেখেন আর্মি অপারেশনে যাচ্ছে। জোরজবরদস্তি করলে আপনারা আপনাদের নিজেদের মতো একটা সিদ্ধান্ত নেন। এ রকম কিছু একটা বলে আমরা বাড়ি থেকে বের হলাম। গাড়িতে উঠলাম, আমরা ধানমণ্ডির দিকে তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায় যাচ্ছি। ওনাকে নিতে গিয়ে বিভিন্ন জায়গায় দেখছি আমাদের রোড ব্লক হয়ে গেছে। এটা রাত নয়টা থেকে পৌনে দশটার মধ্যে হবে। শাহবাগ বন্ধ হয়ে গেছে। ইউনিভার্সিটির টিচার্স ক্লাবের সামনে দিয়ে রেললাইন, তারপর নিউমার্কেট ঘুরে যাচ্ছি আমরা। ওখানেও দেখছি সলিমুল্লাহ্ হল, ইকবাল হলের ছাত্ররা সবাই রাস্তায় আছে। আর যা কিছু পাচ্ছে সব রাস্তায় ফেলছে রাস্তা ব্লক করার জন্য। লেভেল ক্রসিং গেটটা হয়ত বন্ধ হয়ে গেছে। আমাদেরকে নেমে পরিচয় দিয়ে বলতে হয়েছে যে আমরা তো ঐদিকে যাচ্ছি আমাদের পথ করে দাও। ওরা সরিয়ে টরিয়ে আমাদের গাড়ি পাশ করে দিল। সাপ্তাহিক : এই যে বেরুলেন, বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে গেলেন না? ড. কামাল হোসেন : আমরা তাজউদ্দীন ভাইয়ের ওখানে যাব। তখন মনে হয়েছে যে একবার বঙ্গবন্ধুকে সালাম দিয়ে যাই। ৩২ নম্বরে তো প্রত্যেকদিন আমরা সকাল থেকে রাত পর্যন্ত সময় দিয়েছি। আজকে আমরা চলে যাব, একটু গিয়ে আমাদের নেতাকে সালাম দিয়ে আসি। একটু খবরটা নিয়ে আসি। দুই নম্বরে না ঢুকে আমরা ধানমন্ডি ৩২ নম্বরের দিকে অগ্রসর হলাম। ৩২ নম্বরে ঢুকলাম। ঢুকে ভেতরে গেলাম। বাড়ি খালি হয়ে গেছে। আমরা একদম ভেতরে ঢুকে পড়লাম। নিচের তলায় শেষ মাথায় খাবার ঘর আছে। ওখানে গিয়ে দেখি বঙ্গবন্ধু টেবিলে বসা। আমি তখন একটু কনফিউজড হয়ে যাচ্ছি যে, ওনার সঙ্গে বসা আহমদ ফজলুর রহমান নাকি কমান্ডার মোয়াজ্জেম। দু’জন অথবা একজন ডেফিনেটলি সেখানে ছিলেন। বঙ্গবন্ধু আমাদের দেখে বললেন, তোমরা এখানে কেন? তোমাদের তো পুরনো শহরে থাকার কথা। আমি বললাম আমরা পুরনো শহরে যাওয়ার পথেই। উনি বললেন, এত দেরিতে। আমরা বললাম আমরা তাজউদ্দীন ভাইকে তোলার জন্য যাচ্ছি। আপনাকে একটা সালাম দিয়ে যাই। উনি বললেন তাড়াতাড়ি যাও, এখন আর সময় নষ্ট কর না। ওনাকে বললাম আপনাকে ছেড়ে এভাবে যাব! বললেন আমার চিন্তা কর না, আল্লাহ ভরসা, তোমরা যাও, যেভাবে বলছি কর। আমাদেরকে একদম সামনে এনে কলাপসিবল গেট পর্যন্ত এসে বললেন যে, তাড়াতাড়ি যাও। ওনার সঙ্গে ৫-৭ মিনিট আমাদের কথা হয়েছিল। তারপর তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসায় গেছি। দেখছি উনি খুব বিরক্ত। বলছেন যে, দেখেন দেশের এই অবস্থা আর মহিলা সিটগুলোর তদবির নিয়ে এখনও লোক এসেছে। আর কী বলব। সাপ্তাহিক : তাজউদ্দীন সাহেব কি আপনাদের সঙ্গেই চলে এলেন? ড. কামাল হোসেন : আমি বললাম, এখন তো অনেক দেরি হয়ে গেছে তাজউদ্দীন ভাই, চলেন, আমরা গাড়ি নিয়ে এসেছি। উনি গিয়ে ওনার বাক্স প্যাক করে আমাদের সঙ্গে গাড়িতে উঠতে যাবেন এই মূহূর্তে একজন হাঁফাতে হাঁফাতে এলেন। দেখি মুজাফফর সাহেব। মুজাফফর আহমদ ছিলেন আমাদের কুমিল্লার এমপি। উনি বললেন আসার পথে দেখেছি ইপিআর তো নিউমার্কেট পর্যন্ত চলে এসেছে। অর্থাৎ ওই রাস্তায় তো বেরুনো যাবে না। খবরটা পেয়ে তাৎক্ষণিকভাবে আমাদের সিদ্ধান্ত একটু বদলাতে হলো। তাহলে তো আমাদের এ পাড়ায় থাকতে হয়। কিন্তু নিজের বাড়িতে না। আমরা দুজন তো নিজের বাড়ি ত্যাগ করে ব্রিফকেস নিয়ে চলে এসেছি। উনিও ব্যাগ নিয়ে গাড়িতে উঠেছেন। পরিচিত কার বাসা আছে নিরাপদ? তাজউদ্দীন ভাই বললেন, দেখ আমাদের এক জায়গায় তিনজন থাকা তো কঠিন হতে পারে। যদি আমরা আলাদা হয়ে থাকতে পারি সেটা নিরাপদ হয়। আমার একটা ভাগ্নের বাড়ি ছিল, কাছেই। সেটা ১৩ নম্বর না কত যেন। আমি গেছি ওখানে। গেট বন্ধ ছিল। দেয়াল কিন্তু খুব উঁচু ছিল না। আমি বললাম ঠিক আছে আমি দেয়ালের ওপর দিয়ে যাই। ওনারা বললেন ঠিক আছে আপনাকে এখানে নামিয়ে দিলাম। তারা দুজন চিনে রাখলেন বাড়িটা। বললেন, আমরা যেখানেই থাকি লোক পাঠিয়ে আপনাকে পিকআপ করব। পরে একটা ছেলেকে পাঠিয়েছিল। নাম্বারটাও মনে ছিল না, আর ছেলেটাও খুঁজে পায়নি বাড়িটা। সাপ্তাহিক : আপনি ধানমন্ডি ১৩ নম্বর সড়কের ঐ বাড়িতেই থেকে গেলেন? ড. কামাল হোসেন : আমি তো একদম সেন্টারে থেকে গেলাম। মানে ধানমন্ডি ১৩ নম্বর তো একদম সেন্টার। আর রাত্রে বঙ্গবন্ধুকে ওরা নিয়ে গেছে। যাদের বাসায় ছিলাম তারা আমাকে বলছে যে, এখানে থাকা মোটেও নিরাপদ না। দেখেন অন্য কোথায় যেতে পারেন। ওখান থেকে আমি কয়েকটা বাসায় গেছি। এরপর পুরনো পল্টনে এসেছি। সেখান থেকে আরেকটা বাড়ি। সেখান থেকে আরেকটা। আমি শেভ করেছি। চশমা পরেছি। এগুলো করেছি ছদ্মবেশের প্রয়োজনে। শেষে আমি এসেছি আবার লালমাটিয়ার কাছে। তখন পরিচিতদের মধ্যে সাংঘাতিক ভয়ভীতি। আমাদের মতো লোককে একটা ফ্যামিলিতে রাখা সত্যিই ঝামেলা। আমি নিজেও বুঝছি স্বাভাবিকভাবে তারা ভীষণ নার্ভাস। এক বাড়িতে ২৪ ঘণ্টার বেশি থাকি না, পরের দিন অন্য বাড়ি। এভাবে করতে করতে দিন যাচ্ছে। ৩ এপ্রিল কারফিউ হয়ে গেছে। সেদিন সম্ভবত ৪ এপ্রিল। লালমাটিয়ায় একদিন এক বাসায় নক করছে, বলছে মিলিটারি এসেছে। আপনাকে খুঁজছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে বের হয়ে বললাম যে দেখেন আমি এই, আমার পরিচয় এই, বাড়িতে ঢুকবেন না। সাপ্তাহিক : কার বাসায় ছিলেন তখন? ড. কামাল হোসেন : আমার এক আত্মীয়ের বাসায়। উনি মারা গেছেন। বলল, ঠিক আছে আমরা আপনাকে নিতে এসেছি। সাপ্তাহিক : আপনাকে নিতে কোন লেভেলের অফিসার এসেছিল? ড. কামাল হোসেন : ব্রিগেডিয়ার লেবেল ছিল বোধহয়। আর তার সঙ্গে অন্য জওয়ান ছিল। গাড়িতে তুলল, পিকআপের মতো কিছু ছিল। তুলে ক্যান্টনমেন্টের ভেতরে নিল। পাহারায় রেখে কোথায় যেন গেল। আধাঘণ্টার মধ্যে এসে আবার নিয়ে গেল আমাকে জিওসির বাড়িতে। তারপর বারান্দার পাশে গেস্টরুমে ঢুকে বলল যে, ইয়োর লিডার ওয়াজ হিয়ার। তোমার লিডারকে এই রুমে রাখা হয়েছিল। তারা আমাকে একটা প্রশ্ন বার বার করে যাচ্ছে। তুমি তো ২৫ মার্চে রাত ১০টার দিকে ৩২ নম্বরে ঢুকলে। তারপর তোমাকে দেখা গেল তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় ঢুকতে। কোথায় যাচ্ছিলে? ওনাকে পাচ্ছি না, তোমাকে পেয়েছি। কোথায় যাচ্ছিলে। আমি বললাম যে, আমরা সবাই মিলে একসঙ্গে পুরনো শহরে যাচ্ছিলাম। এই প্রশ্নটা এক হাজার বার করেছে। প্রথম দুই মাস আসলেই এক হাজার বার করেছে প্রশ্নটা। কোথায় যাচ্ছিলে, কার বাড়িতে যাচ্ছিলে, ভারত ক্রস করার সিদ্ধান্ত কখন হয় ইত্যাদি। আসলে আমাদের ভারত ক্রস করার সিদ্ধান্ত ঐ মুহূর্তে হয়নি। আমি নিজেও অবাক হয়েছি, মাথায় হয়ত ছিল ব্যাক অব দ্যা মাইন্ড যে, ব্যাক করতে করতে হয়ত এক পর্যায়ে বর্ডার ক্রস করতে হবে। কিন্তু ওরা যে এই রকম মিলিটারি অ্যাকশনে যাবে এটা আমাদের কল্পনার বাইরে ছিল। গণহত্যা চালিয়ে চালিয়ে তারা অগ্রসর হবে, এটা ভাবা যায়নি। যারা আমাকে প্লেনে তুলল তারা ইন্টেলিজেন্সের লোক, সেটা বোঝা গেল। সাপ্তাহিক : আপনার সঙ্গে তারা কি কোনো খারাপ ব্যবহার করেছিল? ড. কামাল হোসেন : না। তবে মানসিক টর্চার ছিল। রুমে মিলিটারি গার্ড ছিল। একই প্রশ্ন বার বার করছিল। এটা একটা মানসিক চাপ। সাপ্তাহিক : খাওয়া-দাওয়া? ড. কামাল হোসেন : খাওয়া-দাওয়া কিছু এনে দিত আর কি। সাপ্তাহিক : আপনি কি বুঝতে পারছিলেন কী করবে আপনাকে? ড. কামাল হোসেন : ওরা বলছে তোমার লিডারকে তো পশ্চিম পাকিস্তানে নিয়ে যাওয়া হয়েছে। আমি তো ধরা পড়েছি ৪ এপ্রিল ১৯৭১। আমারও আশঙ্কা হচ্ছিল যে আমাকেও হয়ত নেবে। ডিটেনশনে তো নেবেই। সেই রাতে না পরের রাতে ভীষণ একটা ঝড় হয়েছিল, সব লাইট বন্ধ হয়ে গেছে। তখন দেখলাম যে হঠাৎ করে একটা মিলিটারি ঢুকে মেশিনগান পয়েন্ট করে টর্চ দিচ্ছে। আমি দাঁড়িয়ে গেলাম। বলল তোমাদের লোকজন তো এখানে আশপাশে ঘোরাফেরা করছে। নিরাপত্তার ব্যাপারে আমাদের খুব সতর্ক থাকতে হয়। রাত গেল, সকালে এসে বলছে যে তোমাকে আমরা প্লেনে পশ্চিম পাকিস্তানে পাঠাব। দুইজন অফিসার দুই পাশে বসল। বসে শুরু হলো প্রশ্ন করা, কোথায় যাচ্ছিলে, তোমার সঙ্গে যারা বেরিয়েছে কোথায় গেছেন। বার বার এই একই প্রশ্ন। আমি বললাম নো আইডিয়া। সাপ্তাহিক : সেই প্লেনে আপনি ছাড়া আর কেউ ছিল? ড. কামাল হোসেন : ব্রিগেডিয়ার মজুমদারকেও সেদিন প্লেনে নিয়েছে তারা। তিনি বাঙালিদের মধ্যে সবচেয়ে সিনিয়র আর্মি অফিসার ছিলেন। সামনের দিকে আমাকে বসাল। সাপ্তাহিক : ওনাকে পরে কী করেছিল? ড. কামাল হোসেন : টর্চার করেছিল, টর্চার করে ওনাকে রাজসাক্ষী হিসেবে দাঁড় করিয়েছিল। করাচিতে প্লেন রানওয়েতে থাকল। আমাকে নামিয়ে আরেকটা প্লেনে তুলল। ওই প্লেনটা গেল ইসলামাবাদ, রাওয়ালপিন্ডি। রাওয়ালপিন্ডি এয়ারপোর্টে একটা মাইক্রোবাসে তুলল। মাইক্রোবাসের চারদিকে কালো পর্দা লাগান। সেই মাইক্রোবাস হাইওয়েতে উঠল। ২-৩ ঘণ্টা হবে। তারপরে এক জায়গায় থামল। গেট খোলা আর বন্ধ হবার শব্দ পেলাম। বলল এটা হরিপুর সেন্ট্রাল জেল। নামো। সাপ্তাহিক : এটা কি ইসলামাবাদ? ড. কামাল হোসেন : না এটা হাজারা ডিস্ট্রিক্ট। এখানে ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স শুরু হয়। অ্যাটক নদী আছে ওখানে। সেই নদী পার হয়ে নর্থওয়েস্টার্ন ফ্রন্টিয়ার প্রভিন্স। এটা হলো আইয়ুব খানের জন্মস্থান। সাপ্তাহিক : তারপর? ড. কামাল হোসেন : ওখানে একটা টেলিফোন ফ্যাক্টরি আছে। জেলখানায় থেকেই শিফট বদলের সাইরেন শোনা যায়। ঘড়ি দেখা যায়। তখন আমাকে ভেতরে নিয়ে গেল একটা ঘরে। ১৮টা সেল ৬, ৬, ৬। সামনে একটু খোলা জায়গা আর চারদিকে তো ঘেরা। ওর মধ্যে ঢুকে দেখলাম যে বাকি ১৮-এর মধ্যে সব কয়টা খালি। আমাকে একটা সেল দিল। আর কোনার সেলটা ৬ নম্বর। ওখানে কিছু পানি রেখে টয়লেট ফ্যাসিলিটি তৈরি করল। আর একটা পানির কল ছিল। ১২টার মধ্যে পানি ধরে রাখতে হতো। আমি আইনজীবী। বললাম যে, জেল রুলস কোথায় দেখা যায়? বলল, তোমার ব্যাপারে কোনো জেল রুলস খাটবে না। কেন? তুমি স্পেশাল কাস্টডিতে আছ। তুমি জেল কোডের অধীনে নাই। জেল কোডে তো অনেক রকমের ফ্যাসিলিটিজ আছে। আইনজীবী চাওয়ার কথা আছে। আইনজীবীর সঙ্গে দেখা করার প্রসঙ্গ তুললে ওরা বলল, না না, ওগুলো কোনো কাজে লাগবে না তোমার। তুমি জাস্ট এখানে থাক। ২-৩ দিন গেল বোধহয়। তারপরে ইন্টেলিজেন্সের লোকেরা আসা শুরু করল। জিজ্ঞাসাবাদ শুরু হলো। বলল, ৯টায় তুমি বঙ্গবন্ধুর বাসায় গেছ। ১০টায় তুমি তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গেছ- তারপর তুমি গাড়িতে উঠেছ, তারপরে তুমি কোথায় গেছ। আমি বললাম ঢাকায় আমি বন্ধু, আত্মীয়দের বাসায় গেছি। তারপর বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। প্রথম তো এটাই বলতে লাগল যে, তোমরা ভারতে যাচ্ছিলে। আমি বললাম, না, কোথায় যাচ্ছিলাম আমি নিজেও জানি না। কেননা আমি একদম শুরুতেই বিচ্ছিন্ন হয়ে গেছি। বাই দ্যাট টাইম ১০ এপ্রিল তারিখ বোধহয় হয়ে গেছে। ৬-১০ জন এসে বলল তোমাদের তো একটা অস্থায়ী সরকার ঘোষণা হয়েছে দিল্লি থেকে। আরে তুমি তো ওর মধ্যে একজন মন্ত্রী আর তুমি বল যে তুমি কিছু জান না! আমি অবাক হচ্ছি আর বলছি, অস্থায়ী সরকার হচ্ছে অথবা আমি তার একজন সদস্য এ বিষয়ে আমার তো কোনো আইডিয়া নেই। ওরা বলল, না না, তোমার নাম ওখানে আছে। তোমাদের প্লান অনুযায়ী নিশ্চয়ই সব হয়েছে। এমনি তো হতে পারে না। ইন্ডিয়ার কার কার সঙ্গে দেখা হয়েছে, কবে দেখা হয়েছে। আমি বলেছি কিছুই জানি না। আরো ৪-৫ দিন এ রকম চলল- তারপরে ওরা চলে গেল। আবার ৭, ৮, ১০ দিন পরে এসে এপ্রিলের শেষের দিকটায় আবার এসেছে। বলল, হ্যাঁ, দেখ তোমার নেতার সঙ্গে আমরা কথা বলেছি। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধুকে কোথায় নেয়া হয়েছিল? ড. কামাল হোসেন : মিয়াওয়ালি জেলে। মিয়াওয়ালি পাকিস্তানের ফ্রন্টিয়ার প্রদেশে অবস্থিত। বঙ্গবন্ধু পরে বুঝতে পারেন যে, এই জায়গাটা ছিল জেনারেল নিয়াজির জন্মস্থান। যে কারণে ১৬ ডিসেম্বরের পরে বঙ্গবন্ধুর জীবনের ওপরে একটা হুমকি এসেছিল। তখন ওনাকে ওখান থেকে বের করে নিয়ে আসা হয়েছিল। পরে বঙ্গবন্ধুর দাবি অনুযায়ী আমাকে নিয়ে যাওয়া হলো সিয়ালা পুলিশ ট্রেনিং ইনস্টিটিউটের গেস্ট ডাকবাংলোতে। সাপ্তাহিক : এখানে থাকলেন কত দিন? ড. কামাল হোসেন : ৫ এপ্রিল থেকে ২৮ ডিসেম্বর, ১৯৭১ পর্যন্ত। সাপ্তাহিক : ওরা পরে কী করল? ড. কামাল হোসেন : প্রথম দিকে তো ওরা নিজেরাই বলত যে, দেখ তুমি তো গন্কেস। যে কোনো মুহূর্তে তোমাকে শুট করা যেতে পারে। আমরা যে কোনো সময় তোমাকে শুট করতে পারি। নিজের জানের প্রতি যদি মায়া থাকে তো কিছু কথা বল। বললাম, সব কথা তো বলেছি। কোনোটাই তো গোপন করছি না। তখন বলল যে, যা বলেছ সব তুমি লিখে ফেল। এটা তোমার লাস্ট চান্স। লিখে তুমি যদি আমাদের কিছু তথ্য দিতে পার, তোমার জান বাঁচবে। তোমার লিডারও তো গন্কেস। ওনার তো ফাঁসি হবেই। তোমারও ফাঁসি হবে। তোমার তো সন্তানও আছে। তাদের জন্য তুমি যদি বাঁচতে চাও আমাদের সলিড কিছু তথ্য দিয়ে দাও। এসব বলার পরে আমাকে কিছু কাগজ-কলম দেয়া হলো। আমি ৭-৮ পাতা লিখেছি। আগ্রহ নিয়ে পাতা কয়টা দেখল। লেখা পড়ে তাদের চেহারা কঠিন হয়ে গেল। বলল, শেষ পর্যন্ত তুমি আর সুযোগ নিতে পারলে না। তুমি তো মনে কর তুমি ডিফেন্স কাউন্সিল অব শেখ মুজিব (এই শব্দটিই উচ্চারণ করেছে)। আমি ওদের সরবরাহ করা কাগজে ছয় দফার কথা, আগরতলা মামলার কথা লিখেছি। কিভাবে আমরা রাউন্ড টেবিলে গিয়েছিলাম, সেটা বিস্তারিত লিখেছি। কিভাবে আমরা ইলেকশন করেছি, ইলেকশনের রেজাল্ট কি হয়েছে, সেটা লিখেছি। লিখেছি কিভাবে আমরা খেটেখুটে প্রস্তাবিত সংবিধানের খসড়া তৈরি করেছি। যেটা অ্যাসেম্বলিতে নিয়ে গিয়ে আমাদের আলোচনা করার কথা। সেটাতে পাকিস্তানিদের বাধায় শেষ পর্যন্ত সংসদের অধিবেশন বসতে পারেনি। তারপর তারা ২৫ মার্চ রাতে আক্রমণ করেছে। এরপর বন্দি হয়ে আমি এখানে। এসব বিস্তারিত লিখেছি। মার্চের তিন সপ্তাহের অসহযোগ আন্দোলনের বর্ণনাটাও খুব ভালোভাবে লিখেছি। এই লেখা দেখে তখন বলল, না এটা তো হলো না। ভারতের কার কার সঙ্গে তোমার দেখা হয়েছে, কিভাবে হয়েছে কি আলাপ করেছ, এটা তো লিখবে। আমি বললাম, আমি যা যা জানি সেটাই লিখেছি। এর বেশি কিছু আমি জানি না । অবশ্য আমি যা কিছু লিখেছি সব ইতোপূর্বে পত্রিকায় প্রকাশিত হয়েছে। আমি মনে মনে ভেবেছি, এগুলো ওদের জানিয়ে আমি আলাদা কোনো তথ্য তো দিচ্ছি না। কেননা এটা তো অলরেডি পত্রিকায় পাবলিশড। সাপ্তাহিক : তখন তারা কি বলল? ড. কামাল হোসেন : বলল যে, আর তো তোমাকে বাঁচাতে পারলাম না। এখন তোমার ট্রায়াল হবে। তোমার লিডারের তো বাঁচার কোনো উপায় নেই। আমরা চেয়েছিলাম যে, তুমি ইয়াংম্যান, তোমাকে যদি উদ্ধার করা যায়। কিন্তু তুমি তো সহযোগিতা করলে না। এটা জুন মাসের ঘটনা। চলে গেল জুলাই-আগস্ট। অনিশ্চয়তার মধ্যে কাটছে। খুব গরম তখন। সেপ্টেম্বরের ৫ তারিখে একজন মেজর পদমর্যাদার সেনা কর্মকর্তা একটা কাগজ নিয়ে এসে বলল, এটা রিসিভ করে নাও। ওটা হচ্ছে আমার বিরুদ্ধে দেশদ্রোহিতার অভিযোগের কাগজ। অভিযোগপত্রটি দেখে বললাম যে, দেখ এটা তো এভাবে লেখা যায় না। এটা বিধিসম্মত হয়নি। অভিযোগপত্রে অভিযোগগুলো সুনির্দিষ্টভাবে চিহ্নিত করতে হয়। একজন আইনজীবী হিসেবে এগুলো তো আমার জানা। অথচ এই অভিযোগপত্রে তা নেই। তখন ঐ মেজর বললেন, আমি আইনকানুন জানি না। আমাকে শুধু বলেছে তাই নিয়ে এসেছি। এগুলোর ব্যাপারে আমার কোনো কিছু বলার নেই, আমার কিছু জানাও নেই। তখন আমি বললাম, আমার আপত্তি আছে। আমি অভিযোগগুলো সবিস্তারে জানতে চাই। বলল, ঠিক আছে আপনার আপত্তি জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে জানিয়ে দেন। আমি অভিযোগপত্রটি রিসিভ করে রেখে দিয়েছি। পরের দিন অবশ্য জেল কর্তৃপক্ষকে আমি বলছি যে, দেখ আমি এটার বিষয়ে আপত্তি লিখছি। আমাকে রেডিও দেয়া হয় না, আমাকে পত্রিকাও দেয়া হয় না। জেল কোডে বন্দিদের অনেক অধিকার দেয়া আছে। প্রিভিলেজ আছে। সাধারণ বন্দিদের সেসব দেয়া হয়, আমাকে দেয়া হয় না। এনক্লোজার থেকে আমাকে বেরুতে দেয়া হয় না। এখানে এপ্রিল থেকে সেপ্টেম্বর এত মাস আছি। এখনো আমাকে কোনো জেলরুল দেখানো হয় নাই। অথচ আমি দেখি যে, অন্য বন্দিরা সকাল থেকে মাগরিব পর্যন্ত হাঁটাহাঁটি করে। বিভিন্ন রকমের কাজ করে। তারপরে লকআপের সময় তাদের নিয়ে লকআপ করা হয়। আমাকে তো সবসময় লকআপে রাখা হয়। এনক্লোজারের বাইরে যেতে পর্যন্ত দেয়া হয় না। এটার কি মানে। এই কথাগুলো ঐ মেজর সাহেবকেও বলেছিলাম। তিনি বললেন যে, ভাই এগুলো কোনো কিছুই আমার দেখার না। আমি এসেছি পেশওয়ার আর্মি হেড কোয়ার্টার থেকে। আমাকে বলা হয়েছে অভিযোগপত্রটি ডেলিভারি দিয়ে রিসিট নিতে। এর বাইরে আমার আর কোনো ক্ষমতা নেই। আপনার যা আপত্তি আছে আপনি জেল কর্তৃপক্ষের মাধ্যমে লিখে পাঠান। কাকে লিখব জিজ্ঞেস করলে বলল যে, লিখবেন ‘টু দি কনসার্ন অথরিটি’। সাপ্তাহিক : জেল কর্তৃপক্ষকে কিছু জানালেন না? ড. কামাল হোসেন : জেল সুপারিনটেনডেন্টকে বললাম একই কথা। তিনি উত্তর দিলেন যে, এগুলো আমার এখতিয়ারের বাইরে। ইউ আর ইন মিলিটারি কাস্টডি ইন দ্য জেল। আপনার অথরিটি হোম মিনিস্ট্রি না। আপনার অথরিটি হচ্ছে মার্শাল ল’ হেড কোয়ার্টার। আপনার আপত্তি আমরা ওখানে পাঠিয়ে দেব। এর মধ্যে ডাক্তার এসেছিল। ডাক্তার এসে সেলের মধ্যে দেখে বলল, বল তোমার কী অসুখ। আমি পরীক্ষা করে ওষুধ দিয়ে দিচ্ছি। আমি অসুস্থতার ভাব করে ভেবেছিলাম এবার হয়ত বাইরে যাবার সুযোগ পাব। সেলের বাইরে যাওয়ার জন্য আমার কোনো কৌশলই কাজে লাগল না। তারপরে অক্টোবরের শেষে অথবা নবেম্বরের প্রথমদিকে এসে তারা বলল যে, তোমার ট্রায়ালের ব্যবস্থা হবে। আমাদের ওপর নির্দেশ এসেছে এই জেলখানার ভেতরে একটা জায়গা সাজাতে হবে, সেই জায়গায় ট্রায়াল হবে। এই প্রথম জেলের ভেতরে আমাকে একটু হাঁটতে দেয়া হলো। ডানপাশে বেরিয়ে গিয়ে আরো একটু এগিয়ে দেখলাম, পাশে একতলা ব্যারাকের মতো একটা জায়গা। এটা হলো জেল হাসপাতাল। সেখানে একটা রুম দেখলাম। ওখানে একটা জায়গায় ট্রায়ালের মতো করে চেয়ার সাজানো হয়েছে। মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। ঐখানে জজরা বসবে। এরপর আমার একটা রিহার্সেল হয়ে গেল। আপডাউন। এরপর আমাকে হেঁটে হেঁটে দেখানো হলো এই পথে তোমাকে আনা হবে, এই পথে তোমাকে সেলে নিয়ে যাওয়া হবে। আমার ভালোই লাগল যে একটু কিছু চেঞ্জ হচ্ছে। সাপ্তাহিক : আপনার পরিবার তখন কোথায়? ড. কামাল হোসেন : আমার ফ্যামিলি এখান থেকে চলে গিয়েছিল করাচিতে। এই নোটিশ দেয়ার পরে একবার দেখা করতে এসেছে জেলে। এপ্রিল মাসের কোনো একটা সময় ঐ অনুমতিটা তারা এখানে ম্যানেজ করেছে। আমার শ্বশুর থাকতেন করাচিতে। আমার স্ত্রী আমার সঙ্গে জেলখানায় দেখা করার অনুমতি নিয়ে করাচিতে বাবার বাসায় থেকেছে। এর মাঝে একটা চিঠি বোধহয় দিতে বলেছিল, আর একটা উত্তর নিয়ে দিতে বলেছিল। একটা চিঠি এসেছে সেপ্টেম্বরের দিকে। আমার পরিবার আমার সঙ্গে জেলে দেখা করতে এলে আমি বলেছি যে, তোমরা আইনজীবীর সঙ্গে আমার সাক্ষাতের ব্যবস্থা কর। ওরা এই নোটিশটা পাওয়ার পরে একবার আসতে চেয়েছে এক ঘণ্টার জন্য। তখন আমি বলেছি লিগ্যাল ডিফেন্স ইত্যাদির ব্যবস্থা কর। সাপ্তাহিক : আপনার পরিবারের ওপর সে সময় কি কোনো টর্চার হয়েছে? ড. কামাল হোসেন : আমার স্ত্রীর ওপরে পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষের নির্দেশ ছিল করাচি শহরের বাইরে যেন সে না যায়। বাচ্চারা তো তখন খুবই ছোট। স্ত্রীর ভাইদের মধ্যে একজন তখন বোধহয় পাকিস্তানের ফরেন সার্ভিসে অ্যাম্বাসেডর হিসেবে কর্মরত। আরেকজন সিএসপি, সেও উঁচু পদে কাজ করতেন। যতদূর মনে পড়ছে তিনি গভর্নরের সেক্রেটারিয়েটে ছিলেন। আমার অন্তরীণ অর্ডার হয়ত আমার স্ত্রীর ভাইকেই স্বাক্ষর করতে হয়েছে। এই অবস্থার মধ্যেই আমার পরিবার করাচিতে থেকেছে। সাপ্তাহিক : ট্রায়ালের জন্য কী বলেছিল? ড. কামাল হোসেন : ট্রায়ালের কথা শুনে আমার স্ত্রী একবার আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আসল। আমি বললাম, আমার জন্য আইনজীবী ঠিক কর। জেলে বসেই ভাবলাম ট্রায়াল হলে তো আমার পরিবারও আসতে পারবে, কোর্টে বসতে পারবে, দেখার সুযোগ হবে। তখন আবার দেখা হবে। জেল কর্তৃপক্ষ জানাল কখন যে ট্রায়াল হবে তা তো জানি না। তবে নভেম্বর মাসে তারিখ পড়ল। অনেক আশাবাদী হয়ে অপেক্ষা করতে থাকলাম। হঠাৎ জেলের লোকজন এসে আমাকে বলল, দেখ এই যে টিম এসেছিল ট্রায়ালের জন্য, গেস্ট হাউসে থাকত আর্মি অফিসাররা, ওরা সব গুছিয়ে, প্যাকআপ করে চলে যাচ্ছে। এই সংবাদ শুনে আমি তখন সাংঘাতিক ঘাবড়ে গেলাম। জেল সুপারিনটেনডেন্টকে বললাম, দেখেন আমার তো ট্রায়ালের জন্য পূর্ব প্রস্তুতিও ছিল, আমার ল’ইয়ার এখনো আসেনি। আমার ফ্যামিলিকে আমি বলে রেখেছি ট্রায়াল হলে আমার পরিবারও আসবে। এখন ওদের কোনো খবর পাচ্ছিও না। এটা শুনে সুপারিনটেনডেন্ট আমাকে বলেছেন, সামনে ঈদ, তাই হয়ত ওরা চলে যাচ্ছে। ঈদের পরে এসে হয়ত ট্রায়াল শুরু হবে। বুঝলাম, এটা সান্ত্বনা দিচ্ছে। কিন্তু পরে বুঝতে পারলাম যে, তখন থেকে রাজনীতির চাকা অন্যদিকে ঘুরছে। তখন নভেম্বরের শেষ। মুক্তিযুদ্ধেরও টার্নিং পয়েন্ট। আমি এটা বুঝতে পারলাম এ কারণে যে, আমাদের সেলের বাইরে সাদা রঙ (হোয়াইট ওয়াশ) করা ছিল। হঠাৎ দেখি বালতিতে করে এর ওপর কাদার মতো বানিয়ে লেপে দিচ্ছে। এটা আমার কাছে একটা পরিবর্তন মনে হলো। জিজ্ঞেস করলে বলল যে, এটা সিভিল ডিফেন্স। আকাশ থেকে বম্বিং হতে পারে। সে কারণেই এ প্রস্তুতি। ইট ইজ ভেরি ইন্টারেস্টিং। এটা যুদ্ধের পূর্ব প্রস্তুতি। ওরা যুদ্ধ বলেনি, সিভিল ডিফেন্স শব্দটা ব্যবহার করেছে। সাপ্তাহিক : এর মধ্যে আর কোনো বড় পরিবর্তন চোখে পড়ল? ড. কামাল হোসেন : সপ্তাহ খানেকের মধ্যে দুটো জিনিস হলো। একটা হলো অল লাইটস অফ। জেলের ভেতর তো খুব ব্রাইট লাইট জ্বলে, বড় বড় সার্চলাইটের মতো। হঠাৎ করে সব বাতি নিভিয়ে ফেলায় একদম অন্ধকার হয়ে গেল। একটা খুব ভয়াবহ পরিবেশ তৈরি হলো। এমনিই তো আমরা বন্দি অবস্থায় আছি। আমি বললাম, কি ব্যাপার এটা! তখন বলে যে- না না, এটা সিভিল ডিফেন্স। দুইদিন পরে সাইরেন বাজে। সাইরেন বাজার পর পর আমাকে বলে যে, এখন তুমি সেল থেকে বেরিয়ে ঐ যে গাছ আছে ওর সামনে গিয়ে দাঁড়িয়ে যাও। জানতে চাই কেন? বলে যে, সিভিল ডিফেন্স। তখন নভেম্বর মাসের কড়া শীত। এই জায়গাটা হরিপুর। মানে ঐ রাস্তায় উঠলে কাশ্মীর যাওয়া যায়। অর্থাৎ ওখান থেকে কড়া ঠাণ্ডা বাতাস আসে। মনে হয় বাতাস একদম হাড়ের ভেতরে ঢুকবে। এই অবস্থায় আমি দুইবার সেলের বাইরে গেছি। দ্বিতীয় দিনে যখন এভাবে সিভিল ডিফেন্স করতে বলল তখন আমি বলেছি, দেখ এই ঠাণ্ডায় দাঁড়িয়ে তুমিও তো মারা যাবে। আমিও মারা যাব। তার চেয়ে আমি ভেতরে থাকি তুমিও ভেতরে থাক, বোমা পড়লে পড়বে। আর বোমা যেহেতু ছোট জিনিস না সেহেতু এখানে পড়লেও মারা যাব, ওখানে গাছের নিচে থাকলেও মারা যাব। একটা মাঠের মতো ছিল। ঐ দিকে পরিখা খুঁড়েছে এবং সাইরেন বাজার সময় ওখানে কিছু লোক গিয়ে আশ্রয় নেয়। আমি বললাম, আমাকে ওখানে যেতে দাও না কেন। কারারক্ষী বলল যে, না তোমার জন্য অ্যালাউড না। তুমি গাছের নিচে দাঁড়াবে। তখন এই চুক্তি করলাম যে, গাছের নিচে দাঁড়ানোর চেয়ে আমার সেলে বসা ভালো, মানে রুমে থাকাটা ভালো। তখন আমার দায়িত্বে যে কারারক্ষী ছিল সে বলল, ঠিক আছে যদি দেখি যে রাউন্ডে কেউ ইন্সপেকশনে আসে তখন আমরা দুজনেই গিয়ে দাঁড়াব। এভাবে অনেক রকমের অ্যারেঞ্জমেন্ট হয়ে যেত। তখন ঠিক হলো আমিও কম্বলের ভেতরে থাকি, তুমিও কম্বলের ভেতরে থাক। এই কয়েকদিন এভাবেই গেল। কয়েক দিন মানে ১৯৭১ সালের ডিসেম্বরের ৭, ৮, ১০ তারিখ হবে। সাপ্তাহিক : তারপর? ড. কামাল হোসেন : হঠাৎ করে একদিন সব লাইট আবার জ্বলে উঠল। একদম একসঙ্গে সব লাইট জ্বলে উঠল। এখন যেটা মনে পড়ছে এটা ১৫ অথবা ১৬ ডিসেম্বরের রাত হবে। ওখানে যিনি সুপারিনটেনডেন্ট ছিলেন তিনি পরের দিন সকাল সকাল এসে বললেন, দেখেন তো আপনার সেলের মধ্যে হাতাওয়ালা চেয়ার নাই! এই দেখেন আমাদের লোকজন এগুলো খেয়াল করে না। এই একটা হাতাওয়ালা চেয়ার নিয়ে আস। শীতের দিন আমাদের জেলে ভালো কার্পেট তৈরি হয়, এখানে একটা কার্পেটও দেয় নাই। এই একটা কার্পেট নিয়ে আস। পরে সেই পাশের সেলটা খুলে দিল। আরো দু-চারটা হাতাওয়ালা চেয়ার ইত্যাদি দিয়ে একটা সিটিংরুম বানিয়ে দিল। তারপরে খাওয়ার সময় দেখি একটা ট্রেতে খাওয়া আসছে, তিন পদের খাবার। আমি বললাম, ব্যাপারটা কি, নয় মাস জেলে এসেছি একটা টিনের বাটিতে ডাল আর একটা রুটি কাপড়ের মধ্যে মোড়ানো থাকত। কাপড়ের ভেতর থেকে একটা রুটি ফেলে দিত। আর একবেলা ভাতও দিত। আমি তখন বললাম, আজ এটা কেন? বলে যে না ডাক্তার সাহেব আজ এই মেন্যু দিতে বলেছে। বলেছে ডায়েট একটু ভালো করে দিতে হবে। আবার বলে যে, কালকে তোমাকে আমরা জেল পরিদর্শনে নিয়ে যাব। বলে, তোমরা তো পলিটিক্যাল পিপল, তোমরা তো এখানে আস কিছু দিনের জন্য। গিয়ে আবার কখন মন্ত্রী-টন্ত্রী হও। আমাদের খেয়াল-টেয়াল রেখ। অন্য ভিআইপিরা এখানে গাছ লাগিয়ে গেছে। আবদুল গাফ্ফার খান, মানে ব্রিটিশ আমলে এমনকি কংগ্রেসের কে কে যেন ছিল। তো তোমার জন্য একটা গাছ লাগানোর ব্যবস্থা করি। আমি বললাম, আমি সেই পর্যায়ের লোক না। তখন আমাকে নিয়ে ঘুরিয়ে দেখাল যে, এটা আমাদের জেল হাসপাতাল, এটা ফ্যাক্টরি, এই যে এখানে কার্পেট তৈরি হয়। সাপ্তাহিক : এসব কি ১৭ ডিসেম্বর ১৯৭১ দেখাল? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ। ১৭ ডিসেম্বর। বলছে, তুমি আর কয়দিনই বা এখানে থাকবে! বেশিদিন তো থাকার কথা না। মজার ব্যাপার যে, আমি তখন জিজ্ঞাসা করছি কি হয়েছে, যুদ্ধ হয়েছে? তারপরে কি হয়েছে? বলল, এটা তো আমি বলতে পারব না। আমাদের কিছু বলা নিষেধ । আমি তো বুঝতে পারছি যে, ওরা বিজয়ী হলে তো আমার অবস্থার উন্নতি হয় না। তারপরে বলে, যা কিছু হয়েছে তোমার জন্য ভালোই হবে। এভাবে জেলবাসে দিন দিন আমার অবস্থার কিছু কিছু উন্নতি হচ্ছে। সুপারিনটেনডেন্ট এসে আমার সঙ্গে প্রতিদিন এক ঘণ্টা বসে। সিটিংরুমে চা-টা আসে। আর ঐসব কথা বলে যে, দেখেন একজন পলিটিক্যাল লিডার জেলে আসাটা তো তাদের জন্য ভালোই হয় ইত্যাদি। অবশ্য আমাকে তখনো নিউজপেপার, রেডিও দেয়নি। বাইরে কি হচ্ছে জানার জন্য আমার খুব আগ্রহ হচ্ছে। এই রকমভাবেই গেল ১৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত। ১২ দিন গেল। আমার জন্য লং টাইম। সাপ্তাহিক : তখনো আপনি বাংলাদেশের অবস্থা কিছু জানেন না? ড. কামাল হোসেন : অনুমান করছি। আমার ওয়ার্ডাররা (কারারক্ষী) কিছু কিছু বলছে। ভাঙা ভাঙা উর্দু পশতু ভাষা মিলিয়ে। আর ওখানে কিছু কিছু পাঠান ছিল তারা নিজেরাও ভুক্তভোগী বলে কিছু সহানুভূতি পেতাম তাদের। এদের একজন তো খুব সাহসী ছিল। বাড়ি থেকে তার স্ত্রী যা বানাত যেমন রুটি সেটা নিয়ে আসত। বলত যে, দেখেন আপনার জন্য এটা নিয়ে এসেছি। জেলে যে ফার্স্ট সুপারিনটেনডেন্ট ছিল একবার সে শবেবরাতে কিসের যেন হালুয়া পাঠিয়েছিল। এটা সঙ্গে সঙ্গে উপরে রিপোর্ট হয়েছে। ফলে তাকে বদলি করে দিয়েছে। এত প্রখরভাবে তারা আমার ওপর নজর রাখত। কোনো কারারক্ষী যদি আমার সঙ্গে কথা বলছে, জানলেই ব্যস, সে আউট। পরে অবশ্য এগুলো শিখে ফেলেছি যে, অন্ধকার হওয়ার পরে ঐ জায়গায় গিয়ে কথা বলতে হবে, যাতে বাইরে থেকে কেউ রিপোর্ট করতে না পারে। সেখানে কিছু কিছু শিক্ষিত লোকও ছিল। একজন ছিল যার বাবাকে কেউ হত্যা করেছিল। পাঠানদের মধ্যে রীতি আছে যে, বাবাকে হত্যা করলে পুত্রকে তার প্রতিশোধ নিতে হয়। তাকে বলে বদলা। প্রতিশোধ নেয়ার জন্য ঐ পাঠান একজনকে খুন করেছে, ফলে তার ১৪ বছর সাজা হয়েছে। সে আমাকে বলেছে, ভাই আমার সাজা ১০ বছর হয়ে গেছে, আমি তো শিগগিরই চলে যাব। আমার মনে হয় তুমি একটা ভালো মানুষ, তোমাকে এখানে অন্যায়ভাবে জেল খাটতে হয়েছে। আমি তো যাচ্ছি, আশা করি তুমিও শিগগিরই চলে যাবে। ১৬ ডিসেম্বরের পরে সে মুক্ত হয়ে বেরিয়ে গেল। আবার ১০ দিন পরে শুনি, সে আবার জেলে চলে এসেছে। কেননা, জেল থেকে বেরিয়ে গিয়ে আবার আরেকটা প্রতিশোধ নিয়েছে। ওদের কালচারটা বুঝলাম যে, ছেলের ওপর এটা একটা কর্তব্য হয়ে থাকে। বিষয়টা এ রকম যে, তুমি যদি সম্মানিত হও, তোমার নিজের যদি একটা আত্মসম্মানবোধ থাকে, তবে তুমি তোমার বাবার হত্যার প্রতিশোধ না নিয়ে শান্তিতে থাকতে পার না। সে ১০ বছর জেল খেটে ১০ দিনের মধ্যে আবার জেলে চলে এসেছে। কারারক্ষীরা সবাই ওকে ভীষণ শ্রদ্ধা করত। বলত যে, সে বাপের ব্যাটা। তারপর দ্বিতীয়বার আসার পরে বলে, রিয়্যাল বাপের ব্যাটা। বদলা নেয়, ১০ বছর জেল খাটে। তাদের অনেকেই আমাকে বলেছে, তুমি তো উকিল মানুষ তুমি এখান থেকে বেরিয়ে গেলে আমাদের জন্য মার্সি পিটিশন করবে। এভাবে ১৬ থেকে ২৮ ডিসেম্বর পর্যন্ত জেলের মধ্যে আমার অবস্থা ক্রমাগত ভালোর দিকে গিয়েছে। প্রতিদিন খাওয়া-দাওয়া ভালোমতো আসত। ঘোরাফেরার কিছু সুযোগ করে দিয়েছিল। বলত, তুমি অন্যদিকে দেখতে চাইলে নিয়ে যেতে পারি। আমি খুব একটা সুযোগ নিতাম না। কেননা, তখন আমার আর কিছুই ভালো লাগছিল না। ভেতরে ভেতরে অস্থির হয়ে পড়েছিলাম। সাপ্তাহিক : তখনো জেল থেকে ছাড়ার ব্যাপারে কিছু বলেনি পাকিস্তানিরা ? ড. কামাল হোসেন : ২৮ ডিসেম্বর ১৯৭১ সকাল ১০টার দিকে বলছে যে তোমার জন্য ভালো খবর আছে। তোমাকে মুক্ত করা হচ্ছে। আমি বললাম তার মানে? বলল, আমরা অর্ডার পেয়েছি, শিফট টু নিউ লোকেশন। খবরটা পেয়ে প্রথমে ভালোই লেগেছে যে জেল থেকে বের হচ্ছি তাহলে। ঠিক তখনই মনে হলো, জেল থেকে বের করে কোথায় নিচ্ছে সেটা তো জানা দরকার। বললাম, নিউ লোকেশন কোথায়? বলল, তা তো বলতে পারব না। তা আমরা জানি না। তবে তোমাকে নিতে সন্ধ্যার দিকে লোক আসবে। কিন্তু এর মধ্যে একটি কথা বার বারই বলছে যে, ‘বাট ইট উইল বি গুড ফর ইউ’। আমার সঙ্গে যে কাপড়-চোপড় ছিল তা একটা ছোট ব্যাগের মধ্যে নিলাম। এরপর রেডি হয়ে বসে আছি। মাগরিবের নামাজের কাছাকাছি সময়ে লকআপের আগে তারা এসে বলল যে, আপনাকে নিতে এসেছি। দেখলাম দুজন স্যুট পরা লোক, ছোট ছোট চুল, বোঝা যাচ্ছে যে এরা মিলিটারির লোক। বলল, ‘ইয়েস উই হ্যাভ কাম টু টেক ইউ’। সাপ্তাহিক : আপনি কি সঙ্গে সঙ্গে যাবার প্রস্তুতি নিলেন? ড. কামাল হোসেন : জেলখানায় আসার সময় আমার সঙ্গে যে ৫-৬শ’ টাকা ছিল সেটা সই করে তুলে নিলাম। আমি যে খাতায় লিখতাম সেটাও রিসিভ করলাম। সেদিনই দেখলাম যে আমার ফ্যামিলি আমার জন্য জেলখানায় কিছু বই পাঠিয়েছিল। জেল কর্তৃপক্ষ এতদিন সেসব কিছুই আমাকে না দিয়ে ওখানে জমা করে রেখেছিল। সেদিন বইগুলো দিল। ফ্রন্টিয়ারে পাকিস্তান বার কাউন্সিলের প্রেসিডেন্ট ছিলেন আবরার সিকান্দার খান। যিনি পরে পেশোয়ারের গভর্নর হয়েছিলেন। আবরার সিকান্দার খান আমাকে শুভেচ্ছা জানিয়ে জেলখানায় একটা বিস্কুটের টিন দিয়ে গিয়েছিলেন। সেই শুভেচ্ছার খবর এবং বিস্কুটের টিন কোনোটাই আমাকে এতদিন দেয়া হয়নি। এখন সেগুলো দেয়া হলো। এসব নিয়ে গাড়িতে উঠলাম। ভক্সওয়াগন গাড়ি। গাড়িতে ঐ দু’জন। একজন সামনে, আমি পেছনের সিটে। পেছনের দিকে দেখলাম, একটা বড় পিকআপের মতো মিলিটারি ট্রাক। সব আর্মড গার্ড, মিলিটারি। পেছনে স্কট করছে। কিছুটা ভালোই লাগছে। কিছুটা ভয়ও পাচ্ছি যে আর্মড গ্রুপ কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? জেলের মধ্যে তো একটু নিরাপত্তা থাকে। আমি বার বার জিজ্ঞেস করছি যে, আমরা কোথায় যাচ্ছি? সে প্রশ্নের উত্তর না দিয়ে কেবল বলে যে, ইউ উইল লাইক ইট। সাপ্তাহিক : আপনি নিজে কি বুঝতে পারছিলেন, কোথায় নিয়ে যাচ্ছে? ড. কামাল হোসেন : গাড়ি রাওয়ালপিন্ডিতে ঢুকল। এটা হলো পেশোয়ার টু রাওয়ালপিন্ডি রোড। এই রোডটা আমার পরিচিত ছিল। রাওয়ালপিন্ডিতে ঢোকার পর ভাবলাম যে বোধহয় এখানেই রাখবে। নয়ত ইসলামাবাদে রাখবে। আমাকে বহনকারী গাড়ি রাওয়ালপিন্ডি থেকে আবার বেরিয়ে যাচ্ছে। তখন তো খুবই উৎকণ্ঠা হচ্ছে, এটা কি হলো! রাওয়ালপিন্ডি নিল না, ইসলামাবাদে নিল না। তবে কোথায় নিচ্ছে? তার ৪০ মিনিটের মধ্যে দেখলাম যে আমাকে বহনকারী গাড়ি একটা লেফট টার্ন নিল। কাঁচা রাস্তার ওপরে। গাছটাছ আছে। ভয় লাগল যে এটা তো খুবই খারাপ লক্ষণ। তখন অন্ধকার হয়ে গেছে। হঠাৎ দেখি গাছগুলোর পেছন দিকে মেশিনগান নিয়ে গাড়ি ঘেরাও করেছে। আমি সঙ্গে সঙ্গে সহযাত্রীকে বললাম এখন অন্তত আমাকে বল যে কি হচ্ছে? বলে যে না না তুমি যা মনে করছ তা হচ্ছে না। তারপর সিগন্যাল দিল গাড়িকে সামনে যেতে। সামনে গিয়ে দেখি একটা ছোট ডাকবাংলোর মতো। সেখানে একটা বাতি জ্বলছে। গাড়ি ডাকবাংলোর সামনে থামল। একজন অফিসারের মতো লোক বেরিয়ে এলো। বলল, ‘আই এম কর্নেল আব্দুল্লাহ্, প্লিজ জাস্ট কাম ইনসাইড’। ভেতরে গেলাম। দেখলাম বৈঠকখানা আছে। তারপর একটা ছোট প্যাসেজ। প্যাসেজের দুই পাশে রুম। প্রতিটি রুমে নম্বর দেয়া। বলল, হোয়াই ডোন্ট ইউ গো ইন রুম নম্বর ওয়ান? আমি রুম নম্বর ওয়ান খুলেই দেখি বঙ্গবন্ধু দাঁড়িয়ে আছেন। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধুকে দেখতে পেলেন? উনি কি আগেই ওখানে এসেছেন? ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধু ড্রেসিং গাউন পরা অবস্থায়। আমরা দুজনই তখন খুবই ইমোশনাল। বঙ্গবন্ধু আমাকে জড়িয়ে ধরলেন। বললেন তোমার এত দেরি হলো কেন? আমি বললাম দেরি তো না, যে মুহূর্তে আমাকে বলেছে সেই মুহূর্ত থেকেই আমি রেডি হয়ে বসেছিলাম। তারা চার-পাঁচ ঘণ্টা পরে এসে আমাকে বাইরে নিয়েছে। বলল কোথায় রেখেছিল? বললাম হরিপুর জেলে। তারপরে কয়েক ঘণ্টা লেগেছে এখানে আসতে। বঙ্গবন্ধু বললেন যে খুব ভালো। আমাকে তো তিনদিন আগে মিয়াওয়ালি থেকে নিয়ে এসেছে। আর বললেন যে, ‘ভুট্টো এসেছিল। তাকে আমি জিজ্ঞেস করেছিলাম, তুমি কি বন্দি অবস্থায় এসেছ? সে বলল যে, না না আমি তো তখন দেশের প্রেসিডেন্ট।’ বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি প্রেসিডেন্ট হলে কি করে? নির্বাচনে আমি তো তোমার চেয়ে দুই গুণ বেশি সিট পেয়েছিলাম। একথা শুনে ভুট্টো লজ্জাই পেয়েছে। লজ্জা পেয়ে বলেছে যে ঠিক আছে আপনিই প্রেসিডেন্ট হয়ে যান। তখন বঙ্গবন্ধু বলেছেন, এসব কথা বাদ দাও। আমি এখন কত দ্রুত বাংলাদেশে যেতে পারি সেটা বলো। ভুট্টো তখন বলেছেন, আমাকে একটু সময় দাও। বঙ্গবন্ধু তখন বলেছেন যে, না যত দ্রুত পার এটার ব্যবস্থা কর। ভুট্টো বলে যে, এখন তো ভারতের ওপর দিয়ে ফ্লাইং করা বন্ধ। বঙ্গবন্ধু তার উত্তরে বলেছেন, দেখ রেডক্রস, জাতিসংঘ (ইউএন) এগুলোর প্লেন তো যেতে পারে। এগুলো কোনো কথা না। তারপরে উনি ভুট্টোকে বলেছেন, আমি যতদূর জানি কামাল হোসেন এখানে আছে। তোমাদের কোন একটা জেলে। ভুট্টো বলেছে কীভাবে জানলেন? উনি বলেছেন, আমার ট্রায়ালের সময় এসএ ব্রোহি সাহেব (পাকিস্তানের বিশিষ্ট আইনজীবী) অন্য আইনজীবীদের বলছিলেন যে, এই ট্রায়াল শেষ হলে আমি কামালের ট্রায়ালে যাব। সেটা আমার কানে এসেছিল। সেই থেকে আমি ধরে নিয়েছি তুমি পাকিস্তানি জেলে বন্দি আছ। ভুট্টোকে এটা বলাতে সেও বলেছে যে ঠিক আছে আমি খবর নিয়ে দেখি ড. কামালকে পেলে আমি পাঠিয়ে দেব। বঙ্গবন্ধুর কথাতেই আমাকে নিতে পাঠানো হয়েছে। এরপর বঙ্গবন্ধু বললেন, তোমাকে আমি ডিফেন্স কাউন্সিলে পাচ্ছি না। আমি চেয়েছিলাম তুমি আমার পক্ষে এসে কেসটা করবে। তখন ওরা বলল এটা সম্ভব না। হেসে বলল যে সম্ভব না। তার মানে ওরা বুঝেছে যে, কোন্ কারণে আমার প্রস্তাবটা তারা রাখতে পারছে না । সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে দেখা হবার পর আপনি বুঝলেন যে, বাংলাদেশ স্বাধীন হয়েছে? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ। তারপরে তো উনি পত্রিকা পাওয়া শুরু করেছেন। বললেন, আমিও এখানে আসার পর প্রথম পত্রিকা পেয়েছি। আর বললেন মিয়াওয়ালি জেলে বসেই আমি বাংলাদেশের স্বাধীনতার খবর পেয়ে গেছি। কেননা, আমি যে কাস্টডিতে ছিলাম সেখানে আব্দুর রহমান নামে একজন ডিআইজি ছিলেন। যার বাড়ি পাঞ্জাবে। আমি ওর হেফাজতে ছিলাম। প্রতিদিন আমার খোঁজ নেয়ার দায়িত্ব ছিল তার। ১৬ ডিসেম্বরের পরে এসে সে আমাকে বলেছে, দ্যাখেন, আপনি যদি আমাকে বিশ্বাস করেন, আমি নিজের দায়িত্বে আপনাকে জেল থেকে বের করে নিয়ে যেতে চাই। কেননা, জেলের ভেতরে অবস্থা খুব খারাপ। এটা জেনারেল নিয়াজির জন্মস্থান। নিয়াজি সারেন্ডার করেছে। এখানকার জনগণ মনে করে এটা খুব অপমানজনক, অসম্মানজনক একটা বিষয়। তারা এটাকে অন্যভাবে দেখছে। তারা ভাবছে এটার প্রতিশোধ নিতে হবে। ডিআইজি বলেছেন যে, আমি আপনাকে একটা নিরাপদ জায়গায় নিয়ে রাখব। আমার পুলিশ পার্টি আছে তারা আপনাকে পাহারা দেবে। সাপ্তাহিক : তখন বঙ্গবন্ধু কি সিদ্ধান্ত নিয়েছিলেন, আপনাকে কি বললেন এ বিষয়ে? ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধু বললেন যে, এটা আমার জন্য খুব কঠিন একটা সিদ্ধান্ত ছিল। জেলের ভেতর তো একটা তুলনামূলক নিরাপত্তায় মানুষ থাকে। এখন এ রকম একজন দায়িত্বশীল ব্যক্তি বলছে যে সে আমাকে নিরাপদ স্থানে নিয়ে যাবে। এ রকম পারসোনাল কাস্টডিতে যাওয়া কতটা নিরাপদ হবে? তাছাড়া জেলের বাইরে আমার নিরাপত্তা নিশ্চিত করতে তার কতটুকু ক্ষমতা থাকবে সেটাও তো একটা বিবেচনার বিষয়। যদিও এই নয় মাসে তার প্রতি আমার একটা আস্থা তৈরি হয়েছিল যে লোক হিসেবে সে মূলত খারাপ না। বঙ্গবন্ধু বললেন, এরপর সে রিস্ক নিয়ে আমাকে নিয়ে গেল চশমাব্যারাজ। ওখানে একটা প্রজেক্ট ছিল। বিদেশি বিশেষজ্ঞদের জন্য ড্যাম না কিসের একটা প্রজেক্ট যেন ছিল। সেখানে অনেক খালি বাংলো ছিল। সেখানে বিদেশিরাও ছিল। ভালো বাংলো খালি ছিল। একটা আমাকে দিল, অন্যটায় সে নিজে থাকত। আর পাশে ওর লোকজন থাকত। এইভাবে দু’চারদিন কাটলো। তারপর হেলিকপ্টার এলো। প্রথমে আব্দুর রহমান বোঝার চেষ্টা করল যে কারা এসেছে? হেলিকপ্টার থেকে প্রথম যখন জিজ্ঞেস করল যে, শেখ মুজিবুর রহমান এখানে আছেন, তখন আব্দুর রহমান বলল ‘জানি না’। তখন হেলিকপ্টার থেকে বলল, আমরা ওনার কোনো ক্ষতি করতে আসিনি, আমাদের বলা হয়েছে ওনাকে এখান থেকে সরিয়ে নিতে। এ ব্যাপারে তুমি বাধা দিও না। তখন সে নিশ্চিত হলো যে, না এরা অন্য কোন উদ্দেশ্য নিয়ে আসেনি। এরা শেখ মুজিবকে ইসলামাবাদের কাছে নিয়ে যেতে এসেছে। তখন সে তাদের বলল, উনি আছেন। এরপর ডিআইজি আব্দুর রহমান বঙ্গবন্ধুকে বুঝিয়ে বললেন যে, মুজিব ভাই এরা এসএসজি গ্রুপ। পরে এই গ্রুপের সঙ্গেই এলাম। সেখানে নামার পর কর্নেল আব্দুল্লাহ বলল যে, এখানে আপনাকে আমরা নিরাপদে রাখছি। এরপর ভুট্টো আসল। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বললেন, আমাকে ‘কিছু সময় দেন। কিভাবে আপনাকে বাংলাদেশে পাঠানো যাবে তার জন্য ব্যবস্থা করছি। কিছু ফরমালিটিজ আছে।’ সাপ্তাহিক : পাকিস্তানের প্রেসিডেন্ট ভুট্টো আর বন্দি স্বাধীন বাংলাদেশের প্রেসিডেন্ট বঙ্গবন্ধুর কথাবার্তা এরপর কোথায় দাঁড়াল? ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধু তখন আমাকে সেই ঘটনাই বলছেন। বঙ্গবন্ধু জানালেন, ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে, দেখেন আমি যখন ইয়াহিয়ার সঙ্গে দেখা করতে যাই, তখনো ইয়াহিয়া আমাকে বলছে আমি তো তোমাকে দায়িত্ব দিচ্ছি তবে আমার একটা অনুরোধ, শেখ মুজিবের ফাঁসি কার্যকর করে দিও। আমি তার ফাঁসির আদেশ সই করে দিয়ে যাচ্ছি। তুমি এটা সঙ্গে সঙ্গে কার্যকর হতে দাও। তোমাকে সে দায়িত্ব পালন করতে হবে। ভুট্টো তখন ভালো সাজার জন্য বঙ্গবন্ধুকে বলছে যে, আমি ওকে বললাম, তুমি ইতোমধ্যেই অনেক ক্ষতি করেছ। তোমার আর ক্ষতি করার দরকার নেই। বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা হয়ত আমাকে খুশি করার জন্যই বলেছে। সাপ্তাহিক : দেশে ফেরার জন্য তখন কি করছেন আপনারা? ড. কামাল হোসেন :
আমরা নিজেদের মধ্যে আলাপ করলাম যে, তাদের তিরানব্বই হাজার লোক স্বাধীন বাংলাদেশে আটকে আছে। বঙ্গবন্ধু একটু রূঢ় হলে ওদের একজনও বেঁচে থাকবে না। তাই এসব হুমকি দেয়ার কোনো দাম নেই। আমরা একটু রিল্যাক্সড হয়ে থাকি। আর ওই দাবিটা করি যত তাড়াতাড়ি স্বাধীন বাংলাদেশে যাওয়া যায়। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে, তুমি একটু লেগে থাক। আমি সকাল-বিকেল লেগে থাকি। কি হচ্ছে, কি ব্যবস্থা, ফোন কর, জানতে চাও, দ্রুত আমাদের জানাও। দু’দিন পরে ওদের পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের প্রতিমন্ত্রী আজিজ আহমেদ এলেন। তিনি পুরনো আইসিএস অফিসার। বাংলাদেশের ভাষা আন্দোলনের সময় গুলি চালানো হয়েছে তার দায়িত্বে। তিনি এসে বলছেন যে, দেখ, এভাবে তো ফ্লাই করা যাবে না। তোমাদের অন্য রুটে যেতে হবে। নিরপেক্ষ কোন দেশ হয়ে তোমাদের নিতে চাই। সেটা ইরান হতে পারে। আমরা বললাম, না ইরান তো নিরপেক্ষ না। ইরান তো পাকিস্তানের পক্ষে। তুরস্ক? না এটাও না। আমি ওদেরকে বলা শুরু করলাম যে, না নিরপেক্ষ মানে যেমন ভিয়েনা, জেনেভা এসব দেশ। তিনি পরের দিন এসে বললেন ঠিক আছে লন্ডন হলে কি রকম হয়? বঙ্গবন্ধু বললেন, এটা তো আমাদের লুফে নেয়া উচিত। লন্ডনে তো আমাদের একটা নিজস্ব জায়গা। সেখানে এত বাঙালি আছে। রেডিও ও পত্রিকাতে পেয়েছি, ওখানে আবু সাঈদ চৌধুরীকে কেন্দ্র করে প্রবাসী বাঙালি যারা ছিলেন, তারা সবাই মুক্তিযুদ্ধের পক্ষে সংগঠিত হয়েছে। এটা আমাদের জন্য খুবই ভালো হবে। এটা মেনে নাও। ওদেরকে বঙ্গবন্ধু বললেন, আমি লন্ডনে যাব। ব্যবস্থা করেন। ব্যবস্থার মধ্যে প্রথম যেটা করল, দর্জি পাঠাল। কিছু গরম কাপড় দেয়া হবে। কারণ তখন তো শীতকাল। তারপর পাকিস্তানি পাসপোর্টের জন্য ছবি তোলা হলো। পাসপোর্ট করা হলো।
পাকিস্তানি পাসপোর্ট দিল, কারণ লন্ডনে দেখাতে হবে। দেখলাম যে, লন্ডনের ছাপটাও বোধহয় মারেনি। ওখান থেকে আমরা গেলাম লন্ডনে। লন্ডনে গিয়ে স্মরণীয় যেটা, ছয় ফুট লম্বা পুলিশম্যান দাঁড়িয়ে আছে ভিআইপি গেটের সামনে। তারা স্যালুট দিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বলল, স্যার উই হ্যাভ বিন প্রেয়িং ফর ইউ। আমরা ভেতরে ঢুকলাম। সেখানে মাইকে ঘোষণা হচ্ছে, শেখ মুজিবুর রহমান, ফোন কল ফর শেখ মুজিবুর রহমান। উনি বললেন যে, তুমি গিয়ে দেখ। আমি গিয়ে ধরেছি। ফোনের অপর প্রান্তে তখন ইয়ান সাদারল্যান্ড। সাদারল্যান্ডের সঙ্গে আমার ১৯৭১-এর ফেব্রুয়ারিতে দেখা। তিনি লন্ডন থেকে এসেছিলেন। সাদারল্যান্ড গুরুত্বপূর্ণ একজন ডিপ্লোম্যাট। ফোনে আমাকে চিনতে পারলেন। বললেন, হ্যাঁ তোমার কথা আমার মনে আছে। তিনি জিজ্ঞাসা করলেন শেখ মুজিবুর রহমান কি সত্যিই লন্ডনে এসেছেন? আমি বললাম হ্যাঁ তিনি সত্যিই লন্ডনে এসেছেন। চুক্তি ছিল শেখ মুজিব অবতরণ করার ১ ঘণ্টা আগে লন্ডনকে জানাতে হবে। সেভাবে জানানোও হয়েছিল। আমরা পাকিস্তানি কর্তৃপক্ষকে বলেছিলাম যে, করাচি ছাড়ার পরে লন্ডনের আগে কোনো দেশে শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী প্লেন নামবে না। ওরা বলল যে, যেসব দেশের সঙ্গে আমাদের ভালো সম্পর্ক আছে সেসব দেশের এয়ার স্পেস আমরা ব্যবহার করব। আমরা বললাম যে, ঠিক আছে, কোনোখানে নামা হবে না। আর বিমান চলার জন্য সংশ্লিষ্ট কর্তৃপক্ষকে আইডেন্টিফিকেশন যেটা দিতে হয় সেখানে বলবে এটা একটা স্ট্র্যাটেজিক কার্গো। পিআইএ স্ট্র্যাটেজিক কার্গো। এটা বলে পার পেয়ে যাবে।
সাপ্তাহিক : ব্রিটিশ ডিপ্লোম্যাট সাদারল্যান্ডের সঙ্গে তখন কি কথা হলো? ড. কামাল হোসেন : সাদারল্যান্ড আমাকে বললেন, আমরা ১ ঘণ্টা আগে তথ্য পেয়েছি যে, শেখ মুজিবুর রহমানকে বহনকারী প্লেন এখানে অবতরণ করতে যাচ্ছে। সে হিসেবে আমি সবকিছু বন্দোবস্ত করে রেখেছি। আপনাকে সে কারণে ভিআইপি রুমে স্বাগত জানানো হয়েছে। বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, জিজ্ঞেস কর আমাদের আবু সাঈদ চৌধুরীর সঙ্গে কিভাবে যোগাযোগ করা যায়? আমি সাদারল্যান্ডকে বললাম যে, আবু সাঈদ চৌধুরীকে কোথায় পাওয়া যাবে? সাদারল্যান্ড বললেন যে, আবু সাঈদ চৌধুরী ইতোমধ্যে ঢাকার উদ্দেশে লন্ডন ত্যাগ করেছেন। তবে মিস্টার রেজাউল করিম এখানে আছেন। তখন তার সঙ্গে যোগাযোগ করতে চাইলাম। সাদারল্যান্ড ব্যবস্থা করলেন। রেজাউল করিমের ফোন আসল। তিনি জানালেন, আমিও রওনা দিয়েছি, আধা ঘণ্টার মধ্যে পৌঁছে যাব। একটু পরে পাকিস্তানি হাইকমিশনার এলেন। তিনি ছিলেন দৈনিক ডনের ওখানকার রিপ্রেজেনটেটিভ। তার নাম নাসিম আহম্মদ। লন্ডন বেইজড করেসপনডেন্ট। বেশ সিনিয়র জার্নালিস্ট। এসে পরিচয় দিলেন। বললেন, স্যার হোয়াট ক্যান আই ডু ফর ইউর হেল্প। বঙ্গবন্ধু বললেন, ইউ হ্যাভ ডান অ্যানাফ। থ্যাংক ইউ ভেরি ম্যাচ। আই ডোন্ট থিংক উই উইল নিড এ্যানি মোর হেলপ। থ্যাংক ইউ। আওয়ার পিপল আর হেয়ার। দে আর কামিং। দশ-পনেরো মিনিটের মধ্যে সাদারল্যান্ডও আসলেন, রেজাউল করিমও আসলেন। সাপ্তাহিক : আপনাদের এই পুরো ট্র্যাভেলটা কয় ঘণ্টার ছিল? ড. কামাল হোসেন : আট-দশ ঘণ্টা তো হবেই। সাপ্তাহিক : আর কোনো যাত্রী ছিল? ড. কামাল হোসেন : আমরা যাত্রা করেছিলাম পিআইএ’র প্লেনে। সেখানে আর কোনো যাত্রী ছিল না। তখন আমার ভাবনা ছিল আমি তো বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে প্লেনে উঠে যাব, কিন্তু আমার ফ্যামিলির কী হবে? আবার আমি তো বঙ্গবন্ধুকে আমার ফ্যামিলির বিষয়ে বলতেও পারি না যে তাদের নেয়ার ব্যবস্থা করুন। এসব ভাবছি আর আমাদের যাওয়ার বিষয়ে কী হবে সেসব আলোচনা চুপচাপ শুনছি। একটা নেগোসিয়েশন শুরু হলো। ভুট্টো তখন বলছে যে, খাওয়া-দাওয়া করে প্লেনে তুলবে। এটা বলে ওখানকার প্রেসিডেন্টের গেস্ট হাউজে আমাদের নিয়েছে। আমরা ব্যাগট্যাগ বেঁধেই গেছি। ভুট্টো বঙ্গবন্ধুকে বলছেন, ‘কিছু মনে করবেন না, একটা ছোট্ট রিকোয়েস্ট আছে।’ কী রিকোয়েস্ট? ‘ইরানের রেজা শাহ্ কাল সকালে আসবেন। আপনার সঙ্গে দেখা করার খুব ইচ্ছে তার।’ বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন, বুঝেছ, এসব ভুট্টোর শয়তানি বুদ্ধি। ইরানের শাহকে দিয়ে আমার কাছ থেকে কিছু প্রতিশ্রুতি নেয়ার চেষ্টা করবে। বাংলাদেশে যেসব পাকিস্তানি আত্মসমর্পণ করেছে, যারা যুদ্ধবন্দি আছে তাদের রক্ষার বিষয়ে হয়ত কিছু প্রস্তাব রাখবে। আমি তো এখানে এ অবস্থায় বসে এসব নিয়ে কোনোভাবেই আলোচনা করতে পারি না। কেননা, আমার সরকার তো ওখানে। ভুট্টোর এসব চালাকি একদম মেনে নেয়া যায় না। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম, আপনি শক্ত হন। উনি বললেন, না আমি এ ব্যাপারে একদম শক্ত। আমরা এক কোনায় গিয়ে এসব কথা বললাম। এরপর বঙ্গবন্ধু এসে বললেন, ‘মিস্টার ভুট্টো, উই আর ভেরি সরি। দিস ইজ নট অ্যাট অল পসিবল। প্লিজ টেক আস ইমিডিয়েটলি ব্যাক টু জেইল। উই থট উই হ্যাভ কাম টু এ্যাজ ইউর গেস্ট টু হ্যাভ ডিনার জাস্ট বিফোর আওয়ার ডিপারচার ফর লন্ডন, আদার ওয়াইজ লেট আস ব্যাক টু জেইল।’ সাপ্তাহিক : তখন ভুট্টো কি বললেন? ড. কামাল হোসেন : ভুট্টো বললেন, ডোন্ট মাইন্ড, ডোন্ট মাইন্ড। এরপর এক কোনায় গিয়ে আজিজ আহমেদকে নিয়ে আলোচনা করতে থাকলেন। তারপর বললেন, ঠিক আছে আপনি শাহের সঙ্গে দেখা করবেন না; কিন্তু দেখেন এখন তো ২৪ ঘণ্টা আগে থেকে সব এয়ার স্পেস বন্ধ হয়ে গেছে। এখন তো প্লেন পাঠানোও বেশ কঠিন। এবার আবার আমরা রুমের এক কোনায় গেলাম। নিজেদের মধ্যে আলোচনা করলাম। ব্যাটারা হাইকোর্ট দেখাচ্ছে। এয়ার স্পেস কি তালা চাবি দিয়ে বন্ধ হয় নাকি যে বন্ধ হয়ে গেছে। বন্ধ হয়ে যাওয়ার মানে হলো, যে কোনো প্লেন আসতে হলে পারমিশন নিয়ে আসতে হয়। আর যেতে হলেও পারমিশন লাগে। ব্যাটাকে বলেন যে, এটা তো ওদের এয়ার স্পেস। এয়ার ফোর্সকে বললেই ওরা বলে দেবে যে আপনাদের প্লেন যাচ্ছে, আমাদেরও প্লেন যাচ্ছে। সুতরাং এটাও পাস করুক। বঙ্গবন্ধু ভুট্টোকে এসে বললেন যে, এসব বলে তুমি আমাকে ডাইভার্ট করছ। এয়ারপোর্টকে বললে এটা খুলে দেবে। ভুট্টো এসে হেসে বললেন যে না, আপনার সঙ্গে আর পারা গেল না। ওকে ওকে কল দ্য মিলিটারি সেক্রেটারি, গার্ড এয়ারফোর্স টু এনশিউর প্লেন টু কাম। আসার কথা ছিল ১০-১২টায়। মেবি ইটস টু আওয়ার লেইট। ইটস কামিং ফ্রম করাচি। তখন আমি আমার সুযোগটা পেয়ে গেলাম। আমি বঙ্গবন্ধুর কানে কানে বললাম, বঙ্গবন্ধু করাচি থেকে প্লেনটা আসবে। আমার ফ্যামিলি তো করাচিতে আছে। ওদের তো এই প্লেনে তুলে দিতে পারে। বঙ্গবন্ধু একদম সঙ্গে সঙ্গে কথাটা ধরেই বললেন, ওকে ভুট্টো আই আস্ক ইউ ফর এ ফেভার। কামাল হোসেন’স ফ্যামিলি, ইউ নো দেয়ার ফ্যামিলি। ভুট্টো বলছে যে, ইয়েস আই নো হিজ ফ্যামিলি। ওর ফ্যামিলি ওর বাবার বাড়িতে আছে। তার ফ্যামিলিকে ওই প্লেনে তুলে দিতে পারেন। তখন সঙ্গে সঙ্গেই ভুট্টো কর্তৃপক্ষকে বলে দিলেন যে, কামাল হোসেনের ফ্যামিলির সঙ্গে যোগাযোগ কর। সাপ্তাহিক : তারপর, আপনার পরিবার খবর পেল? ড. কামাল হোসেন : পরে আমার স্ত্রী হামিদা হোসেন আমাকে বলেছেন তাকে রাত আটটার দিকে বলা হয়েছে যে, এক ঘণ্টার মধে তুমি রেডি হয়ে যাও। হামিদা ভেবেছে আমার সঙ্গে দেখা করতে তাকে রাওয়ালপিন্ডিতে নিয়ে আসবে। লন্ডনের কথা কিছুই বলেনি। শুধু বলেছে সঙ্গে কিছু গরম কাপড় নিতে। তো রাওয়ালপিন্ডিতেও তো গরম কাপড় লাগে। ওখানেও করাচির চেয়ে শীত বেশি। হামিদা বলেছেন, প্যাক করে আমরা প্লেনে উঠেছি, প্লেনে ওঠার পরে বুঝতে পেরেছি যে না এটা তো আরো অনেক দূর যাবে। প্লেনে আমাদের বসিয়ে রাখল। রাওয়ালপিন্ডিতে আমরা নামতে চাইলে বলল, না না তোমাদের নামার দরকার নেই, দেখ কি হয়। পরে হামিদা হোসেন আমাদের দেখে সব বুঝল। সাপ্তাহিক : প্লেনে বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে স্বাধীনতা, সরকার, তাজউদ্দীন সাহেব এগুলো নিয়ে কি কথা হলো? ড. কামাল হোসেন : কিছু কিছু কথা তো আমরা বলতেই থাকলাম। ওখানকার রেডিও আর পত্রিকা দুটোই ফলো করতাম। আমি প্রত্যেক লাইন স্ক্যান করতাম। তখন কন্টিনিউয়াস রেডিও শুনছি। বিবিসি, আকাশবাণী। বাই দ্যাট টাইম দেশের অনেক পিকচার পেয়ে গেছি। আমি খবর শুনতে থাকি আর বঙ্গবন্ধুকে বলতে থাকি। এর মধ্যে শুনতে পেলাম যে, আমাদের একজন নতুন ফরেন মিনিস্টার হয়েছে। নাম আব্দুস সামাদ আজাদ। বঙ্গবন্ধু বললেন, আজাদ নামে তো আমাদের কেউ নেই। ওরা এটা কোথা থেকে আমদানি করল। আমি বললাম, আমার ধারণা এটা আমাদের সামাদ ভাই। যুদ্ধ চলাকালীন অনেকের নাম সংযোজন হয়, ‘আজাদ’ নামটাও সামাদ ভাইয়ের নামের সঙ্গে এভাবেই যুক্ত হয়েছিল। বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের খবর আমাদের খুবই মর্মাহত করেছে। আমার অনেক ঘনিষ্ঠ বন্ধু, আত্মীয়স্বজনও নিহত হয়েছেন। গিয়াসউদ্দিন, তারপরে মনিরুজ্জামান। মনিরুজ্জামান ছিল আমার ভাগ্নিজামাই। একেকটা করে বুদ্ধিজীবী হত্যাকাণ্ডের নাম শুনছি আর আমাদের খারাপ লাগা বাড়ছে। সাপ্তাহিক : তাজউদ্দীন সাহেব সম্পর্কে কি বললেন বঙ্গবন্ধু? ড. কামাল হোসেন : বঙ্গবন্ধু বললেন যে দেখ, আমার মনে তাজউদ্দীন সম্পর্কে এই বিশ্বাসটা জন্মেছে এখন থেকে না ’৬৪ সাল থেকে। যে কারণে তাজউদ্দীনকে আমি সকলের ওপর জেনারেল সেক্রেটারি করেছিলাম। তাজউদ্দীনের চেয়ে যারা বয়সে বড়, পার্টিতে সিনিয়রিটি দাবি করতে পারে এরকম অনেকেই পার্টির জেনারেল সেক্রেটারির দাবিদার ছিল। কিন্তু আমি ওকে চিহ্নিত করেছি সবচেয়ে কর্মক্ষম ও বিচক্ষণ মানুষ হিসেবে। তাজউদ্দীন হলেন সক্ষম, যোগ্যতাসম্পন্ন জেনারেল সেক্রেটারি। আমি বিশ্বাস করেছি সংগঠক হিসেবে পার্টি পরিচালনা করার দায়িত্ব তাকে দিলে কাজ হবে এবং হয়েছে। দ্বিতীয়ত, আমি যে জিনিসটা ধরে নিয়েছি যে, ২৬ মার্চের পরে কিছু করতে পারলে, তাজউদ্দীনই পারবে। এবং দেখ সে ঠিক ঠিক পেরেছে। তাজউদ্দীন আমার অনুপস্থিতিতে এতবড় একটা যুদ্ধ পরিচালনা করে একটা রেজাল্ট দিয়েছে। আমি এখন সারাদেশে ঘুরে ঘুরে মানুষকে সংঘবদ্ধ করব। আর তাজউদ্দীনই সরকার চালাবে। যদি পার্টি ঠিক থাকে, মানুষকে সংঘবদ্ধ রাখতে পারি, আর এই ঐক্যটা রাখতে পারি সেটা সবদিক থেকে আমাদের জন্য ভালো হবে। তাজউদ্দীন ভাইকে নিয়ে বঙ্গবন্ধু এই চিন্তাগুলো করলেন। আমি ওনার কথা শুনতে থাকলাম। সাপ্তাহিক : লন্ডনে পৌঁছার পর কি ঘটল? ড. কামাল হোসেন : লন্ডনে অনেক ইন্টারেস্টিং ঘটনা ঘটেছে। ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী অ্যাডওয়ার্ড হিথের সঙ্গে লন্ডনে দেখা হলো। উনি বললেন, ইউরোপে আমরা সবাই মিলে স্বাধীন বাংলাদেশকে স্বীকৃতি দেব। বঙ্গবন্ধু তাঁকে বললেন আমাকে একটা প্লেন দিলে আমরা দ্রুত বাংলাদেশে যেতে পারি। এর আগে টেলিফোনে কথা হচ্ছিল সম্ভবত ভারত থেকে লন্ডনে প্লেন পাঠানো হবে। তাতে সময় তো অনেক বেশি লাগত। আমাদের আরও তিনদিন লন্ডনে থাকতে হতো। লন্ডনে ব্রিটিশ প্রধানমন্ত্রী হিথ তার সেক্রেটারিকে ডেকে বললেন যে আমার তো একটা প্লেন আছে, ওটাকে অ্যাভেইলেবল কর, ওনাকে পৌঁছিয়ে দিয়ে আসবে। হিথ আরো বললেন, ৮ তারিখের মধ্যে রেডি হয়ে ৯ জানুয়ারি ভোরবেলা রওনা হতে পারে। কেননা, ওই সময়টা হিসেব করতে হয়েছে যাতে, আমাদের প্লেন কয়টায় ছাড়লে দিল্লিতে নেমে আমরা দিনের বেলা ঢাকা পৌঁছাব। যে কারণে কলকাতা যাওয়া হলো না। কলকাতা থেকে ফোনের পর ফোন আসতে লাগল বঙ্গবন্ধুর কাছে, যে, আপনি কলকাতা বাদ দিয়ে কিভাবে যাবেন? তাহলে আপনার কর্মসূচি থেকে দিল্লি বাদ দেন। তখন বলা হলো যে না এটা হয় না। স্বাধীন রাষ্ট্রের পক্ষে প্রোটোকল অনুযায়ী দিল্লি বাদ দিয়ে কলকাতায় যাওয়া সম্ভব না। এসব নিয়ে টেলিফোনে অনেক আলাপ হলো। তাজউদ্দীন ভাই ওদের সঙ্গে টেলিফোনে আলাপ করলেন যে, ঠিক আছে কলকাতাকে আমরা বাণী দিয়ে বিশেষভাবে কৃতজ্ঞতা ও শুভেচ্ছা জানিয়ে দিচ্ছি। কথা দিচ্ছি অল্প সময়ের মধ্যে বঙ্গবন্ধুর প্রথম বিদেশ সফর হবে কলকাতায়। বঙ্গবন্ধু দেশে ফেরার পর ১৯৭২ সালের জানুয়ারি মাসের মধ্যেই কিন্তু কলকাতায় গিয়েছিলেন। সাপ্তাহিক : পাকিস্তান থেকে লন্ডনে আসার সময় বঙ্গবন্ধু মাথায় হাত দিয়ে ভাবছিলেন, বললেন, কিন্তু সেটা কেন? ড. কামাল হোসেন : বললেন দেখ, আমরা ঐক্যবদ্ধ হয়েছিলাম বলে স্বাধীনতা পেয়েছি। কিন্তু বাঙালিরা, আমরা এটাকে কতদিন ধরে রাখতে পারব। নিজেদের আরো সুসংহত করতে না পারলে হবে না। আমাদের অভ্যেস আছে, কেউই কারো ভালো দেখতে পারে না। অতীতেও আমাদের যারা প্রতিপক্ষ তারা সবসময় এটাকে কাজে লাগিয়েছে। আমি এটাই চিন্তা করছি যে, এই ঐক্যটা ধরে রাখা এবং এর মধ্যদিয়েই দেশ গড়ার সম্ভাবনা নিহিত আছে। আর একটা কথা বললেন যে, বল তো আমাদের জন্য কোনটা ভালো হবে- প্রেসিডেন্সিয়াল নাকি পার্লামেন্টারি ফর্ম। আমি বললাম, দেখেন এটা তো ছয় দফার মধ্যেই লেখা আছে। সংসদীয় গণতন্ত্রের কথা ছয় দফায় আছে। সাপ্তাহিক : ১০ জানুয়ারি ১৯৭১ বঙ্গবন্ধু সহ আপনি দেশে ফিরলেন। তারপর কি হলো? ড. কামাল হোসেন : আমরা এসেছি একসঙ্গে। ১১ তারিখ আমি তো খুব ফুর্তিতে। বঙ্গভবন তখন হোস্টেলের মতো। ওখানে গিয়ে প্রত্যেক টেবিলে বসছি, চা খাচ্ছি, তখনকার ঘটনাগুলো শুনছি। আগের দিন আমরা খবর পেলাম যে, তাজউদ্দীন ভাই তখনকার চিফ জাস্টিসের পাশের ভবন প্রাইম মিনিস্টার হাউজে আমাকে এবং আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেবকে ডেকেছেন। আমি আমীর-উল ইসলামকেও সঙ্গে নিয়েছি। নিয়ে আমরা তাজউদ্দীন সাহেবের বাসায় গিয়েছি। আমাদের উপরে বসতে বলা হয়েছে। নিচে বৈঠকখানায় কেবিনেট মিটিং হচ্ছে। বঙ্গবন্ধু সেই মিটিংয়ে প্রেসিডেন্ট হিসেবে আছেন। আমাকে ডেকে বললেন, দেখ আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছি যে আমরা সংসদীয় পদ্ধতিতে যেতে চাই। বঙ্গবন্ধু তখন প্রেসিডেন্ট। তাজউদ্দীন আহমদ তখন প্রাইমমিনিস্টার। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করলেন, সংসদীয় গণতন্ত্রে ফিরতে হলে কি করা লাগবে? আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব হাইকোর্টেরও জজ ছিলেন। আমরা বারান্দায় বসে বুদ্ধি করছি যে, এক লাইন যোগ করলেই তো হয়। স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যে আছে বঙ্গবন্ধু ইজ প্রেসিডেন্ট। তাজউদ্দীন ইজ প্রাইমমিনিস্টার। নজরুল ইসলাম ইজ অ্যাকটিং প্রেসিডেন্ট। আমি বললাম, একটা বাক্য ‘প্রেসিডেন্ট শ্যাল পারফর্ম অল হিজ ফাংশন্স অন দি অ্যাডভাইজ অব দ্য প্রাইমমিনিস্টার’ এটা যদি একটা গেজেট করে স্বাধীনতার ঘোষণাপত্রের মধ্যে ঢুকিয়ে দেয়া হয় আর বঙ্গবন্ধু প্রাইমমিনিস্টার হিসেবে শপথ নেন, আর অন্য একজন প্রেসিডেন্ট হন, তখন ওই প্রেসিডেন্টের তো কোনো ক্ষমতা থাকবে না। কারণ যা কিছু হবে, সই করবে প্রেসিডেন্ট, সবই করবে প্রধানমন্ত্রীর পরামর্শ অনুযায়ী। এটা হবে পার্লামেন্টারি ফর্মের ভাষা। আমরা এসে ঘণ্টাখানেকের মতো বোধহয় বসেছি। বঙ্গবন্ধু বললেন, রুহুল কুদ্দুস এটাকে গভর্নমেন্ট প্রেসে পাঠিয়ে দাও। তাহলে আমাকে তো প্রাইমমিনিস্টার হতে হচ্ছে। তাজউদ্দীন তুমি ফাইন্যান্স মিনিস্টার হবে আর প্রেসিডেন্ট কে হবে? আবু সাঈদ চৌধুরী সাহেব আপনি প্রেসিডেন্টের শপথ নেবেন কালকে। এভাবেই নিজেদের মধ্যে কথা হয়েছে। আবু সাঈদ চৌধুরী বললেন, বলেন কি! আমার তো ফ্যামিলি লন্ডনে। ওনার ধারণা ছিল যে উনি অ্যাম্বাসেডর হবেন। স্বীকৃতি পাওয়ার জন্য বিভিন্ন দেশে রাষ্ট্রের পক্ষে যাবেন। বঙ্গবন্ধু বললেন, না না আপনাকে ছাড়া হয় কী করে! আপনার প্রেসিডেন্ট হওয়া সম্মানজনক হবে। কনস্টিটিউশনাল হেড হবেন। আর কালকে আপনি আমাদেরকে শপথ পড়াবেন। সাপ্তাহিক : আপনার মন্ত্রী হবার ঘটনা?
ড. কামাল হোসেন : এটা ১১-১২ জানুয়ারি ১৯৭২ তারিখের কথা। ১২ তারিখ আমি বঙ্গভবনে গেছি। ওনারা কেবিনেট মিটিং করছেন। আমি সবার সঙ্গে চা খাচ্ছি, গল্প করছি। ওনারা বেরুলেন কেবিনেট মিটিং থেকে। আমরা জাস্ট দাঁড়িয়েছি সালাম দিতে। বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি আজকে দুটোয় এসো তো এখানে। একটু পরিষ্কার কাপড়চোপড় পরে এসো। আমাকে আবার বললেন, তোমাকে কেবিনেটে শপথ নিতে হবে। আমরা কেবিনেটে তোমাকে অ্যাড করছি। আমি তো রীতিমতো বিস্মিত! ১২ তারিখে আমি তিনজনের কাছ থেকে কাপড় ধার নিয়েছি। একজনের থেকে পাঞ্জাবি, একজনের থেকে পায়জামা, একজনের স্যান্ডেল। শুধু কালো কোটটা বোধহয় বঙ্গবন্ধু যেটা দিয়েছেন সেটা ছিল। এগুলো সব ম্যানেজ করেছি। এসব কাপড় পরে দুটোর সময় গেছি। তারপর শপথ নিলাম মন্ত্রী হিসেবে। আইনমন্ত্রীর দপ্তর পেলাম। ১৩ জানুয়ারি থেকে বোধহয় বসেছি অফিসে। সাপ্তাহিক : আপনার বয়স তখন কত? ড. কামাল হোসেন : ৩৪ বছর। সাপ্তাহিক : ল’মিনিস্টার হিসেবে আপনি কাজ করা শুরু করেছেন? ড. কামাল হোসেন : তখন কাজ করার একটা অসাধারণ সুযোগ, চারিদিকে একদম শূন্যতা। একটা প্রদেশকে উন্নীত করে একটা রাষ্ট্রে পরিণত করা। আইনের পুরো জিনিসগুলো রদবদল করা। কিভাবে হবে, কিভাবে হবে না। কিভাবে চলবে, কিভাবে চলবে না। প্রায় দুশ’-তিনশ’ আইন করতে হয়েছে। সাপ্তাহিক : এটা তো গেল আপনার একদিকের কাজ। কিন্তু পাশাপাশি একটা রাজনৈতিক সরকার হলো, পিপি নিয়োগ, এপিপি নিয়োগ এই রাজনৈতিক বিষয়গুলো কিভাবে মোকাবিলা করলেন? আপনি তো নিজে রাজনৈতিক লোক ছিলেন না? ড. কামাল হোসেন : সবচেয়ে বড় যে জিনিসটা হলো আমি বঙ্গবন্ধুর আস্থা পেয়েছি। শুরুতেই তিনি বলেছেন তুমি তোমার নীতিমালা দিয়ে চালিয়ে যাও। তোমাকে যে দায়িত্ব দেয়া হয়েছে আমি চাই তুমি সেটা সুষ্ঠুভাবে পালন করবে। আমার মনে পড়ে যে একবার মন্ত্রিসভার মিটিংয়ে আমি ফাইল নিয়ে গেছি বঙ্গবন্ধুর অর্ডার নিতে। উনি আমার লেখার ওপর হাত রেখে সব কেবিনেট মেম্বারকে দেখিয়ে বলছেন যে, দেখ আমি ড. কামালকে কত ট্রাস্ট করি। আমি ফাইলে ওর লেখা না দেখেই সই করছি। তারপরে খুলে দেখছি ও কী লিখেছে। একবার সিনিয়র সিএসপি অনেককেই চাকরিচ্যুত করা হয়েছিল। তখন বঙ্গবন্ধু আমাকে বললেন যে, তুমি এটা রিভিউ করে নোট দাও। নরমালি এটা সংস্থাপন সচিব বা সিনিয়র আমলাদের করতে দেয়া হতো। কিন্তু বঙ্গবন্ধু এই কাজটি আমলাদের না দিয়ে আমাকে দিয়েছেন। আমি ফাইল দেখে যাদের নাম ওখানে ছিল তাদের ডাকছি। জিজ্ঞেস করছি কি ঘটনা? কি করেছেন? আমি জিজ্ঞাসাবাদ করে জানলাম এই সিএসপি অফিসারদের অনেককেই তদানীন্তন পাকিস্তান সরকার নানারকম সরকারি খেতাব দিয়েছিল। তাদের অনেককেই ‘সিতার-এ পাকিস্তান’, ‘হেলাল-এ পাকিস্তান’ এসব খেতাব দেয়া হয়েছিল। তাঁরা বললেন এসব খেতাব আমরা পেয়েছি ১৯৭১ সালের পূর্বে আমাদের সরকারি কাজে নানারকম দক্ষতার কারণে। বিশেষত ’৭০-এ ঘূর্ণিঝড়ের পর আমরা খুব ভালো কাজ করেছিলাম। লিস্ট তো তখন গেছে। রিভিউ করে আমি দেখলাম পাকিস্তানি খেতাব পাওয়া সবাই স্বাধীনতাযুদ্ধের বিপক্ষে কাজ করে নাই। দু-একজন পাকিস্তানি প্রশাসনকে সহযোগিতা করেছেন। দু-একজনের রেকর্ড খারাপ ছিল। এই রকম একটি স্পর্শকাতর কাজ আমাকে দিয়ে করিয়ে বঙ্গবন্ধু আমাকে টেস্ট করলেন। আমি চাপের মুখে কোন সময় পাশ থেকে কিছু শুনতামও না। সবসময় নিরপেক্ষতারও পরিচয় দিয়েছি। সাপ্তাহিক : রাজনৈতিক চাপ আসত না? ড. কামাল হোসেন : এটা তো সবচেয়ে বড় পরীক্ষা ছিল আমার জন্য। সবাই আমাকে গিয়ে বলে যে, এই আমার লিস্ট। এদের দলীয়ভাবে নিয়োগ দিতে হবে। আমি দেখলাম মহামুশকিল। আমি বিশ্বাস করতাম পিপি, এপিপি এসব নিয়োগ দলীয় ভিত্তিতে না হয়ে হওয়া উচিত যোগ্যতার ভিত্তিতে। দলে যোগ্য লোক থাকলে, আরেকজনের সমান যোগ্যতা থাকলে দলের লোককে অগ্রাধিকার দেব। ঠিক আছে, এটা আমি মানি। একটা পোস্টে দু’জন সমান যোগ্যতার হলে, দলে যারা কাজ করেছে তারা একটা দাবি করতে পারে যে, আমাকে প্রাধান্য দেয়া হোক। কিন্তু কেউ যদি দলীয় প্রার্থীর চেয়ে অনেক বেশি যোগ্য ও অভিজ্ঞ হয় তখন আমি তাকেই নেব। আমি তো রাষ্ট্রের একটা পদে রাষ্ট্রের স্বার্থে নিয়োগ দিচ্ছি। আমি তো শপথ নিয়েছি যে আমি রাষ্ট্রের কল্যাণের জন্য কাজ করব। সেই শপথ অনুসারে আমার সঠিক কাজ হবে কোনো পদে যোগ্য লোককে নিয়োগ দেয়া। সবসময় এমনটাই ছিল আমার বিশ্বাস এবং ধারণা ছিল। আমি বিষয়টা নিয়ে ভাবলাম এবং অর্থমন্ত্রী তাজউদ্দীন ভাইয়ের সঙ্গে আলাপ করলাম। তাজউদ্দীন ভাইকে আমি বললাম, দেখেন আমি খুব সমস্যায় আছি। সাপ্তাহিক : তখন তো আওয়ামী লীগের সিনিয়র লিডাররা আপনার চেয়ে বয়সে বড় ছিলেন? তারা যখন তদবির নিয়ে যাচ্ছেন তখন তো সেটা রাখতে না পারা একটা কঠিন ব্যাপার? ড. কামাল হোসেন : আমি তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছে গিয়ে বললাম, দেখেন এসব ব্যাপারে আমার তো আপনার গাইডেন্স দরকার। এখানে কি করা যায়? তাজউদ্দীন ভাই বললেন, আপনি কী করতে চান? আমি সব বুঝিয়ে বললাম। তিনি বললেন, হ্যাঁ এটাই তো সঠিক। সব জায়গায় দলের লোক দিতেই হবে এটা তো কোন নীতি হতেই পারে না। আপনি শক্ত হয়ে থাকেন। দেখেন বঙ্গবন্ধুও আপনাকে সমর্থন দেবেন। এরপরে তাজউদ্দীন ভাই’র পরামর্শে তৎকালীন এটর্নি জেনারেল ফকির সাহাবুদ্দীন সাহেবকে দিয়ে একটি নিয়োগ কমিটি করলাম। ঐ কমিটি একটার পর একটা অ্যাপয়েন্টমেন্ট দিতে থাকল। তখন কেউ যদি আমাকে এসে অভিযোগ করত তাহলে আমি বলতাম যে, দেখেন আমি তো কিছু না, একটা কমিটি করা আছে, তারা করছে। যোগ্যতা আর কর্মক্ষমতার ভিত্তিতেই সবকিছু হবে। সাপ্তাহিক : এরপরে নিশ্চয়ই আপনার ওপরে বাকি লোক ক্ষিপ্ত হয়ে উঠল? ড. কামাল হোসেন : কিছুটা ক্ষিপ্ত হয়েছে তো বটেই। তবে এটাও ঠিক উনারাও সুস্থ রাজনীতির মধ্যে থেকে এসেছেন। প্রথম প্রথম হয়ত ভেবেছেন, এই ব্যাটা কি করে? তারপরে যখন দেখেছেন যে না এটা ভালো কাজ। তখন সানন্দেই মেনে নিয়েছেন। সাপ্তাহিক : এরপরে আপনি ফরেন মিনিস্টার হলেন কবে? ড. কামাল হোসেন : ’৭৩-এর ইলেকশনের পরে। সাপ্তাহিক : ’৭৩-এ তো আপনি নির্বাচন করলেন… ড. কামাল হোসেন : এটা খুবই ব্যতিক্রমধর্মী এক ঘটনা। ’৭১-এ যেভাবে বঙ্গবন্ধু আমাকে নির্বাচন করালেন, ’৭৩-এও তাই। সংবিধান তৈরির কাজ শেষ হলো। আমি কমনওয়েলথ ল’মিনিস্টার কনফারেন্সে গেলাম। এটা ১৯৭৩ সালের জানুয়ারি-ফেব্রুয়ারির দিকে। এরপর নির্বাচন হতে যাচ্ছে, নমিনেশন দেয়া হচ্ছে। আমি ধরে নিয়েছি যে আমি নির্বাচন করছি না। কেননা, আমার ধারণা যে আই হ্যাভ ফিনিশড মাই ওয়ার্ক। আমার যতটুকু করার করেছি। এখন আমি কাজ করলে মন্ত্রিসভার বাইরে থেকে কাজ করব। মন্ত্রী হওয়া তো আমার কাজ না। আর মন্ত্রী হওয়ার জন্য দলে অনেক আগ্রহী লোকও আছেন। আমি কনফারেন্সে চলে গেছি লন্ডনে। কনফারেন্স করে হাতে সময় ছিল ১০ দিন। পুরনো বন্ধুদের সঙ্গে সময় কাটাচ্ছি। আর সেখানে ম্যাসেজ পাচ্ছি যে বঙ্গবন্ধু আমাকে খুঁজছেন। একটু সময় নিয়ে লন্ডন থেকে ফিরে এসে দেখা করতে গেলে বঙ্গবন্ধু বললেন, তুমি কোথায় হারিয়ে গিয়েছিলে? বললাম, আমি তো সব কাজ শেষ করে গেছি। তিনি বললেন, আমি তো স্বাক্ষর করে তোমার জন্য নমিনেশন ফরম আনিয়ে রেখেছি। মিরপুর, মোহাম্মদপুর নির্বাচনী এলাকায় তুমি নির্বাচন করবে। আমি বললাম যে, দেখেন আমার তো এগুলো করার কথা না। আরেকটা কথা, আমার তো টাকা-পয়সা একদমই নেই। তখন তিনি বললেন ঠিক আছে ২০ হাজার টাকা আমিই দিয়ে দিচ্ছি। আমাদের দরকার আছে তোমাকে। উনি যখন বলছেন আমি আর কিছু বলিনি। আর ইলেকশন করে তখন তো খুব আনন্দ পেয়েছি। সবাই মিলে ঘোরাফেরা, মানুষের সঙ্গে দেখা হওয়া। এই ইলেকশনে আমার প্রতিদ্বন্দ্বী ছিলেন জাসদের শাহজাহান সিরাজ। সবাই বলল পোস্টার, লিফলেট দরকার। কর্মীদের শখ তারা ভোট��রদের দেবে। আমি বললাম ঠিক আছে পাঁচ হাজার পোস্টার করে দাও। আর একটা লিফলেট করে দাও। বিশ্বাস করবেন না, এর মধ্যে আমার টাকা বেঁচে গেছে। বঙ্গবন্ধুর দেয়া ২০ হাজার টাকার মধ্যে নির্বাচনের পরে সাত হাজার টাকা না কত যেন, ফেরত দিয়েছি। এই হলো তখনকার ইলেকশন। ভোটারদের ঘরে ঘরে যাওয়া, সবার সঙ্গে কথা বলা, দেখা হওয়া, আন্তরিকতাই ছিল তখন অন্য রকম। একটা ঘটনা খুব মনে পড়ে। আমি নির্বাচনী প্রচারাভিযানে বের হচ্ছি দেখি একজন বোরখা পরা মেয়ে দাঁড়িয়ে আছে। বলে আপনার সঙ্গে একটু কথা বলতে চাই। আমার স্বামী বাঙালি সৈনিক ছিল, শহীদ হয়েছে। সে তো দেশের জন্য প্রাণ দিয়েছে। আমি শুনেছি আপনি নাকি ভালো মানুষ। এই দশটা টাকা রাখুন, দেশের জন্য কাজ করবেন। ওই মহিলাকে আমি কোনোদিন ভুলতে পারব না। কিছু চায়নি সে। এরচেয়ে বেশি দেশপ্রেমের পরিচয় কোথায় পাবেন? এই হচ্ছে বাংলাদেশ। সেই মহিলার বাংলাদেশ, বঙ্গবন্ধুর বাংলাদেশ। সাপ্তাহিক : ইলেকশনের পরে তো আপনি কেবিনেটে ফরেন মিনিস্টার হন… ড. কামাল হোসেন : সেটা খুব ইন্টারেস্টিং। যখন কেবিনেট গঠন নিয়ে কথা হচ্ছে, আমি তখন ঘুরছি। একেকজনের আগ্রহ থাকে, টার্গেট থাকে। বঙ্গবন্ধু জিজ্ঞেস করেছেন, ল-ট তো হলো এখন কি করবে? বললাম স্পেশাল এসিসট্যান্ট মানে, সহায়ক হিসেবে একটা রুম যদি থাকে, আপনার অফিসের কাছে নেব। তা হলে আমার অফিস থেকে এসে আমি কাজ করতে পারব। যে কাজ বলবেন করে দেব। আর যদি প্রফেশনে ফিরে যাই তবে মোটামুটি মাসে চলার মতো আমি আয় করব। দ্যাটস নট টু মাচ ডিফিকাল্টস। আমি কোনো চাকরির জন্য ইচ্ছুক না। তখন উনি বললেন, ঠিক আছে। তুমি তো অভিজ্ঞতা অর্জন করেছ। আমি বললাম দেখেন, আমার কোনো দাবি নেই। আর বিশেষ করে আমার সিনিয়র কলিগরা অনেকেই মন্ত্রী হতে আগ্রহী থাকবেন। আমাকে আপনি বিবেচনার মধ্যে একদম না রাখলেই পারেন। রাখলে আমার কিছু বলার থাকবে না। বাট আই হ্যাভ নো প্রেফারেন্স। এভাবেই কথা শেষ করে আমি চলে এলাম। দিনে আমার কোনো খোঁজখবরই নেই, রাত সাতটা-আটটার দিকে হঠাৎ অনেকের ফোন পাওয়া শুরু হলো। তাজউদ্দীন ভাই ফোন করে বললেন, কনগ্রাচুলেশন। আমি বললাম কিসের? কনগ্রেচুলেশন ফরেন মিনিস্টার। আমি তো অবাক! তাজউদ্দীন ভাই বললেন, আমি একটা কথা বলি, আপনি তাড়াতাড়ি সামাদ (তখনকার পররাষ্ট্রমন্ত্রী আবদুস সামাদ আজাদ) ভাইয়ের ওখানে যান। উনি কিন্তু মন খারাপ করেছেন। ফরেন মিনিস্টার থেকে উনি এগ্রিকালচার মিনিস্টার হয়েছেন। ওনার সঙ্গে দেখা করুন। ওখান থেকে আপনি দেখা করে, কনগ্রাচুলেশন দিয়ে, তারপর আমার বাসায় আসেন। আমি গেলাম সামাদ সাহেবের বাসায়। উনি তাজউদ্দীন ভাইয়ের বাসার পাশের বাসায় থাকতেন। সাপ্তাহিক : তার মানে তাজউদ্দীন সাহেবও আপনাকে অনেক পছন্দ করতেন… ড. কামাল হোসেন : এই ঘটনার মধ্যে দিয়ে তো তাই মনে হয়। আমিও মনে করি আমার মন্ত্রিত্ব পাওয়ার বিষয়ে হয়ত ওনার প্রস্তাব ছিল। তাছাড়া নেতৃবৃন্দের দু’চারজনের মধ্যে আলোচনা করেই তো এসব ঠিক করা হয়। তবে আমি তাজউদ্দীন ভাইকে একবারও বলিনি যে আমি মন্ত্রী হবার ব্যাপারে আগ্রহী কিংবা আপনি আমার জন্যে কিছু করবেন। আমি বলব তাজউদ্দীন ভাই সবসময়ই শিক্ষণীয় মানুষ ছিলেন। যিনি সুস্থ রাজনীতিতে বিশ্বাস করতেন। সাপ্তাহিক : এরপর আপনি আবদুস সামাদ আজাদ সাহেবের বাসায় গেলেন? ড. কামাল হোসেন : গেলাম। দেখা করলাম। উনি ছিলেন আমার শ্রদ্ধার মানুষ। উনি সিনিয়র মানুষ। তিনি আমাকে বুঝতে দেননি যে উনি মনোক্ষুণœ হয়েছেন। উনি ছিলেন সিটিং ফরেন মিনিস্টার। আমি শুধু তাকে বলেছি যে, দেখেন সামাদ ভাই, বিশ্বাস করেন আমি এ ব্যাপারে এতটুকুও জানি না। কল পাওয়ার আগে আমার চিন্তার মধ্যে এতটুকুও আসেনি যে, এ রকম হতে পারে। তখন উনি বললেন, না না, ঠিক আছে। আমি বললাম, আপনার সাহায্য, আশীর্বাদ লাগবে। আমি তো নতুন। তারপর সেখান থেকে তাজউদ্দীন সাহেবের কাছে গিয়েছি। তখন উনি বললেন যে, আমি দেখলাম বঙ্গবন্ধু বলছেন, পররাষ্ট্রমন্ত্রীর পদে একটা পরিবর্তন দরকার। আর কৃষি মন্ত্রণালয়ের জন্য অনেক কাজ, মানুষের মাঝে গিয়ে কাজ করতে হবে, এখানে দরকার একজন মাঠপর্যায়ে কাজ করা অভিজ্ঞ মানুষ। এই বিবেচনা থেকেই বঙ্গবন্ধু বললেন আব্দুস সামাদ আজাদ কৃষি মন্ত্রণালয়ে যাক। আর অন্যান্য প্রার্থীদের মধ্যে পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের জন্য মন্ত্রী হিসেবে বঙ্গবন্ধু বিশেষ করে আপনার নাম প্রথম লিস্টে রেখেছিলেন। তাজউদ্দীন ভাই বললেন, বঙ্গবন্ধুকে আমিও বলেছি যে, এটা ভালোই হবে। এভাবেই ’৭৩-এর মার্চে পররাষ্ট্রমন্ত্রী হলাম। সাপ্তাহিক : এরপরে আপনি পেট্রোলিয়াম মিনিস্টার হয়েছেন কবে? ড. কামাল হোসেন : ’৭৪-এ। এটাও খুব বিস্ময়কর ঘটনা। ড. মফিজ চৌধুরী ছিলেন পেট্রোলিয়াম মিনিস্টার। ’৭৩-এর অক্টোবরে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রথম তেলের দাম বাড়ল। তখন সুয়েজ ক্যানেল ক্রস করে মিসরীয়রা ওয়েস্ট ব্যাংক দখল করে। সৌদি রাজা কিং ফয়সাল তা সমর্থনের জন্য বললেন সৌদি আরব তেলের সরবরাহ নিয়ন্ত্রিত করবে। ফলে আন্তর্জাতিক বাজারে প্রতি ব্যারেল তেলের দাম তিন ডলার থেকে ১০ বা ১৫ ডলারে উঠল। এর ফলে নতুন তেলের অনুসন্ধানে নতুন নতুন দেশে গিয়ে তেল খোঁজার আগ্রহ তৈরি হলো আন্তর্জাতিক তেল কোম্পানিগুলোর। এ প্রেক্ষিতেই চল্লিশটা তেল-গ্যাস কোম্পানি বাংলাদেশে তেল-গ্যাস অনুসন্ধানের জন্য আবেদন করল। তাদের ধারণা যে বঙ্গোপসাগরে তেলের ভালো মজুদ থাকতে পারে। বঙ্গোপসাগরে তেল অনুসন্ধানের বিষয়ে আন্তর্জাতিক কোম্পানিগুলোর এই আগ্রহে আমাদের উৎসাহ বাড়ল। তাদের সঙ্গে কাজ করতে হলে তো চুক্তি করতে হবে। এ জন্য আইন বানাতে হবে। আমি তখন আইনমন্ত্রী নই। আইনমন্ত্রী তখন মনোরঞ্জন ধর। আমাকে তখন বলা হলো যে, আইনমন্ত্রীকে এ ব্যাপারে সাহায্য কর। কেননা এটা তো তখন সবার জন্য নতুন ব্যাপার। আমি তখন খোঁজা শুরু করলাম যে, অন্যান্য দেশে এ বিষয়ে কি কি আইন আছে। আমাদের আইনটা দেখলাম। এটা ব্রিটিশ আমলের আইন এবং অন্যান্য দেশে এ রকম আইনকে মনে করা হচ্ছে যে, এটা অকেজো হয়ে গেছে। কেন? ঔপনিবেশিক আমলে তৈরি এসব আইনের পুরোটাই হলো বহুজাতিক তেল কোম্পানির স্বার্থে তৈরি। নতুন দেশ যারা স্বাধীন হয়েছে তারা এসব আইনের ব্যাপারে পুনর্বিবেচনা করছে। নিজ দেশের স্বার্থ বিবেচনায় দেশগুলো তখন তেল-গ্যাস অনুসন্ধানে বিদেশি কোম্পানির সঙ্গে চালু করছে প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট বা পিএসসি। দেখলাম যে, এই কাজটা ইতোমধ্যে ইন্দোনেশিয়াতে অনেকটা এগিয়ে আছে। সাপ্তাহিক : বাংলাদেশ তখন একটা নতুন স্বাধীন দেশ। পেট্রোলিয়ামের নতুন আইনকানুনের প্রয়োজন আছে। যেহেতু আপনি একজন ল’ইয়ার সে কারণেই বোধহয় আপনাকে জ্বালানিমন্ত্রী হিসেবে নেয়া হলো। ড. কামাল হোসেন : বোধহয় কেবিনেট কমিটিতেও নেয়া হলো। একটা কমিটি করা হলো। মফিজ ভাই বললেন যে, ভাই আপনি তো আইনজীবী আপনি একটু দেখে-টেখে বলেন। সাপ্তাহিক : তারপর… ড. কামাল হোসেন : নরমালি যেটা হয়, মন্ত্রণালয়ে যারা থাকেন, সেক্রেটারি, ডেপুটি সেক্রেটারি এরা এগুলো তৈরি করেন। আর যাদের কাছ থেকে বুদ্ধি নিতে চায়, আমাকে তো মন্ত্রী হিসেবে না আমি আইনজীবী হিসেবে এটা করেছি। যদিও কেবিনেট মেম্বার হিসেবে কেবিনেট কমিটিতে তো মতামত বা পরামর্শ দেয়াই যায়। তবে কেবিনেট কমিটির একজন সদস্য হিসেবে এসব নিয়ে তো এই ধরনের গবেষণা করার কথা না। আমি এই বিষয়টি নিয়ে সিরিয়াস গবেষণা করেছি। অনেক দেশে নানারকম চিঠিপত্র আদান-প্রদান করেছি। অন্যান্য দেশের আইনে কি আছে দেখেছি। আলজেরিয়ায় কি হচ্ছে দেখেছি। এ বিষয়ে ইরাকে একজন বেশ পণ্ডিত ব্যক্তি ছিলেন, ড. হাছান জাকারিয়া, তাদের চিঠি দিয়েছি যে আপনারা এসব ব্যাপারে আমাদের কিছু পরামর্শ দেন। আমরা এ বিষয়ে জ্ঞানার্জন করতে চাই। সাপ্তাহিক : তখন পর্যন্ত ড. মফিজ চৌধুরীই তো পেট্রোলিয়াম মিনিস্টার ছিলেন। ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ। সংশ্লিষ্ট মন্ত্রণালয় থেকে নতুন আইনের বিষয়ে যে প্রস্তাবটা এলো তা অনেকটা ঔপনিবেশিক দেশের আদলে তৈরি। আইনটায় পাকিস্তান কেটে কেবল বাংলাদেশ লিখে দেয়া হয়েছে। যেটা অন্যান্য অনেক ক্ষেত্রে আমাদের করতে হতো। ওপরে একটু কাটছাঁট করে তৈরি করা হতো, বলা হতো এটা বাংলাদেশের আইন। কিন্তু এক্ষেত্রে আমার গবেষণার ভিত্তিতে আমি বললাম যে, পাকিস্তান আমলে তৈরি আইনের ওপর শুধু পাকিস্তান কেটে বাংলাদেশ লিখে আইন করলে হবে না। কেননা এই দশকে বিশেষ করে ১৯৫০-১৯৭০ সালের মধ্যে জ্বালানি অনুসন্ধানে পৃথিবীতে অনেক রকমের উন্নতি হয়েছে। ইন্দোনেশিয়ায় জাতিসংঘের যে এক্সপার্ট ছিলেন তিনি বললেন, হ্যাঁ ঠিকই বুঝেছ। যেসব দেশে স্বাধীন সরকার আছে তারা এগুলো পুনর্বিবেচনা করছে। তারা নতুন করে এক্ষেত্রে সংস্কারের কথা চিন্তা করছে। তখন আমি দেখলাম যে এ বিষয়ে অনেক এগিয়ে যাওয়া, সবচেয়ে কাছের দেশ তো মালয়েশিয়া। তারা জ্বালানি অনুসন্ধানের জন্য ঠিক একই সময়ে ’৭৪-এ কমিটি করে এবং তারাও ইন্দোনেশিয়াকে অনুসরণ করেছে। বাংলাদেশের পেট্রোবাংলা এবং মালয়েশিয়ার তেল অনুসন্ধান প্রতিষ্ঠান পেট্রোনাস একই সময়ে জন্ম নেয়। আমরা ড্রাফটগুলো এক্সচেঞ্জ করেছি। আর ইন্দোনেশিয়াতে এই প্রতিষ্ঠানের নাম ছিল পেট্রোমিনা ন্যাশনাল ওয়েল কোম্পানি। তারাও তৈরি করেছে প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট। আমাদের কাছে এটা খুবই আকর্ষণীয় বিষয় মনে হলো। আমি এটার ওপরে একটা পেপার লিখে, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের তৈরি পেপারের পাশাপাশি এই পেপারটাও সবাইকে দিয়েছি। আমার পরামর্শ হলো অন্যান্য প্রচলিত পুরনো নীতির বদলে আমাদের এখানেও প্রোডাকশন শেয়ারিং কনট্রাক্ট (পিএসসি) এর ভিত্তিতে জ্বালানি অনুসন্ধান হওয়া উচিত। তাতে মালয়েশিয়া, ইন্দোনেশিয়ার মতো আমরাও লাভবান হব। সাপ্তাহিক : আপনি তো ঐ কমিটির মেম্বার হিসেবে তেল গ্যাস অনুসন্ধানের বিষয়ে চুক্তি তৈরির কাজ করলেন? ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ মেম্বার হিসেবে। এজ এ ফরেন মিনিস্টার অথবা কমিটি মেম্বার হিসেবে। এই পেপারগুলো লিখে যখন আলোচনা হলো তখন আলোচনার মধ্যে আমি এগুলো বলে যাচ্ছি আর সংশ্লিষ্ট মন্ত্রী মফিজ ভাই শুনে যাচ্ছেন। ওনার দপ্তরের সচিব যারা ছিলেন এদের তো এত কাজ করার সময়ও থাকে না। আগ্রহও থাকে না। একটা লিগ্যাল ব্যাকগ্রাউন্ড না থাকলে তো এত গভীরেও যাওয়া যায় না। আমি আসলেই এই বিষয়ে একটা ছোটখাটো রিসার্চ প্রজেক্টের মতো করেছিলাম। আমি তখন ভাবিনি এগুলোর ফলাফল কি হবে? পরে দেখলাম যে, আমার যুক্তিগুলো সবাই মেনে নিচ্ছে। আমরা পেট্রোবাংলা করব, আমরা নতুন আইন করব। সবাই দেখছে যে এটা খুবই যুক্তিসঙ্গত। আর তখনই আমি পেট্রোনাসের সঙ্গে মতামত বিনিময় করা শুরু করলাম। ইভেন বিফোর বিকামিং অয়েল মিনিস্টার। তারপরে বঙ্গবন্ধু আমাকে ডেকে বললেন, এই সব তো করলে, এখন এগুলো বাস্তবায়ন করবে কে? তুমি পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী হয়ে যাও। আমি বললাম, বলেন কি! আমার বর্তমান মিনিস্ট্রি ইজ বিগ এনাফ, সেখানে তো এখনও আমার অভিজ্ঞতার ঘাটতি আছে। অনেক দেশের সঙ্গে আমাদের সম্পর্ক তখনও শুরুই করা যায়নি। জাতিসংঘে আমরা তখনও সদস্যপদ লাভ করিনি। পররাষ্ট্রমন্ত্রী করার সময় উনি আমাকে ডেকে বলেছিলেন, তোমাকে এই কাজটা এ কারণে দিয়েছি যে আমরা এখনও জাতিসংঘের সদস্যরাষ্ট্র হইনি। আমাদের কার্যকরভাবে এগিয়ে দ্রুত জাতিসংঘের সদস্যপদ লাভ করতে হবে। ফরেন মিনিস্ট্রিকেও গড়তে হবে। এই কাজটা তোমাকে আমি দিয়েছি যে তুমি ইয়াংম্যান, এনার্জি নিয়ে কাজ করবে। ফলে আমি ধরে নিয়েছি যে জাতিসংঘের মেম্বার হয়ে যাওয়ার পরে আমার এই পর্বটাও শেষ হবে। সাপ্তাহিক : তার মানে, জ্বালানি মন্ত্রণালয়ের মন্ত্রী হবার বিষয়ে আপনি মোটেই আগ্রহী ছিলেন না? ড. কামাল হোসেন : আমার যেহেতু মাঠপর্যায়ের রাজনীতির ঘাটতি আছে সে কারণে তখনও ভাবছি যে রাজনীতিতে থাকলেও মন্ত্রী থাকতে চাই না। কিন্তু তাজউদ্দীন ভাই বার বার বলেছেন, আপনারা যেসব পলিসি বানাচ্ছেন এসব বাস্তবায়ন করবে কে? আমাদের সংগঠনে তো সেরকম লোকবল নাই। উনি বার বার এটা বলে যাচ্ছেন। স্বাধীনতার আগে থেকে বলে যাচ্ছেন। ফ্রি টাইমে যখন আমি ওনার সঙ্গে বসি, এসব আলোচনা হতো। তাজউদ্দীন ভাই বলতেন দেখেন ড. কামাল সাহেব নির্বাচনী ম্যানিফেস্টো লিখছেন ভালো কথা, কিন্তু এসব বাস্তবায়ন করতে হলে তো মানুষ লাগবে। সংগঠন তো তৈরি করতে হবে। সংগঠনকে শক্তিশালী করতে হবে। একে ঢেলে সাজাতে হবে। সাপ্তাহিক : এই সব কাজ বাস্তবায়নের জন্যই কী বঙ্গবন্ধু আপনাকে তখন পেট্রোলিয়াম মিনিস্ট্রির দায়িত্ব দিয়েছিলেন? ড. কামাল হোসেন : পেট্রোলিয়াম মন্ত্রণালয়ের দায়িত্ব দিলেন তা গড়ার জন্য। একদম জিরো থেকে এটা শুরু করতে হয়েছে। পেট্রোবাংলা করে আমরা অর্গানোগ্রাম বানিয়েছি। আমার তখন দরকার ছিল জিওলজিস্ট। পেলাম একজনকে, ড. হাবিবুর রহমান। অসম্ভব ভালো যোগ্য মানুষ ছিলেন তিনি। অল পাকিস্তানের চিফ জিওলজিস্ট ছিলেন। মুক্তিযোদ্ধা ছিলেন। পঞ্চাশে পিএইচডি করা লোক। ফাদার অব পেট্রোবাংলা যদি কাউকে বলতে হয়, আমি ওনার নামই বলতে চাই। সাপ্তাহিক : এ কাজের অভিজ্ঞতার ফলেই পরবর্তীতে কি অক্সফোর্ডে একাডেমিক কাজ করার সুযোগ মিলল, আপনার? ড. কামাল হোসেন : আই টেল ইউ আমি বিশেষজ্ঞদের ম্যাটেরিয়াল এনে একত্র করে, এনালাইস করে পরিশ্রম করে যে কাগজটা লিখেছি, তা সত্যিই অকল্পনীয়। সে কারণে ’৭৫-এর পরে যখন অক্সফোর্ডে গেলাম তারা আমাকে রিসার্চের সুযোগ দিল। জিজ্ঞেস করল, কিসের ওপরে কাজ করবে। আমি বললাম, পেট্রোলিয়াম এগ্রিমেন্ট। সাপ্তাহিক : আপনার থিসিসটা তো পরে বিখ্যাত বই হয়েছে… ড. কামাল হোসেন : হ্যাঁ বই হয়েছে। জাতিসংঘ ’৮০-তে আমাকে বলল এ বিষয়ে কাজ করতে আপনি চীনে যান। একটা টিম যাচ্ছে ওরা কিভাবে তেল উত্তোলন অনুসন্ধান চুক্তি করে সেটা দেখুন। আমি বললাম যে, দেখ এ বিষয়ে আমার অভিজ্ঞতাও খুব সীমিত। তিন বছর বাংলাদেশে এ বিষয়ে কাজ করেছি, আর একটি মাত্র বই লিখেছি। তখন তারা বলল যে, এই বইয়ের জন্য আমরা তোমাকে মনে করি যে তুমি একজন ভালো এনার্জি বিশেষজ্ঞ। সাপ্তাহিক : আপনি যখন ফরেন মিনিস্টার ছিলেন তখন শুনেছি একবার বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেয়ার জন্য দলের লোকজন আপনার অফিসের একটি রেড কার্পেট (লাল গালিচা) চেয়েছিলেন। আপনি আপত্তি করেছিলেন। ওই ঘটনাটি যদি একটু বলেন, আপনি কি করলেন? ড. কামাল হোসেন : আমি তো সবসময় বলেছি যে, একটা নতুন অভিজ্ঞতা অর্জন করেছি আমরা। সেটার ভিত্তি ছিল নৈতিকতা। বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে, তাজউদ্দীন ভাইয়ের কাছ থেকে শিক্ষা পেয়েছিলাম যে রাষ্ট্র এবং দল একদম ভিন্ন। এটা আমার পররাষ্ট্রমন্ত্রী থাকাকালীন প্রথম দিকের ঘটনা। ঢাকা মহানগরীতে বঙ্গবন্ধুকে একটা সংবর্ধনা দেয়া হবে। এটা ছিল ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের দলীয় অনুষ্ঠান। বঙ্গবন্ধুকে তারা লাল গালিচা সংবর্ধনা দেবে। এ জন্য একটা লাল গালিচা দরকার। তখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে বিদেশি অতিথিদের সম্মাননা দেবার জন্য এরকম একটি রেড কার্পেট ছিল। ঢাকা মহানগর আওয়ামী লীগের লোকজন বঙ্গবন্ধুকে সংবর্ধনা দেবার জন্য সেই রেড কার্পেটটি চাইল। আমার মনে হলো এটা তো রাষ্ট্রীয় কোনো অনুষ্ঠান না। দলীয় অনুষ্ঠান। সরকারি জিনিস দলীয় অনুষ্ঠানে ব্যবহার করতে দেয়া তো উচিত না। কেননা দল আর রাষ্ট্র তো ভিন্ন। আমি তখন তাজউদ্দীন ভাইকে জিজ্ঞেস করেছি যে, এ রকম একটা প্রস্তাব আসছে। তিনি তখন বললেন, এটা তো হওয়া উচিত না। দল এবং রাষ্ট্রকে আমাদের সংবিধান আলাদা রেখেছে। আমাদের কাজের মধ্যেও এটা প্রতিফলিত হতে হবে। তিনি বললেন যে, আপনার সঠিক সিদ্ধান্ত। আপনি আপনার সিদ্ধান্তে অটল থাকুন। আমি অটল থাকলাম। লাল গালিচা দেয়া হলো না। ফলে এ নিয়ে দলের মধ্যে অনেক কথা উঠল। দলের লোকজন নানা কথা বলা শুরু করল। অনেকে ভাবল ব্যাটা কি মনে করে, মন্ত্রী হয়েছে তো কি হয়েছে। বঙ্গবন্ধুর জন্য কার্পেট দেয়ার ব্যাপারে কোনো কথা থাকতে পারে! এসব নিয়ে যখন কানাঘুষা চলছে তখন সোজা বঙ্গবন্ধুর কাছে চলে গেলাম। আমি বললাম, দেখেন আপনি আমাকে সবসময় বলেছেন যে, যা কিছু করি আইন মেনে, নীতি মেনে যেন চলি। দল এবং সরকারকে যেন মিশিয়ে না ফেলি। আমার কথা শুনে উনি খুবই হেসেছেন। হেসে বলেছেন যে, না ঠিকই করেছ। ইউ আর রাইট। সাপ্তাহিক : বঙ্গবন্ধু সরকারের সময় আপনি পররাষ্ট্রমন্ত্রীর দায়িত্ব পালন করেছেন। সেই সময়ে বিভিন্ন দেশে বাংলাদেশের অ্যাম্বাসেডরদের নিয়োগ সংক্রান্ত বিষয়ে তদবিরের অনেক গল্প আছে। এ বিষয়ে কিছু বলবেন কি? ড. কামাল হোসেন : নিয়োগ আর বদলি নিয়ে খুব তদবির চলে। প্রচুর তদবির হয়। কে কোন দেশে যাবে, ইউরোপ, আমেরিকায় নাকি আফ্রিকায় পোস্টিং নেবে এগুলো নিয়ে তো পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে সাংঘাতিক তদবির চলে। আমি বঙ্গবন্ধুকে বললাম যে, দেখেন এটা নিচের দিকের নিয়োগ। কমিটি করে দিচ্ছি। এই নিচের দিকের নিয়োগ বা বদলির বিষয়টি আপনি একদম কমিটির ওপরে ছেড়ে দেন। আমি বললাম, পররাষ্ট্র সচিব এনায়েত করিম, প্রশাসনের অতিরিক্ত সচিব ফখরুদ্দীন সাহেব- এদের দিয়ে কমিটি করে দিচ্ছি। কমিটির মাধ্যমে এরাই এ কাজটি করুক। বঙ্গবন্ধু বললেন, ঠিক আছে এই কমিটি তো খুবই ভালো কমিটি। তখন অ্যাম্বাসেডরদের ব্যাপারে দু’চারটি যে রাজনৈতিক অ্যাপয়েন্টমেন্ট হয়েছে তার মধ্যে ছিলেন মুনতাকিন চৌধুরী। তিনি আমাদের এমপি ছিলেন, উনি রাষ্ট্রদূত হিসেবে জাপানে গেলেন। শামসুর রহমান সাহেব গেলেন রাশিয়ায়। সৈয়দ আব্দুস সুলতান লন্ডনে গেলেন। রাজনীতিতে তাদের যোগ্যতাও ছিল আর তখন তারা আর এমপি থাকতে চাচ্ছেন না। শামসুর রহমান সাহেব তো ইলেকশনও করেননি। মুনতাকিন চৌধুরীও সরে যেতে চাচ্ছেন। এরকম কয়েকটা পলিটিক্যাল নিয়োগ দেয়া হয়েছিল যাদের রাজনৈতিক অভিজ্ঞতা আর যোগ্যতা দুই-ই ছিল। দলীয় আনুগত্যের কারণে অযোগ্য কাউকে তখন নেয়া হয়নি। হতোও না। বঙ্গবন্ধু সবার সঙ্গে আলাপ করে এগুলো করতেন। শেষের দিকে ’৭৪-৭৫ এ আমি আরেকটা কমিটি করে বলেছিলাম যে, আমাদের এখন কমিটি করে পারফরমে›স দেখা দরকার। পারফরমেন্স অডিট। কোথায় কোন অ্যাম্বাসেডররা কি করছেন? উনাদের আগে থেকে জানিয়ে দেয়া যে, এক বছরের মধ্যে যেখানে যে যে সম্ভাবনা আছে তা বাড়ছে কিনা। যেখানে শ্রমিক যাওয়ার কথা সেখানে শ্রমিক পাঠানো বাড়ছে কিনা ইত্যাদি। একটা সিস্টেমেটিক টার্গেট করে বলা হয় যে, এই টার্গেট অনুযায়ী মূল্যায়ন হবে। মূল্যায়নের ভিত্তিতে সিদ্ধান্ত হবে, কোন রাষ্ট্রদূত কোথায় থাকবেন, কার কোথায় পোস্টিং হবে। সেক্ষেত্রে কর্মদক্ষতা দেখাতে না পারলে অদক্ষ রাষ্ট্রদূতদের ফিরে আসতে হতে পারে। কয়েকজনের ফিরে আসার সিদ্ধান্তও হয়েছে। সাপ্তাহিক : এই কারণে কী কোনো দুর্ভোগ পোহাতে হয়েছে? ড. কামাল হোসেন : এখানে আমি একটু বলি। আমাকে দু’তিনবার বঙ্গবন্ধুকে লিখে বলতে হয়েছে যে চাপের মুখে আপনি যদি এটা করাতে চান তবে আমাকে মন্ত্রীর পদ থেকে রিলিজ করে দেন। আমাকে মন্ত্রীর পদে রেখে এটা তো করা যাবে না। আপনার ক্ষমতা আছে, আপনি যেটা বলবেন সেটাই হবে। একটা ঘটনার কথা বলি। আমি যখন পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে মন্ত্রী তখনকার ঘটনা। একজন অ্যাম্বাসেডর সাহেব এসে সোজা চলে গেলেন বঙ্গবন্ধুর কাছে, একজন ফার্স্ট সেক্রেটারির বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে। তাঁর অভিযোগ ফার্স্ট সেক্রেটারি বেয়াদবি করে, রাষ্ট্রদূতের কথা শোনে না। উনি সোজা গিয়ে বঙ্গবন্ধুকে বললেন যে, এই লোকটাকে রাখা যাবে না। আমাকে বঙ্গবন্ধু বললেন যে, অ্যাম্বাসেডর এসে এ অভিযোগ দিয়ে গেল। আমি তখন ওই অ্যাম্বাসেডরকে ডাকলাম। বললাম আপনি এটা কি কাজ করলেন! আপনি একজন সিনিয়র অ্যাম্বাসেডর হয়ে, একটা ফার্স্ট সেক্রেটারির বিরুদ্ধে অভিযোগ নিয়ে প্রাইম মিনিস্টারের কাছে চলে গেলেন। এটা তো আমার কাছেও আসার কথা না। এটা পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের ডিজি অ্যাডমিনিস্ট্রেশনের ব্যাপার। ইউ আর লেবেল অব সেক্রেটারি। সিনিয়র অ্যাম্বাসেডর, অভিজ্ঞ মানুষ। আপনাকে আমরা এত রেসপেক্ট করি। এটা কি করলেন! উনি বুঝলেন যে ভুল করেছেন। বললেন, আই এম সরি। এটা তো ভুল হয়ে গেছে। আমি বললাম দেখেন, আপনি এত সিনিয়র, এ রকম ঘটনা যেন আর না হয়। আমি বঙ্গবন্ধুকে বলে দেব যে আপনি আমার সঙ্গে বসে কথা বলে সমস্যার সমাধান করে দিয়েছেন। এটা বঙ্গবন্ধুকে বলার সঙ্গে সঙ্গে উনি বললেন যে, এটা ঠিক করেছ। বঙ্গবন্ধু বললেন, যেহেতু আমার সঙ্গে অনেকের ব্যক্তিগত সম্পর্ক আছে, কার্টেসি কল দিলে অনেকেই আসবে। আমি বললাম একশ’বার আসবে। কার্টেসি কল ছাড়াও এসে আপনাকে ব্রিফ করবে। প্রাইম মিনিস্টারকে ব্রিফিং করবে। দিস ইজ ফাইন। কিন্তু ফার্স্ট সেক্রেটারি নিয়ে অভিযোগ থাকলে, তার একটা চ্যানেল আছে, চেইন অব কমান্ড আছে। সরাসরি আপনার লেবেলে অভিযোগ নিয়ে গেলে তো সেই চেইন অব কমান্ড থাকবে না। ফলে কোনোরকম সিস্টেম দাঁড়াবে না। সাপ্তাহিক : পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ে আর কোনো স্মরণীয় ঘটনা? ড. কামাল হোসেন : আরেকবার আরেকটা ঘটনা ঘটল। একটা নোট আসল প্রাইম মিনিস্টারের অফিস থেকে। কোন কোন দেশে কোন কোন রাষ্ট্রদূতকেÑ কাকে কোথায় পোস্টিং করা হয়েছে তার একটা সামারি দিতে হবে। পররাষ্ট্র সচিব এনায়েত করিম সাহেব হন্তদন্ত হয়ে প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের এই আদেশ নিয়ে এলেন। বললেন, দেখেন এটা কেন আসল? আমিও বললাম এটা কেন আসল! প্রাইম মিনিস্টারের অফিস এটা এইভাবে কেন জানতে চাইবে? জানতে চাইবে অমুক জায়গায় কে আছে? সব অ্যাম্বাসেডরের ব্যাপারে টপ টু বটম কেন তারা জানতে চাইবে? বললাম, আপনি কী মনে করেন নীতির দিক থেকে এটা পাঠানো উচিত? তখন উনি বললেন, নীতির দিক থেকে বোধহয় এটা ঠিক হচ্ছে না। তখন আমি বললাম, এটা পাঠাবেন না। নীতি অনুযায়ী ঠিক হচ্ছে না তো পাঠাবেন না। তখন এনায়েত করিম সাহেব বললেন, আমি কি করে এটা প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরের সচিব রহুল কুদুসকে বলব যে, ওনার রিক্যুয়েস্ট আমি মানব না। তখন আমি বললাম, ঠিক আছে মন্ত্রী হিসেবে আমি এটা লিখে দিচ্ছি। নোট দিয়ে দিচ্ছি যে, এটা পাঠাতে হবে না। সাপ্তাহিক : আপনার এ রকম সিদ্ধান্তের কোনো প্রতিক্রিয়া কি পেলেন, পরবর্তীতে? ড. কামাল হোসেন : তার কয়েকদিন পর বঙ্গবন্ধুর সঙ্গে সম্ভবত কোথাও যাচ্ছিলাম। বললেন, তুমি কি বিদ্রোহ করতেছ? আমি বললাম, কি বলেন স্যার! উনি বললেন, এই যে আমার অফিস থেকে রাষ্ট্রদূতরা কে কোথায় আছে জানার জন্য চাওয়া হলো, তুমি ফাইলে লিখে দিলে এটা পাঠাতে হবে না। তখন বললাম, এইভাবে এটা তো চাওয়ার কথা না। আমি তো আছি আপনার জন্য। আমাকে বললেই তো আমি জানাব আপনাকে। যে কোনো ভাবেই হোক সেটা জানাব। কিন্তু আপনার দপ্তরের সচিব মারফত তো এটা জানতে চাওয়া নীতিসম্মত হয়নি। আর তাছাড়া পররাষ্ট্র সচিব এনায়েত করিমকে তো আপনি চেনেন। তিনি পাওয়ার প্র্যাকটিস করা লোক না। তিনি খুব নীতিবান লোক। বঙ্গবন্ধুও খুবই ভালো জানতেন তাকে। আমি বললাম, উনি তো ওরকম লোক না। আর আপনি আমাকেও মনে করবেন না যে আমি অন্য কোনো কারণে এটা বলেছি। যে মন্ত্রণালয়কে দায়িত্ব দেয়া হয় সে মন্ত্রণালয়কে ওদের মতো কাজ করার জন্য কিছু সুযোগ দেয়া উচিত। যার যার কাজের জন্য সে দায়ী হবে। আপনি সে দায়িত্বটা কেন নিজে নেবেন? আমার মন্ত্রণালয়ের কোনো কাজ, কোনো পোস্টিং যদি সঠিক না হয় তবে সেজন্য মন্ত্রী হিসেবে আমি দায়ী হব। আপনি আমাকে যে কোনো মুহূর্তে বাদ দিতে পারেন। নট ইভেন মাই সেক্রেটারি। আমি সেক্রেটারিকে কোনো দোষ দেব না। এসে বলব না যে ভাই আমার সেক্রেটারি কি করল আমি জানি না। আপনি দেখেন যে আমার মন্ত্রণালয়ে কোনো ব্যাড পোস্টিং হচ্ছে, ব্যাড অ্যাডমিনিস্ট্রেশন হচ্ছে? আমাকে বলবেন জবাবদিহি করতে। আপনি যদি সন্তোষজনক উত্তর না পান আমাকে রিলিজ করবেন। আফটার দ্যাট ইউ ক্যান রিমুভ দা সেক্রেটারি বাট, ফার্স্ট ইউ হ্যাভ রিমুভ মি। তখন বঙ্গবন্ধু বললেন, হ্যাঁ, বুঝলাম। আচ্ছা ঠিক আছে, ঠিক আছে, কঠিন মানুষ তুমি। ঠিক আছে আমি রুহুল কুদ্দুসকে বলে দেব। এটা আর চাইবে না। বঙ্গবন্ধু খুব এপ্রিসিয়েট করেছিলেন আমাকে। উনি আমাকে সবসময় বুঝতেন। আমি তো বলব যে আমি বঙ্গবন্ধুর কাছ থেকে শতভাগ নৈতিকতার শিক্ষা পেয়েছি। যুক্তি দিয়ে যখন বলতাম, তখন বঙ্গবন্ধু শুনে বলতেন যে, ইউ আর রাইট, করে যাও। পেট্রোলিয়াম মন্ত্রী থাকাকালে তো আমি কড়াভাবে লিখেছিলাম। আর এখানে মুখে বলেছিলাম যে, আমার মন্ত্রণালয়ের কাজ যদি আপনার পছন্দ না হয়, আমাকে রিলিজ করে দেন। আর আপনার সেক্রেটারি যদি মনে করে এটা বেটার রান করবে তখন তাকে ফরেন মিনিস্টার করে দেন। যদি পোস্টিংগুলো ঠিক না হয় আপনি ডাকলে আমি যে কোনো সময় আসতে পারি। আপনি আমাকে বলতে পারেন যে, আপনার দৃষ্টিতে এই এই কাজ ঠিক হচ্ছে না। কিন্তু আপনার কার্যালয়ের সেক্রেটারি আমার মন্ত্রণালয়ের হোল চার্জটা নেবে এটা তো হতে পারে না। প্রধানমন্ত্রীর কার্যালয়ের সচিবের যেভাবে ক্ষমতা চর্চা করার কথা সেটা তো হচ্ছে না। আমার এসব যুক্তিতর্ক বঙ্গবন্ধু সবসময় বুঝতেন। সাপ্তাহিক : আপনি এই সাক্ষাৎকারের মধ্যেই বলছিলেন একজন হচ্ছেন মুজিব ভাই। একজন হচ্ছেন রাষ্ট্রের শাসক বঙ্গবন্ধু। আপনার জায়গা থেকে বলেন কখন কিভাবে দেখেছেন ওনাকে? ড. কামাল হোসেন : তিনি অসাধারণ সংগঠক ছিলেন। অসাধারণ রাজনৈতিক নেতা ছিলেন। মানুষের মনকে জয় করার অসাধারণ ক্ষমতা ছিল তাঁর। মানুষের অন্তর বুঝতেন। দেখে বুঝতেন যে মানুষ কি চাচ্ছে? মানুষের কী কষ্ট হচ্ছে? নির্যাতিত মানুষের কাছে ছুটে যাওয়া এটা তো এক নম্বর নীতি ছিল ওনার। এই যে বন্যা হয়েছে নৌকায় বসে নিজ হাতে সাহায্য দিয়েছেন। তখন তো অলরেডি ওনার পপুলারিটি তুঙ্গে। কিন্তু উনি নিজে ছুটে গেছেন বন্যার্তদের সাহায্য করার জন্য এবং আমাদেরও ট্রেনিং হয়েছে ওনার সঙ্গে ঘুরে ঘুরে। ওনার একটাই কথা ছিল- মানুষের কাছে যাও, দুর্গত মানুষের কাছে যাও। এটা উনার মধ্যে দেখেছি আর তাজউদ্দীন ভাইয়ের মধ্যে তো দেখেছি হান্ড্রেড পার্সেন্ট। সাপ্তাহিক : এটা তো আপনি দেখলেন মুজিব ভাইয়ের বেলায়। তারপর যখন উনি বঙ্গবন্ধু হলেন? ড. কামাল হোসেন : ১৯৭১ পর্যন্ত মুজিব ভাই এবং বঙ্গবন্ধুর মধ্যে কোনো পার্থক্য দেখিনি। ১৯৭২-র পরে তো উনি রাষ্ট্রপ্রধান হলেন। উনি কিন্তু একসঙ্গে রাষ্ট্রপ্রধান আর পার্টি প্রধান থাকেননি। কিন্তু তারপর যে পরিবর্তন হলো সেটা তো বাকশাল হওয়ার সময়। সেটা হলো খুবই জটিল একটা পরিস্থিতির মধ্যে। কি ডাইনামিক্সের মধ্য দিয়ে এটা হলো এগুলো আমি এখনো ঠিক পুরোটা বুঝতে পারি না। ১৯৭২ থেকে ১৯৭৪ এর শেষ পর্যন্ত আরেক রকম হলো। আর ১৯৭৫-এ তখন তো অন্য জিনিস, প্রেসিডেন্ট, পার্টি হেড একই জন হলেন বাকশালের মাধ্যমে। আমি কোনো সময় বলব না যে, এগুলোর কারণে ওনাকে হত্যা করা হলো। কেননা, যারা হত্যা করল তারা এটা বলার চেষ্টা করেছে। এটা একদম মিথ্যা অজুহাত। তখন বলা শুরু করল যে, ‘দ্যাখেন এ কারণে ওনাকে জীবন দিতে হয়েছে।’ না। আই ডোন্ট বিলিভ ইট। বঙ্গবন্ধু, বঙ্গবন্ধুই। মানুষের জন্য জীবন উৎসর্গ করা এই মানুষ আর কোনোদিন হবে না। এমন মানুষ হয় না। এত বড় নেতাও হবে না। সাপ্তাহিক : তাজউদ্দীন সাহেবের সঙ্গে আপনি কাজ করার সুযোগ পেয়েছেন। পরে কেবিনেটে আবার কলিগ হিসেবে পেয়েছেন ওনাকে। তাকে কিভাবে দেখেছেন আপনি? ড. কামাল হোসেন : অসম্ভব ভালো মানুষ ছিলেন। তার যে কর্মক্ষমতা, সততা, যে বিনয় ছিল, সেটা অসাধারণ। আমি তার মতো এত বিনয়ী হতে কাউকে দেখিনি। যে কোনো সময় ওনার নিজের স্বার্থের কথা এসেছে, উনি ফিরে গিয়েছেন। মন্ত্রিসভা থেকে পদত্যাগের আগে থেকেই তো উনি মনে মনে ঠিক করেছিলেন যে উনি থাকবেন না। এটা একটা জটিল ব্যাপার। তার নিজের এই পার্টের লেখাটা যদি আমরা তার কাছ থেকে পেতাম, খুব ভালো হতো। আমি শুনেছি যে উনি লিখেছিলেন। শেষ মুহূর্তে জেলে একটা ডায়েরিও ছিল। ওটা গুম হয়ে গেছে। ’৭৪ এর শেষের দিকে যেভাবে দেশে শাসন কার্য চলছিল সেটার ব্যাপারে উনি খুব খুশি ছিলেন না। ১৯৭২, ১৯৭৩ সালে তো উনি ছিলেন ভেরি মাচ হার্ট অব দি অ্যাডমিনিসট্রেশন। কিন্তু ১৯৭৪-এর অক্টোবরের দিকে ওনাকে মন্ত্রিসভা ছাড়তে হলো, রিজাইন করলেন উনি। সাপ্তাহিক : আপনি স্বাধীনতার ঘোষণা সম্পর্কে বলছিলেন … ড. কামাল হোসেন : এটা খামোখা একটা বিতর্ক তখন তৈরি করার চেষ্টা হয়েছিল। বঙ্গবন্ধু জীবিত থাকাকালেই, কিন্তু এতে কেউ সফল হয়নি। এটা একেবারেই বাজে চেষ্টা বলব। সাপ্তাহিক : জীবিত থাকাকালেই …? ড. কামাল হোসেন : এটা তো তখনি বন্ধ হয়ে গেছে। সবাই তো তখন জীবিত ছিল। সেই ’৬৬ থেকে কি কি ঘটেছে তা ধারাবাহিকভাবে তো জানা যায়। আর আমি সোহ্রাওয়ার্দী সাহেবের লেখার মধ্যে আরেকটা ইন্টারেস্টিং জিনিস পেয়েছি, এটা অনেকেই হয়ত জানে না অথবা দেখেনি। পরে এটা বইও হয়েছে। সাপ্তাহিক : বইটি প্রকাশিত হয়েছে কোথা থেকে? ড. কামাল হোসেন : এটা ইউপিএল প্রকাশ করেছে। সিক্সটি থ্রি-তে হোসেন শহীদ সোহ্রাওয়ার্দী মারা গেছেন। উনার ডায়েরিতে একটা জায়গায় উনি লিখেছেন, ‘মুজিব অ্যান্ড ইয়ংগার জেনারেশন ডু নট থিংক দ্যাট অ্যানি সল্যুউশন ইজ পসিবল উইদইন ওয়ান পাকিস্তান।’ আমি চেষ্টা করেছি একটা ফেডারেল সিস্টেম রাখতে। কিন্তু মুজিব এবং ইয়ংগার জেনারেশন মনে করে না যে, এক পাকিস্তান রেখে কোনো সমাধান সম্ভব। আমি যখন বঙ্গবন্ধুকে এই লেখাটা দেখিয়ে বললাম, আপনার বস তো আপনাকে সার্টিফিকেট দিয়ে গেছেন। যারা বলে যে আপনি স্বাধীনতার কথা চিন্তা করেননি, তাদের বিভ্রান্তি দূর করার জন্য তো উনি লিখে গেছেন। সাপ্তাহিক : স্বাধীনতার ঘোষণার ব্যাপারে জিয়াউর রহমান সাহেব কি নিজে কিছু বলেছিলেন? ড. কামাল হোসেন : বিএনপি যেটা বলে এটা একদম বাজে কথা। আই এ্যাম শিওর, আমি নিজে জিয়াউর রহমানের পঠিত ঘোষণা শুনেছি। শুনে সবারই তো ভালো লেগেছে। উনি ঘোষণা করেছেন, অন বিহাফ অফ শেখ মুজিব। পরে উনি নিজেই লিখে এটা স্বীকার করেছেন। দ্বিতীয়ত পরে এখানে ডিটেইলস সবাই বলেছে। এম আর সিদ্দিকী বলেছেন, হান্নান সাহেব বলেছেন। সবাই বলেছেন। সর্বোপরি তিনি নিজে লিখেও গেছেন। জিয়াউর রহমান জীবিত অবস্থায় কোনো সময় বলতেন না যে, আমি নিজে স্বাধীনতার ঘোষণা দিয়েছি। এখন যা বলা হয় এসব তো পাগলামি। সাপ্তাহিক : এবার একটু ভিন্ন প্রসঙ্গে আসি। আপনার প্রফেশনাল লাইফ তো পঞ্চাশ বছরের। আপনি অটোবায়োগ্রাফি লিখবেন না? ড. কামাল হোসেন : দীর্ঘদিন ধরে লিখছি, দুইরকম আত্মজীবনী। একটা তো এই রাজনৈতিক ঘটনাকেন্দ্রিক লেখা। প্রায় তৈরি হয়ে আছে। ’৬৬ থেকে ’৭৪। জাতিসংঘের সদস্য হওয়া পর্যন্ত। ওখানে আমি থেমে গেছি। তিন মাসের মধ্যে আমি সেটা আমার প্রকাশককে দিয়ে দিতে চাই। সাপ্তাহিক : আর নিজের ব্যক্তিগত জীবন নিয়ে অটোবায়োগ্রাফি রচনা? ড. কামাল হোসেন : খুব শিগগিরই শুরু করব। একজন তরুণ রিসার্চার আমাকে এই কাজে সহযোগিতা করবেন। সাপ্তাহিক : কর্মমুখর জীবন আপনার। জীবনজুড়েই নানান সুখের স্মৃতি, দুঃখের স্মৃতি আছে। জীবন সম্পর্কে আপনার দর্শনটা কি? ড. কামাল হোসেন : অটোবায়োগ্রাফি লেখার সময় আরো গভীরে চিন্তা করতে হবে। স্বাধীন বাংলাদেশে ফিরে আসার প্রথম সময়টা অসাধারণ ভালো লেগেছে। ���ই ভালোলাগা বোঝানো যায় না। আমাদের তো বেঁচে থাকারই কথা ছিল না। ২৫ মার্চের রাতে যখন ঘর ছেড়ে অজানার পথে বেরিয়েছি তখন চিন্তা ছিল আমরা বোধহয় আর বেঁচে ফিরতে পারলাম না। এটা তো আমি মিরাকল মনে করি যে, মুক্তিযুদ্ধ শেষে জীবিত অবস্থায় আমরা ১৯৭২ সালের ১০ জানুয়ারি স্বাধীন দেশে ফিরতে পেরেছি। স্বাধীনতা, স্বাধীন দেশের চেয়ে বড় আর কোনো আনন্দ নেই জীবনে। স্বাধীন দেশে জীবিত আছি এর চেয়ে বেশি পাবার আর কি আছে ? তার ভিতরে যা কিছু আমরা দেখেছি ভাঙা-গড়া, একটা রাষ্ট্র দাঁড়াচ্ছে, জাতীয় পতাকা, জাতীয় সঙ্গীত, সংবিধান এগুলো একেকটা জিনিস আমরা তৈরি করেছি। সবাই মিলে করেছি। ইতিহাসের এই নতুন পর্বের যাত্রাপথকে আমরাও ছুঁয়ে চলেছি। এগুলো সব মনে হয়েছে নতুন জীবনের একেকটা আলামত। জাতিসংঘে স্বাধীন বাংলাদেশের প্রথম পতাকা উত্তোলন আমার জীবনে একটা বড় ঘটনা। সাপ্তাহিক : কিন্তু যেই দেশ করতে চেয়েছিলেন, সেখানে যে ব্যর্থতাও আছে, দুঃখ-কষ্টও আছে, এগুলো আপনাকে পীড়িত করে না? ড. কামাল হোসেন : প্রত্যেক মুহূর্তে আমি নিজেকে জিজ্ঞাসা করি, যে প্রতিশ্রুতি আমাদের ছিল তা কী আমরা পূরণ করতে পেরেছি? জনগণ ক্ষমতার মালিক হবে। এত লোক এটার জন্যই জীবন দিয়েছিল। এদেশে আমরা অসহায় বোধ করব না। এদেশে আমাদের জান-মালের নিরাপত্তা থাকবে। আমাদের রাষ্ট্র ভালোভাবে পরিচালনা করা হবে। অন্ন, বস্ত্র, শিক্ষা, চিকিৎসা নিয়ে আমরা ভালোভাবে বাঁচব। কর্মসংস্থান হবে। বাংলাদেশের সাধারণ মানুষ যা আশা করে, যেগুলো সংবিধানে লেখা আছে এগুলো তারা পাবে। এর বাইরে সাধারণ মানুষ খুব বেশি চায় না। ব্রিটিশ আমল থেকে যে বৈষম্য আমাদের সমাজে লক্ষ্য করেছি তার খুব একটা হেরফের হয়নি। এখনও সমাজের সর্বক্ষেত্রে বৈষম্য বিরাজ করছে। অল্প সংখ্যক লোককে সর্বক্ষেত্রে বিশেষ সুযোগ করে দেয়া হয়েছে শুধুমাত্র অর্থের কারণে। আমি মনে করি না টাকা দিয়ে সব হওয়া উচিত। অথচ হচ্ছে। এটা আমাকে দারুণভাবে পীড়া দেয়। সাপ্তাহিক : মৃত্যু নিয়ে কি আপনি ভাবেন? মৃত্যু কি আপনাকে কিছু ভাবায়? ড. কামাল হোসেন : ভাবায় তো বটেই। আমি মনে করি জীবন আল্লাহর একটা বিশেষ রহমত বা উপহার। কিন্তু মৃত্যুর চিন্তা করে জীবনের যে সময় আছে সেটাকে হারাতে চাই না। যে জিনিসটাকে মনে রেখে বাকি সময়টা কাটানো দরকার সেটা হচ্ছে যে, আমার হাতে সীমাহীন সময় নাই। মানুষ যখন তরুণ থাকে তখন এসব চিন্তাই করে না। মনে করে তার সামনে একটা সীমাহীন সময় আছে। এদিক থেকে তরুণ থাকাটা ভালো ব্যাপার। তখন এসব চিন্তা আসে না। আমি অনেককে বলি দেখেন, আমি মরে যাব সেটা নিয়ে সারাক্ষণ ভাবি না। আমি খুব ঠাণ্ডা মাথায় বলি, জীবনের অন্তত ৫ ভাগের ৪ ভাগ তো শেষ হয়ে গেছে। ১০ ভাগের অন্তত ৭-৮ ভাগ তো পার হয়ে গেছে। আমি কাজটাকেই জীবন মনে করি। সাপ্তাহিক : জীবন তো একই সঙ্গে একটা সুযোগও বটে। ড. কামাল হোসেন : সুযোগ তো অবশ্যই। ভালো কিছু করার সুযোগ। মানুষের জন্য কাজ করার সুযোগ। টাইমটাকে বেটার ইউজ করার সুযোগ। আমার যা অর্জন, যা অভিজ্ঞতা সেটা থেকে দিয়ে যাওয়া, যাতে আগামী প্রজন্ম কাজে লাগাতে পারে- তাদের প্রতি এটাই আমাদের দায়িত্ব। আমাদের সময়ে আমরা যাদের দিকে তাকিয়ে দেখতামÑ পরিবারে মা, বাবা, পারিবারিক মুরব্বি তাদের কাছ থেকে ভালো দিকনির্দেশনা পেতাম। হালাল-হারামের কথা তো আমাদের মতো মুসলিম পরিবারে ছোটবেলা থেকেই শিক্ষা পেয়েছি। এখন কেবল শুনি টাকা আয়ের কথা। টাকা মানুষকে কী দেবে, কোথায় নিয়ে যাবে আমি জানি না। গ্রেগরি স্কুলের ছাত্র থাকার সময় ঊংংধু লিখেছি যে, টাকা-পয়সা অর্জন করা বড় জিনিস না- ভালো মানুষ হওয়া, সমাজের একটা দায়িত্ব পালন করা এবং মানুষের প্রতি সহনশীল থাকা জরুরি। আমার মনে হয় আমাদের সময় ম্যাট্রিকের টেক্সট বইয়ে ছিল ঐড়ি সঁপয ষধহফ ধ সধহ হববফ নামের একটা গল্প, এখন আছে কিনা জানি না! এখন তো দেখে মনে হয় সবার হাজার হাজার বিঘা জমি দরকার। তা না হলে এত কালো টাকা কেন? যত কালো টাকা লাগে ততই প্রয়োজন বাড়ে! এই যে পরিবর্তনÑ যার ফলে সুষ্ঠু সমাজ, সুষ্ঠু মানুষের বদলে আমরা দেখছি রুগ্ন মানুষ, রুগ্ন সমাজ এবং রুগ্ন রাজনীতি। সাপ্তাহিক : তারপরেও কি আপনি বাংলাদেশ নিয়ে আশাবাদী? ড. কামাল হোসেন : হানড্রেড পারসেন্ট আশাবাদী। এই মাটি, এই দেশ, এই সমাজ অবশ্যই এই রোগ থেকে মুক্ত হবে। একটা সুস্থ দেহ নিয়ে আমাদের একটা দেশ দাঁড়িয়েছে। এই দেশ তো কারো দয়ামায়ার মধ্যে জন্ম নেয়নি। সবকিছু আমরা অর্জনের মাধ্যমে পেয়েছি। এখানকার মানুষের ৯৯% মানুষ নিজের অর্জনের ভিত্তিতে বেঁচে আছে। আজ বিশাল কৃতিত্ব কৃষকের। আজকে যে গার্মেন্ট শিল্প বেঁচে আছে অল্প, পয়সায় শ্রম দিয়ে যাচ্ছে- বিলিয়ন বিলিয়ন ডলার আয় করছে। আজকে যারা প্রবাসী আছেন, কী পরিশ্রমই না করছেন তারা। দেশকে দিয়ে যাচ্ছেন। এই দেশকে কেউ বঞ্চিত করে রাখতে পারে? অবহেলিত করে রাখতে পারে? এই দেশ তো মানুষের শ্রম ও ঘামের ফসল। সাপ্তাহিক : ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ দিয়ে শেষ করি। আপনার শারীরিক ফিটনেস এখনো খুব ভালো। এখনো তারুণ্যের উচ্ছ্বাস আপনার কর্মে, কর্ম প্রেরণায়… ড. কামাল হোসেন : শারীরিক গঠন পারিবারিকভাবে পাওয়া। আমার জন্য ডাক্তারের একটাই পরামর্শ বাই নেচার তুমি ভালো স্বাস্থ্য পেয়েছ। এভরিথিং ইজ ভেরি ফাইন। কিন্তু খাবার-দাবার নিয়ন্ত্রণ করে ওজন কমাও। খাওয়া কমাও। এক্সারসাইজ কর। আমার ডায়াবেটিস নেই। আল্লাহর কাছে শোকর করি। আল্লাহর কাছে আমার একটাই চাওয়ার আছে যে, কাজের ব্যস্ততার মধ্যেই যেন সব সময় থাকতে পারি।
(সাপ্তাহিক, ২৬ আগস্ট ২০১১ সংখ্যা থেকে ধারাবাহিকভাবে প্রকাশিত হয়েছে)।
The clouds are thundering, my heart gets terrified.
Ek boond kabhi paani ki mori ankhiyon se barsaaye
I wish, sometime a drop of water flows from my eyes
Dil hoom hoom kare, ghabraaye
My heart is puffing, and scared
Teri johori daaroon, sab sukhe paat jo aaye
I want to put in your lap all the dry leaves I have
Tera chhua laage, meri sukhi daar hariyaaye
When you touch me, my dry bough will become green
Dil hoom hoom kare, ghabraaye
My heart is puffing, and scared
Jis tan ko chhua tu ney, us tan ko shhupaoon
The body that you have touched, I am hiding that body
Jis man ko laagey naina, voh kisko dikhaaoon
The mind infatuated with your eyes, who do I show it to?
O morey chandrama, teri chaandni ang jalaaye
Oh my moon, your moonlight burns my body
Teri uonchi ataari, mainey pankh liye katwaaye
You are up on a high balcony; I have cut off my wings
Dil hoom hoom kare, ghabraaye
My heart is puffing, and scared
Ghan dham dham kare, darr jaaye
The clouds are thundering, my heart is terrified
Ek boond kabhi paani ki mori ankhiyon se barsaaye
A drop of water sometimes could flow from my eyes
Dil hoom hoom kare, ghabraaye
My heart is puffing, and scared
Rudaali is a 1993 Hindi film directed by the Feminist Indian director Kalpana Lajmi, based on the short story written by famous Bengali litterateur Mahasweta Devi.
The title is a reference to a custom in certain areas of Rajasthan where women of a lower caste are hired as professional mourners upon the death of upper-caste males. These women are referred to as a ‘rudaali’ (roo-dah-lee), literally translated as ‘female weeper‘ or “Weeping Woman” Their job is to publicly express grief of family members who are not permitted to display emotion due to social status.
Kalpana Lajmi, The director of the great movie Rudaali (1993) admits that Hazarika’s music contributed hugely to making the film unforgettable, as did his evergreen track, Dil hoom hoom kare. This time it was Gulzar, who took the creative liberty of using the words” hoom hoom ” from Hazarika’a original Assamese song, “Buku hom hom kore”, instead of going with the literal Hindi translation “Dhak dhak”.
On Lata Mangeshker’s request, Hazarika sang the dubbed track himself. She and recordist Amil Sood were so mesmerised by his voice that they entreated Kalpana not to wipe it out. “So I had the song on the cassette and when Dimple requested me to send her all the songs before we left on location, I sent this one too. She was also bowled over and insisted we use his version in the film,” remembers Kalpana. “I told her that there was no scope to use Bhupenda’s distinctly male voice, but she still insisted I transfer the song on to a spool and take it along with us for the shoot.”
The song was played during the scene in which Dimple turns into a widow. It was a 400-feet uncut shot taken at 4 am in the wilderness. Describing it as one of the finest scenes in the film, Kalpana says that once again Dimple insisted that Bhupenda’s song be played in the background while she enacted the scene. Later, she again insisted that they retain the song in the film.
“So even though I knew that I should have really had a female voice singing Dil hoom hoom kare, I went with Bhupen da’s voice,” admits Kalpana. “Bhupen da later joked that of his huge repertoire of songs, this was the one that made him famous across India.”
দিনলিপি
০১.০১.২০১২ : বেশ শীত, কেউ বীজ উঠানে শুকায়;
০২.০১.২০১২ : ডানা থেকে শিশির ঝাড়লো পাখি,
ছাদে বুড়ো পায়রা ওড়ায়;
০৩.০১.২০১২ : হাজার হাজার বিপরীত শব্দ
স্কুলের সবুজ ব্যাগে নিয়ে যাচ্ছে একদল শিশু।
আমরা, তোমরা আর আমি তিরিশটা দিন কি লিখবো?
পঞ্জিকার পাতায় একটি কালো পাখি নেমে যাচ্ছে শিকারের দিকে,
নখের নিচেই ঢেউ শুধু ঢেউ।
৩১.০১.২০১২ : বসন্ত আসছে, এইরকম আশার স্বপ্ন আকাশও দেখছে না।
(জাহিদ হায়দারের কবিতা)